ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-০৫

0
399

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৫

‘ আয়াত আবার কে কুহু? এই ভার্সিটিতে পড়ে? ‘

ইরার প্রশ্নে কুহু ব্যাস্ত দৃষ্টিতে তাকালো। বললো, ‘ পড়ে না পড়তো। আজ তো প্রাক্তন স্টুডেন্ট রাও আসছে তাই না? আর ভাইয়ার প্রায় সব বন্ধুই বিদেশে থাকে। তাই আমায় নিয়ে টানাটানি। ‘

ইরা ছোট্ট করে বললো, ‘ওহ্।’

‘ আরও কতক্ষণ লাগবে বলতো? ‘

ইরা ইনোসেন্ট হাসলো। বললো,’ আসছে হয়তো। আমি কি জানি? ‘

কিছুক্ষণের মধ্যেই কলেজের দ্বারে উপস্থিত আয়াত। পুরো ভার্সিটি সাজানো হয়েছে। গেটেও বেশ করে একটা বোর্ড টানানো। অনেক পুরোনো ব্যাচও এসেছে। কুহু না থাকলে ইরা হয়তো অনাথ হয়ে পড়তো। কে জানে।

‘ কেমন আছিস কুক পাখি? ‘

পুরুষালি কন্ঠ পেতেই ইরা ও কুহু তাকালো সেদিকে। আয়াত ধির পায়ে হেঁটে এলো। কুহুকে ‘কুক পাখি’ ডাকায় বেজায় খেপে উঠলো কুহু। শক্ত আর কর্কশ গলায় বলে উঠলো ,

‘ ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমি এখন ভার্সিটিতে পড়ি। এখানে এসে আমার মান-সন্মানের ফেলুদা বানাইয়ো না প্লিজ। ‘

আয়াত দুষ্ট হাসলো। বললো,’ আচ্ছা কুক পাখি। ‘

ভাই বোনের কথাগুলো ইরার কানে গেলো বলে মনে হলো না। ইরা আয়াতকে দেখতে ব্যাস্ত। শুধু দেখছেই না, খুঁতিয়ে দেখছে। সেম টু সেম সেই আগুন্তকঃ। সেদিন ইরা খুব কাছ থেকে আগুন্তককে দেখেছে। সে ভুল দেখছে না। আয়াতের মুখেও সেই কালো মাস্ক। সেই বেশিবহুল শরীর। আর কন্ঠ? এ কন্ঠ তো ইরা চেনে। শুনেছে। ছেলেটা তার সাথে কথা বলেছে খুব কাছ থেকে। ইরা চমকালো। কি বলবে ভেবে পেলো না। মনের ভেতর জমা ক্ষতগুলি উঁকি দিলো আরও একবার। কোথাও জ্বলতে থাকলো আত্নসন্মানের আগুন। ততক্ষণে অনেকটা এগিয়েছে আয়াত আর কুহু। ইরাকে পাশে না পেয়ে পিছু ফিরতেই ইরাকে সেখানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুকুটি করে ডেকে ওঠে কুহু,

‘ ইরা পেছোলে কেন? এসো। ‘

চমকে তাকালো ইরা। কি করবে খুঁজে না পেয়ে আবারো তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত ও তাকিয়ে। কিন্তু তার মাঝে কোনরূপ পরিবর্তন দেখা গেলো না। কুহুকে বললো,

‘ কে মেয়েটা? ‘

‘ আমার ফ্রেন্ড ভাইয়া। তুমি দাড়াও তো, হয়তো দ্বিধা করছে। আমি নিয়ে আসছি। ‘

বলেই কুহু ইরার কাছে চলে গেলো। আয়াত কলেজের চারিদিক দেখছে। খানিক বাদেই ইরাকে নিয়ে হাজির হলো কুহু। কুহু ইরাকে বোঝালো, ভয়ের কিছু নেই। ভাইয়া কিছু মনে করবে না।’ ভয়! শব্দটি শুনে হেঁসে উঠেছিলো ইরা। এ মানুষটি যে তার পূর্ব পরিচিত। খুব ঘৃণিত মানুষ একজন। তাকে ভয় নয়, ধরা উচিত। তাও হাতেনাতে। এসকল চিন্তা মাথায় আসলেও কিছু করে ওঠার সাহস দেখাতে পারেনি ইরা। আয়াতের পূর্ব পরিচিত একজন স্যার ধরে বেধে অনেকক্ষন গল্প করালেন। ইরার মন চাইছিলো বলার। আয়াতকে বলার। কিন্তু পারেনি। খুব জড়তা ঘিরে ধরে আয়াতের সামনে গেলে। আর যখন খুব সাহস যুগিয়ে নেয় ইরা, তখন কেন জানি আয়াতই অবহেলা করে। চোরের মতো পালায়। আয়াতের হাবভাব এমন, যেন চেনেই না ইরাকে। ইরা পুরো ফাংশন এটেন্ড করলো ওদের সাথে। রিয়াদের সাথে দেখা হয়নি।

অবশেষে ঘনিয়ে এলো যাওয়ার সময়। সকল স্টুডেন্ট বেড়িয়ে যেতে আরম্ভ করলো। আয়াত কুহুকে যেতে দিলো না। বললো, সকলে গেলে তবেই যাবো। এতো ভিরের মাঝে যাওয়ার মানে হয় না। সবাই বেরোতেই হাটতে লাগলো ওরাও। ইরা স্থির করলো, এটাই সময়! জানতেই হবে তাকে। একবার হলেও বলতে হবে। কে সে? কহু একটু এগোতেই পেছন থেকে খপ করে হাত ধরে নিলো ইরা আয়াতের। আয়াত থামলো। হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রুযুগল বাঁকিয়ে তাকায় আয়াত। ইরা স্থির কন্ঠে বলে,

‘ আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। ‘

আয়াতের মাঝে কোনরূপ পরিবর্তন ঠাওর করা গেলো না। একজন অচেনা মেয়ে যে তার হাত ধরেছে, এতে তার অনুভূতি শূন্য’ই মনে হলো। আয়াত একবার কুহুর দিকে তাকালো। এগিয়েছে অনেকটা। আচমকা হেঁচকা টানে ইরাকে পাশের বিল্ডিং এর এক কোনে নিয়ে গেলো আয়াত। ইরা আশ্চর্য হলো। অবাক হয়ে বললো,

‘ এসব কি করছেন? ‘

আয়াত হাসলো বোধহয়। বোঝা গেলো না। আয়াত ক্ষিন স্বরে বললো,

‘ আপনিই তো বললেন কি জানি বলবেন? এখন বলুন। কেউ দেখবে না। আর না কেউ শুনবে। ‘

ইরা আয়াতের কথার মানে বুঝলো না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো শুধু। আয়াত মুখের মাস্ক খুললো। ফর্সা মুখে চাপদাড়িগুলো মানিয়েছে খুব। নাকের ঘাম মুছে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো ইরার দিকে। দুষ্টু হেঁসে বললো,

‘ বান্ধবীর হ্যান্ডসাম ভাই দেখে কি প্রপোজ-ট্রোপজ করার ইচ্ছে হয়েছে নাকি? করতে পারেন! আমি আজকের দিনে কাউকে ফেরাবো না। আর আপনার মতো সুন্দরী মেয়েকে তো নয়’ই। ‘

ইরা এবারও অবাক না হয়ে পারলো না। সেখান থেকে দু’পা পিছিয়ে গেলো আপনা আপনি। সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠলো,

‘ কেন ভেঙেছেন আমার বিয়ে? ‘

এতো বড় গুরুতর কথা বলার পরও আয়াতের মুখের ভাবভঙ্গি পাল্টালো না। কোনরুপ আশ্চর্য হবার ভাব প্রকাশ পেলো না। তার মুখে হাসি অটুট রইলো। একচোখে তাকিয়েই রইলো ইরার দিকে। ইরা আয়াতকে বুঝছে না। একজন মানুষ যে কোন অপবাদেও এমন স্থির হয়ে থাকতে পারে, ইরা জানতো না। সত্যিই কি এই লোকটাই সে? নাকি নয়? এতোটা মিল কিভাবে থাকতে পারে? পারে না! সম্ভব নয়! আগুন্তকের প্রতিটা কথাই এখনো কানে বাজে ইরার। এ স্বর তারই। আর লোকটাও! ইরা নিজেকে সামলে নিলো। কন্ঠে একটু কাঠিন্যতা এনে বললো,

‘ কেন ভাঙেছেন বললেন না যে? কেন মিথ্যে দাগ টেনেছেন আমার সুন্দর জিবনটায়? কেন সবার চোখে আজ আমি কলঙ্কিনি? কলুষিত? বলুন! আপনিই সে। আমি জানি। বলুন! উত্তর দিন। ‘

‘ জিবন সুন্দর! সত্যিই কি সুন্দর? ‘ নির্লিপ্ত স্বর আয়াতের। মুখের ইনোসেন্ট ভাব অটুট।

‘ ছিলো। আপনি নষ্ট করেছেন। কেন করলেন? ‘

‘ আপনি অপেক্ষা করেননি। ঘৃণা থেকে করেছি। ‘

ইরা থমকে গেলো। রাগে শারীর ঝেকে উঠলো ইরার। চোখদুটি সূক্ষ্ম, তিক্ন হয়ে উঠলো। চেয়াল খিঁচে একপ্রকার ছুটে গিয়ে আয়াতে শার্ট চেপে নিলো ইরা। তবুও এতটুকু অবাক হলো না আয়াত। ইরা চিৎকার করে বলে উঠলো,

‘ কেন করেছেন? জানেন এর জন্য আমার জিবনে কি ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত? একটা মেয়েকে কোন বর বিয়ের আসরে বলে গেলো ধর্ষিতা! এর মানে বোঝেন? সমাজ, পরিবার, আত্মীয়দের কাছে আজ আমার অবস্থাটা কোথায়? ব্যাবসার মতো কটু কথা অব্ধি শুনতে হয়েছে। আর সেখানে সেদিন বেশ করে বলে গিয়েছিলেন ‘থাকো এভাবে।’ কেন? কোন দুঃসাহসে? বলুন! ‘

মুহুর্তে ইরার মুখ লাল হয়ে ওঠে। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে কয়েকটা। ইরার দৃষ্টি এলোমেলো। তার করা প্রশ্নের উত্তর এখন না পেলে পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে এমন চাহনি। তার ইচ্ছে করছে খুন করতে লোকটাকে। এতটা দ্রুত আগুন্তককে পেয়ে যাবে এটা ভাবেনি ঠিকিই, কিন্তু যখন পেয়েছে তখন তাকে সবটা জানতেই হবে। জানতে হবেই!

আয়াত এতক্ষণে কপাল কুঁচকালো। দু’হাত উঁচু করে বলে উঠলো,

‘ কাছে আসার জন্য এতো কাহিনি বলে কেউ? আমাকে বললেই তো ছোটখাটো কিছ করে দিতাম। ‘

রাগে কেঁপে উঠলো ইরার শরীর। ডান চোখের পাতা কাঁপতে লাগলো তিরতির করে। নিচু মস্তিষ্কের লোকটাকে ঠাটিয়ে চড় বসানোর জন্য যেই হাত তুলবে, তখনি ঘটে গেলো এক আশ্চর্য ঘটনা। এ ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে ইরাকে, কল্পনাতেও ভাবেনি ইরার ছোট্ট মস্তিষ্ক।

#চলবে….