একথোকা কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০২

0
256

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া
#পর্বঃ২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩,
সাজিয়ার শ্বশুর আলম সাহেবের অনুমতি পেয়ে শ্রাবণ বলে,

” তাওই আপত্তি না থাকে তো আমরা সাজিয়া ভাবীর বাড়ি গিয়ে গ্রাম ঘুরে দেখে আসতে চাই। শহরের ধুলাবালি ইটপাথরে বিরক্তি এসে গিয়েছে। সেজন্য চাচ্ছি আমরা ছোটোরা মিলে একটু গ্রামের মুক্ত পরিবেশে ঘুরে আসতে চাই। আমি শুনেছি ভাবীর কাছে বড় ভাবীর বাবার বাড়ি গ্রামে।”

একদমে কথাগুলো বলে থামে শ্রাবণ। তাহিরা চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণের সাথে একদিন এমনিই পরিবার নিয়ে গল্প করার সময় তার ভাবীদের বাবার বাসা কোথায়,পরিবার কেমন সেগুলোও জেনে নিয়েছিলো। কিন্তু হুট করে সাজিয়া ভাবীর বাবার বাসায় ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপার টা বুঝতে পারলোনা তাহিরা। এদিকে আলম সাহেব শ্রাবণের কথায় উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে পুত্রবধু সাজিয়ার দিকে তাকালেন। বাকি সবাই উৎসুক জনতা হয়ে আলম সাহেব কি বলেন তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এরমাঝে সাজিয়ার উদ্দেশ্যে আলম সাহেব বলেন,

” মা সাজিয়া! তোমার কি মতামত? ”

শ্বশুর মশাইয়ের প্রশ্নে সাজিয়া চিন্তিত হয়ে তাকালো উনার দিকে। তৃপ্তি বাচ্চা দুটোকে খাওয়ানো শেষে হাত ধুয়ে তাদের মুখ মুছিয়ে দিয়ে সাজিয়াকে বললো,

” ধারার পরিক্ষা চলছে, এরমাঝে আমরা যদি যাই সমস্যা হবে। কিছু ভুল বললাম ভাবী? ”

তৃপ্তির কথার সুর ধরে তাদের শ্বাশুড়ি মা শান্তি বেগম বলেন,

” তৃপ্তি তো ঠিকই বলেছে। ওর কথাও বিবেচনা করা উচিত। ”

সবার কথায় খানিকটা হতাশ হলো শ্রাবণ৷ তার মনের মাঝে যে ঝ”ড় চলছে, তার সমাধান তো হচ্ছে না। কি করবে সে,চিন্তায় মাথা নিচু করে নিলো। সাজিয়া ব্যাপার টা খেয়াল করলো৷ মনে মনে ভাবলো, ‘শ্রাবণ যখন শখ করে যেতে চেয়েছে,নিয়ে যাই। ধারার পরিক্ষা, ওকে কেউ বি”রক্ত না করলেই হলো।’ এটা ভেবেই সাজিয়া বললো,

” সমস্যা নেই, বাবার অনুমতি থাকলে আমরা যাচ্ছি। ”

সাজিয়ার কথায় বেশ উৎফুল্লতা প্রকাশ পেলো শ্রাবণের চোখে মুখে। তাহিরা শ্রাবণের মতিগতি বুঝতে পারছেনা ঠিকঠাক । এরমাঝে তৃপ্তি বললো,

” ভাবী আপনারা যান। আমি থাকি? বাবা-মাকে তো রান্নাবান্না করে খাওয়াতে হবে,খেয়াল রাখতে হবে তাইনা?”

” না তৃপ্তি মা, তুমিও গিয়ে ঘুরে আসো সবার সাথে, ভালো লাগবে৷ আমি এতোটাও বুড়ো হইনি,দুবেলা রাধতে পারবোনা৷ বাকি সব কাজ তো কাজের লোক এসেই করে দেয়। ”

শ্বাশুড়ি মায়ের কথার উপর তৃপ্তি আর না করলো না। সবার খাওয়া শেষে সাজিয়া আর তৃপ্তি খেয়ে নিয়ে যে যার রুমে গেলো সব গুছিয়ে নিতে।

এদিকে তাহিরা নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গেস্ট রুমে শ্রাবণকে ডাকতে আসে। আসার সময় তেমন কিছু তারা আনেনি। কিন্তু শ্রাবণ এভাবে হুট করে তার বড় ভাবীর বাবার বাসায় শুধু যে ঘুরতে যাবেনা, এটা তাহিরা নিশ্চিত। কিন্তু যাবে কেনো এটাই এখন জানার বিষয়। দরজায় দাড়িয়ে নক করে সে। শ্রাবণ তাহিরাকে দেখে বলে,

” আরে ভাবী আসো। তোমার আবার আমার রুমে আসতে নক করতে হয় নাকি? ”

” করতে হয় করতে হয় বুঝলা ছোটো দেবর । বউ হলে তখনও যদি নক না করে ঢুকে পরি আর তোমাদের রোমান্স দেখে ফেলি! কি রকম হবে। তাই এখন থেকেই নক করে ঢোকার প্রাক্টিস করে রাখছি। ”

” বেশ ভালো ভাবী। সিঙ্গেল দেবরকে বউ না হতেই মিঙ্গেল বানিয়ে দিলে। ”

” দেবর আদৌও সিঙ্গেল তো? ”

” মানে কি বুঝাতে চাচ্ছো ভাবী? ”

তাহিরার শেষ কথায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শ্রাবণ। তাহিরা শ্রাবণের মুখা ভঙ্গি দেখে হেসে বলে,

” আরে এতো অবাক হওয়ার কি আছে? দেবর অনার্স শেষ করে, মাস্টার্সে পড়তেছে, সে সিঙ্গেল তো আদৌও? নইলে এভাবে আচমকাই আমার বড় ভাবীর বাবার বাড়ির এলাকায় যেতে চাচ্ছো? শুধু ঘুরতেই? নাকি অন্য উদ্দেশ্য আছে বলো তো? ”

” তুমি না জিনিয়াস ভাবী। জার্নালিজম নিয়ে পড়লে জীবনে ভালো একটা ক্যারিয়ার হতো। তোমার ব্রেইন ভালো। ”

শ্রাবণের মুখে নিজের নামে অযথা প্রশংসা শুনে তাহিরা ভ্রূকুটি করে বলে,

” কথা এড়িয়ে যাচ্ছো ভাইয়া? আমার বাপু এতো সাংবাদিক হয়ে কাজ নেই। বাংলায় অনার্স কমপ্লিট করতেই যথেষ্ট হেপা পোহাচ্ছি। আরও দুইটা বছর বাকি। কি যে য’ন্ত্র’ণা পড়াশোনায়। আর চাইনা, মাফ করো। আসল কথা বলো। ”

তাহিরার কথা শেষ হতে না হতেই সাজিয়ার ডাকে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে দুজনেই একসাথে ড্রইং রুমে আসে। আসতেই সাজিয়া বলে গাড়িতে গিয়ে উঠতে। এরপর সবাই বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেয় সাজিয়াদের গ্রামের উদ্দেশ্যে।

২,
পরিক্ষা দিয়ে মাত্র বাসায় ফিরলো ধারা। দুপুরের শিফটে পরিক্ষা হচ্ছে তার। উঠানের গেট খুলে ভেতরে পা দিয়েই হিজাবের পিন খোলায় ব্যস্ত হয়ে পরে সে। একহাতে পরিক্ষার যাবতীয় জিনিসের ফাইল ধরে অন্য হাতে হিজাবের পিন খুলতে খুলতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বাড়িতে যে আরও কিছু মানুষ উপস্থিত আছে সেদিকে তার ধ্যান নেই। তখনই ধারার সামনে উপস্থিত হয় সাজিয়া। বড় বোনকে এই অসময়ে দেখে একটু আশ্চর্য হয় সে। সাধারণত দুই ঈদ ছাড়া বিয়ের ছয় বছরে বাবার বাসায় আসা হয়না সাজিয়ার। মাঝে মাঝে দরকারে আসলে আসার আগে ফোন করে আসে। স্বামী প্রবাসে থাকে, স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় থাকে সাজিয়ার স্বামী,সেজন্য বাবা মায়ের সাথেই বেশি থাকতে বলে গেছে সে। এজন্য বাবার বাসায় আসা তার জন্য একপ্রকার নিয়মের মতো, ঈদের পরদিন ছাড়া আসা হয়না। ধারার এই বিষয় নিয়ে অবশ্য বোনের উপর ভীষণ অভিমান জমে আছে। ছোটো থেকে বড় হয়েছে বোনের কাছে। মা-কে পায়নি সে। সেজন্য বড় বোন মা সমতুল্য ধারার কাছে। সেই বোনকেও অনার্স ২য় বর্ষে উঠতেই বিয়ে দিয়ে দেয় চাচা ফুফুরা মিলে। ভাইবোনের দোহায় দিয়ে পড়াশোনা শেষ করা অব্দি বিয়েতে নাকচ ছিলো সাজিয়ার। কিন্তু চাচা-ফুফুদের তার মৃ”ত ভাইয়ের বিয়ের যোগ্য মেয়েকে নিয়ে চিন্তা ছিলো, খুজে খুজে ভালো পাত্র পাওয়ায় বিয়ে দিয়ে দেন। এতিম মেয়েকে অবশ্য তার শ্বশুড় বাড়ির লোকজন সাদরে গ্রহণ করেছিলো। বিয়ের পর পড়াশোনাটা শে’ষ করেছে সাজিয়া। শুধু একটা কথাই রাখেননি তারা। দুলাভাই প্রবাসে থাকে, ধারা চেয়েছিলো বোন তাদের সাথে থাকুক, সাজিয়ার স্বামী শহিদ দেশে একেবারে চলে আসলে সাজিয়াও চলে যাবে। কথাটা রাখেনি শহিদ। এজন্য বোনের উপর অবশ্য একরাশ অভিমান ধারার। কিন্তু পরের বাড়ি,পর যা বলে বিয়ের পর সেটাই শুনতে হয় নারীদের। কিছু করার নেই।বিয়ের পর পড়াশোনা শেষে অর্ধ সরকারি একটা স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে চাকরি পায় সাজিয়া। বেতনটুকু সব ভাইবোনের খরচ হিসেবে পাঠায়। এজন্য যেনো আরও বাবার বাসায় আসা হয়ে উঠেনা তার৷
অতীতের কথা মনে হতেই অশ্রসজল চাহনীতে তাকায় ধারা। বোনকে এই অবস্থায় দেখে সাজিয়া জাপ্টে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে । সেই আড়াই বছর বয়সী বোনকে রেখে মা”রা যায় তাদের বাবা। ছোট্ট ভাই আর বোনকে নিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে সাজিয়া নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছে৷ দুইবোন অনেক দিন পর একঅপরকে কাছে পেয়ে অনবরত কেদে চলেছে। তাহিরার বিয়ের সময় গিয়েছিলো, তখন বোন তো ননদের বিয়ে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো সময় দিতে পারেনি। দুইবোনের এই আবেগঘন মুহুর্তে উঠানের গেট দিয়ে প্রবেশ করে শ্রাবণ আর সৃজান। দুইবোনকে কাদতে দেখে সৃজান ধারার উদ্দেশ্যে বলে,

” কিরে পেত্নী? আপু আসতে না আসতেই কাঁন্না শুরু করে দিয়েছিস। ”

সৃজান কথাটা একটু জোড়েই বলে। শ্রাবণ দু-হাত বুকে বেঁধে তাদের দেখছে। ঐ সময় ঘর থেকে তাহিরা, তৃপ্তি লাম আর তাহসিনকে নিয়ে উঠোনে আসে। তাহসিন খালামনিকে দেখে তাহিরার কোল থেকে নেমে দৌড়ে এসে ধারার কোলে উঠে। তখুনি শ্রাবণ ধারার উদ্দেশ্যে বলে,

” এটা আপনার ছেলে তাইনা ধারা?”

শ্রাবণের কথায় তার দিকে নজর দেয় ধারা। এতক্ষণ তাকে খেয়াল করেনি সে। খেয়াল হতেই বলে উঠে,

” আপনি? এখানে? ”

চলবে?