ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-০৪

0
441

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৪

দৈবিক নিয়মে জিবন চলছে, চলবে। ভরা বিয়ের আসরে খুব বাজে ভাবে অপমানিত হয়েও থেমে নেই ইরার জিবন। পুরো একটা দিন কাটিয়েছে কোনরকম চিন্তা, খারাপলাগা ছাড়া। কোন নিন্দুক প্রচার করলো ইরা ধর্ষিতা, তাই সে সত্যিই কি তাই হয়ে গেলো? সময় নিজ গতিতে চলছে। আজও উঠেছে পূর্ব দিগন্তে সূর্য। ঝকমকে একটি সকাল। নতুন আলো। ইরা ব্যাস্ত তৈরি হতে। আজ ভার্সিটি যেতে হবে। এভাবে বসে থাকার মানে হয় না। আর জানতেও তো হবে কে সেই লোক? তাকেও তার প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিতে হবে। হবেই!

ইরা তৈরি হয়ে নিলো। শুভ্রতার প্রতিক সাদা। সেই রঙা সালোয়ার-কামিজ পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিলো সে। নিজের রুম থেকে বেরোলো ঝটপট। ছুটে ডাইনিং টেবিলে বসে আহেরাকে ডেকে উঠলো,

‘ আম্মা সময় নাই। খাইতে দাও। ‘

ডাইনিং এ তখন ইরা আর রিয়াদ। রিয়াদ অফিসের জন্য একদম প্রস্তুত। খেয়েই বেরোবে। ইরার তারাহুরো দেখে ধমকে উঠলো,

‘ এতো ছটফট করছিস কেনো? সময় আছে তো। ‘

ইরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিয়াদের দিকে তাকিয়ে সরু গলায় বলে উঠলো,

‘ কাল কলেজে পুনর্মিলন ফাংশন আছে। রাজ্যের কাজ। স্যার ফোন করেছিলেন সকাল সকাল। বললেন তারাতাড়ি যেতে। আর তুমি আসবে না কালকে? ‘

রিয়াদ হাসলো। বললো,’ যাবো তো। কত পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হবে। আমি উদগ্রীব। ‘

আর কোন কথা হলো না। আহেরা মেয়েকে খাবার বেড়ে দিলেন। ইরা খেয়ে নিলো যতটা তারাতাড়ি সম্ভব। অতপর সে আর রিয়াদ একসাথে খেয়ে বেড়িয়ে গেলো। বাড়ি থেকে কলেজ এক কিলোর মতো। ইরার যাতায়াত কখনো অটো আবার কখনো ভ্যানে। কিন্তু আজ পেতে হলো রিকশা। রিকশাতে করেই চলে গেলো ইরা কলেজে। তেমন বন্ধু-বান্ধব নেই ইরার। সবাই অপরিচিত। তবে একটি মেয়ের সাথে বেশ ভালো কথা বার্তা হয় ইরার। অনার্স প্রথম বর্ষের মেয়েটি। প্রথম দিন থেকেই বেশ ভাব তাদের। আর গত সপ্তাহেই ভার্সিটি সাজানোর দায়িত্ব ভার্সিটির সবথেকে জুনিয়দের দেয়া হবে বলেছিলো। ইরা ভেবেছিলো তার হয়তো আসাই হবে না। কিন্তু ভাগ্য যে কখন কোন দিকে মোর নেবে এটা সয়ং সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। ভার্সিটি গিয়েই দেখা মিললো পরিচিত মুখখানার। কুহুর। দূরে দাড়িয়ে কারো অপেক্ষায় সে। ইরা একপ্রকার ছুটে গেলো। ডাকলো,

‘ কেমন আছো? ‘

কুহু তাকালো। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। মেকাপ ও করেছে। ইরার ভ্রু কুঁচকে এলো। ঠাট্টা হেঁসে বললো,

‘ আজ অনুষ্ঠান নয়। অনুষ্ঠান তো কালকে। তাহলে এতো সেজেগুজে এসেছো কেন? ‘

কুহুর মুখে লজ্জার ছাপ। মুচকি হেঁসে মাথা নিচু করে বললো,

‘ বয়ফ্রেন্ড আসছে। ‘

ইরা হাসলো। বললো,’ ভার্সিটিতে? ‘

‘ হুম। আজ প্রথম দেখা আমাদের। ‘

ইরা অবাক কন্ঠে শুধালো,’ প্রথম দেখা মানে? এতোদিন কি ফেসবুকে প্রেম চলছিলো নাকি? ‘

কুহুর লজ্জামাখা কন্ঠ, ‘হুম।’

‘ কখন আসছে সে? ‘

‘ এইতো একটু পর’ই। তুমি একটু পাশে থাকবে প্লিজ? আমার নার্ভাস লাগছে। হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বুকটা টিপটিপ ও করছে। থাকো প্লিজ।’

‘ সরি, আমার স্যার ডেকেছেন। ‘

কুহু অসহায়ের মতো তাকালো। খানিক ওভাবেই চেয়ে থেকে খপ করে হাত খিচে নিলো ইরার। বললো,

‘ আরে স্যার ওমন সবাইকে ডেকেছেন। অনেকেই গেছে। তোমার না গেলেও হবে। দাড়াও তো। ‘

‘ কিন্ত-‘

ইরাকে কথার মাঝে থামিয়ে বিরক্ত হয়ে চাইলো কুহু। বললো, ‘ থামো তো। কিছু হবে না। ‘

ব্যাস! ইরা আর ফেলতে পারলো না কুহুর কথা। কুহুর সাথে দাড়িয়ে রইলো বিরাট আমগাছটার নিচে। একটু পর কুহু আনমনে তাকালো ইরার দিকে। একটু সতর্ক কন্ঠে বললো,

‘ আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি? ‘

চোখদুটি চকচক করে উঠলো ইরার। ভার্সিটি নতুন, ক্যাম্পাসও নতুন। সেখানে ফ্রেন্ড ছাড়া চলে না। চলতে পারে না। ইরা হাসি মুখে কুহুর হাত ধরে বললো,

‘ শুধু ফ্রেন্ড? উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড, ওকে? ‘

‘ ওকে। ‘ বললো কুহু।
__
এই নিয়ে হতে চললো ছাব্বিশটা। একের পর এক ছবি মেলে ধরেছেন ত্রপা বেগম। আর আয়াত না চাইতেও দেখে চলেছে ছবিগুলো। কি অদ্ভুত! তার বন্ধুদের বিয়ের বয়সই নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে অথচ বাড়িতে বিয়ের কথাটাও ওঠে না। এ নিয়ে কি দুঃখ তাদের। সারাক্ষণ ফেসবুকে এটা-সেটা স্যাস্টাস দিয়েই চলেছে তারা। আর সেখানে আয়াতের বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে তার বাবা মা। আয়াত প্রায় অতিষ্ঠ হয়েই সোফা ছাড়লো। বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ খোদার কসম, একটা মেয়েকেও পছন্দ হয়নি মা। ‘

ত্রপা বেগমের মুখ লাল হয়ে উঠলো। কড়া গলায় বলে উঠলেন,

‘ এই সপ্তাহেই তোর বিয়ে দেবো। আর তুই না দেখে দিলে আমাদের পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো। ‘

আয়াত কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। চোখদুটি বুজে বিয়ের পর তার করুন দৃশ্য দেখতেই আৎকে উঠলো আয়াতের বুক। মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললো,

‘ কাল প্রাক্তন ভার্সিটি থেকে ডাক এসেছে। পুনর্মিলন অনুষ্ঠান হবে। কই ভেবেছি দেশে এসে আনন্দ করবো, ঘুরবো। আর সেখানে তোমরা পড়ে আছো বিয়ে নিয়ে। এ কেমন জুলুম শুরু করলে বলবে প্লিজ? ‘

‘ তো যাবি কলেজে। কে আটকালো তোকে? ‘

‘ গিয়ে তো আর ফিলিংস টা আসবে না। সারাক্ষণ বিয়ের কথা মাথায় ঘুরবে। ‘

‘ বিয়ের জন্য ফিলিংস না হলে না হোক,
আমরা ফিলিংস ছাড়া বিয়ে দেওয়া লোক। ‘

আয়াত টাসকি খেয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। কেন যে কাল বলতে গেছিলো!!
__

‘ ভাবি..ভাবি ভাইয়া কই? ‘

ইরার কন্ঠে রুম থেকে ছুটে বেরোলেন ইলিমা। বাইরে আসতেই অবাক ইলিমা। চোখজোড়া ডিমের মতো হয়ে উঠলো বড়োবড়ো। কালো শাড়ি পড়েছে ইরা। কোমর অব্ধি পড়া চুলগুলোর বিরাট এক খোপা মাথায় ইরার। কানের কাছে গোজা লাল রক্তজবা। কানে ছোট্ট দুটি দুল। গলায় সোনালি রঙের চেইন। ব্যাস! এতেই অপ্সরী লাগছে ইরাকে। ইলিমার মনে হচ্ছে পরী সামনে এসেছে তার। আহেরা মানুষ জন্ম দিয়েছে? নাকি পরী? এই প্রশ্ন মাঝেমাঝেই মাথায় ঘুরপাক খায় ইলিমার৷ উত্তর পান না তিনি। হিতাহিত জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলেন ভাবতে ভাবতে। তবুও ভাবনার শেষ হয় না। তিনি বুঝতে পারেন না ইরার সৌন্দর্যের রহস্য। সবার কথা ইলিমা জানেন না, কিন্তু ইরা নিজের সব সৌন্দর্য সামলে রাখতে পারে। ইলিমার বিয়ের তিন বছর হলো। এতোদিনেও কোন খারাপ কথা শোনেনি ইরার নামে। ইরা স্নিগ্ধ,মায়াবতী। পবিত্র।

‘ কথা বলো ভাবি। ভাইয়া কই? যাবে না আজ ভার্সিটিতে? ‘

ইলিমার ধ্যান ভাঙলো। চোখ সরিয়ে দেয়ালে দু’সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকেই আবারো ইরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন ইলিমা,

‘ ভার্সিটি যাবে মানে? ‘

‘ আজ পুনর্মিলন অনুষ্ঠান আছে। ভাইয়া তো বলেছিলো কালকে যাবে। কই? নাকি আজও অফিসে বেড়িয়ে গেছে? ‘

‘ না যায়নি। রুমে আছে। ‘

ইরা ইলিমাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ডুকলো। ল্যাপটপে মুখ গুজে রিয়াদ। ইরা গিয়েই হৈ হৈ করে উঠলো,

‘ আজও ল্যাপটপ নিয়ে বসেছো ভাইয়া? যাবা না তুমি? ‘

‘ হুম যাবো তো-

বলেই রিয়াদ তাকালো ইরার দিকে। সে ও অবাক। মুগ্ধ নয়নে বোনকে দেখতে লাগলো রিয়াদ। স্নেহময় কন্ঠে বললো,

‘ বাহ্! দারুন লাগছে তো তোকে! ‘

ইরা হাসলো। হাসিতে মুক্ত ঝড়ে যেন। রিয়াদ আবারো ল্যাপটপের দিকে চেয়ে ব্যাস্ত গলায় বললো,

‘ একটু কাজ আছে রে। তুই একা একাই চলে যা। আমি দেড়ি করে যাবো। কেমন? ‘

ইরা বেশ বিরক্ত হলো। কোমরে হাত গুঁজে কিছুক্ষণ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো ইরা। বাইরে এসেই ভ্যান পেয়ে গেলো। কুহু মেসেজ দিয়েছে তারাতাড়ি যাওয়ার জন্য। তাই চালককে তাড়া দিলো ইরা।
.
ভ্যান থামলো ভার্সিটির গেটে। ইরা ভারা মিটিয়েই ভিতরের দিকে অগ্রসর হলো। পেছন থেকে কেউ হেঁচকা টান দিতেই চমকে উঠলো ইরা। কুহু কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,

‘ কই যাচ্ছিস? দাড়া একটু। ‘

ইরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দম নিয়ে বললো,’ এক্ষুনি প্রান উড়ে যাচ্ছিলো আমার। এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন? ‘

কুহু কপাল চাপড়ালো। মুখচোখ কালো করে বলে উঠলো,

‘ আয়াত ভাইয়া আসবে। ফোন করেছিলো। একটু দাড়া প্লিজ। ‘

#চলবে….