এক টুকরো নূর পর্ব-০৭

0
99

#এক_টুকরো_নূর
——————–(৭ম পর্ব)
লেখা উম্মে হানি মিম

বাসায় ফিরেই সাদমান নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।অনেক রাত হয়েগেছে তাই লিপিও আর তাকে ঘাটালেন না।নূরা গেস্ট রুমেই ঘুমালো।
একা একা তার ঘুম আসতে চাইছে না।এর আগে তো কখনই একা একটা ঘরে ঘুমায়নি সে।নোহা আর সে সব সময় একসাথেই থাকে।মা’কে আর নোহাকে ছাড়া এর আগে কোথাও একা থাকেনি সে।মা আর নোহার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে তার।কষ্ট, ভয়, চিন্তা সব একসাথে হয়েগেছে।আল্লাহ তাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন।নূরা উঠে অযু করে এলো।তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লো।জায়নামাজে বসেই অঝোরে কাঁদছে। সব কষ্ট যেন রবের কাছে সমর্পণ করতে চাইছে।

সকাল বেলা নূরা ফজরের নামাজ পড়লো।কিছুক্ষণ তেলাওয়াত করলো।তারপর রান্নাঘরে গেল।সব কিছু হাতের কাছেই আছে।সবার জন্য নাস্তা বানালো সে।কাজে যিনি সাহায্য করেন আমেনা খালা তিনি বার বার নূরাকে এসব করতে নিষেধ করলেন।নূরা মুচকি হেসে বললো,”আপনি তো সব সময় এসব করেন।আমি আজকে করলে কি এমন হবে?”
আমেনা বললেন,”আমাকে ম্যাডাম বকবো।আপনে এসব কইরেন না ম্যাডাম।”
নূরা তাকে আস্বস্ত করে বললো,”কিছু বলবেন না উনি আমি বলবো যে সব আমার ইচ্ছায় করেছি।”
“আপনে এসব করবেন কেন ম্যাডাম?”
“আমাকে ম্যাডাম বলবেন না খালা আমাকে নূরা বলে ডাকেন। আমার এসব করতে ভালো লাগছে।”
“ছিঃ ছিঃ কি কন? আপনে না আমাদের ছোট সাহেবের বউ।আপনারে আমি নাম ধরে ডাকতে পারি?”
“কেন পারবেন না খালা? আপনি তো আমার থেকে বয়সে বড়।”
“আপনে আমারে আমেনা কইয়া ডাকেন, খালা ডাইকেন না ম্যাডাম।”
“আপনার নামটা কি সুন্দর খালা।আমি তো আপনাকে আমেনা খালাই বলবো।আমেনা কার নাম ছিল জানেন? আমাদের নবী (সাঃ) এর মাতার নাম।আপনি কিন্তু আর আমাকে ম্যাডাম ডাকবেন না নূরা বলে ডাকবেন।”
আমেনা উৎফুল্ল হয়ে মাথা নাড়ালেন।
নূরা বললো,”বাসায় সবাই আপনাকে নাম ধরেই ডাকেন?”
“জি”
“আপনার ছোট সাহেব?”
“তিনিও নাম ধরে ডাকেন।”
নূরার মোটেও ভালো লাগলো না।মধ্যবয়সী একজন মহিলাকে সাদমান নাম ধরে ডাকে সেটা শুনে।
আমেনার সামনে আর কিছু বললো না।কাজ করতে শুরু করলো।
মিসেস লিপি আর হক সাহেব ঘুম থেকে উঠলে,নূরা আমেনার থেকে জেনে নিলো তারা সকালে চা খান।সেভাবেই চা নিয়ে ওনাদের ঘরে গেল সে।
হক সাহেব এই প্রথমবার নূরাকে দেখছেন।ভিষণ মিষ্টি মেয়েটা।নূরাকে কাছে ডেকে বসালেন তিনি।তারপর আদরমেশানো কন্ঠে বললেন,”তুমি এত কষ্ট করতে গেলে কেন মা?”
লিপিও সম্মতি জানালেন।
নূরা মিষ্টি করে হেসে বললো, “আমি সকালে আম্মার আব্বার জন্য রোজ চা বানাতাম তো আমার অভ্যাস এটা।”
লিপি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,”এবার থেকে বাবা-মায়ের জন্য বানাবে।দারুণ চা বানিয়েছো নূরা।”
নূরা মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,”নাস্তা দিয়ে দিচ্ছি টেবিলে।আপনারা আসুন।”
লিপি ভ্রু কুচকে বললেন,”আমেনা কোথায়? তুমি কেন এতসব করতে গেলে?”
নূরা দ্রুত বললো,”আমেনা খালা আমাদে নিষেধ করেছিলেন আমি শুনিনি তার কথা।আমার খুব ইচ্ছে করছিল নাস্তা বানাতে তাই বানিয়ে ফেলেছি।আপনারা তাকে কিছু বলবেন না দয়া করে।”
লিপি হাসলেন,”আচ্ছা যাও কিছু বলবো না”
হক সাহেব তাড়া দিলেন,”চলো তো আমার বউমার হাতের নাস্তা খাবো আজ আমার তো এখনই ক্ষুধা পেয়ে গেছে।”

নাস্তার টেবিলে লিপি আর হক সাহেব।সাদমান এখনও আসেনি।উঠেনি হয়তো ঘুম থেকে।নূরাও খেতে বসছে না।হক সাহেব নূরার রান্নার প্রশংসা করে বললেন”তুমি তো চমৎকার রান্না করো মা।লিপি তোমার লাটসাহেব ছেলেকে ঘুম থেকে তুলো এগুলো ঠান্ডা হয়েগেলে খেয়ে মজা পাবে না।দেখুক খেয়ে রান্না কত মজার হতে পারে।কে জানতো তার মতো অপদার্থের কপালে এতকিছু জুটবে।”
লিপি চোখের ইশারায় বুঝালেন, নূরার সামনে এসব না বলতে।হক সাহেব বিরক্তি নিয়ে চুপ করলেন।
লিপি আমেনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,”সাদমান উঠেছে?”
আমেনা মাথা নাড়িয়ে বললো,যে ম্যাডাম।কফি দিতে কইলো।আমি দিয়া আইমু?”
লিপি কিছু একটা চিন্তা করে বললেন, না।নূরা তুমি নিয়ে যাও কফি।”
নুরা যেন চমকে উঠলো কথাটা শুনে।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কফির ট্রেটা হাতে নিলো।এলেমেলো পা ফেলে হাঁটছে সে, হাতও কাঁপছে খুব।কখন না কাপটা হাত থেকেই পড়ে যায়।
নূরা ঘরে ঢুকার আগে দরজায় নক করলো।সাদমান ভিতর থেকে বললো,”আসো।”
নূরা মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলো।সাদমান নূরাকে দেখে চমকে উঠলো,দ্রুত বললো,” আপনি কেন? আমেনা কোথায়?”
নূরা কাচুমাচু করে বললো,”মা বললেন আমাকে নিয়ে আসতে।”
“কোন মা?”
“আপনার মা”
“মায়ের সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।আপনি যান এখন।”
নূরা চলে যাচ্ছিল সাদমান আবার পেছন থেকে ডাকলো,”শুনুন?”
নূরা থামলো।
সাদমান আমতা আমতা করে বললো,”আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো এখানে? কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন।”
নূরা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।

নূরা ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে গেস্ট রুমের ওয়্যারড্রপে রাখছিল।তখন মিসেস লিপি ঘরে ঢুকলেন।এগিয়ে এসে বললেন, এখানে কেন কাপড় রাখছো?
নূরা বিস্মিত হয়ে বললো,কোথায় রাখবো মা?
“আজ থেকে তুমি সাদমানের ঘরে থাকবে।ওখানেই তোমাদের দুজনের জামা কাপড় থাকবে।”
নূরা আমতা আমতা করে বললো,”একটা কথা বলবো?
“বলো।”
“আমি এখানেই ঠিক আছি মা।”
লিপি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “না নূরা।যেটা হওয়ার হয়েছে কিন্তু এখন তো সব ঠিক করে নেয়া লাগবে তুমি চলো আমার সাথে।তোমার কাপড় রাখার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি। ”
অসম্মতি সত্যেও নূরা লিপির পেছন পেছন গেল।সাদমান বাইরে গিয়েছে ঘরটা ফাঁকা ছিল।লিপি বললেন তুমি সাদমানের ক্লোজেটেই কাপড় রাখো।
লিপি নূরাকে দেখিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।ততক্ষণে সাদমান চলে এসেছে।
ঘরে ঢুকে নূরাকে তার ক্লোজেটে কাপড় রাখতে দেখে একটু জোরেই বললো,”আপনি কি করছেন এখানে?”
নূরা অপ্রস্তুতভাবে বললো,”আমার কাপড়গুলো রাখছিলাম।”
“হ্যাঁ তো এখানেই কেন রাখতে হবে, বাসায় কি আর কোনো ক্লোজেট নাই?”
নূরা মাথা নিচু করে বললো,”মা বলেছেন।”
সাদমান চেঁচিয়ে উঠলো, সব সময় এত মা মা করেন কেন আপনি, খুব বিরক্ত লাগে।আর আমার ঘরে যখন তখন আসবেন না।আমি আমার ঘরে অন্য কারোর যখন তখন আসা পছন্দ করি না।মনে থাকবে?”
সাদমান এত জোরে ধমক দিলো যে নূরার চোখে পানি চলে এলো।কোনোরকমে চোখের পানি মুছে চলে যাচ্ছিল তখন লিপি ঘরে ঢুকলেন।তিনি সাদমানের চেঁচামেচি শুনেই এসেছেন।
লিপিও চেঁচিয়ে উঠলেন,”কি শুরু করেছো সাদমান?”
“তোমরা কি শুরু করেছো মা? আমার ঘরে আমি কারোর আসা পছন্দ করি না সেটা জানো না তুমি? তবুও মেয়েটাকে পাঠিয়েছো।”
“অন্য সবার আসা আর নূরার আসা কি এক হলো?”
“হ্যাঁ একই হলো।কেন আসবে মেয়েটা আমার ঘরে।সকালে কিছু বলিনি দেখে ভেবেছো এখনও কিছু বলবো না।”
লিপি ধমকের স্বরে বললেন,কি মেয়েটা মেয়েটা করছো এটা তোমার বউ।ওকে নূরা বলে সম্মোধন করো।আর আজ থেকে নূরা এই ঘরেই থাকবে।”
সাদমান চিৎকার করে উঠলো,”আমি এই মেয়েটার সাথে রুম শেয়ার করবো? যাকে তাকে ঘরে এনে দিলে আর আমিও মেনে নিলাম তাই না? সবকিছু এত সহজ কেন ভাবো তোমরা? আমার জীবনটা তো শেষ করে দিয়েছো এবার একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও আমাকে।”
সাদমান উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। চোখগুলো র’ক্ত লাল হয়ে উঠেছে।মাথা কাজ করছে না তার।
কাছেই নূরা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,”বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে।যদি আর একবার আমার ঘরে আপনাকে দেখি আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
নূরা ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেঝেতেই পড়েগেল।লিপি এসে তাকে ধরলেন।লিপিও চরম অপমানিত বোধ করছেন।নূরার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।লিপি নূরাকে উঠিয়ে গেস্টরুমে নিয়ে গেলেন।

মিহি একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছে।সাদমান ভেবে পাচ্ছে না কল রিসিভ করে কি বলবে সে।পরশিরা জেনে গেছে সাদমান বিয়ে করেছে।মিহিও নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে।মিহির সাথে কোন মুখে কথা বলবে সে।কল কেটে দিয়ে ফোনটা অফ করে মেঝেতে ছুড়ে মারলো।

লিপি কাঁদছেন।হক সাহেব বুঝিয়েও তাকে শান্ত করতে পারছেন না। লিপি আজ খুব অপমানিত হয়েছেন।নূরাকে তো তিনিই নিয়ে গিয়ে ছিলেন।মেয়েটাকে অপমান করা মানে তাকেই অপমান করা।নূরা তখন থেকে কাঁদছে।কতটা কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।লিপি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন,নূরার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তিনি পানিও স্পর্শ করবেন না।উত্তেজনায় মিসেস লিপির প্রেশার হাই হয়ে গেল।সাদমানকে কিছুতেই তিনি প্রেশার মাপতে দিচ্ছেন না।হক সাহেব প্রেশারটা মাপলেন।অনেক হাই হয়ে আছে।কিন্তু তিনি ঔষধ খাবেন না।এক কথাই বলে যাচ্ছেন নূরার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে সাদমান নিজের ঘরে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি কিছুই মুখে দিবেন না।সাদমান এক পর্যায়ে রাজি হলো লিপির কথায়।নূরার ঘরে গেল সে।দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল।নক করার কিছুক্ষণ পর নূরা দরজাটা খুললো।চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে তার।সাদমান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,সরি।
নূরা নিশ্চুপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সাদমান আবার বললো,চলুন।
নূরা বিস্মিত হয়ে বললো,কোথায়?
“আমার ঘরে।”
নূরা একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বললো,”না”
সাদমান নাক ফুলিয়ে বললো,বলেছি তো আমার সাথে আসতে।”
নূরা না সূচক মাথা নাড়ালো।
সাদমান এবার দাঁত কটমট করে চোখ বন্ধ করলো।একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নূরার হাতটা চেপে ধরলো।তারপর টেনে নিয়ে চললো তার ঘরে….
চলবে..