ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-০৬

0
406

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৬

আচমকা হেঁচকা টানে দেয়ালে মিশিয়ে নিলো ইরাকে আয়াত। আকম্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে উঠলো ইরা। আগুনে ঘি ডালার মতো জ্বলে উঠলো ইরার সর্বাঙ্গ। জিবনের সবচেয়ে ঘৃণ্য মানুষটা তাকে আরও একবার স্পর্শ করায় রি রি করে উঠলো ইরার শরীর। রক্তচক্ষু মেলে তাকালো ইরা আয়াতের দিকে। স্বভাবগতভাবেই হাসি লেপ্টে মুখে আয়াতের। ইরার মনে হলো, জন্মের পর হয়তো পচা মধু গিলিয়েছে বোতলে বোতলে। তাই সবসময় কুৎসিত হাসিটা থাকেই মুখে। ইরা দাঁতে দাত চেপে বলে উঠলো,

‘ অসভ্য লোক! আমি চিৎকার করতে বাধ্য হবো বলে রাখলাম। ছাড়ুন আমায়। ‘

মুখের হাসি মুহুর্তে পাল্টে বিরক্তি ফুটে উঠলো আয়াতের ঠোঁটে। ইরার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

‘ ধরা পরার সখ জেগেছে? কুহু খুজছে আমাদের। ‘

ধুপ করে নিভে গেলো ইরার তেজ। আশেপাশে আয়াত নামক পুরুষালি এক গন্ধে ভরে উঠলো। চড়া পার্ফিউম নয়, হাল্কা। কুহু অনেক খুজেও পেলো না। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আবারো চলে গেলো। কুহু যেতেই ইরা ছিটকে দূরে সড়িয়ে দিলো আয়াতকে। গলা খিচে বলে উঠলো,

‘ আর একবার টাচ করলে মামলা ঠুকবো। ‘

আয়াত হাসলো। শরীরে লেপ্টে থাকা ঘামে জর্জরিত গেঞ্জিটা একটু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,

‘ আপনার থেকে এটা আশা করিনি মিস ইরা। সব মেয়েদের মতো আপনিও যে এমন সস্তা ভয় দেখাবেন, এটা ভাবাই হাস্যকর। ‘

‘ সেটা সময় বলবে। আপনাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। পেতে হবেই! ‘

‘ কিন্তু কেন? ‘

ইরার রাগ এবার আকাশ ছুলো। ছুটে গিয়ে একটা ঠাটিয়ে চড় বসানোর জন্য কেঁদে উঠলো মন। কিন্তু নির্জনতা আটকালো ইরাকে। নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। ছেলেটা যে চরম অসভ্য আর বেয়াদব তা বুঝতে বাকি নেই। কখন কি করে বসে! ইরা সময় নষ্ট করবে না। বাকিটা কুহুর থেকে জেনে নেওয়া যাবে। এখন এই জায়গা পরিত্যাগ করা উচিত। যাওয়ার আগে আবারো শাসিয়ে উঠলো ইরা,

‘ মনে রাখবেন। আমি এখন যাচ্ছি ঠিকিই। কিন্তু আপনাকে শাস্তি না দিয়ে মরেও শান্তি পাবো না আমি। ‘

বলেই ইরা পা বাড়ালো। আয়াত পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ আমার বিয়ে মিস ইরাবতী। আগাম দাওয়াত দিলাম। দিন-তারিখসহ সবটা কুহুর থেকে জেনে নিবেন। ‘

ইরা থামলো। কিছু একটা ভাবতেই চোখে মুখে ফুটে উঠলো উল্লাস। এতক্ষণে কিছুটা ভালো লাগলো ইরার। মুখের হাসি চওড়া হলো। যেভাবে ইরাকে খারাপ হতে হয়েছে, সেভাবে আয়াতকেও করার সু্যোগ বুঝি এটাই। আয়াতের দিকে না তাকিয়েই বাঁকা হাসলো ইরা। শান্ত দৃষ্টি নিয়ে পিছু ফিরে বলে উঠলো,

‘ আমি যাবো। যেতে তো হবেই! অপেক্ষায় থাকবেন। ‘

ইরার শান্ত চাহনি, আর কন্ঠে অবাক হলো আয়াত। ভেবেছিলো জ্বলবে ইরা। ছুটে আসবে মারার জন্য। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। ইরা ধির পায়ে ভার্সিটি ত্যাগ করলো। আয়াত বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো ইরার আচরনে।
__
ধরনীতে আধার নেমেছে। সূর্য ডুবেছে ঘন্টাখানেক আগে। আয়াতের পরিবারের সবাই ব্যাস্ত আজ। বিয়ে পাকা! আয়াত না বলার পরেও ইরফান আলী তোরজোর শুরু করেছেন। মনমরা হয়ে বলকনিতে রাতের শহর দেখতে ব্যাস্ত আয়াত। তিনটি বছর আগে তার জীবনে একজন মায়াবতী আগমন! তার মায়া আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি আয়াত। চাচার ছাত্রীর সাথে সে কি প্রেম করার সপ্ন তার! অথচ পূরন হলো না কিছুই। তার মায়াবতী তাকে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে বললে ভুল হবে, আয়াতই কখনো সাহস যুগিয়ে বলতে পারেনি মনের কথা। পারবে কি? সময় আছে? না! নেই। তার জিবনে মোর এসেছে। অন্য কেউ ডুকে পড়েছে। আর সম্ভব নয় তার মায়াবতীকে জিবনে আনা। পাত্রীপক্ষ সন্ধ্যায় এসেছিলো। ইরফান আলী কঠোর গলায় বলে গেছেন,’তুমি যদি এ বিয়েটা না করো। তাহলে আর বাবা বলে ডাকতে আসবে না।’ এই মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার আরও একটি কারন হলো মেয়ের বাবা ইরফান আলীর অফিসের বস হন। তিনিই আগে প্রস্তাব দিয়েছেন। ইরফান আলী মানা করতে পারেননি। কিছু না বলতে পারলেও আয়াতে কোথাও কষ্ট হচ্ছে। দু’দীন ঠিকমতো ঘুমটাও হচ্ছে না। কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে, জ্বালা করছে। মায়াবতীর মায়া কাটিয়ে সে কি পারবে নতুন কাউকে বাঁচতে? এতোই সোজা? একপাক্ষিক ভালোবাসা গুলো কষ্টের। খুব কষ্টের!

সময় নিজ গতিতে চলছে। রাত আটটা তখন। পিচডালা বাড়ির সামনের রাস্তাটা আজ নির্জন। লোকচলাচল নেই। সোডিয়ামের ক্ষিন আলোতে উজ্জ্বল রাস্তায় তাকিয়ে আয়াত। পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,

‘ তুমি কি প্রনয় বিরহে ভুগছো ভাইয়া? ‘

আয়াত ঝটপট তাকালো। কুহু এসেছে। আয়াত একটু অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,

‘ তুই? কখন এলি? ‘

কুহু ধির পায়ে হেঁটে আয়াতের পাশে দাড়ালো। দুষ্টু হেঁসে বললো,

‘ কাউকে ভালোবাসো, বলতে পারছো না? সমস্যা নেই! আমায় বলো। এক্ষুনি এ বিয়ে ভেঙে দিচ্ছি। ‘

আয়াত কুহুর মাথায় গাট্টা মারে বললো,

‘ খুব পেকেছিস তাইনা? ‘

মাথায় হাত গুজে কুঁকিয়ে উটলো কুহু। বেরস কন্ঠে আওড়ালো, ‘ মারছো কেন? ভালো কথা বললেও দোষ? তুমি বললে আমি সত্যিই ফুপাকে বলবো। ‘

আয়াত আবারো রেলিঙের উপর ঠেস দিয়ে রাস্তায় দৃষ্টি রাখলো। ধারালো গলায় বললো,

‘ লাগবে না। ‘

কুহু অবাক হলো বোধহয়। আয়াত এতোটা গম্ভীর, দেখে কান্না পেলো ওর। ভালোবাসে না তারমানে? তাহলে এই উদাসিতার কারন কি? কুহু নিজের জানতে চাওয়ার আকাঙ্খাটা সম্পূর্ণ দমিয়ে বললো,

‘ তাহলে কি আজকের ঘটনা মিথ্যা? ‘

আয়াত তাকালো। তার গম্ভির মুখখানা দেখে বুঝে উঠতে অক্ষম হলো কুহু। আয়াত কিছু বললো না। হয়তো ইচ্ছেই জাগলো না।
___

‘ সকাল নয়টায় কেউ ওঠে? কুহু ওঠ! তুই কিন্তু বলেছিলি এখান থেকে কলেজে যাবি। ‘

ঘুমোঘুমো চোখে উঠে বসলো কুহু। মায়ের এতগুলো কথা তার কানে গিয়েছে বলে মনে হলো না। আড়মোড়া ভেঙে বসে জানালার বাইরে তাকাতেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো। চোখ হয়ে উঠলো ডিমের মতো বড়বড়ো। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। কুহুর মা কোমরে হাত গুঁজে বলে উঠলেন,

‘ ঘন্টাখানেকের পথ৷ আরও ঘুমা বেশি করে। ‘

কুহু ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কোনমতে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো। অন্যদিন হলে মেরেও কুহুকে ভার্সিটি পাঠানো যেত না। কিন্তু আজ কাজ আছে। কুহুকে সত্যের সন্ধ্যানে বের হতে হবে আজ। জানতে হবে অনেককিছু। কিছু না খেয়েই বেড়িয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্য।

ভার্সিটিতে পৌছাতে পৌছাতে বেজে গেলো দশটা দশ। তবুও যে ক্লাসের বাইরে ইরার দেখা মিলবে এ যেন কল্পনাও করতে পারেনি কুহু। কুহু ডেকে উঠলো,

‘ ইরা ভাবি! ইরা ভাবি শোন….’

হকচকিয়ে তাকালো ইরা। কুহু ছুটে এলো ইরার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফের বলতে লাগলো,

‘ ভালো আছো ভাবী? ‘

#চলবে….