এক টুকরো নূর পর্ব-০২

0
116

#এক_টুকরো_নূর
—————(২য় পর্ব)
লেখিকা: উম্মে হানি মিম

নাস্তা নিয়ে পরশির রুমে ঢুকলো নূরা সাথে নোহাও।
নাস্তা বেশি হওয়ায় একার পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
ওড়নাটা দিয়ে নূরার মুখে নেকাবের মতো বাধা।পরশির ছেলে-মেয়ে বন্ধুরা হা হয়ে তাকিয়ে আছে নূরার দিকে।নূরা নাস্তাগুলো সার্ভ করে বেরিয়ে আসছিল তখনই একটা ছেলে বলে উঠলো, “এটা কোন গ্রহের প্রানী রে।”
সাথে সাথে সবাই হেসে উঠলো।নোহার গা জ্বলে উঠলো।ফুলের মতো পবিত্র বোনটার সম্পর্কে এরকম কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না।কিছু বলতে যাচ্ছিল।নূরা বিষয়টা বুঝতে পারে আর তখনই নোহাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে এমন সময় আরেকটা মেয়ে বললো,”মেয়েটা মনে হয় অতিরিক্ত সুন্দরী সে জন্য মুখ ঢেকে রাখে আমরা দেখলে তার রুপের আগুনে জ্বলে যাব যে।”
ঘর আবার অট্টহাসিতে ভরে উঠলো।
নোহা আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলো,”আমার আপা তার নিজের মতো চলে।আপনারাও তো হ্যাফপেন্ট পরে হাটেন।মেয়েরা ছেলেদের মতো জামা কাপড় পরেন আমরা কিছু বলতে যাই?তো আমাদের নিয়ে আপনাদের এত সমস্যা কেন?”
নূরা আস্তে করে ধমক দিলো নোহাকে।সে চুপ হয়ে গেল।মেয়েটা নোহার কথা হজম করতে পারলো না তেড়ে এসে বললো,”এতবড় সাহস আমাদের জামা-কাপড় নিয়ে কথা বলো।আমরা কে জানো তুমি?গ্রাম থেকে উঠে আসছো আনকালচার কতগুলো আর আমাদের সাথে মেলাচ্ছো নিজেদের।”
“মেলাতে যাব কেন আমার আপার নখের যোগ্যও আপনারা না” কথাটা দ্রুত বললো নোহা।
মেয়েটা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো নোহার গালে।এবার সাদমান উঠে দাঁড়ালো পরবর্তী চড়টা আর মারতে দিলো না মেয়েটাকে।
মেয়েটা রাগে ফুসছে।
নূরা নিজেকে সামলে কমল সুরে বললো,”আপনারা ওকে ক্ষমা করে দিন, ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি আপনাদের কাছে।ওর বিচার আমি করবো।”
কথাটা বলে নোহাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মিহি নামের মেয়েটা রাগে ফুসছে।পরশিকে বললো,”এভাবে তোর বাসায় এনে অপমান করালি? আগে বলতি আসতাম না আর তোর বাসায়।”
পরশি বিচলিত হয়ে বললো,”মিহি প্লিজ কিছু মনে করিস না দোস্ত।ওদের বিচার আমি মাম্মি পাপাকে দিয়ে করাবো।তোরা প্লিজ এই বিষয়টা ভুলে যা।”
প্রথম কথা বলা ছেলেটা বললো, “এই বিষয় ভুলে যাওয়ার মতো না।”
সাদমান বেশ কিছুক্ষণ থেকে নিরব ছিল, এবার বললো,”তোমরা কাজটা ঠিক করোনি।আবার এখন ওদেরই দোষ দিচ্ছো? কারোর গায়ে হাত তুলার মতো অধিকার তো তোমাদের নেই।”
মিহি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,”সাদমান তুমি তখন আমাকে আটকেছো আবার তুমি আমাকে দোষও দিচ্ছো।এখন আমার সব কিছুই তোমার কাছে খারাপ লাগে।বড় নায়ক হয়ে গেছো তো।আমাকে তো এখন খারাপ লাগবেই।”
সাদমান মিহিকে আর বুঝানোর চেষ্টা করলো না।সোজা উঠে বেরিয়ে গেল।অন্যায় কখনই তার সহ্য হয় না।আর মিহি সেটা ভালো করেই জানে।এক বছরের রিলেশনে এখনও সাদমানকে চিনেই উঠতে পারেনি সে।
সাদমানের রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে মিহির।সে চলে যাওয়ায় আরও বিচলিত হয়ে উঠলো।পরশিকে উদ্দেশ্য করে বললো,”দেখলি কীভাবে উঠে চলে গেল? এবার আমাকেই ওর রাগ ভাঙাতে হবে।আমাদের সম্পর্কে ঝামেলা সৃষ্টি হলো আজকে তোর চাচাতো বোনগুলোর জন্য।মনে রাখিস এটা।”
মিহি উঠে চলে গেল সাথে উপস্থিত সবাইও একে একে পরশিকে কথা শুনিয়ে চলে গেল।
পরশির সবচেয়ে ভালো বন্ধু মিহি।তার মাধ্যমেই মিহি আর সাদমানের পরিচয়।সাদমানের জন্য পাগল ছিল মিহি।একপর্যায়ে অনেক রকম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সাদমানকে রিলেশনে রাজি করায় মিহি আর পরশি। আজকে যদি নূরা নোহার জন্য তাদের বন্ধুত্ব খারাপ হয় ওদের ছেড়ে দিবে না সে।”

সন্ধ্যায় পলি আর আশরাফ বাসায় আসলে পরশি কাঁদতে কাঁদতে বললো নূরা নোহা ওর বন্ধুদের অপমান করেছে।আশরাফ, পলি ঠিক ভুল যাচাই না করেই ডেকে পাঠিয়ে কথা শুনাতে শুরু করলেন।
আলেয়াও উপস্থিত ছিলেন তিনি এক পর্যায়ে বললেন,”আমার মেয়েদের ভুল হয়ে গেছে ভাইজান।তবে এই ভুলটার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য আমি চাইব পরশি মায়ের বন্ধুদের সামনে আর ওরা যাবে না।মানে আপনি পরশি মাকে বলে দেন কষ্ট করে যেন নাস্তাটা সেই নিয়ে যায়।তাহলে আর ঝামেলা হয় না।”
পলি রুক্ষভাবে বললেন,”আমার মেয়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না সে নাস্তা নিয়ে যাবে!তাহলে বাসায় বসে বসে তোমার মেয়েরা কি করবে পায়ের উপর পা তুলে খাবে? আর আমার মেয়ে কাজ করবে তাই না? কতবড় সাহস দেখেছো আশরাফ।”
“আমি এমন কিছু বলি নাই আপা।”
আশরাফ আলেয়াকে আর কথা বাড়াতে দিলেন না।চেঁচিয়ে বললেন,”মানুষ বানানোর জন্য নিয়ে এসেছি এখানে আর তুমি এখানে এসেও মেয়েগুলোকে আজব প্রানী বানিয়ে রেখেছো।আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি সময় থাকতে ঠিক হয়ে যাও।এই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলো।গ্রামের আচরণ ভুলে যাও।আমার তো লজ্জাই লাগে তোমাদের আমার আত্মীয় বলতে।”
আলেয়া আর কথা বাড়ালেন না দুই মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন।নোহাকে কড়াভাবে শাসন করলেন।আজকে নোহার বেয়াদবির জন্যই এসব হলো।মেয়েটাকে চেয়েও তিনি নূরার মতো বানাতে পারছেন না।এত প্রতিবাদী কেন হতে হবে তাকে।
আলেয়া ভেবে পাচ্ছেন না দুইটা মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন।নিজের বাবা মাও বেঁচে নেই।ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো না এদিকে নূরার ভার্সিটির পড়াশোনা। ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ে সে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছা মেয়েটার। আলেয়া মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।

পরদিন সকালে আশরাফ সাহেব নাস্তা খাচ্ছিলেন আলেয়া এসে ভয়ে ভয়ে বললেন,ভাইজান একটা বিষয়ে কথা ছিল আপনার সাথে।
আশরাফ এক টুকরো পাউরুটি মুখে নিয়ে বললেন,”কি কথা বলো।”
“আমি চাচ্ছিলাম ভাইজান নূরার বিয়েটা দিয়ে দিতে।”
“এখনই কেন বিয়ে দিবে? ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে মাত্র, পড়াশোনা শেষ করুক।তোমরা গ্রামের মেয়েদের এটাই সমস্যা, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়ার চিন্তা”
“না ভাইজান পড়াশোনা বিয়ের পরেও শেষ করতে পারবে।দয়া করে আপনি একটা ভালো ছেলে দেখুন।আর আমিও নূরার মামাকে বলে দিবো সেও দেখবে”
“ঠিক আছে তাড়াহুড়ো করো না,আমি দেখছি কি করা যায়।”
“আচ্ছা ভাইজান”
আলেয়া চলে যেতেই আশরাফ পলিকে বললেন,আমার ভাতিজীটা তার বাবার মতোই সুন্দর। কাজ টাজও ভালো জানে।পড়াশোনায় ভালো তবে কেন যে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়ছে কে জানে।কত ভালো সাবজেক্ট ছিল।
পলি জুসে চুমুক দিয়ে বললেন,হুম মেয়েটা সিনেমার হিরোইনদের থেকে কম সুন্দরী না।চাইলেই মিডিয়ায় চান্স পেয়ে যেতো।সে তো এগুলো করবে বলে মনে হয় না নাহলে কথা বলে দেখতাম আমাদের ওখানে।
“আরে দেখো না কেমন লুকিয়ে থাকে সারাদিন এসবে যাবে না।তবে আমার একটা ভাবনা আছে মাথায়।”
“কি?
” পলাশের জন্য যদি নূরাকে রেখে দিতাম ”
পলি যেন আকাশ থেকে পড়লেন,কি যে বলো না তুমি? মাথা খারাপ তোমার! আমার বিদেশে চাকরি করা ছেলের সাথে এই মেয়ে! তাছাড়া পলাশের পছন্দ আছে।এই যুগে আধুনিক মেয়েদেরই ছেলেরা পছন্দ করে।”
আশরাফ সাহেব কিছুটা মনমরা হয়ে বললেন,আমি তো এসব জানি না।বলেছি কারণ নূরা মেয়েটা রূপে গুণে অন্য দশটা মেয়ের থেকে এগিয়ে।”
“তা যাই হোক না কেন আমার ছেলের জন্যে না।তবে নূরার জন্য আমি একটা বিষয় ভাবছি”
“কি সেটা?”
পলি একটু ঝুকে ফিসফিস করে বললেন,আমাদের জাহিদ।
আশরাফ সাহেব কিছুটা চমকালেন,তোমার বান্ধবীর বড় বোনের ছেলেটা?কিন্তু সে তো বিবাহিত আর একটা বাচ্চাও আছে।
“ডিভোর্স তো হয়েগেছে,বাচ্চা থাকলেও বা কি সমস্যা জাহিদের স্ট্যাটাসের সাথে নূরা যায় কোনোভাবে? শুধু দেখতে ভালো আর কাজটাজ জানে দেখেই আমি এটা ভাবলাম।তাছাড়া জাহিদের মা হেনা আপাও এমন একটা ঘরোয়া মেয়েই চাচ্ছে এখন।”
“জাহিদের বয়স আর নূরার বয়সের একটা ফাড়াক আছে সেটা?”
“ওরা গ্রামে থেকে অভ্যস্ত বুড়া বুড়া লোকদের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।জাহিদের আর তেমন কি বয়স। তুমি এত না ভেবে আলেয়ার সাথে কথা বলো।আর আমি হেনা আপা আর জাহিদের সাথে কথা বলি ওরা মানবে কি না সেটাই বিষয়।আলেয়ার অমত করার তো প্রশ্ন আসে না।”
“আচ্ছা আমি কথা বলছি”

আশরাফ ওনার ঘরে আলেয়াকে ডেকে পাঠালেন তারপর সবটা বললেন।আলেয়া বেগম বললেন তিনি নূরার সাথে কথা বলে জানাবেন।
আলেয়া ঘরে এসে নূরার মাথায় হাত রেখে বললেন,আম্মা আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নূরা অবাক হয়ে বললো,কি সিদ্ধান্ত আম্মা?
“তোর বিয়েটা দিয়ে দিবো”
“আম্মা”
“হ্যাঁ আম্মা দেখো এভাবে এখানে আমরা কয়দিন থাকতে পারবো আমি জানি না।আর তুইও এখানে একদম নিরাপদ না। এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে তোর কতটা কষ্ট হয় আমি বুঝি।তোকে একটা উত্তম পরিবেশে পাঠিয়ে দিতে পারলেই আমার একটা দায়িত্ব শেষ হবে।”
“কিন্তু আম্মা আমি এমন স্বার্থপরের মতো তোমাদের ছেড়ে চলে যাব?”
“স্বার্থপর না মা এটাই মেয়েদের নিয়তি। তুই পর হয়ে যাবি না কখনই আমাদের”
নূরা ছলছল চোখে মাথা নিচু করলো।আলেয়া স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন।মেয়ের চোখে সম্মতি দেখতে পেয়েছেন তিনি।
মেয়েটা কখনই তাদের অবাধ্য হয়না।তবে জাহিদের বিষয়েও জিজ্ঞেস করতে হবে তাকে।
আলেয়া ঢুক গিলে বললেন,”তোর চাচ্চু একটা ছেলের কথা বললেন।ছেলেটার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল।ডিভোর্স হয়েগেছে। একটা বাচ্চাও আছে তার।বয়স তোর থেকে খানিকটা বেশি।”
নূরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”একটা মানুষ কি পরিস্থিতিতে বিয়ে ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয় আমরা জানি না আম্মা।আল্লাহ এই বিষয়টাকে খুব অপছন্দ করেন।তবুও ডিভোর্স হারাম না।আর বয়স বেশি হলে কি হয়? আয়েশা (রাঃ) আর আমাদের রাসুল (সঃ) এর বয়সেরও পার্থক্য ছিল।কিন্তু ওনারা খুব সুখী ছিলেন।এখন আমার জানার বিষয় যে মানুষটার কথা তোমরা বলছো তিনি আল্লাহওয়ালি কি না।রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী কি না।পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন কি না।এগুলোই আমার কাছে বড় আম্মা।”
আলেয়া নূরার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”আলহামদুলিল্লাহ আম্মা।আমিও এগুলো জেনে নিবো ইনশাআল্লাহ।”

কয়েকদিন পর জাহিদের মা হেনা জানালেন জাহিদ নূরার সাথে দেখা করতে চায় পরে তার মতামত জানাবে।পলি আলেয়াকে বিষয়টা জানালে,আলেয়া বললেন ঠিক আছে ওনাদের বাসায় আসতে বলেন।আমি নূরার সাথে কথা বলেছি।তবে আপা আমি জানতে চাই জাহিদ ছেলেটা কি নামাজ কালাম পড়ে?মানে আল্লাহ রাসুল (সাঃ) এর অনুসারী তো?
পলি বিরক্ত হয়ে বললেন,তোমাদের কি মনে হয় দুনিয়ায় তোমরাই একা মুসলিম?তুমি জানো জাহিদ কত ভালো চাকরি করে? নূরা তো কোনোভাবে ওর যোগ্য না তবুও আমার কথায় ওরা নূরার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে।এসব প্রশ্ন করে আর কথা বাড়িও না।আমি বলে দিচ্ছি ওরা কালকে আসবে।
আলেয়া নিরবে মাথা নাড়ালেন।
পরদিন জাহিদরা এলো কিন্তু ঝামেলা বাধলো তখন যখন জাহিদ নূরার সাথে হিজাব, নেকাব ছাড়া অবস্থায় একা কথা বলতে চাইলো…
চলবে..

(পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্টে দেয়া হবে।)