একথোকা কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০১

0
394

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া
#সূচনাপর্ব
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১,
” মি’থ্যা কেনো বলেছিলেন সেদিন? আপনি অবিবাহিত বাচ্চা একটা মেয়ে হয়ে নিজেকেই এক বাচ্চার মা বানিয়েছিলেন নিজেকে! ”

ফোনে টুংটাং মেসেজের শব্দে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ খুলে পড়তেই কথাগুলো দেখতে পায় ধারা। সে আবার কবে কাকে মিথ্যা বললো! আর সে বাচ্চা মেয়ে! আসলেই! লোকটা কি পা’গ’ল। আজব তো। মেয়েটা মেসেজ টাকে অগ্রাহ্য করে বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। সময়টা রাত দুটো। এইচএসসি বোর্ড পরিক্ষা চলছে ধারার। আর ৩টা পরিক্ষা বাকি, শেষ হলে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। এরমাঝে এই এতো রাতে কে কি মেসেজ দিলো গুরুত্ব দেওয়ার সময় নেই ধারার। ঘুম থেকে উঠেছেই দেড়টায়। ছোটোবেলা থেকেই অভ্যাস তার, পরিক্ষার সময়, রাত দেড়টায় উঠে পড়া শুরু করে, পরিক্ষা দিয়ে এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই ঘুমিয়ে পরে। অভ্যাসটা তার বড় বোন করে দিয়েছে ছোটো থেকেই। সেজন্যই প্রতিবারের রুটিন মোতাবেক এবারও দেড়টায় উঠে কম্বল মুড়িয়ে বই নিয়ে পড়ছে সে। ফোনটা পাশে পরে ছিলো, তখনই মেসেজটা আসে। চোখ থেকে ঘুম ছাড়েনি তার। এই মুহুর্তে কড়া লিকারের চা দরকার তার। মাথা-টাও ব্যথা করছে আজ। ব্যথাটা মাইগ্রেনের দিকে ধাবিত হলে পরিক্ষা আজ কতটা ভালো হবে! ভাবতেই গা শিউরে উঠলো ধারার। আলসেমি ছেড়ে কম্বল ফেলে পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। আজ আম্মু থাকলে নিজেকে অন্তত চা বানিয়ে খেতে হতো না তার। আম্মু শব্দটা মাথায় আসতেই নিজের প্রতি বিরক্ত হলো ধারা। সব চিন্তা বাদ দিয়ে চা বানাতে হবে সেদিকে ধ্যান দিলো৷ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা দিতেই ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত আকাশের চাঁদ টাকে নজরে পরলো তার। মুচকি হেসে বড় ভাইয়ের ঘরের দিকে তাকালো,এখনও লাইট জ্ব”ল’ছে রুমের অদ্ভুত। অবশ্য তার ভাই আগামাথা পুরো টাই অদ্ভুত। অনার্স ১ম বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা হয়ে গিয়েছে। তবুও তার ভাই রাত কেনো জাগছে বুঝেনা ধারা। বুঝার চেষ্টা বাদ দিয়ে সে চা বানাতে গেলো রান্নাঘরে। উঠোনের এক কোণায় রান্নাঘর,অন্য কোণায় কলপাড়। চায়ের জন্য পানি নিয়ে এসে চা বসিয়ে দেয় গ্যাসের চুলায়। মাটির চুলার পাশাপাশি সময়ে অসময়ে ব্যবহারের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার আর চুলাও কিনে দিয়েছে তার বড় আপু। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার দরুণ সে তাদের সাথে থাকেনা। বড়বোন আর বড় ভাই ধারার দুনিয়া। বাবা সে তো, ধারা আড়াই বছরের থাকতেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন লিভার ক্যা’ন্সা’রে। আর মা! মায়ের কথা মাথায় আসতেই তাচ্ছিল্যের সহিত হাসি হাসলো ধারা। চায়ের পানি গরম হতেই লিকার দিয়ে একটু সময় নিয়ে ফু’টি’য়ে চা তৈরি করে নিলো ধারা। মগভর্তি চা না হলে চলে না ধারার। মগভর্তি চা নিয়ে কিছু টা চা ফ্লাক্সেও তুলে রাখলো। রাতের বাকি প্রহর গুলো তার চা খেয়েই জাগতে হবে। এটা তার বদঅভ্যেস হয়ে গিয়েছে। রান্নাঘর ছেড়ে চা নিয়ে বেরুতেই দেখে বড় ভাই সৃজান দাড়িয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। তাদের গ্রাম টা উপজেলার শেষের প্রান্তে হওয়ায় নেটওয়ার্কের যে ঢেড় সমস্যা আছে সেটা জানে ধারা। সেজন্য হয়তো নেট খুজতে ফোন নিয়ে বাইরে বের হয়েছে সৃজান। সেটা বুঝেই সৃজানকে বিরক্ত করলোনা সে। এখন কথা বললেই ঝ’গ’ড়া লেগে যাবে।পিঠাপিঠি ভাইবোন হলে যা হয়। সৃজান তার থেকে মাত্র তিনবছরের বড় যে। ঘরে যাওয়ার সময় অবশ্য সৃজান ধারার উদ্দেশ্যে মজা করে পে’ত্নী বলে ডেকেছিলো। সৃজান যে ধারাকে পে’ত্নী বলেই অভ্যস্ত। আর দুই ভাইবোনের মাঝে এটা নিয়েই ঝ’গড়া লেগে যায়। ধারা গায়ে মাখেনি সৃজানের ডাক৷ পড়াগুলো কমপ্লিট করে ফেলতে হবে তার। সারাবছর পড়ার খবর কমই থাকে। পরিক্ষার আগের রাতে সিলেবাস শেষ করার মতো ম’জা বোধহয় কোনো শিক্ষার্থীরই অজানা নয়। ধারাও তাদের মাঝে একজন।রেজাল্ট মোটামুটি রকম ভালো হয় এটাই তার কাছে আলহামদুলিল্লাহ। মগ ভর্তি চা খেতে খেতে পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে ধারা। এরমাঝে সময় দেখতে ফোন হাতে নিতেই দেখে আরও একটা মেসেজ। তাতে লিখা,

” রিপ্লাই করছেন না কেনো? আমি জানি আপনি জেগে আছেন। ”

এ আবার কোন হালের ব’ল’দ যে তার ব্যাপারে সব জেনে বসে আছে। মেসেজটা দেখে এরকম টাই ভাবলো ধারা। নাম্বার টা ব্লক করে দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো।


সকাল সকাল ননদ আর তার দেবরকে বাসায় আসতে দেখে অবাক হয় সাজিয়া। হালকা একটু জ্বর থাকায় আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে তার। ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঘরিতে সময় দেখে নিলো। ৭ঃ৩৩ বাজে। এতো সকালে আসার কারণ উদঘাটন করতে পারলোনা সাজিয়া। সে বিছানা ছেড়ে নেমে ছেলেকে খুজলো পুরো রুমে নজর বুলিয়ে। কোথাও না পেয়ে ড্রইং রুমে এসে দাড়ালো। ড্রইং রুম থেকেই ননদের গলার স্বর শুনে সে আন্দাজ করেছিলো তাহিরা এসেছে। তাহিরা সাজিয়ার ননদের নাম। কিন্তু সাতসকালে আসার কারণ কি উদঘাটন করতে তাহিরা-কে ড্রইং রুমে দাড়িয়ে জিগাসা করলো,

” আরে তাহু! তুমি এতো সকালে? শ্বশুর বাড়িতে সব ঠিক আছে তো? ”

” হ্যাঁ ভাবী সব ঠিক আছে। এমনিই সবাইকে খুব মনে পরছিলো। কান্না করে দিয়েছিলো ভাবী সকাল সকাল। সেজন্য আমি সাথে করে নিয়ে আসলাম। ”

সাজিয়ার প্রশ্নে তাহিরার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উত্তরটা দেয় তাহিরার দেবর শ্রাবণ। তাহিরা ভেবাচেকা খেয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে।কি ডাহা মি’থ্যা বললো শ্রাবণ। আসার জিদ কার ছিলো,আর কার উপর চাপিয়ে দিলো। তাহিরার সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে। সবে দুইমাসে পা পরলো বিয়ের। তাই সাজিয়া বিনাবাক্যে কথাগুলো মেনে নিলো। ড্রইং রুমে আর কাউকে না পেয়ে ফের জিগাসা করলো,

” তাহিরা! আম্মু, তোমার ছোটো ভাবী কোথায়? তোমরা এসেছো, গলা ফা”টিয়ে ডাকলে। অথচ তাদের হদিস নেই যে! ”

” ভাবী আম্মু আর ছোটো ভাবী নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে গেছে। তুমিও যাও, তাদের পেয়ে যাবে। ”

” আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। শীতের সময়, ঠান্ডায় একটু জ্বর জ্বর ভাব এসে গেছে। আমি আসছি,তোমরা বসো,নয়তো তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। শ্রাবণকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দাও। ”

কথাগুলো বলেই সাজিয়া রুমের দিকে পা বাড়ালো। তাহিরা বড় ভাবীর কথামতো শ্রাবণকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিতে উঠে দাড়ালো। যেতে যেতে শ্রাবণকে প্রশ্ন করলো,

” এখানে আসার তাড়া ছিলো তোমার ভাইয়া। আমার উপর সব দো’ষ চাপিয়ে দিলে। ব্যাপার কি বলো তো? ”

” সময় হলেই বুঝবে ভাবী। আপাতত ফ্রেশ হয়ে খেয়ে পরবর্তী প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা যাবে। তুমিও তোমার রুমে চলে যাও এখন। ”

তাহিরা শ্রাবণের থেকে বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের ছোটো, কিন্তু সম্পর্কে বড় । বয়সে বড় হওয়ায় শ্রাবণকে সে ভাইয়া ডেকে আপনি সম্মোধন করতো। কিন্তু শ্রাবণ অনেক চঞ্চল একজন মানুষ৷ তাহিরা তাকে আপনি করে বলুক এটা সে মানতে নারাজ। তারমাঝে হয় ছোটো দেবর। সেজন্য সে তাহিরাকে তুমি বলতে বলে। বিনিময়ে তাহিরাও তাকে তুমি বলে সম্মোধন করতে শর্ত দেয়। সেজন্য তারা একে-অপরকে তুমি বলেই ডাকে এখন৷ তাহিরা শ্রাবণকে গেস্ট রুমে পৌছে দিয়ে নিজের রুমে আসে। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর সেভাবে এসে থাকা হয়নি বাবার বাসায়। শ্রাবণ সেটারই সুযোগ নিলো। কি করতে চায় সে আর খোদা জানে। তাহিরা নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বিয়ের পর মেয়েদের বাবার বাড়িতেও যে অতিথি হতে হয়, কথাটার গুরুত্ব সে আগে দিতো না। এখন নিজে এই পরিস্থিতিতে পরে গুরুত্ব দিতে শিখেছে। ভাবীদের আগে কত বলতো, ‘ আমার বাবা মা কি তোমাদের বাবা মা না! এতো বাবার বাসায় যেতে চাও কেনো? ‘ এখন সে প্রতিক্ষণে বুঝে কেনো প্রতিটা নারী বিয়ের পর বাবার বাসায় আসতে উৎসুক হয়ে বসে থাকে। শ্বশুড় বাড়িতে যেনো মন টিকে সেজন্য তার শাশুড়ি সেভাবে এসে থাকতে দেয়নি তাকে। যদিও মা আর শ্বাশুড়ি মায়ের পার্থক্য সে বুঝেনি, কিন্তু তবুও মা তো। নিজের আলমারীর ভাজে নিজের পুরাতন কাপড় গুলোয় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো ভাবছিলো তাহিরা। এরমাঝেই তার ছোটো ভাবীর ডাক। খেতে ডাকছে সে। সকাল বেলা শ্রাবণ যখন তাকে বললো, ‘ তাকে বাবার আসতে জিদ করতে হবে, খাওয়া দাওয়া রেখেই আগে শ্রাবণের কথা শুনতে হয়েছে তার। নয়তো শ্রাবণের নাকি খুব ক্ষ’তি হয়ে যাবে। কি ক্ষ”তি সেটা শ্রাবণ বলেনি। শ্রাবণের জিদে অগত্যা রাজী হতে হলো তাকে। তাহিরার স্বামী ঢাকা শহরে একটা কোম্পানিতে চাকরি করে বিধায় সে বাড়িতে নেই। তাই জিদ করতেই শ্বাশুড়ি মা শ্রাবণের সাথে তাকে পাঠিয়ে দিলো। শ্রাবণ কি করতে চাইছে শ্রাবণই ভালো জানে। ফ্রেশ হয়ে তাহিরা ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। আগে থেকেই সবাই সেখানে বসে ছিলো। সে যেতেই সাজিয়া খাবার সার্ভ করে দিলো সবাইকে। খাবার টেবিলে শ্রাবণ,তাহিরার বাবা-মা, সাজিয়ার ছেলে তাহসিন, তাহিরার ছোটো ভাইয়ের ছেলে লাম বসেছে।তাহিরার ছোটো ভাবী তৃপ্তি দুই ছেলেকে তুলে খাওয়াচ্ছে। দুজনেই সম বয়সী প্রায়। তাহিরার দু’ভাই বড়জন প্রবাসে আছে, ছোটোজন একটা এনজিও চালায় বিধায় দুজনই খাবার টেবিলে নেই।বড়জনের পক্ষে তো থাকা সম্ভবই না,ছোটোজন সকাল ৬টা বাজতেই উঠে চলে যায়। এখন সময় আট টা প্রায় সেজন্য সেও নেই খাবার টেবিলে। সবারই খাওয়ার মাঝে শ্রাবণ হুট করে বলো উঠে,

” তাওই একটা কথা বলার ছিলো। যদি অনুমতি দিতেন, বলতাম। ”

চলবে?