এক টুকরো নূর পর্ব-১২+১৩

0
105

#এক_টুকরো_নূর
—————–(১২পর্ব)
লেখা: উম্মে হানি মিম

নূরা বললো,শান্ত হন আপনি অস্থির হবেন না।মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।
সাদমান অস্থির হয়ে বললো,”আমার শান্ত হওয়ার সময় এখন না।আপনি তাড়াতাড়ি তৈরি হন।এখনই আমার যেতে হবে।”
নূরা দ্রুত বোরকা পরে তৈরি হয়ে গেল।
ফ্লাইটে দ্রুতই তারা শহরে ফিরে এলো।নূরাকে বাসায় রেখে সাদমান হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরোলো।পরশি কল দিয়ে যে কেবিনের কথা বলেছিল সেই কেবিনের সামনে আসতেই সাদমান থামলো।ভিতর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।পরশি বলছে,”মিহি সাদমান ভাইয়া যদি একবার জানতে পারে তুই সু*সাইড এর নাটক করেছিস তোকে কিন্তু সত্যি সত্যি মে’রে ফেলবে।
মিহি হাসতে হাসতে বললো, “জানবে কীভাবে?আমি কোনো প্ল্যান করে আজ পর্যন্ত অসফল হইনি।আজকেও হবো না।”
সাদমান আর সহ্য করতে পারলো না দরজাটা খট করে খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।মিহি,পরশি দুজনেই সাদমানকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো।
সাদমান মিহিকে বেড থেকে টেনে তুললো।তারপর রাগতস্বরে বললো,”কেন এই মিথ্যে নাটকটা করলে মিহি?”
মিহি কাচুমাচু করে বললো,”কী করেছি আমি?”
সাদমানের রাগের তেজ আরও বাড়লো,”এই নাটকটা করে আমাকে এখানে আনার মানেটা কী?কেন এতবড় একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বললে?”
মিহি নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,”খুব সমস্যা হয়ে গেল তাই না? তোমার হানিমুনটা নষ্ট হয়ে গেল।”
“বাজে কথা বলা বন্ধ করো মিহি।আমার মাথাটা খুব গরম হচ্ছে।”
মিহি এবার একটু নরম হলো।গলার স্বর পরিবর্তন করে বললো,”সাদমান আমার সহ্য হচ্ছিল না তুমি মেয়েটার সাথে হানিমুনে গিয়েছো।আমি কী করে এসব সহ্য করবো বলো তো? ওই গেঁও মেয়েটাকে পেয়ে তুমি আমাকে ভুলে থাকবে তা তো হতে পারে না।কোনো উপায় না পেয়ে আমি পরশিকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছি।হসপিটালে এডমিট হয়েছি যাতে তোমার সন্দেহ না হয়।সব কিছু তো তোমার জন্যই করেছি জান।”
সাদমান চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে বললো,”কাজটা মোটেও ঠিক করনি মিহি।এখন আমি যাচ্ছি আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”
সাদমান দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
পরশি মিহিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “হলো তো এবার? কতবার না করলাম, শুনলি না আমার কথা।”
মিহি আড়চোখে পরশির দিকে তাকিয়ে বললো,”তুই ভাবিস না সাদমান আমাকে ছাড়তে পারবে না।আমি ছাড়তে দিবো না।”

সাদমান ফিরে এসে বিষন্ন মনেই বসে রইলো। নূরা খাবার জন্য ডাকতে এলো,”আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম আসসালামু”
“টেবিলে খাবার দিয়েছি খেয়ে নিন এসে।”
“আমি খাবো না আমার ভালো লাগছে না।”
“রাতে না খেয়ে ঘুমাতে হয় না অল্প হলেও খেয়ে নিন।”
“আপনি গিয়ে খান আমার ভালো লাগছে না।”
“চলুন না।”
সাদমান চেঁচিয়ে উঠলো, “বললাম তো আমার ভালো লাগছে না।বার বার কেন জোর করছেন? এখন কি সব কাজ আপনার ইচ্ছায় করতে হবে আমার? আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কি কোনো দাম নেই এই বাসায়?”
নূরা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”না তা কেন হবে।খাওয়া-দাওয়া না করলে আপনার শরির খারাপ হবে তাই বলছিলাম।”
“আমার বিষয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”
“তাহলে কে ভাববে?”
“আমি নিজের বিষয়ে নিজেই ভাববো।আমার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না।আমার বাবা-মা আমার জন্য ভাবতে ভাবতে আমার জীবনটাকে আজ এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে।আমার ক্যারিয়ার খারাপ হওয়ার পথে।নূরা আমার মাথা কাজ করছে না এমনিতেই। আপনি এখন যান আমি ভুলভাল কিছু বলে ফেলবো আপনাকে।”
নূরা মাথা নিচু করে বললো,”আপনি যেভাবে হারামে লিপ্ত হয়ে আছেন এভাবে শান্তি আসে না মনে।”
সাদমান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো কোনো রকমে।নূরা কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিহি বার বার কল দিচ্ছে সাদমান রিসিভ করছে না।এক পর্যায়ে ভাবলো,এবার বিষয়টা শেষ করা উচিৎ। মিহি আর নূরাকে একসাথে নিয়েই সে কথা বলবে।নূরাকে পরিস্থিতি বুঝাবে তার।মিহি থাকলে সেও বুঝতে পারবে সাদমান কোন পরিস্থিতির স্বীকার। সাদমান তাওসিফকে কল করলো।ওপাশ থেকে তাওসিফ হ্যালো বলতেই সাদমান বলা শুরু করলো,”দোস্ত আমি ঠিক করেছি মিহি আর নূরাকে একসাথে নিয়ে কথা বলবো।তিনজনে একসাথে কথা বললে বিষয়টা মিটমাট করা সহজ হবে মনে হচ্ছে।মিহিও উল্টাপাল্টা কাজ বন্ধ করবে।
তাওসিফ গলা পরিষ্কার করে বললো,”দেখিস আবার দুই সতিনে চুলোচুলি যেন না লাগে।”
সাদমান বিরক্তি নিয়ে বললো,”নূরা এমন মেয়ে না।সে কারোর সাথে ঝগড়া করে না।”
“যাক বউয়ের প্রশংসা বেরোলো মুখ থেকে।বুঝা গেল ভালোবাসা আছে।”
“তুই চুপ কর বেটা ফাজলামি কম কর।
” এটা ফাজলামি না।সত্যিই বলছি ভেবে দেখ।তোর কথা অনুযায়ী নূরা আর মিহির কতটা পার্থক্য।তাছাড়া নূরা তোর বিয়ে করা বউ।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিবি। আমি কিন্তু তোর ভালোটাই চাই।”
সাদমান রাগতস্বরে বললো,”তুইও আমাকে বুঝিস না।নূরা আর আমি দুইমেরুর দুজন মানুষ।মিহি আমার গার্লফ্রেন্ড।এখন আমি কাকে নিয়ে আমার জীবন কাটাবো তুই বল? অবশ্যই মিহিকে নিয়েই।”
“ঠিক আছে দেখ কী করবি।মাঝখান থেকে নূরার জীবনটা নষ্ট হবে।”
“আমি তো ওর জীবন নষ্ট করার জন্য দায়ী না দোস্ত।আর দেখিস আমি ওকে একজন ভালো হুজুর দেখে বিয়ে করিয়ে দিবো।একজন হুজুরই ওনার জন্য পারফেক্ট। মেয়েটা তখন খুশিই হয়ে যাবে দেখিস।”
“সবকিছু এত সহজ কী করে ভাবিস সাদমান।তোদের বিয়ে হয়েছে।একটা মেয়ের কাছে বিয়ের মূল্য অনেক বেশি হয় যতদূর আমি জানি।আর তোর বউ যে ধরনের মেয়ে তার কাছে এই বিয়েটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুই যদি বিয়েটা ভেঙ্গে দিস সে কষ্ট পাবে না?”
“তুই আমার বউ, আমার বউ করিস না তো।ওর জীবনে আমি ঝড় আনিনি তাই তার কষ্টটা দেখার দায়িত্বও আমার না।”
“তো কি বলবো আমার বউ?”
“চুপ সা’লা।
” তোর বউ বললেও রাগ করিস, আমার বউ বললেও গালি দিস। আমি বলবোটা কী?”
“কিছু বলতে হবে না আর রাখ ফোন।”

সাদমান কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর মিহিকে কল দিলো।মিহি কল রিসিভ করেই একশোটা কথা শুনালো। সাদমান তাকে শান্ত করার জন্য বললো,”আমরা কালকে দেখা করবো মিহি।”
মিহি উৎফুল্ল হয়ে বললো,”সত্যি? কোথায় দেখা করবো?”
“কোথাও একটা নিরিবিলি জায়গায়।”
“কখন বলো।”
“আমার সাথে নূরা থাকবে।”
মিহি উত্তেজিত হয়ে উঠলো,”মানে কী?ওই মেয়ে কেন থাকবে?তুমি আমার সাথে নাটক শুরু করেছো সাদমান?”
“মিহি আমাদের একসাথে বসে কথা বলা জরুরি। ”
“মেয়েটার সাথে আমার কোনো কথা নেই।আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই শুধু।”
“বলা লাগবে।দেখো সে তো আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে।এটা মিথ্যে নয় যে নূরা আমার স্ত্রী।”
“বাহ!বাহ! মেয়েটাকে স্ত্রী বলা শুরু করে দিয়েছো।আর কী বাকি আছে!”
“মিহি আমরা মানি না মানি এটাই সত্যি।সে জন্য বলেছি।বুঝার চেষ্টা করো আমাকে।নূরাকে নিয়ে কাল আমি তোমার সাথে দেখা করবো।মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলবে।”
“আমি মেয়েটার মুখও দেখতে চাই না।”
“প্লিজ আমার কথা শুনো।”
“না। ”
“তাহলে ভুলে যাও আমাকে।কল কেটে দিচ্ছি, এই নাম্বারে আর জীবনেও পাবে না আমাকে।
” সাদমান মেয়েটা আমার চোখের বি’ষ।”
“পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করো।”

সাদমান অনেক বুঝিয়ে মিহিকে রাজি করালো। এবার নূরাকে রাজি করানোর পালা।
নূরা ঘরে আসতেই সাদমান প্রস্তুত হয়ে বললো,”নূরা আগামীকাল আমরা এক জায়গায় যাব।”
“ঠিক আছে।”
“মিহির সাথে দেখা করতে যাব?”
“আমি কেন তাহলে?”
“প্রয়োজন আছে”
নূরা আর কোনো প্রশ্ন না করে বললো,” ঠিক আছে।”
সাদমান কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো,”এত সহজে রাজি হয়ে গেলেন।”
“আপনি বললেন যে তাই।”
“আমি বললে আপনি কোনোকিছুতে আপত্তি করবেন না?”
“সেটা যদি কোনোভাবে হারাম না হয় তাহলে আপত্তি কেন করবো?”
“আপনার খারাপ লাগলেও করবেন?”
“আমার কাছে আপনার ভালো লাগাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজান মাসে রোজা রাখে, স্বীয় সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা করে শালীনতা বজায় রেখে চলে এবং স্বামীর আনুগত্য প্রকাশ করে; তখন সে বেহেশতের যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (আবু দাউদ শরিফ)।
আপনার সব কথা পালন করা আমার দায়িত্ব।”

সাদমান আর একটি কথাও বললো না।স্তব্ধ হয়ে গেল।নূরা তাকে স্বামী হিসেবে মান্য করা শুরু করে দিয়েছে।সাদমানের মনে কোথাও একটা ব্যথার সঞ্চার ঘটালো কথাটা।

সাদমান, নূরা,আর মিহি মুখোমুখি বসে আছে একটা নিরিবিলি জায়গায়।জনমানবশূন্য চারিদিক।
সাদমান বললো,” নূরা এবং মিহি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে আশা করছি।”
নূরা মাথা নাড়ালো।মিহি হ্যাঁ, না কিছুই বললো না।নূরার দিকে তাকাচ্ছেও না সে।রাগ রাগ চেহারায় বসে আছে।”
সাদমান নূরাকে উদ্দেশ্য করে বলা শুরু করলো,”নূরা, মিহির পরিচয় আপনি জানেন।সে আমার গার্লফ্রেন্ড।আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি।বেশ অনেকদিনের সম্পর্ক আমাদের।আমি মিহিকেই বিয়ে করতে চেয়ে ছিলাম।ভাগ্যক্রমে সেটা হয়নি।কিন্তু আমাদের জীবন শেষও হয়ে যায়নি।এখনও সময় আছে আমরা আমাদের জীবন গুছিয়ে নিতে পারি।এভাবে আমাদের তিনজনের জীবনই নষ্ট হচ্ছে।”
নূরা ঢোক গিলে বললো,”কি করতে চাচ্ছেন এখন?”
“বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছি।আপনাকে আমি একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবো।আপনি শুধু আমাদের একটু সাহায্য করেন।”
মিহি এবার তেজি কন্ঠে বললো,”এত রিকুয়েষ্ট করার কী আছে? সোজা বলো সে যেন আমাদের জীবন থেকে বিদেয় হয়।তোমার মাথার বোঝা হয়ে না থেকে চলে যায়।ছোট্ট একটা কথা সে বুঝে না? তুমি তাকে ভালোবাসো না আমাকে ভালোবাসো।ছ্যা’চড়ার মতো তোমার জীবনে পড়ে আছে কেন।”
“মিহি তুমি থামো।” সাদমান মিহিকে থামালো।
নূরার বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে,চোখটা ঝপসা হয়ে আসছে।তবুও নিজেকে সামলে বললো,আপনারা যা বলবেন তা-ই হবে।”
সাদমান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।কথা বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ দুইটা বাইকে কয়েকজন ছেলে তাদের ঘিরে দাঁড়ালো।তাদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে একটা ছুড়ি বের করে বললো,যা আছে দিয়ে দাও।বাকি ছেলে গুলোও ছুড়ি বের করলো।পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সাদমানের একটু সময় লাগলো।কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো তারা ছি’নতাইকারীর কবলে পড়েছে।নূরা ভয় পেয়ে কুকড়ে আছে।মিহিও কাচুমাচু করছে।মিহি বললো,”সাদমান আমার এত দামী ফোন।সাদমান ইশারায় বললো দিয়ে দিতে।”
সাদমান নিজের ফোন, ঘড়ি সব খুলে দিলো।মানিব্যাগ বের করে দিলো।মিহিও গলার চেন খুলে দিলো।ছেলেদের মধ্যে একজন এবার নূরার দিকে এগিয়ে এসে বললো,এই যে বোরকাওয়ালী মেয়ে তোমার কাছে কি আছে দিয়ে দাও।
নূরা আস্তে করে বললো,”আমার কাছে কিছু নেই।”
ছেলেটা বললো,”কিছু নেই বললে হবে বোরকা খুলেন চ্যাক করতে হবে আপনারে।পাশের ম্যাডামের মতো সুন্দর কী না দেখি একটু” ছেলেটা ঠোঁট বাকিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিতে হাসি দিলো।
সাদমান নূরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রাগতস্বরে বললো,”ঠিক করে কথা বলো।”
ছেলেগুলো হাসতে হাসতে বললো,দুইটা ফুলের একটা মালি,এক নাগর দিয়ে চলে তো? একজন দেখি বোরকাওয়ালী তাও বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে।”
সাদমান তেজি কন্ঠে বললো,মুখ সামলে কথা বলো।ও আমার স্ত্রী হয়…..
চলবে…

#এক_টুকরো_নূর
——————(১৩ পর্ব)
লেখা উম্মে হানি মিম

সাদমান তেজি কন্ঠে বললো,”মুখ সামলে কথা বলো।ও আমার স্ত্রী হয়।”
ছেলেগুলো হাসতে হাসতে বললো,”মর্ডান ছেলের আবার বোরকাওয়ালী বউ। যাই হোক আমরা আপনার বউয়ের চেহারাটা দেখতে চাই।গলায়,কানে স্বর্ণ আছে কী না দেখবো।ভালোয় ভালোয় আমাদের কাজ করতে দেন।নাহলে..
“নাহলে কী” রাগে ফেটে পড়ে বললো সাদমান।
“নাহলে আমরা নিজেই সব খুলে ফেলবো।”
সাদমান তৎক্ষণাৎ একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো ছেলেটার গায়ে।রাগে ফুসতে ফুসতে বললো,”উনি কারোর সামনে নিজের চেহারা দেখায় না আর তোদের মতো ফা’লতু ছেলেরা ওনার চেহারা দেখবে!আজকে তো মে’রে তোদের হা’ড্ডি গু’ড়া করবো আমি।”
ছেলেগুলো ধস্তাধস্তি শুরু করলো সাদমানের সাথে।নূরা বিচলিত হয়ে আছে।ছেলেদের কাছে ছু’রি আছে, সাদমানের না লেগে যায়।
সাদমান মিহিকে উদ্দেশ্য করে দ্রুত বললো,”মিহি গাড়িতে রাখা আমার আরেকটা ফোন আছে পুলিশকে কল করো তাড়াতাড়ি। একটা ছেলে মিহির দিকে তেড়ে যেতেই মিহি একটা জড়সড় দৌড় দিলো।সাদমান বিস্মিত হয়েছে অনেকখানি।মিহি সাদমানের গাড়ির দিকে না গিয়ে নিজের গাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছে ।ছেলেগুলো ছু”রি ধরে সাদমানকে সাবধান করার চেষ্টা করছে।নূরা বুঝতে পারছে যেকোনো সময় তারা ছু’রি লাগিয়ে দিবে সাদমানের গায়ে।নূরা আর ঠিক থাকতে না পেরে সাদমানকে গিয়ে ধরলো।টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সে।সাদমান নূরাকে সরিয়ে দিয়ে বললো,দূরে গিয়ে দাড়ান আপনি।”
নূরা কিছুতেই সরছে না। তৎক্ষণাৎ একটা ছেলে সাদমানকে আঘাত করছিল নূরা সেটা আটকানোর চেষ্টা করে হাত দিতেই তার হাতে লাগলো ছু’রিকাঘাত।নূরা কুঁকিয়ে উঠলো।সাদমানও আঁতকে উঠলো।ছেলেগুলোকে এবার সে বেদম পেটাতে শুরু করলো।এক পর্যায়ে লোকজন জড়ো হতে দেখে ছেলেগুলো বাইকে উঠে দ্রুত পালিয়ে গেল।
নূরার র’ক্তাক্ত হাত চেপে ধরে আছে সাদমান।তার হাতও র’ক্তে মাখামাখি। অস্থির লাগছে সাদমানের।নূরা মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।সাদমানের ভিতরটা কাঁপছে।নূরার যদি কিছু হয়ে যায়! সে নূরাকে রক্ষা করতে পারলো না।সাদমানের ভিতরটা কেঁদে উঠলো। নূরাকে কোলে তুলে নিলো সে।দৌড়ে গাড়ির কাছে চলে গেল।নূরাকে গাড়িতে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্য চললো।
নূরাকে ইমার্জেন্সি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা করা হচ্ছে।সাদমান বাইরে দাঁড়িয়ে হাসফাস করছে।মনে মনে আল্লাহর কাছে চাইছে নূরা যেন ঠিক হয়ে যায়।
একজন ডাক্তার এসে বললেন নূরা আশংকা মুক্ত আছে।আ’ঘাতটা বেশি গুরুতর ছিল না তাই বাঁচা গেছে।র’ক্ত একটু বেশি বেরিয়ে গেছে শরির থেকে।আপাতত র’ক্ত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাদমান দ্রুত হসপিটাল থেকে তাওসিফকে কল দিয়ে ব্লা’ড আর টাকার ব্যবস্থা করলো।
তাওসিফ এসে সাদমানের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে বললো,কী হয়েছিল বল তো?
“সাদমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ছি’নতাইকারীর কবলে পড়েছিলাম।শ’য়তান ছেলেগুলো আমাকে আ’ঘাত করতে যাচ্ছিল নূরা সেধে এসে আ’ঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।মেয়েটাকে কতবার বললাম সরে দাড়াতে শুনলোই না আমার কথা।”
তাওসিফ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,”মিহি কোথায়?”
সাদমানের মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মিহির কথাটা।তাওসিফ বলায় মনে পড়লো।রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বললো,”পরিস্থিতি বুঝে পালিয়ে গিয়েছে।”
তাওসিফ বিস্মিত হয়ে বললো,”বাহ তোর গার্লফ্রেন্ড তোকে বিপদের মধ্যে রেখে পালালো আর মেনে না নেয়া বউ তোর জন্য আ’ঘাত পেলো।সুন্দর তো ব্যপারটা।”
সাদমান আমতা আমতা করে বললো,”ভয় পেয়ে গিয়েছিল।”
“সেটাই তো, যে নিজের থেকেও বেশি আরেকটা মানুষকে ভালোবাসে সে কখনও সেই মানুষটাকে বিপদে ফেলে যেতে পারে না।সব ভয় জয় করে ফেলে নূরার মতো।তোর মিহির মতো আপন পরাণ বাঁচায় না।”
সাদমান কোনো কথা বললো না।কথাটা তার মনের গভীরে লেগেছে।সত্যিই তো আজকে নূরার কাজটা মিহির করা উচিৎ ছিল।অথচ মিহি তখন চাইলে অন্য কিছুও করতে পারতো।কিছুই না করে সে নিজের জান নিয়ে পালিয়ে গেল।কিন্তু নূরাকে সাদমান সরে দাঁড়াতে বলার পরেও সে এগিয়ে এলো।সাদমানের আ’ঘাত লাগতে দিলো না।নূরা কী তাহলে সত্যিই বলে হালাল সম্পর্কের থেকে সুন্দর আর কিছু নেই।কী আছে এই হালাল সম্পর্কে! সাদমানের সেই সম্পর্কের সৌন্দর্য অনুসন্ধান করতে যাওয়ার পালা এবার।

নূরা হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে।সাদমান ভিতরে প্রবেশ করলো।আস্তে করে বললো,”আসসালামু আলাইকুম।”
নূরা বলে সালাম দিলে সেই মানুষটার উপর শান্তি বর্ষিত হয়।নূরার ঠিক হওয়াটা এখন জরুরি।
নূরার কষ্টের মরুভূমিতে খানিকটা রহমতের বৃষ্টির মতো লাগলো।কাঁপা গলায় বললো,”ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
সাদমান চেয়ার টেনে নূরার পাশে গিয়ে বসলো।মেয়েটার ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা।একজন নার্স এসে বলে গেলেন নূরাকে কিছু খাওয়াতে।সাদমান বাইরে থেকে স্যুপ নিয়ে এসেছে।নূরাকে তুলে বসিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।নূরা এবার বললো,”বাসায় বাবা মা জানে কিছু?”
সাদমান না সূচক মাথা নাড়ালো। চিন্তা করবেন দেখে সে কিছু বলেনি তাদের।
নূরা বললো,”ভালো করেছেন।বাবা মা দুশ্চিন্তা করতেন।কিন্তু আমার আম্মাকে আর নোহাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সেটা তো সম্ভব না একটু কথা বলিয়ে দিবেন।সাদমান রাজি হলো।নূরার সামনে ফোন স্পিকারে দিয়ে ধরলো।নূরা আলেয়া বেগম এবং নোহার সাথে কথা বললো।যখনই সে তাদের সাথে কথা বলে তার চোখ ভেজা থাকে।
সাদমান খেয়াল করে বললো,”তোমার খুব মন খারাপ হয় মা বোনের জন্য তাই না?”
নূড়া মাথা নাড়ালো।খেয়াল করলো সাদমান তাকে তুমি বলা শুরু করেছে।
সাদমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”তুমি তো দেখি খুব সাহসী।”
“কেন?”
“ছি’নতাইকারীর ছু’রির সামনে চলে গেলে নির্ভয়ে।
” ওরা আপনাকে আঘাত করছিল।”
“তো কী হয়েছিল? আমি সামলে নিতাম।”
“এখন আমার যতটা কষ্ট হচ্ছে তখন এর থেকে অনেক বেশি কষ্ট হতো।”
সাদমান এক মুহুর্ত নূরার দিকে নিশব্দে তাকিয়ে রইলো।সে মাথা নিচু করে আছে।সাদমান নিশব্দে হাসলো।তারপর বললো,”আমার জন্য এত কষ্ট পাওয়ার কারণ কী?”
নূরা আস্তে করে বললো,”জানি না।”
সাদমান অপলক তাকিয়ে রইলো।

নূরাকে বাসায় নিয়ে গেলে।মিসেস লিপি আর হক সাহেব সাদমানকে খুব বকলেন তাদের কিছু না জানানোর জন্য।সাদমান সব বুঝিয়ে বললো তাদের।নূরা সুস্থ হয়ে না উঠা পর্যন্ত সে নূরাকে খাইয়ে দিলো।ঔষধ খাওয়ালো সময় মতো।অনেক যত্ন করলো তার।নূরা দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠলো।তাদের সম্পর্কটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েগেছে বন্ধুর মতো।
একে অপরের খেয়াল রাখে,যত্ন নেয়।সুখ,দুঃখ বুঝার চেষ্টা করে।অথচ এখনও কেউ কাউকে ভালোবাসে কী না জানে না।নূরা মোটামুটি সুস্থ হতেই সাদমান শুটিংয়ে ফিরে গেল।আর ছুটি কাটানো সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে।পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে গেল।কখনও কখনও রাতেও বাইরে কাজে থাকে সে।নূরার এগুলো মোটেও ভালো লাগে না।সাদমান নামাজ পড়ে না।ইসলামিক জীবন ধারণ করে না।
আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজ না পড়া। যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে গেল (কাফেরের মতো কাজ করল)।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮২)

হাদিসটা মনে পড়তেই নূরার বুক কেঁপে উঠলো।কান্না পেয়ে গেল।সে আস্তে আস্তে সাদমানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।তার স্বামী, তার ভালোবাসার মানুষ নামাজ পড়ে না।অশালীন জীবন কাটায়।এটা কিছুতেই মেনে উঠতে পারছে না।নূরা অঝোরে কাঁদছে।হঠাৎ কলিংবেল বাজলো।
লিপি নূরাকে ডাক দিলেন।নূরা চোখ মুছে ঘর থেকে বের হতেই দেখলো আলেয়া আর নোহা এসেছেন।নূরা এক দৌড়ে গিয়ে তাদের ঝাপটে ধরলো।
আলেয়া নূরার কপালে চুমু খেয়ে বললেন”কেমন আছিস আম্মা?”
নূরা উৎফুল্ল হয়ে বললো,”এখন তো অনেক ভালো আছি তোমাদের দেখে।কিন্তু তোমরা হঠাৎ এলে কীভাবে আম্মা?”
আলেয়া মুচকি হেসে বললেন,”সাদমান বাবা গাড়ি পাঠিয়ে আনালেন।”
লিপি হেসে বললেন,কাজটা খুব ভালো করেছে সাদমান।আপনারা এসেছেন এখন নূরার আর আমাদেরও ভালো লাগবে।”
নূরা খুশিমনে বললো,”এসো মা বোরকা খুলে হাতমুখ ধুয়ে নিবে।”
লিপি বললেন ওনাদের গেস্টরুমে নিয়ে যাও।আমি আমেনাকে খাবার দিতে বলছি।কতদূর থেকে এসেছে খেয়ে-দেয়ে রেস্ট করুক।”
নূরা মাথা নাড়ালো।

সাদমান শুটিংয়ে ব্যস্ত।নতুন একটা সিনেমার শুটিং চলছে।মিহি শুটিং স্পটে এসে হাজির হলো।এখানে অনেকেই মিহিকে চিনে তাই ঢুকতে পারলো সে।
মিহি এসেই সাদমানকে, সেদিনের বিষয়ে বুঝাতে শুরু করলো।সাদমান শুটিংয়ের বিরতিতে রেস্ট নিচ্ছিল তখন।সাদমান বিরক্তি নিয়ে বললো,”মিহি তুমি যাও এখান থেকে।তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”
“সরি বলছি তো সাদমান,আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম।এমন ভুল আর কখনও হবে না।”
“আর কখনও আমি তোমার সাথে বাইরে গেলে তো।”
“কী বলছো এসব সাদমান?”
“যা বলছি ঠিকই বলছি। অনেক ভেবেচিন্তে বলছি।দেখো নূরা তোমার সাথে আমি আর”,..সাদমান থেমে গেল সে মিহির জায়গায় নূরা বলে ফেলেছে।
মিহি চোখ রাঙিয়ে বললো,”বাহ! আমার জায়গাটা নূরাকে দেয়া হয়েগেছে তাহলে?”
সাদমান বিদ্রুপ করে হেসে বললো,”নূরার জায়গায় তুমি কোনোদিন ছিলেই না মিহি।”
“মানে কী সাদমান?”
“মানে হচ্ছে নূরা আমার বউ হয়েগেছে তুমি সেটা হওনি।নূরা সব ভয়কে জয় করে ফেলে আমার জন্য।তুমি বিপদে আমাকে ফেলে রেখে পালাও।নূরা নিজের থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে।তুমি আমাকে ভালোইবাসো না।”
“কী বললে সাদমান আমি ভালোবাসি না তোমাকে?ওই মেয়েটা ভালোবাসে?”
“প্রমাণ তো তুমি নিজেই দিলে।”
“মেয়েটা তোমার ব্রেনওয়াশ করেছে সাদমান তাই তুমি ঠিক ভুল বুঝতে পারছো না।”
“ভাগ্যেস ব্রেনওয়াশ করেছে নাহলে তো তোমাকেই চিনতে পারতাম না।”
“পরে কিন্তু তোমাকে আফসোস করতে হবে।সব হারাবে তুমি আমি বলে দিচ্ছি সাদমান।মেয়েটা তোমার জীবনে এসেছে সব কেড়ে নিতে।প্রথমেই তোমার ভালোবাসা কেড়ে নিলো সে।আমাকে সরিয়ে দিলো।এরপর শেষ করবে তোমার ক্যারিয়ার।”
“তোমার এসব ভাবতে হবে না মিহি।আমার ক্যারিয়ার আমি আমার বাপ-মায়ের জন্যেও শেষ করিনি।সাদমানের ক্যারিয়ার কেউ খারাপ করতে পারবে না।”
“তোমাকে পুরো শেষ করে দিবে সে দেখে নিও।”
“সাদমান যেমন আছে তেমনই থাকবে।সাদমান কারোর জন্যে শেষও হয় না,বদলায়ও না।আজকে আমি তোমাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পুরোপুরি নিজের মতে।সাদমানকে কেউ কিছু জোর করেও করাতে পারে না, যদি সে সেটা না চায়।”
“তুমি একদিন অনেক কাঁদবে সাদমান।”
“নূরা বলে কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।তুমিও নিশ্চয়ই আমারটা দেখতে পাচ্ছো না।পারলে আমি তোমার থেকে জেনে নিতাম কী করে নূরার আর আমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে।এখন বিদেয় হও এখান থেকে।আমার শুটিং সেটে যেতে হবে।
মিহি রাগে ফুসতে ফুসতে বললো, ” তুমি শেষ হয়ে যাবে সাদমান একমাত্র ওই মেয়েটার জন্য।”
কথাটা বলে সে হনহন করে বেরিয়ে গেল।
সাদমান হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল সাদমানের।নূরা খাবার নিয়ে এখনও অপেক্ষা করছে।সে নিজেও খায়নি।সাদমান যে খেয়ে এসেছে সেটা আর বললো না নূরার সাথে আবার খেতে বসলো।
নূরা বললো,”আমার একটা কথা বলার ছিল।”
সাদমান খেতে খেতে বললো,”বলো।”
“আমি ঠিক করেছি আম্মা আর নোহার সাথে চলে যাব।”
“বেড়াতে যাবে? যাও ঘুরে এসো।এটা আমাকে বলার কী আছে।”
নূরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”একেবারে।”
“মানে?”
“মানে আমি আম্মার সাথে একেবারে চলে যেতে চাই।সারাজীবনের জন্য আপনার জীবন থেকে সরে যেতে চাই…
চলবে….