একথোকা কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৩

0
237

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া
#পর্বঃ৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৫,
” তুই শ্রাবণকে চিনিস ধারা?”

শ্রাবণের প্রতি ধারার অভিব্যক্তি দেখে প্রশ্নটি করে সাজিয়া। ধারা বড় বোনের কথার উত্তর দিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

” না। ইয়ে মানে হ্যা চিনি।”

” তো এতো না হ্যাঁ মানে মানে শুরু করছিস কেনো? ”

” আরে ভাবী ওনাকে এতো প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। আমি ক্লিয়ার করছি ব্যাপারটা। আসলে ভাইয়ার বিয়ের সময় ধারা উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো একঝলক।আমি জানতাম না উনি আপনার বোন। তাহসিনকে উনার কোলে দেখে আমি জাস্ট উনার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ বাচ্চাটা উনার কিনা!’ উনি উত্তরে হ্যাঁ বলেন। সেজন্য আর কি আমি ওভাবে প্রশ্ন করেছি। ”

ধারার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উত্তরটা দেয় শ্রাবণ। শ্রাবণের উত্তর নরমালই নেয় সবাই। যেহেতু বিয়ে বাড়ি, দেখা হতেই পারে দুজনের। কিন্তু শ্রাবণের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তৃপ্তি ধারার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

” তো ধারা তুমি তাহসিন বাবাইকে নিজের সন্তান বলেছিলে কেনো শ্রাবণের কাছে? ”

ধারা নিরলস ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,

” বড় বোনের সন্তান নিজের সন্তান হয় খালাজাতীর। এটা আমাদের খালাগত অধিকার।”

উত্তর দিয়েই ধারা তাহসিনকে কোলে নিয়েই নিজের ঘরের দিকে হনহনিয়ে হাটা ধরে। উপস্থিত সকলে ধারার এমন উত্তরে তার দিকে অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে উঠানেই দাড়িয়ে থাকে। তাহিরা পরিবেশ টাকে স্বাভাবিক করতে সৃজানের উদ্দেশ্যে বলে,

” কিন্তু সৃজান তুমি আর শ্রাবণ ভাই কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ”

” আমার ফোনে রিচার্জ করতে হতো, সেজন্য একটু বাজারের দিকে গিয়েছিলাম। ”

শ্রাবণ আবারও সৃজানের বদলে উত্তর দিয়ে দেয়। শ্রাবণের কথা ফুরোতেই সাজিয়া বলে উঠে,

” তোমরা ঘরে যাও। আমি রাতের রান্না শেষ করে আসছি। ”

” ভাবী আমি আপনার সাথে থাকি?”

প্রশ্নটি করে তৃপ্তি। উত্তরে সাজিয়া মুচকি হেসে বলে,

” লামকে নিয়ে ঘরে থাকো বোন। এটা গ্রাম,ঠান্ডাও বেশি। লাম বাবার ঠান্ডা লেগে যাবে। ”

তৃপ্তি মাথা নাড়ায় বড় জা-য়ের কথায়। তাহিরা তার ভাবীদের কথার জবাবে বলে,

” আমার তো আর বাচ্চা নেই, আমি তো তোমায় হেল্প করতে পারি বড় ভাবী? ”

” তা পারো, কিন্তু যদি তাহসিনকে সামলাতে ভালো হতো। ধারা আসলো মাত্র, ও একটু ফ্রেশ হোক। ”

” তাহসিন বাবাকে আমরা সামলাচ্ছি আপু। তুমি নিশ্চিন্তে রান্নার আয়োজন করো। ”

সৃজান কথাটা বলে। তাদের কথা শেষ হতেই যে যার মতো ঘরে চলে গেলো। সাজিয়া রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার আয়োজন শুরু করে। বাজার সদাই সব আসার সময়ই বাজারে গাড়ি থামিয়ে করে নিয়েছে। চুলা জ্বা”লিয়ে ভাতের চাল ধুয়ে বসিয়ে দিতেই সাজিয়ার বড় চাচী রান্নাঘরে হাজির হোন। তাকে দেখেই সাজিয়া সালাম দেয়। উনি সালামের জবাব দিয়ে বলেন,

” কেমন আছো আম্মু? তুমি আসলে অথচ আমরা টেরও পেলাম না। সৃজান না বললে তো জানতামওনন আম্মু। এতটা পর করে দিলে?”

” ব্যাপারটা তেমন নয় বড়আম্মু। সাথে আরও মানুষজন এসেছে তো। তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।রান্না শেষ করে সবাইকে নিয়েই ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম।ধারাও পরিক্ষা দিতে গিয়েছিলো, সবাইকে রেখে যেতেও পারছিলাম না।বাসার সবাই কেমন আছে বড় আম্মু?”

সাজিয়ার বাবারা তিনভাই দুইবোন। সাজিয়ার দুই চাচীকে সে বড় আম্মু আর ছোটো আম্মু বলে সম্মোধন করে। সেজন্যই বড় চাচীকে বড় আম্মু ডাকলো সে। সম্পর্কে চাচী হলেও মায়ের অভাব সেভাবে বুঝতে দেয়নি তার দুই চাচী। সেজন্য সম্মানের জায়গা থেকেই চাচী না বলে আম্মু বলেই ডাকে। দুইজন হওয়ায় বড় বর ছোটো বলে ডাকটুকু পৃথক করে তারা তিন ভাইবোন-ই।সাজিয়াদের বাড়ি সাজিয়ার বাবা বড় হওয়ায় সব বাড়ির শুরুতে,তাদের বাড়ি ছাড়িয়ে তাদের চাচাদের বাড়িতে যেতে হয়। সেজন্য সে বাড়ি আসলেও না জানালে কেউ বুঝতে পারেনা সে এসেছে। সাজিয়ার কথা বুঝে তার বড় আম্মু উত্তর দেন,

” সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে আম্মু। একা এতো আয়োজন করবে কিভাবে? আমি সাহায্য করি তোমার হাতে হাতে। ”

কথাটুকু বলেই বাহারী বাজার দেখে সাহায্য করতে বসে যান সাজিয়ার বড় আম্মু। সাজিয়াও হাসিমুখে চাচীর সাথে কাজ করতে শুরু করে।

৬,
নিজের ঘরে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে ধারা। তাহসিন সৃজানের কাছে আছে। ধারার ঘরে চেয়ার টেবিলের কাছে চেয়ার পেতে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন তাহিরা। ধারাদের বাড়িতে ঘর তিনটা, দুচালা টিনের ঘর বড় একটা।মাঝখানে টিনের পাটিশন দিয়ে তিনটা রুম করা। একটা ধারার,অন্যটা সৃজানের।আর একটায় মানুষ আসলে থাকতে দেওয়া হয়, যেটায় তৃপ্তি লামকে নিয়ে শুয়ে ফিডিং করাতে ব্যস্ত। তাহসিনের বয়স ২বছর আর লামের দেড় বছর। সাজিয়ার বর শহীদ আর তার ভাই সানু একবছরের ছোটো বড় হওয়ায় একসাথেই বিয়ে করে আর তাদের বউয়ের বাচ্চাও হয়েছে প্রায় একসাথে, ছয়মাসের আগপাছ শুধু । তাহিরা ভাইদের ভাবনায় মশগুল থাকতে থাকতেই শ্রাবণ ধারার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে বলে,

” ভাবী একটু বাইরে আসবে? কথা ছিলো। ”

তাহিরার শ্রাবণের কথা কানে যেতেই নিশব্দে শরীরে শীতের শালটা জড়িয়ে বেরিয়ে আসে। ধারা সেটা একঝলক দেখেই আবার বইয়ে মুখ গুজে বসে। আগামী কাল-পরশু দুদিন গ্যাপ আছে। সেজন্য সে ঘুমায়নি,পড়তে বসেছে। পড়ে একটু করে এগিয়ে রাখতেই মূলত পড়তে বসা। নয়তো তাহসিন আর লাম এসেছে আর সে বই নিয়ে বসে আছে এমন টা হবার নয়। ধারা যে ভীষণ বাচ্চাপাগলি। সেখানে দুজনই তার ভীষণ প্রিয় আদরের বাচ্চা। ধারার মন টিকছে না বইয়ে । সৃজানের ঘরে গিয়ে তাহসিনকে আনতে ইচ্ছে করছে তার৷ কিন্তু এই শ্রাবণ নামক মানুষকে তার একদম পছন্দ নয়, সেজন্য ঘর থেকে বের হচ্ছে না সে। তাহিরা আপুর বিয়ের দিনই ধারা বুঝে ছিলো লোকটা ভালো নয়। সেজন্য তো কথা বলতে আসলেই বলেছিলো সে তাহসিনের মা। দিনটার কথা মনেও করতে চায় না ধারা। তার বিয়ের আনন্দ টাই মাটি করে দিয়েছিলো লোক-টা।

” আমি যদি ভুল না হই, ধারার জন্যই তুমি এখানে এসেছো। তাইনা ভাইয়া? ধারাকে তো তুমি আমার ফোনে ওর ছবি দেখে জিগাসা করে জেনেছিলে ও বড় ভাবীর বোন। তোমাদের যে তোমার ভাইয়ার আর আমার বিয়ের সময় আলাপ হয়েছিলো এটা তো বলোনি। একটু খোলাখুলি বলবে ভাইয়া আদৎ এ কি হয়েছিলো?”

পুকুর পারে শানের উপর বসে শ্রাবণের উদ্দেশ্যে কথাটুকু বলে তাহিরা। শ্রাবণ তাকে ডেকে নিয়ে ধারাদের পুকুরপারে নিয়ে এসেছে। ধারার বাবা মা*রা গেলেও উনি যে পিতৃ সূত্রে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, সেগুলোর জৌলুশ এখনও ধরে রেখেছে উনার তিন সন্তান, সেটা বুঝাই যায় সবকিছুতে। মাছের চাষ করতে নিজস্ব পুকুরও করেছিলেন ধারার বাবা।যেখানে এই মুহুর্তে শ্রাবণ আর তাহিরা উপস্থিত।

” কি হলো ভাইয়া? উত্তর দিচ্ছো না যে? ”

শ্রাবণ একের পর এক ছোটো ছোটো মাটির ঢিল পুকুরের পানিতে শূণ্যে ছুড়ছিলো বসে বসে। তাহিরার কথা ফের কানে যেতেই বলে,

” তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেক ঘটনা ভাবী। আপাতত আমার এতো কথা বলতে ভালো লাগছেনা। ”

” তাহলে ডেকে আনলে কেনো এখানে? ”

” এমনিই? আজব তো ভাইয়া। আচ্ছা ধারার জন্যই কি আমার ভাবীদের ঠিকুজি গুস্টি জানতে চেয়েছিলে গল্পের ছলে? আর আজ এখানে আসলে। কিন্তু আজ কেনো? তুমি তো অনেক আগেই জেনেছিলে তাদের ব্যাপারে! ”

” আগে জানলেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি ভাবী৷ কিন্তু যখন করলাম, নাম্বারই ব্লক দিলো। ”

” মানে? কি বুঝাতে চাইছো ভাইয়া? ”

” উনি বুঝাতে চাচ্ছেন উনি আমার কাছে মেসেজ করেছিলেন। আর আমি উনার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছি তাহিরা আপু। ”

শ্রাবণের সাথে কথার মাঝেই তাহিরার সাথে কথা শেষ হতেই পিছন থেকে ধারা এসে উত্তরটা দেয়। শ্রাবণ নিরলস অভিব্যক্তিতে সেই পুকুরপানেই তাকিয়ে আছে।তাহিরা দুজনকে একঝলক দেখে ধারাকে বলে,

” তুমি তো পড়তে বসে ছিলে? হঠাৎ এখানে? ”

” আপু সন্ধ্যার নাস্তা গুছিয়ে ফেলেছে৷ আপনাদের ডাকছে৷ আসুন। ”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে চলে যায় ধারা। মনের মাঝে একগাদা প্রশ্নের ঝড় থাকলেও তাহিরার সামনে শ্রাবণকে জিগাসা করলো না সে। লোকটার সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করেনা তার৷ বিরক্তিকর মানুষ একজন মনে হয়। ধারা চোখের আড়াল হতেই তাহিরা শ্রাবণকে প্রশ্ন করে,

” একটু ক্লিয়ারলি বলবে ভাইয়া আসলে তোমাদের মাঝে হয়েছে কি? কানেকশন কি? ধারা তোমার প্রতি এতো বিরক্ত কেনো? ওর চাহনী দেখলেই বোঝা যায় সে অনেক বিরক্ত তোমার উপর৷ একটু ক্লিয়ার করো প্লিজ। ”

চলবে?