এক টুকরো নূর পর্ব-০৬

0
91

#এক_টুকরো_নূর
———————(৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখা: উম্মে হানি মিম

প্রেস কনফারেন্সে বসে আছে সাদমান।চারিদিক থেকে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে রেখেছে।সবাই খুব উৎসুক হয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাচ্ছে।
সাদমান বলা শুরু করলো,”গতকালকে যেটা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যে,ভুয়া।জাহিদ সাহেব অহেতুক আমার উপর অপবাদ দিয়েছেন।গতকাল আমি আমার খালামনির ফ্ল্যাটে যাই আমার একটা ড্রেস আনতে।তাদের বাসার এক্সট্রা চাবি ছিল আমার কাছে তাই নক না করেই ঢুকতে পারি।তারপর দেখি করিডোরে নূরা নামের মেয়েটির সাথে জাহিদ কিছু নিয়ে জোরাজোরি করছে।পরে আমি মেয়েটার থেকে জানতে পারি, জাহিদ মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করতে চাইছে।তখন আমি তাকে মা’রা শুরু করি আর ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেই।”
একজন সাংবাদিক বললো,”কিন্তু নূরা ম্যাডামের সাথে তো জাহিদ সাহেবের আগামী কাল বিয়ের কথা হচ্ছিল উনি এমন কেন করবেন?”
আরেকজন সাংবাদিক বললো,”আর আপনাদের প্রতিবেশীরাও তো আপনার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন সেটাকেও কি আপনি ভুল প্রমাণ করবেন?”
তৃতীয় সাংবাদিক বললো,”আপনি কি নতুন গল্প সাজিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?”
চতুর্থ সাংবাদিক বললো,”আপনার একটা সম্পর্ক থাকতেই পারে কিন্তু অন্য একজনের হবু বউয়ের সাথে কেন সম্পর্ক করতে গেলেন,তাও আবার গোপনে”
সাদমানের রাগে শরির কাঁপছে।সে সত্যি বলছে তবুও নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ।রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,”আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই এসবের সে জন্য আমি ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ।এখন আপনাদের বিষয় এটা আপনারা কাকে বিশ্বাস করবেন।”
সাদমান রাগ নিয়েই উঠে চলে গেল।যেভাবে জল ঘোলা হয়েছে সেটা সহজে ঠিক হওয়ার নয়।এভাবেই চলতে থাকুক।সেও দেখে ছাড়বে তার কতটা ক্ষতি করতে পারে ওরা।

সাদমান ফিরে এলো বাসায়।লিপি এসে বললেন নূরারা চলে যাচ্ছে তাদের গ্রামে।
সাদমান সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো।
লিপি বললেন,ওদের পৌঁছে দিয়ে আসবো আমরা।
“মানে?”
“মানে তুমি গাড়ি নিয়ে চলো।ওদের অন্তত গ্রামে ছেড়ে আসি সেইফলি।”
সাদমান কিছু একটা ভেবে বললো ঠিক আছে।
লিপি কিছুক্ষণ থেমে বললেন,তোমার বাবাও সাথে যাবেন।
“সাদমাম বিস্মিত হয়ে বললো বাবা কেন?”
“উনি চাইছেন তাই।”
সাদমান মাথা নাড়ালো।

সাদমান ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসা।
পেছনে লিপি আর হক সাহেব।একেবারে পেছনের সিটে মেয়েদের নিয়ে বসেছেন আলেয়া।নূরার শরির এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি।শারীরিক, মানসিক দুইভাবেই সে ভেঙ্গে পড়েছে।লিপি জোর করছিলেন কয়েক দিন থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু আলেয়া রাজি হননি।
গ্রামে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল।ওরা বাড়িতে ঢুকতেই লোকজনের ভিড় বাড়তে শুরু করলো।গ্রামের লোকজন জড়ো হচ্ছেন নূরাদের বাড়ির উঠানে।সাদমানকে দেখে কমবয়সীরা অনেকেই ঘিরে ধরেছে।সিনেমার হিরোর দেখা পাওয়া কম বড় কথা না।
মুরব্বিরা তাদের সাবধান করে দিচ্ছেন।আলেয়া এত মানুষের ভিড় দেখে কিছুটা বিস্মিত আর অনেকটা ভয়ে কুঁকড়ে আছেন।নোহা নূরাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেলেন। সাদমানদের বসার ঘরে বসতে দিলেন।গ্রামের পঞ্চায়েত প্রদান পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছেন তাদের বাড়িতে।আলেয়া পঞ্চায়েতের লোকজনকেও বসার ঘরে বসতে দিলেন।পঞ্চায়েত প্রদান আলেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”তোমার মেয়ে নূরা যেটা করেছে সেটা আমাদের গ্রামের সম্মান নষ্ট করেছে।সারা দেশের মানুষ টিভিতে তোমার মেয়ের কুকর্ম সম্পর্কে জেনেছে আর তুমি সেই মানুষগুলোকেই সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছো? তোমাদের স্পর্ধা দেখে আমরা অবাক হচ্ছি।তোমার মেয়েদের তো আমরা ভালোই জানতাম তলে তলে এতদূর।আলেয়া টুশব্দটি করছেন না, নিরবে চোখের জল ফেলছেন।পাশের ঘর থেকে নূরা নোহা সবটা শুনছে।নোহা বললো,”আপা এবার কি হবে? এখন তো আরও বড় বিপদ হয়ে গেল।গ্রামের লোকজনও তোকে ভুল বুঝেছে।এসব কেন হচ্ছে আপা?”
নোহা কান্না আটকাতে পারছে না।নূরা পাথরের মতো স্থির হয়ে আছে।না কাঁদছে আর না কোনো কথা বলছে।
পঞ্চায়েতের লোকেরা একেকজন একেক রকম কথা বলেই চলেছে।হক সাহেব এক পর্যায়ে বললেন,”আপনারা ছোটবেলা থেকে যে মেয়েটিকে দেখেছেন সেই মেয়েটিকে এত অবিশ্বাস করতে পারছেন কীভাবে? আমি তো একদিনেই মেয়েটাকে চিনে ফেলেছি।আপনারা এতদিনে চিনতে পারলেন না।সব দেখা আর সব শুনা তো সত্যি নাও হতে পারে।”
একজন লোক হক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,”হ্যাঁ আপনি তো চিনবেনই, আপনার ছেলেও জড়িত কি না কুকর্মে তাই পক্ষপাতিত্বই করছেন। ”
পঞ্চায়েত প্রদান লোকটাকে থামিয়ে বললেন,”দেখুন সাহেব, আপনারা শহরের শিক্ষিত মানুষ।আপনাদের কাছে এসব কিছু না কিন্তু আমাদের কাছে আমাদের সম্মানটাই আসল।সম্মান বেচে আমরা ভাত খাই না।”
সাদমান এবার তেজিকন্ঠে বললো,”কি বলতে চান আপনারা? এতক্ষণ থেকে আপনাদের অহেতুক কথা শুনেই যাচ্ছি। অকারণে একটা পরিবারকে দোষারোপ করছেন আপনারা।”
হক সাহেব সাদমানকে চোখ রাঙিয়ে শান্ত করলেন।
পঞ্চায়েত প্রদান বললেন,”আপনি বড় নায়ক হতে পারেন কিন্তু আমাদের সম্মান নিয়ে খেলেছেন। আপনাকে আমরা সহজে ছেড়ে দিতাম না শুধু আপনার আব্বা বয়স্ক মানুষ তাই ওনাকে সম্মান দিচ্ছি আমরা।”
সাদমান রাগে ফুসছে।তবুও কিছু বললো না হক সাহেবের দিকে তাকিয়ে।
হক সাহেব বললেন,”এখন আপনারা কি চান?”
পঞ্চায়ের প্রদান আলেয়াকে ইঙ্গিত করে বললেন,”এই মহিলাকে তার মেয়েগুলো সহ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করতে চাই আমরা।আমাদের গ্রামের কলঙ্ক এভাবেই দূর করবো আমরা।”
হক সাহেব বললেন,”আর যদি অন্য কোনো মাধ্যমে এই কলঙ্ক দূর করা সম্ভব হয় তাহলে?”
পঞ্চায়েত প্রদান বললেন, “কীভাবে?”
হক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন,”আমি আমার একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে যাব এই মেয়েটাকে।তাহলে আপনাদের সম্মান রক্ষা হবে তো?”
কথাটা শুনামাত্র সাদমান উঠে দাঁড়ালো।কিছু বলতে যাবে,ততক্ষণাৎ লিপি তাকে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
পঞ্চায়েত প্রদান বললেন,”এটা তো খুবই উত্তম প্রস্তাব। যদি এটা হয় তাহলে আর আমাদের কোনো আপত্তি নাই।”
হক সাহেব মুচকি হেসে মাথা নাড়ালেন।

সাদমান গাড়িতে উঠতে যাবে লিপি তাকে আটকালেন।রাগতস্বরে বললেন,”দেখো সাদমান এখানে তোমার বাবার মান সম্মান জড়িত তুমি যদি এখন চলে যাও আমরা দুজনেই অপমানিত হবো।আমাদের এতবড় অপমান করতে তোমার বাধছে না?”
সাদমান রুক্ষকন্ঠে বললো,”হও তোমরা অপমানিত।আমার সাথে বোঝাপড়া না করে এত বড় সিদ্ধান্তটা বাবা জানিয়ে দিলেন কেন?”
লিপি নিজেই বুঝতে পারছেন না কি বলবেন।শুধু বললেন,”তোমার বাবা যা বলেছে তাই হবে যদি তুমি এটা না করো তবে আর কোনদিন আমাদের মা-বাবা বলে ডাকবে না।মনে করবে আমরা তোমার জন্য মা’রা গেছি।”
সাদমান চিৎকার করলো, “মা।তোমরা আমার জীবনটা শেষ করে দিবে তো? ঠিক আছে তোমাদের যা খুশি করে নাও।আমি তোমাদের কাছে ঋণি তোমরা আমাকে জন্ম দিয়েছো।এখন নিজের হাতে মে’রে ফেলো আমাকে।”
লিপি বললেন,”তুমি এত স্বার্থপর সাদমান।মেয়েটার সাথে কি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছো না তুমি?”
” বললাম তো তোমাদের যা খুশি করো।”
সাদমান কথাটা বলে দুম করে মাটিতেই বসে পড়লো। লিপি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

নূরাকে যখন আলেয়া কথাটা জানালেন,তখন নূরা স্তব্ধ হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আলেয়া নূরাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,আমি জানি আম্মা ছেলেটা তোমার মতো না একদম।কিন্তু পরিস্থিতি তোমাকে আর তাকে জোরে দিয়েছে।মনে করো এটা আল্লাহরই হুকুম।আল্লাহ ওনার বান্দার জন্য ভুল কিছু পছন্দ করেন না তুমি সেটা জানো তো আম্মা?
নূরা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।

গ্রামের সবার সামনেই নূরা আর সাদমানের বিয়ে সম্পন্ন হলো।গ্রামের সবাই খুশিমনে যার যার ঘরে ফিরে গেল।অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা সাদমানকে নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে লাগলো।কেউ নাস্তা এনে দিচ্ছে তো কেউ ফল।কেউ আবার একটার পর একটা ছবি তুলার আবদার করে যাচ্ছে।নায়ক সাদমান হক সয়ং তাদের সামনে।আর এখন তো তাদের গ্রামের জামাই।উচ্ছসিত হবে নাই বা কেন!
সাদমানের এসব কিছুতে মন নেই।কখন শহরে যাবে আর কখন এই আপদগুলোর থেকে রেহাই পাবে সেটাই ভাবছে।তবে আস্ত আপদ তো আজ তার ঘাড়ে করে নিয়েই যেতে হবে।মিহির কথা খুব মনে পড়ছে।এখন যেন এসব ভাবতেই তার ভয় হচ্ছে।মিহিকে কীভাবে ফেস করবে সে। কীভাবেই বা নিজের জীবন কাটাবে।কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।দুশ্চিন্তায় মাথাটা ভরে উঠেছে তার।

নূরাকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন আলেয়া।সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে অঝোরে কাঁদছে।কাঁদছেন আলেয়া আর নোহাও।আলেয়া নূরার মাথায় হাত রেখে বললেন,ভালোভাবে থেকো আম্মা।আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা করো না।তোমার মামাকে ফোন করেছি আমি সে আসছে আমরা তার সাথেই চলে যাব।তুমি নিজের খেয়াল রেখো।
নূরা মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।আলেয়া কোনোমতে মেয়েকে শান্ত করলেন।নুরা নোহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।দুই বোন এই প্রথমবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে বুক তো ফাটবেই দুজনের।নূরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,আম্মার খেয়াল রাখিস নোহা।নিজেও সাবধানে থাকিস।
নোহা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়ালো।

গাড়িতে নূরার পাশে মাঝখানে বসেছেন লিপি।অন্যপাশে হক সাহেব।সাদমান ড্রাইভারের পাশের সিটেই বসা।নূরার দিকে এখন পর্যন্ত একবারও তাকায়নি সে।অনেকক্ষণ থেকে গাড়িতেই বসে ছিল চুপচাপ।গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।গাড়িটা পর্যন্ত তার গন্তব্য জানে অথচ
নূরা জানে না তার গন্তব্য কোথায় গিয়ে আদৌ থামবে!যেখানে যাচ্ছে সেখানে চলার রাস্তা কতটা মসৃণ হবে সেটাও জানে না।
শুধু জানে জীবনটা বদলে গেল তার।আজকের পর থেকে সবকিছুই অন্যরকম হয়ে যাবে।যে মানুষটার সাথে তার জীবনটা জড়িয়ে গেল সেই মানুষটাই তো তার থেকে পুরোপুরি বিপরীত।দুই মেরুর দুজন মানুষ সারাজীবন একসাথে কি করে থাকবে? থাকতে পারবে তো আদৌ!….
চলবে