আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-০৮

0
403

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৮>
” কি! কি বলছিস কি তুই এইসব! বউদিভাই চলে গেছে মানে টা কি! আর তুই ওকে আটকালি না কেন? অন্তত কিছু বলে চেষ্টা তো করতে পারতিস!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মেঘা। অভীক আসলে অনেকক্ষণ নিজের ঘরে চুপচাপ বসে ছিল সেদিন। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার পরও মেঘা অভীক এর দেখা না পাওয়ায় নিজেই গেছিল আস্তে আস্তে ওয়াকার নিয়ে অভীকের ঘরে। তারপর থমকে থাকা অভীকের কাছ থেকে শুনেছিল সবটা। মেঘা যেন আকাশ থেকে পড়েছিল সেই মুহূর্তে। ও আসলে বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকে নিজের। তাই ঐশী কখন চলে গেছে মেঘা বুঝতেও পারেনি ঠিক! কথাগুলো আনমনেই ভাবছিল ও, তখনই অভীক আস্তে গলায় বলে উঠলো,
——–” কিভাবে আটকাতাম ওকে! আমি এতটা ভুল বুঝেছি ঐশীকে, এত খারাপ ভাবে বিহেভ করেছি!”
কথাগুলো ঠিক আর শেষ করতে পারলো না যেন ও। কিন্তু মেঘা এবার দৃঢ় ভাবেই বললো অভীককে,
—–” তোকে আমি তখন হাজার বার বলেছিলাম, যে যেটা হয়েছে আমার সাথে, সেটা একটা এক্সিডেন্ট। বৌদি ভাই এর কোন দোষ নেই এতে । কিন্তু তুই তো আলাদা মেন্টাল জোনেই ছিলিস যেন তখন! আমার জন্য তোর ওভার পজেজিভ নেস, অতিরিক্ত কনসার্ন ই এই মেন্টাল ব্লকেজটা তৈরি করেছে! আর সেই জন্য তুই বৌদি ভাই এর মতন অতো ভালো একটা মানুষের সাথে ওইভাবে বিহেভ করলি! এত অপমান করলি যে মেয়েটা চলে গেল এইভাবে শেষে! সিরিয়াসলি, শেম অন ইউ দাদা। একবার নিজের সম্পর্কটা নিয়ে ভাবলি না! একবার যেই মানুষটা তোকে এত ভালোবাসলো, তাকে নিয়ে ভাবলি না! এইভাবে নষ্ট করলি নিজের বিয়েটাকে!”
কথাগুলো কেমন রাগের মাথায় বলেছিল মেঘা। কিন্তু অভীক কোন উত্তর দিতে পারেনি সেই সময়। শুধু চোখটা হঠাৎ ভিজে আসছিল ওর। নিজের ভুলগুলো কেমন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল আজ এই ঝাপসা চোখে। মেঘার তবে খারাপ লেগেছিল এরপর অভীক কে দেখে। ও যে নিজের ভুলগুলোর মধ্যে ভীষণ ভাবে জরিয়ে গেছে, এটা বুঝেছিল মেঘা; তাই অভীকের কাছে গিয়ে ওর হাতটা ধরেছিল নিজে শক্ত ভাবে। তারপর কিছুটা বোঝানোর মতন করেই বলেছিল,
——” দাদা তুই বৌদি ভাই দের বাড়িতে যা। কথা বলার চেষ্টা কর ওর সাথে। দ্যাখ, তুই যেই ভুল, যেই ব্যাবহার গুলো করেছিস, তাতে একদিনে সব ঠিক হবে না। অনেক সময় লাগবে হয়ত। কিন্তু তুই এইভাবে চুপ করে বসে থাকিস না। একবার অন্তত কথা বলার চেষ্টা কর। প্লিজ।”
কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলেছিল মেঘা। অভীক এরপর আর চুপচাপ বসে থাকেনি ঘরে। ঐশীর কাছে যেতেই হবে ওকে। জানে না ফিরে পাওয়া আর সম্ভব কি না সেই মানুষটাকে; কিন্তু ক্ষমা ওকে চাইতেই হবে এতগুলো দিনের জন্য। নিজের পুরনো সমস্ত কথা, সমস্ত অপমানগুলোর জন্য; যেটা অভীক না বুঝে রাগের মাথায় করেছে ঐশীর সঙ্গে।
কথাগুলো ভেবেই সেদিন কলকাতার ভিড় রাস্তা পেরিয়ে অভীক বেশ জোরেই গাড়ি চালিয়ে এসেছিল ঐশী দের বাড়ি। এরপর কিছুটা মনকে শক্ত করে কলিং বেলটা বাজিয়েছিল দরজার। এরপর কিছুক্ষণের ভিড়ে ঐশীর বাবা দরজা খুলেছিল ওকে। কিন্তু আজ অভীককে দেখে ওনার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে গেছিল যেন! অভীক সেটা খেয়াল করেই একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——” ঐশীর সঙ্গে কথা বলা যাবে? ও কোথায়?”
এই প্রশ্নে ঐশীর বাবা বেশ রাগের সাথেই উত্তর দিয়েছিল, ——” আর কি কিছু বাকি আছে বলার মতন?”
অভীক এটা শুনে ঠিক কোন উত্তর দিতে পারেনি। নিজের ওপর রাগে লজ্জায় মাথাটা নিচু হয়ে গেছিল ওর। ঐশীর বাবা সেটা দেখে আস্তে গলায় বলেছিল,
——” ভেতরে এসো।”
অভীক তারপর ড্রইং রুমে আসতে উনি কিছুটা সময় নিয়ে বলেছিল,
—–” তুমি বসো। আমি ঐশীকে গিয়ে বলছি তুমি এসেছ।”
কথাটা শেষ করেই উনি আর না দাঁড়িয়ে ঐশীর ঘরে গেছিল এরপর। ঐশী সেই মুহূর্তে চুপচাপ একটা বই নিয়ে বসেছিল নিজের মনে; কিন্তু বাবার আসার শব্দে ওর যেন ঘোরটা কেটেছিল হঠাৎ। ঐশী এরপর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা বলেছিল, ——” অভীক এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে এসেছি ওকে।”
কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল বাবা। কিন্তু ঐশী সেটা শুনে কেমন নির্লিপ্ত স্বরে বলেছিল,
—–” কিন্তু আর তো কোন কথা নেই আমার ওর সাথে! যা বলার ছিল সেটা আমি বলেই এসেছি এখানে। এরপর বাকি কথা উকিলের সামনেই হবে। যাইহোক, তুমি প্লিজ ওকে চলে যেতে বলো।”
কথাগুলো শেষ করেই ঐশী আবার বইয়ের পাতায় মন দিয়েছিল। ঐশীকে এই মুহূর্তে যেন পাথরের মতন কঠিন লাগছিল কেমন! অভীক কে নিয়ে এতটা নির্লিপ্ত, এতটা নির্বিকার ও, যে বাবাও সেদিন আর কিছু বলে উঠতে পারলো না ঠিক। তবে ঐশীর মনে যে অনেক খারাপ লাগা জমে এরকম নির্লিপ্ততা এসেছে, সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ওনার। ঐশীর বাবা তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে চলে গেল সেই মুহূর্তে।
সেদিন এরপর ড্রয়িং রুমে এসে উনি আস্তে গলায় অভীক কে বলেছিল ,
—–” ঐশী তোমার সাথে আলাদা করে কোন কথা বলতে চায় না আর। তুমি এসো এখন।”
কথাটা শুনে অভীক যেন নিস্তেজ হয়ে গেছিল কেমন! তবে এই মুহূর্তে ও নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
—–” আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবো না! আমি ডিভোর্স দেব না ঐশীকে। অসম্ভব!”
কথাটা শেষ হতে ঐশীর বাবা বেশ অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” তুমি তো নিজের মুখেই বলেছিলে তুমি ঐশীর সাথে থাকতে চাও না। এতগুলো দিন ওকেই দোষারোপ করতে নিজের বোনের এক্সিডেন্ট এর জন্য। আজ হঠাৎ তাহলে কি হলো? ঐশী ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতেই তোমার ভালোবাসা জেগে উঠলো!”
বেশ রেগেই কথাগুলো বললেন উনি। কিন্তু অভীক থমকে থাকা গলায় বলে উঠলো এবার,
——” ভুল হয়ে গেছে আমার। বিশ্বাস করুন, খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। মেঘার এক্সিডেন্ট এর পর আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না! একটা সময় মা বাবাকে হারিয়েছি তো; বোনটা ই আমার সব। ওকে ওইভাবে হুইল চেয়ারে দেখে আমার মনে হয়েছিল ওই এক্সিডেন্ট টা র জন্য ঐশী রেসপনসিবেল, যেহেতু ও ড্রাইভিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছিল মেঘাকে। এতটা ইললজিক্যাল ভাবে কি করে ভাবলাম কে জানে! অন্ধ হয়ে গেছিলাম মনে হয় সেই সময়ে। মেঘার এক্সিডেন্ট টা কে আসলে আমি কখনো মেনেই নিতে পারিনি! আর তখন ওর শরীরে অতো কষ্ট দেখে আমার অন্য কোন কিছু নিয়ে ভাবার মতন মন ছিল না। খুব হেল্পলেস লাগতো নিজেকে। রাগ হতো ভীষণ সব কিছুর ওপর। হিংস্র মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম খুব। ঐশীর সাথে সেই সময় আমি যা নয় তাই ব্যাবহার করেছি। যা মনে হয়েছে বলেছি। আমি নিজের দোষে নিজের রিলেশনটা কে এইভাবে নষ্ট করে ফেললাম! ঐশীকে চিনতে এতটা ভুল করলাম! আজ আমার বোন সুস্থ্য হয়েছে শুধুমাত্র ওর জন্য। ওর চেনা ফিজিও থেরাপিস্ট এর কাছে মেঘা রিকভার করেছে। ঐশীর চেষ্টায় ও ঠিক হয়েছে। আমি যদি হাতজোড় করে ওর কাছে ক্ষমা না চাই, আমি শান্তি পাবো না। সত্যি শান্তি পাবো না!”
কথাগুলো বলতে বলতে অভীক সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ। পায়ের জোর হারিয়ে বসে পড়েছিল মেঝেতে। কেমন নিঃস্ব মানুষের মতন কেঁদে উঠেছিল ও। ভীষণ অসহায় লাগছিল ছেলেটাকে সেই মুহূর্তে। ঐশীর বাবার অভীক কে এই অবস্থায় দেখে খারাপ লাগছিল খুব। আসলে বোনের এক্সিডেন্ট এর ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি ছেলেটা ঠিকভাবে। তাই এরকম ভুল করে ফেলেছে। হয়ত মাথার ঠিক ছিল না বলেই অতটা বাজে ভাবে রিয়্যাক্ট করেছে ঐশীর ওপর! আর আজ যখন সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাচ্ছে অবশেষে, ঐশী দূরে সরে যাচ্ছে পুরোপুরি ওর থেকে, তখন নিজেকে আর সামলাতে পারছে না ঠিক। কথাগুলো ভেবেই সেই মুহূর্তে ঐশীর বাবা অভীক কে ধরেছিল শক্ত করে। কোন রকমে হাত ধরে তুলেছিল মাটি থেকে। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে বলেছিল আস্তে গলায়,
—–” দ্যাখো তুমি যে কথাগুলো ঐশীকে বলেছ রাগের মাথায়, যেভাবে বিহেভ করেছ ওর সাথে, তারপর সত্যি আর কিছু বাকি থাকে না। আর আমি ঐশীকে এত কিছুর পর আর কখনো জোর ও করতে পারবো না তোমার সাথে থাকার জন্য, কথা বলার জন্য; যতদিন না ওর মনে হচ্ছে। তবে তুমি এই বাড়িতে আসতে পারো। ঐশীর খোঁজ খবর যদি নিতে চাও, নিতে পারো আমার থেকে। আমি তোমাকেও কখনো আটকাবো না। তবে অনেক আশা নিয়ে তোমার সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম! ভাবিনি; যে এইভাবে সম্পর্কটাকে নষ্ট করে দেবে তুমি! যাইহোক, এখন বাড়ি যাও। পরে কথা হবে।”
কথাগুলো খুব স্থির গলায় বলেছিল ঐশীর বাবা। অভীকও সেই মুহূর্তে আর কোন উত্তর দেয়ার অবস্থায় ছিল না! আসলে এতটা ভুলের পর আর কোন মুখে কথা বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই নিঃশব্দে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল , একটা ফাঁকা নিঃসঙ্গ জীবনে, ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে।

চলবে।