কারণে অকারণে ভালোবাসি02 পর্ব-০৭

0
612

#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি02
#সুরাইয়া_আয়াত

৭.

আরিশ ব্রেকফাস্ট করে রুমে ঢুকেছে আর সবে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে,আজ শুক্রবার তাছাড়া ওদের হাফ ম্যারেজ এনিভার্সারি বলে হসপিটাল যায়নি। আরুও বিড়বিড় করে রুমে ঢুকলো আরিশের পিছুপিছু, আর ঘরে এসে আরিশের সামনে চঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে আরুর ভাবসাব আরিশের ভালো ঠেকছে না দেখে আরিশ ল্যাপটপ টা কোলের ওপর রেখে আরুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল
— স্ট্রেট হয়ে দাঁড়াতে পারো না? অলওয়েজ হেলতে দুলতে হয়?

আরু আরিশের কথায় জবাব দিলো না তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতখন নড়াচড়া করছিলো সেটা বন্ধ হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো যেমনটা ছোট্ট বেলায় বাচ্চারা তাদের টিচার কে ভয় পেয়ে দাঁড়ায় ঠিক তেমন।
আরু সোজা হয়ে দাঁড়ালো কিন্তু মুখে কুলুপ এটে রেখেছে কোন কথা বলছে না দেখে আরিশই বলে উঠলো পুনরায়

— কিছু বলবে?

আরু প্রথমে মাথা নাড়িয়ে জানালো না, তারপর তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে জানালো হ্যাঁ। আরিশ না বোঝার ভান করে ধমক দিয়ে বলল

— হ্যাঁ নাকি না কোনটা?

আরু মিনমিন সুরে বলল

— হ্যাঁ।

আরিশ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল

— গুনে গুনে ৩০ সেকেন্ড সময় আছে তোমার কাছে তার মধ্যে যা বলার আছে বলো, সময় পার হয়ে গেলে কিন্তু আমি শুনবো না।

আরু ভ্রু কুঁচকে বলল

— সম্ভব না এটা, আমি যা বলবো তা অনেক লম্বা কথা। ৩০ সেকেন্ড সময়ে আমার মতো একটা মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব না।

আরু ভারী গলায় বলল। আরিশ আগের মতোই ভাবলেষহীন হয়ে বলল

— একোরডিং টু মেডিকেল সায়েন্স একটা মানুষ ৩০ সেকেন্ড এ তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো শব্দ বলতে পারে, আই বিলিভ ইন সায়েন্স ইউ নো, নাও ইটস আপ টু ইউ। ইউর টাইম স্টার্টস নাও।

আরু করুন সুরে বলল

— মি অভদ্র এমন করছেন কেন, আমার কথাটা শুনুন না প্লিজ।

আরিশ ল্যাপটপের দিকেই তাকিয়ে থেকে বলল

— ২৫ সেকেন্ডস লেফট।

আরু এমনিই ভয়ে তাড়াতাড়ি রোবটের মতো ঝড়ের গতিতে বলতে শুরু করলো

— আমি হলাম আপনার আরুপাখি,মানে আরুশি খান যে এই বাসায় মানে তার শ্বশুর বাবার বাসায় কিউট আর ভদ্র আর ঠান্ডা বাচ্চা হয়ে থাকে, সে আপনাদের এই পরিবারেরই একটা সদস্য সেটা আপনি মানে আবরার আরিশ খান মানেন কি না জানি না তবে, আপনারা নাকি কোন একটা ফ্যামিলি পিকনিক করছেন আর আমিও সেই ফ্যামিলির একজন টুইটুই সদস্য তাই আমি আপনাদের সাথে সেই পিকনিকে যেতে চায়। আমি কি যেতে পারি? না নিয়ে গেলে কিন্ত শ্বশুর বাবাকে বলে ঝাড়ু পেটা,,,,,

হঠাৎ আরুর ঝড়ের গতিতে বলা কথা থামিয়ে বলল

— স্টপ, ইউর টাইম ইজ ওভার নাও। যাও আমার জন্য এক কাপ কফি আনো, তোমার কথাতে এনার্জি লেভেল লো হয়ে গেছে। আই নিড সাম কফি, আর মেক সিওর যে কফিটা তোমার হাতেরই বানানো।

আরুর কথাতে আরিশের এমন লাপাত্তা ব্যাবহারে আরু ঝাঝিয়ে বলল

— আমি কি বলেছি আপনার কানে যায়নি? আমি এতখন ধরে কি বললাম তার কোন গুরুত্ব নেই আপনার কাছে?

আরিশ আরুর দিকে তাকিয়ে বলল

— আছে, আলবাদ আছে, আমি ভাবছি। স্টিল ভাবছি, ভাবতে ভাবতে কতক্ষন বা কতো দিন লাগবে আমি জানি না। এখন আমি আর সুস্থ মস্তিষ্কে নেয় তাই কফি আনো, আর যদি না আনো তো আমি তোমাকে নিয়ে যাবো কি তা নিয়ে যা ভাবছিলাম সেটা ভাবাও বন্ধ করে দেবো। নাও ইউর চয়েজ, তুমি কফি না করে দিলেও আম্মু অর সানা করে দেবে নো ডাউট বাট আলটিমেট লস টা তোমারই।

আরু হাত দুটো আরিশের দিকে বাড়িয়ে বলল

— আরে না না, ভাবা বন্ধ করবেন না প্লিজ, আপনি ভাবুন, আমি যেতে চাই আপনাদের সাথে, আমি কফি করে আনছি। আনছি আমি, আমিই বানাবো।

আরিশ কিছু একটা সার্চ করতে করতে বলল

— গো ফাস্ট।

আরু দৌড় দিলো কফি বানাতে, আরু মনে মনে আরিশ কে হাজারো কথা শোনাতে লাগলো

— একবার শুধু যাই তখন আপনার কি অবস্থা করি খালি দেখেন, আপনি না নিয়ে গেলেও আমার শাশুড়িআম্মু আমাকে নিয়ে যাবে। উইইইমা টুইটুই ☺!

আরিশ আজকের দিনটাতে সব কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে যেন। ল্যাপটপ টা নিয়ে ভালো জায়গা খুঁজতে লাগলো যেখানে শুধু পিকনিক না একটা ভালো ট্যুর ও হয়ে যাবে।
একটা ভালো টুরিস্ট স্পট খুঁজে সেখানকার একটা হোটেল বুক করলো আরিশ সেটা সিলেটেরই একটা জায়গা। আরিশ সব ডিটেইলস একটা পিডিএফ করে রাখলো, ডকুমেন্ট এরিয়াতে আরুর নামের একটা বড়োসড়ো ফাইল আছে, আরিশ আজ বহুদিন পর ফাইলটা অন করলো। ওখানে ওর আর আরুর অনেক ছবি আছে, আরুর ছোট থেকে বড়ো বেলার সব ছবিই আছে আরিশের কাছে।
ছবি গুলো দেখছে আর আরিশের মুখে একটা শীতল হাসি ছেয়ে আছে। ওর আর আরুর একটা ছবি আছে যেখানে আরিশ আর আরু দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে আর আরিশ আরুর হাতটা ওর হাতের মাঝে মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে, আরিশের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল।
দিনটা ছিলো ২৯শে জানুয়ারি, আরিশের জন্মদিন। আরিশের বয়স ছিলো তখন ১৮ বছর,ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার আর আরুর বয়স তখন তেরো, ৭এ পড়তো। আরিশ তখন সবে সবে নতুন নতুন কলেজে গিয়ে অনেক প্র্যাকটিক্যাল করতো আর আরু কে সেগুলো বলে মাঝে মাঝে ভয় দেখাতো আর আরুও ভয় পেতো বেশ।
আরিশ রুমের মধ্যে বসে আছে আর একটা বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখছিলো, কপালে ছিলো গভীর ভাঁজ, হঠাৎ আরু একটা ছৌট্ট গিফটের বাক্স নিয়ে আরিশের রুমে ঢুকলো। আরু গিফটটা বেডের ওপর রেখে পা ঝুলিয়ে বসে আছে আর পা নাড়াচ্ছে হয়তো অপেক্ষা করছে কখন আরিশের চোখ সরবে বই থেকে আর ওর গিফটের বাক্সটা খুলবে। কিন্তু আরিশ কোনভাবেই আরুর উপস্থিতিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না দেখে আরু এবার আরিশের পাশে গিয়ে উঁকি মেরে বলল

— আরিশ ভাইয়া, কি পড়ছো তুমি এতো মনোযোগ দিয়ে?

আরুর কথাতে আরিশের মনোযোগ এ ব্যাঘাত ঘটলো। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আরু নেই তারপর পাশে ওর কানের কাছে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাশে তাকাতেই দেখলো আরু ওর দিকে কৌতুহলী চাহনিতে তাকিয়ে আছে। আরিশ হঠাৎই চমকে গিয়ে
আরুর দিকে তাকালো আর খানিকটা রাগী কন্ঠে বলল

— কি দেখছো তুমি ওভাবে?

আরু আরিশের এমন ব্যাবহারের সাথে খুব একটা পরিচিত নয়, আরিশ তো কখনো এমন ভবে কথা বলে না তবে কি হলো হঠাৎ ভেবে পাচ্ছে না। আরিশ কে আরু বলে উঠলো

— তোমার জন্য গিফট এনেছিলাম ভাইয়া, তুমি তো ওটা দেখলে না।

আরিশ ওর হাতে থাকা বইটার দিকে ইশারা করে বলল

— এই বইটা তুমি পড়েছো?

আরু বইটা দেখে বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল

— এটা তো উপন্যাসের বই! ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাস। তুমিও পড়েছো নাকি এটা? আমার খুব প্রিয় এটা।

আরিশ কখনোই কোন গল্পের বই বা উপন্যাস পড়েনি তবে আরু অনেক ছোট থেকেই এই গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে অভ্যস্ত, আরুর প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় এই উপন্যাসটা জুড়ে ছিলো তা আরিশ আরুর ঘরে গিয়ে জানতে পারে, তারপর আরু কে না বলেই উপন্যাসটা নিয়ে আসে পড়ার জন্য, এতোদিনে কলেজের প্রেসারে পড়ে উঠতে পারেনি তবে আজ পড়েছে। আরিশ আরুর কথাটা শুনে রেগে গেল আর বলল

— এটা কেমন ধরনের উপন্যাস!

আরু অবাক হয়ে বলল

— কেন, খুব ভালো তুমি পড়ে দেখো।

আরিশ আরুর দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— এই লাইনটা এমন কেন?

কথাটা বলে আরুর দিকে বইটা দিয়ে সেটা খুলে দিল যেই লাইনটা আরু হাইলাইট করেছে কারন লাইনটা আরুর মনে ধরেছিলো

— যাহাকে ভালবাসি,সে যদি ভাল না বাসে,এমন কি ঘৃণাও করে,তাও বোধ করি সহ্য হয়,কিন্তু যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি,সেইখানেই ভুল ভাঙ্গিয়া যাওয়াটাই সবচেয়ে নিদারুণ। পূর্বেরটা ব্যথাই দেয়,কিন্তু শেষেরটা ব্যথাও দেয়,অপমানও করে।

“চরিত্রহীন~ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ”

আরু বইটা দেখে বলল

— আরে এটা তো আমার বই, তোমার কাছে যে!

আরিশ হয়তো সেদিন উপন্যাসের লাইনটা বুঝতে পারেনি তাই অবুঝের মতো একটাই কথা বলেছিল

— আর যেন তোমাকে কখনো কোন গল্পের বই বা উপন্যাস পড়তে না দেখি।

কথাটা বলে আরিশ চলে যেতে নিলেই আরু বেশ কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে উঠেছিলো

— তুমি শুধু এটুকুই পড়লে! পুরোটা উপন্যাস পড়লে কি খুব ক্ষতি হতো।

আরিশ রেগে গিয়ে আরুর দু বাহু ধরে বলেছিলো

— আমি এমন কোন উক্তি পড়তে চাই না যেখানে কাওকে না পাওয়ার বেদনা প্রকাশ পায়।

সেদিন হয়তো আরিশ ওর নিজের কথায় বোঝাতে চেয়েছিলো যে উপন্যাসের চরিত্রের মতো ওউ হতে চাই না যেখানে ও ওর আরুপাখিকে পাবে না।

আরিশ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আরু সেদিন ওই উপন্যাসের বইটা আরিশের ঘরেই রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাইরে যেতেই দেখলো আরিশ এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে চোয়াল শক্ত করে। আরু কাঁদোকাঁদো চোখে বেরিয়ে আসতেই হঠাৎ আরুর হাতটা শক্ত করে ধরে সানার সামনে টেনে নিয়ে বলল

— একটা ছবি তোল।

আরু নিরবে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও আরিশ ছাড়েনি। সানা ছবিটা তুলে দিয়েছিলো সেদিন, আরুর মাঝে কোন চঞ্চলতা ছিলো না সেদিন।
ছবি তোলার শেষে আরু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল
— আপনি খুব খারাপ, খুব খুব খুব।

আরিশ রেগে বলল

— আর কখনো যেন আপনি না শুনি।

আরু ধরা কন্ঠে বলল

— আপনি আপনি আপনি!

সেদিনের পর থেকে শুরু হয় আরিশের তুমি থেকেকে আপনি হয়ে ওঠার গল্প।

সেদিনের পর থেকে আরু আর কোন উপন্যাসের বই পড়ে না।
ছবিটার পিছনে থাকা অতীতটা ভাবতেই আরিশের মুখটা ফেঁকাশে হয়ে উঠলো, আজ প্রিয় মনুষটা ওর কাছেই আছে আজ তবে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তার একটা প্রিয় শখ, তবে তা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে আরিশের। ছবিটা দেখতে দেখতে আরু রুমে চলে এলো কফি নিয়ে, আরিশ আরুর উপস্থিতি বুঝে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো।

আরু কফি এনে আরিশের সামনে ধরে বলল

— কি হলো ভবেছেন কিছু?

আরিশ আরুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এই আরুকেই আরিশ ছোট থেকে বড়ো হতো দেখেছে আজ ওর জীবনের সমস্ত অধিকার টুকুও যে তার। আরিশ কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল

— একটা কথা বলবো আরুপাখি?

আরু ভাবলো আরিশ হয়তো পিকনিকের ব্যাপারে কিছু বলবে তাই উত্তেজিত হয়ে বলল

— হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।

আরিশ কফির মগটা রেখে আরুর হাতটা ধরে বলল

— তোমার কাছে আমার তুমি থেকে আপনি হয়ে ওঠার গল্পটা মনে আছে?

আরুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, মনে পড়ে গেল নিমেষেই। আমাদের হৃদয়ে যে জিনিসগুলো বেশি আঘাত করে সেই জিনিসগুলো আমরা কখনো ভুলি না তেমনি আরুও ভোলেনি সেদিনের কথা। আরু বেশ থমকে বলল

— আপনি হোক বা তুমি, সম্পর্ক অস্তিত্ব বহন করে, আমি এখন আপনার সেটাই হলো এখনকার সবচেয়ে বড়ো সত্যি, এর থেকে আর বেশি কিছু ভাবতে আমার ভালো লাগছে না।

কথাটা বলে আরু আরিশকে জড়িয়ে ধরে বলল

— এই মিঃ অভদ্র বলুন না আমাকে নিয়ে যাবেন কি।

আরিশ হঠাৎ যেন একটা ঘোর থেকে বেরিয়ে এল আরুর পাগলামিতে, তারপর আরু কে পুনরায় রাগাতে বলল

— আমি ভাবছি আরুপাখি, স্টিল ভাবছি, কতক্ষন ভাববো বা কতো বছর ভাববো ঠিক নেই।

কথাটা বলে আরিশ হেসে ফেলল। আরু রেগে বলল
— না নিয়ে গেলে আপনার কিন্তু বিয়ে হবে না বলে দিলাম!

আরিশ হাসতে হাসতে বলল
— সো হু আর ইউ আফা🤭

#চলবূ,,,,

উপন্যাসের কাহিনীটা কেও নেগেটিভলি নেবেন না প্লিজ!