কারণে-অকারণে-ভালোবাসি02 পর্ব-১৬+১৭

0
619

#কারণে-অকারণে-ভালোবাসি02
#সুরাইয়া-আয়াত

১৬.

বেশ কয়েকদিন পর আজ ঠান্ডাটা বেশ কম, তাই গার্ডেনে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠেছে পুরো খান ফ্যামিলি, আজ যেন কারোর মাঝে কোন ব্যাস্ততার ছাপনেই, সবাই তার যে যার কাজকে ছুটি করে সমস্ত সময় পরিবারকে ঢেলে দিয়েছে।আজ অনিকা খান ও ছুটি পেয়েছে কিচেন থেকে, সারাদিনের খাবার ফুড পান্ডা থেকে এসেছে।
পরশু মধুর বিয়ে সেই কারনে বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছে আরিশ আর সেই সুযোগকে সদ্ ব্যাবহার করে আরিশের হাড় হিম করে চলেছে আরু ক্রমাগত, সারাদিন এই ওই বাহানায় আরিশ কে ব্যাস্ত রাখে। ভাগ্যিস ডক্টরদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম জিনিসটা হয় না নাহলে আরিশ কে জ্বালানোর তীব্র ইচ্ছা নিয়ে তা সফল করার জন্য আরিশ কে রোজ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করাতো আরুআর আরিশের পুরো দিন তেজপাতাময় করে তুলতো তা আরিশ বেশ ভালোই বোঝে।

পারিবারিক আড্ডা চলছে তার মাঝে হচ্ছে নানা ধরনের গল্পগুজব, সানার মুডটাও বেশ ভালো। আরাভের সাথে এখন নিজেকে কল্পনা করতে পারে, মানুষটা কি আসলেই জাদু জানে? কথাটা ভেবে মুচকি হেসে উঠলো সানা। হঠাৎই আরু একটা পকোড়া মুখে পুরে চেবাতে চেবাতে বেশ গুরুগম্ভীর সুর করে বলে উঠলো
— – ফুপি তোমার আর ফুপার বিয়েটা নাকি লাভ ম্যারেজ আর তোমার ভাই আরমান ওরফে আরুশি খানের বাবা সেই বিশেষ ব্যাক্তি নাকি তোমাদেরকে প্রথমে মেনে নেয়নি! নাকি তোমাদের বিয়ে নিয়ে অনেক তামাশা করেছিলো, এটা কি সত্যি?

ভ্রু কুঁচকে বেশ কৌতুহল জাগ্ৰত করে অনিকা খানকে প্রশ্ন করে উঠল আরু। ওনাকে গোল করে ঘিরে বসে আছে সবাই, আফজাল খান মিঠিমিঠি হাসছেন উনিও হয়তো অপেক্ষা করছেন যে অনিকা খান কি কি বলেন পুরোনো সেই ঘটনাগুলোকে মনে করে।
অনিকা খান দ্বিধা ছাড়াই হঠাৎ রাগী আর গম্ভীর কন্ঠে বলেন
— আর বলিস না সে এক কাহিনী, ভাইয়া তো আমাদেরকে মেনে নেবে না মানে নেবেন ই না, সেকি জেদ তার, এদিকে সে নিজেই তোর মায়ের সাথে প্রেম করতো সে বেলায় সাত খুন মাফ।

কথাটা শোনা মাত্রই আরু হো হো করে হেসে উঠলো, আরিশ আরুর দিকে আড়চোখে তাকালো আরুর প্রান খোলা হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে আড়ালে।
আরুর হাসির শব্দে সবাই আলতো হেসে উঠল তবে আরিশ নির্বিকার, সে আরুর হাসি দেখছে। আরুর হাসির মাঝে অনিকা খান বললেন
— এটুকুতেই হাসছিস? পরে কি হয়েছে শোন।

আরু কোনক্রমে হাসি থামিয়ে বলল
— হমমম বলো বলো, তারপর কি করে কি হলো।

অনিকা খান আবার নিজের তালে ফিরলেন

— তোর ফুপা তখন নতুন নতুন তার বাবার অফিস জয়েন করেছে, নেহাত বয়সটাও তার অল্পই ছিলো আর তোর দাদাজি মানে আমার বাবাও তখন আমার বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেন, আমি আর আফজাল চিন্তায় পড়ে যায়, দুজনেই কিভাবে বাসায় বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আফজাল তার বাবাকে বলে ঠিক মানিয়ে নিয়েছিলো, ভার্সিটি জীবনে ততোটাও খারাপ ছিলাম না দেখতে, আরিশের দাদাজি আমাকে মেনে নেন।

কথাটা শেষ হতেই আরু অনিকা খানের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
— তুমি এখনো কিউট আর আমার সুইটহার্ট, এখনো আগের মতোই। তারপর বলো।
আরিশ কেবল আরুর পাগলামো গুলো দেখছে গভীর ভাবে আর মনে মনে এক প্রশান্তি অনুভব করছে।

অনিকা খান আবার বললেন
— তারপর আমি এক বুদ্ধি খাটালাম, তোর মা আর আমি ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড, আরমান ভাইয়া আফসানাকে অনেক পছন্দ করতো, আর আমাদের সেই জটিল সময়ে তো তারা একে অপরকে ভালোও বাসতো। আমি আমার কথাটা তোর মাকে দিয়ে ভাইয়াকে বলালাম, তারপর শুরু হয় লঙ্কা কান্ড। আর তারপর যা হলো তা শুনলে তোর শ্বশুরবাবার মান ইজ্জত এর ফেলুদা হয়ে যাবে।

মেইন পয়েন্ট এ এসে আফজাল খান নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে বললেন
— অনেক হয়েছে থামো, আর কিছু বলিও না, বাচ্চাগুলোর সামনে আর মান সম্মান ধূলোয় মিশিও না আর।

কথাটা শুনে সবাই হেসে ফেলল, আরিশ ও। তবে আরু তো নাছোড়বান্দা আর সেই সাথে সানাও তাল মেলাতেই অনিকা খান আবার বলতে শুরু করলেন

— তারপর ও ভাইয়া মেনে নেইনি। তারপর আফজাল হঠাৎ একদিন এক লিটার কেরোসিনের ড্রাম নিয়ে হাজির যেটা ছিলো পানির সাথে রঙ মেশানো নকল কেরোসিন।

ওনার এমন কথা শুনে আরিশ ফিক করে হেসে ফেলে নিজেকে সংযত করে নিলেই আফজাল খান বললেন
— দেখেছো তো, এখন ওরাও হাসবে। তিনি ওদের গল্প শোনাও আমি যাচ্ছি। কথাটা বলে উনি উঠে চলে যেতে নিলেই আরু ওনার হাত ধরে পুনরায় বসিয়ে ওনার ওক হাত জাপটে ধরে আর একহাত দিয়ে অনিকা খানকে জাপটে ধরে তাদের দুইজনের মাঝে বসে রইলো।
আরু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল
— তারপর তারপর।

— তারপর ই তো হলো আসল কাহিনী, তোর ফুপার সে কি প্রেমের ভাসন, ভাগ্যিস সেদিন বাবা বাড়িতে ছিলো না, শুধু আরমান ভাইয়াই ছিলো। ভয়ে আমি কল দিয়ে তোর মা কে ডাকলাম কারন তোর মা ই ছিলো তখন ভইয়াকে শান্ত করার মূল মন্ত্র। তোর ফূপা হঠাৎ দেশলাই জ্বালিয়ে ধরলো আর ভাইয়াকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলো, ততখনে তোর মা ও হাজির, আমার তো ভয়ে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা।
তোর মা তোর বাবাকে অনেক কিছু বোঝালেন আর এদিকে আফজাল পাগল প্রেমিক এর মতো প্রলাপ গেয়েই চলেছে। তারপর হঠাৎ ভাইয়া বলে উঠলো যে তার কোন আপত্তি নেই। সবশেষে ভাইয়া আফজালকে বলে উঠলো
— প্রেম করার সাহস হলো যখন তখন নকল কেরোসিন নিয়ে এসে বৃথা ভয় দেখানোর চেষ্টা না করলেও পারতে।

সেদিন সেই মুহূর্তে আফজালকে দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরীহ আর বোকা মনে হচ্ছিল।

কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠলো। আফজাল সাহেব হাত দিয়ে দাঁড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন, মান ইজ্জত আর রইলো না।

তারপর হঠাৎ সানা আরিশের দিকে ইশারা করে বলল
— আর আরিশ আর আরুর বিয়েটা!

কথাটা শুনে আরু বেশ লজ্জা পেয়ে গেল, আরিশ আরুর লাজুক মুখের দিকে তাকালো, গোলুমোলু্ গাল দুটো হালকা গোলাপী আভায় ছেয়ে গেছে।

অনিকা খান বললেন
— সে তো আগে থেকেই ঠিক ছিলো বিয়ে।

সানা হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলো
— কি আরুর সাথে?

— না, তবে আরুর সাথে না অন্য এক জনের সাথে যার নাম হলো আদিবা যে আরুর বড়ো বোন।

কথাটা শুনতেই আরুর বুকের ভিতর ধক করে উঠলো, কই এতোদিন তো আরু এসব কথা জানতো না। আরিশ বেশ চুপচাপ ই আছে। আরু বেশ থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো
— আপুর সাথে ওনার বিয়ে ঠিক করা ছিলো জানতাম না তো! আর কেও কখনো বলেনি তো এটা!

আরিশ আরুর মুখের দিকে তাকালো, আরুর মুখে অজানা আশঙ্কা আর ভয় আরিশ কে নিয়ে তবে সে ভয় যদিও অর্থহীন কারন আদিবা আর এই পৃথিবীতে নেই। আরিশ আরু কে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো যে সে শুধুই তার কিন্তু তাতেও যেন আরুর ছটফটানি কমছে না।

অনিকা খানকে আরু পুনরায় প্রশ্ন করে উঠলো
— কি হলো ফুপি বলো না!

— আমার বিয়ের দুইবছর পর আরমান ভাইয়া আর তোর মা বিয়ে করে, তখন আমার আরিশের বয়স একবছর প্রায়। বিয়ের তিনমাস পর আফসানা কনসিভ করে, আর ফুটফুটে একটা মেয়েও হয় যার নাম রাখা হলো আদিবা। আমার আর আফসানার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছা ছিলো যে আমাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে হবে। আদিবা হতেই তখন ভাবলাম আরিশের সাথে আদিবার বিয়ে দেবো বড়ো হলে। তারপর দিন যেতে লাগলো আরিশ আর আদিবা দুইজনই বড়ো হতে লাগলো। তবে একটা অবাক করা বিষয় কি জানিস?

আরুর বুকের ভিতর টিমটিমে করতে লাগলো, গলা শুকিয়ে এলো, আরিশের দিকে ভীরু চোখে একবার তাকালো আরু, আরিশ নির্বিকার যাতে করে আরুর ভয় আরও দ্বিগুণ বাড়লো।

আরু কাঁপা কন্ঠে বলল
— কি ফুপি?

সানা আরুর মুখের দিকে তাকিয়ে আরুর ভয় পায় কাটাতে আরুর হাতটা ধরে বললো — আরু রিল্যাক্স, কিচ্ছু হইনি।

আরু মিথ্যা হাসি দিয়ে বলল
— আরে কিছু না, ফুপি তুমি বলো।

— অবাক করা বিষয় হলো আরিশ ভ্রুনাক্ষরেও আদিবার সাথে কখনো কথা বলতো না, আরিশের যখন চার বছর বয়স হয় তখন আদিবা তিন, ধরতে গেলে সমবয়সী প্রায় কিন্তু তবুও আরিশ আদিবার সাথে কখনো মিশতো না। এমনটাও নয় যে আদিবা খুব চঞ্চল। আরিশ ছোট থেকেই ভীষন চাপা স্বভাবের আর একগুয়ে, কিছু প্রকাশ করতো না, আমরাও ভীষন চিন্তায় থাকতাম ওকে নিয়ে।
তারপর তুলি এই পৃথিবীতে এলি, তখন আরিশ সবে পাঁচ। প্রথম একবছর আরিশ তোকেও কখনো ছুঁয়ে দেখেনি তারপর যখন তুই হাটতে শুরু করলি তখন থেকেই আরিশ যেন তোকে আগলে আগলে রাখতো, আমরা সবাই অন্য পসেসিভ একটা আরিশ কে দেখে অবাক হয়েছিলাম, সারাদিন ছোট্ট আরুর সাথেই খেলতো ও, ছোট্ট আরু যখন কথা বলতে শিখলো তখন হঠাৎ একদিন বেফাসে আবদার করে তার খরিশ ভাইয়াকে বলে ফেলেছিলো যে
— আরিশ ভাইয়া আমার একটা পাখি চাই তুমি এনে দেবে? আমিও পাখিটার সাথে উড়বো।

সেদিন অরিশ হঠাৎই আরুর গালে ঠোঁট দুইয়ে বলেছিলো
— তুই ই তো আমার আর আমার খেলার সাথী, আমার পুতুল বউ, তুই সবসময় আমার সাথেই থাকবি আমার পাখি হয়ে।

আরুর বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আরিশ মাথা নীচু করে পুরোনো অনুভূতিগুলোকে তাজা করার চেষ্টা করছে।

এই কথাটা আদিবা আরিশ কে বলল
— আরিশ ভাইয়া আমাকেও পাখি এনে দেবে!
তবে আরিশ উত্তরে কিছু না বলে তার আরুপাখির হাত ধরে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো।
ছোট্ট আদিবা কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এসে বলেছিলো
— ফুপি আরিশ ভাইয়া আমাকে আদর করে না কেন! ভাইয়া কি আমাকে পাখি এনে দেবে না?

সেদিন আদিবা কে কি উত্তর দেবো বুঝতে পারিনি। এভাবেই গেল আরো দুই মাস, হঠাৎ একদিন ভীষনরকম অসুস্থ হলো আদিবা, ডক্টর বললেন যে আদিবার বোন ম্যারো ডিজিস আছে, আর এতো ছোট বয়সে কোন অপারেশন ও সম্ভব না তাই ঔষধ এ যতদিন যায়! কয়েকমাস পরই আদিবা সবাইকে ছেড়ে চলে গেল তবে তার সাথে তার আরিশ কে ছেড়ে গিয়েছিলো আরিশের আরুপাখির কাছে।

কথাটা বলে উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। হঠাৎই আরুর গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো, আরু নিজেকে সামলাতে বলে উঠলো
— ফুপি আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।
হঠাৎ করেই আরু ওখান থেকে দিয়ে ছুটে ঘরে চলে গেল।

কাওকে কিছু বলার অপেক্ষা না রেখে আরিশও আরুর পিছনে ছুটলো। সানার গলা ধরে আসছে।
আফজাল খান ধমকের সুরে বললেন
— মেয়েটাকে এসব বলার দরকার কি ছিলো! না জেনেই থাকতো না হয়।

আরুর কষ্টে অনিকা খান নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন। উনিও ভাঙা কন্ঠে বললেন
— আমি বুঝতে পারিনি মেয়েটা এমন কষ্ট পাবে, কথায় কথায় মজার ছলে সবটা বলে ফেলেছি। আচ্ছা আমি দেখছি।

কথাটা বলে উনি উঠতে গেলেই সানা বলে উঠলো
— মা তুমি যেও না, ভাইয়া গেছে ও সামলে নেবে।

হঠাৎ পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেল, সবাই যেন আরুর কারনে বুক এর মাঝে এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে।

—-

হালকা শীতের আমেজ আর হালকা বাতাসে ছাদে রেলিং এর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আরু, চাঁদটা কি চমৎকার লাগছে দূর থেকে।
সারা ঘর তন্নতন্ন করে আরু কে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদে এলো একপ্রকার ছুটতে ছুটতে, ছাদে এসে দেখলো আরু রেলিং এর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আরিশের পদধ্বনি শুনে আরু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘুরে তাকালো, আরিশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরু আরিশ কে দেখে এক চিলতে রোদের মতো মুখে হাসি ফুটিয়ে আরিশের দিকে এক পা দু পা করে এগোতে লাগলো, আরিশ অবাক আর মুগ্ধ। হঠাৎই আরু এসে আরিশ কে জাপটে জড়িয়ে ধরলো, আরিশের দ্রুত হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে আরু। আরু আরিশের বুকে মাথা রেখে এক হাত আরিশের বুকের বাম পাশে রাখলো যার অর্থ
— আমি এখানেই আছি আপনার বুকে,এবার আপনি শান্ত হন!

আরিশ আরু কে জড়িয়ে ধরে ঝিম ধরা কন্ঠে বলল
— আরুপাখি!

#চলবে,,,,

#কারণে_অকারণে_ভালোবাসি০২
#সুরাইয়া_আয়াত

১৭.

— আমার আরিশ ভাইয়াকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও না আরুপাখি।

বাচ্চা মেয়ের কন্ঠে এমন কথা শুনে অবাক হলো আরু, পথটা যেন থমকে গেল, পিছু ফিরে চেয়ে দেখতেই একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়েকে দেখে আরু ঝুকে তার কাছে বসলো আর তাকে বেশ আল্হাদী কন্ঠে বলল
— তুমি আরিশ ভাইয়াকে চেনো?

আরুর কথাতে বাচ্চাটি মুখ চেপে পিটপিট করে হেসে উঠতেই সেই হাসির ক্ষীন আওয়াজটাও যেন আরুর কাছে গগনবিদারী মনে হলো, চমকে উঠলো বেশ তারপরও বলে উঠলো
— তুমি হাসছো যে! আরিশ ভাইয়াকে তুমি চেনো!

আরুর এমন কথাতে বাচ্চা মেয়েটি পুনরায় হেসে উঠতেই আরু আগের তুলনায় বেশ নরম সুরে বলল
— বলো বলো তাহলে তোমাকে চকলেট দিবো আর আরিশ ভাইয়ার সাথে দেখাও করাবো।

বাচ্চা মেয়েটি এবার হঠাৎই আরু কে জড়িয়ে ধরে আদুরে কন্ঠে বলল
— আগে বলো তুমি আরিশ ভাইয়াকে আমার কাছে এনে দেবে।

আরুর ভ্রু কুঁচকে এলো, বাচ্চা মেয়ে কি বলতে চাইছে তা বুঝতে পারছে না সে, তাই হাসি মুখে বলল
— সে তো পরের কথা আগে তুমি বলো তুমি কি আরিশ ভাইয়াকে চেনো?

মেয়েটির দু বাহু ধরে আরু কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ বাচ্চাটি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই আরু তার গালে হাত রেখে বলল
— তা তুমি অরিশ ভাইয়াকে কি করে চেনো আর তোমার নাম ই বা কি?

মেয়েটি মিষ্টি হেসে হঠাৎ আরুর কানের কাছে গিয়ে আচমকাই অস্বাভাবিক ভাবে ফিসফিসিয়ে বলল
— আমি তো আদিবা আরুপাখি, আরিশ ভাইয়া তো আমার!

আদিবা নামটা শুনতেই আরুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো, সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো, আদিবা নামের এই বাচ্চাটাকে যেন এখন ওর সবচেয়ে বড়ো বাধা বলে মনে হচ্ছে।

আরু আচমকাই আদিবা কে ছেড়ে দিলো, আরুর চোখে ক্রোধ আর ভয় উভয়ই বিরাজমান, সেই চোখ দিয়েই যেন ভস্ম করে দেবে আদিবাকে। আরু ক্রুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন করলো
— কেন এসেছো তুমি এখানে? আর তুমি কি জানো না যে সে শুধু আমার!

আরুর কথাতে আদিবা আরুর কাছে এসে আরুর মুখে একটা ফু দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বলল
— আমি তো আরিশ ভাইয়াকে ভালোবাসি আরুপাখি, সে তো শুধুই আমার।

আদিবার কন্ঠে আরিশ কে পাওয়ার তীব্র কাতোরউক্তি আরুকে ভেঙে দিচ্ছে ক্রমে ক্রমে। রাগে আর তীব্র ভয়ে আদিবাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল আরু, আর এক পা দু পা করে পিছিয়ে গেল, আরুর সারা শরীর দরদর করে ঘামছে, আরিশকে হারানোর তীব্র ভয় গুলো ক্রমে ক্রমে মনের আঙিনায় বাসা বাধছে। ছোট্ট আদিবা মাটিতে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর মুখে একটাই বুলি আওড়াচ্ছে
— আরিশকে ভাইয়া আমাকে একটু কোলে নাও না দেখো আমাকে আরু পাখি আমাকে ব্যাথা দিয়েছে।

আরু এবার দৌড়ে ছুটলো আর জোরে চিৎকার দিয়ে বলল
— উনি শুধু আমার, শুধু আমার।

বলে দিগন্তের শেষ প্রান্তে মিলিয়ে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল আরুর সাথে নাহহহ! বলে এক তীব্র চিৎকার দিলো সে।
আরুর চিৎকারে আরিশের ঘুম ভেঙে গেল, ধড়ফড়িয়ে উঠলো আরিশ, উঠে দেখলো আরু হাটু ভাজ করে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, ঘন কালো চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে বিছানায় ঠেকছে, আর গভীর নিশির তীব্র নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আরুর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ বাঁশির সুরের মতো যেন বাতাসে ভাসছে। আরিশ দ্রুত আরুর কাছে গেল, আরুর কাঁপা কাঁপা শরীরের দিকে আরিশ হাত বাড়িয়ে আরুর কাধে স্পর্শ করতেই আরু মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে আরিশের দিকে চায়তে লাগলো। চোখের জলের সাথে আগোছালো চুলগুলো গালে লেপ্টে আছে, কান্নার রেশে চোখগুলোর এক ভয়ংকর অবস্থা। আরিশের গলা ধরে এলো। কথা বলার সাহসটুকু পাচ্ছে না। আরুও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। আরিশ সবটা জানার তীব্র উন্মাদনা নিয়ে বলে উঠলো
— কি হয়েছে আরু পাখি কাঁদছো কেন?

আরু এবার হাত পা ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, কোন কথা বার হচ্ছে না মুখ থেকে, কেবল কেঁদেই চলেছে। আরুর কান্নায় আরিশের হৃদয় ভিজছে। আরিশ নিষ্পলক ভাবে চেয়ে আছে, কথা বলার শক্তিটুকুও যেন হারিয়েছে।
আরুর কান্নার গতি ক্রমশ বাড়ছে। নাহ আর সহ্য করতে পারছে না আরিশ, অনেক সুযোগ দিয়েছে তার আরুপাখিকে কাঁদার, আর না। আরিশ আরুর দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলো, এক মুহূর্তও দেরি করলো না আরু, আরিশের বুকে হামলে পড়লো। আরিশের শার্ট ভিজছে।
আরিশ আরুর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো আর থামানোর তীব্র প্রচেষ্টা চালাতে বলল
— কি হয়েছে আরু পাখি কাঁদছো কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?

আরু আরিশের শার্ট খামচি মেরে ধরলো, আগোছালো ভঙ্গিমায় বলল
— আদিবা এসেছিলো আরিশ, উনি আপনাকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাই।

এই প্রথম আরু আরিশের নাম ধরে ডাকলো এক ভয়মিশ্রিত ভঙ্গিমায়। আরিশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— কিছু হবে না আরুপাখি, আদিবা আর কোথাও নেই। তুমি দু স্বপ্ন দেখেছো আরুপাখি, আর আমিতো কোথাও যাইনি দেখো, তোমার সাথেই আছি।

আরিশের সমস্ত প্রচেষ্টাকে নাকচ করে আরু পুনরায় বললো

–আমি আপনাকে ভালোবাসি আরিশ, বিশ্বাস করুন। আমি সত্যিই আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আমি আপনাকে হারাতে চাই না। প্লিজ আমাকে আপনার থেকে দূরে সরাবেন না, আমি আর কক্ষনও আপনাকে বিরক্ত করবো না, আমি শান্ত হয়ে থাকবো যেমনটা আপনি চান। কখনো কোন অন্যায় আবদার করবো না। কখনো রাতবিরেত আইসক্রিম খাওয়ার বাহানা করবো না। কখনো ফুপিকে দিয়ে আপনাকে বকা খাওয়াবো না, আর কখনো বলবো না মি অভদ্র আমাকে একা ছেড়ে দিন। আর কখনো আপনাকে কিল ঘুষি ও মারবো না বিশ্বাস করুন। অনেক শান্ত হয়ে যাব আমি। তবুও আমাকে ছাড়বেন না প্লিজ। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু আমি প্রকাশ করি না। আপনার থেকে দূরে গেলেও আমার সহ্য হয় না। প্লিজ আপনি আদিবার কাছে যাবেন না। আপনি আমার হয়েই থাকুন।

কথাটা বলে পুনরায় অনবরত কান্না করতে লাগলো আরু। আরিশ কে হারানোর ভয় আগে কখনো ওর কল্পনাতেই আসেনি কিন্তু আজ যখন যানলো যে মানুষটা হয়তো ওর ছিলো না, আদিবা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ তারই হতো তারপর থেকেই আরিশ কে হারানোর তীব্র ভয় আরুর মাঝে। আরুর এই প্রথম এমন অনুভূতি। কিন্তু আরিশ! সে যে চিরটা কাল এই তীব্র ভয়কে বুকে জমাট করে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ায় তার হদিশ কি কেও পেয়েছে?
আরিশ আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে একটা দীর্ঘ তপ্তশ্বাস ফেলে বলল
— আমি তোমারই, সে আদিবা বা অন্য কোন তৃতীয় ব্যাক্তি থাক আর না থাক। আর তোমার চঞ্চলতাকেই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি। আমার এই থমথমে জীবনে তুমিই হলো আমাকে জিইয়ে রাখার সুপ্ত মাধ্যম।

আরু কাঁপতে কাঁপতে আরিশের মুখের দিকে তাকালো, চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু কনা গড়াচ্ছে আর আরিশের হাতের ওপর চুইয়ে পড়ছে। আরিশ আরু কে জড়িয়ে ধরে আরুর মুখের ওপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আরুর গালে হাত রাখলো। আর চোক্ষুযুগল আর কপালে ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়া দিলো। স্পষ্ট বুলিতে আওড়ালো

— আম্মু কি বললো তখন শোনোনি? আমার পুরো শৈশবটা কেটেছে তোমার সাথে, জন্মের পর আমি ছিলাম খুবই ইন্ট্রোভার্ট একটা বাচ্চা তারপর আমার আরুপাখি এলো আর একটু বৃহৎ দায়িত্ব চাপিয়ে দিলো আমার ওপর, তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব আমার যৌবনকালে ভালোবাসার দায়িত্ব হিসাবে প্রাধান্য পেয়েছে। আদিবা থাকতেও আমি তোমাকে চেয়েছিলাম আর না থাকতেও আমি তোমাকেই চাই আর চাইবো।

সবার প্রতি কারণে অকারণে ভালোবাসাটা আসেনা আরুপাখি! অকারণে ভালোবাসাটাও বিরাট এক অনুভূতি যা সবাইকে বাসা যায় না। তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি, হোক না তা কারনহীন! ভালোবাসাটা কোন পাটিগণিত বা বীজগণিতের হিসেব নিকেশ নয়, এমনটাও নয় যে ভালো না লাগলে ত্রিকোনমিতিতে যাবো, ভালোবাসা এক পবিত্র অনুভূতি যার কোন সংঞ্জা হয় না। এটা হলো কেবলই দুটি মনের মিলন, একে অপরকে প্রতি এক বিশেষ টান অনুভব করা, একে অপরের প্রতি ব্যাকুল হওয়া, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শুধুই তাকে অনুভব করা আর তোমার কল্পনায় তাকে তোমার রাজ্যের সাম্রাজ্রী করে রাখা। আমার কল্পনা আর বাস্তব রাজ্যে একটাই রানি যাকে আমি কারণে অকারণে ভালোবাসি। আমার আরুপাখি!

আরুর গলা শুকিয়ে এলো, মানুষটা এতো আবেগপ্রবন! আরু একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরিশের দিকে। অনেক কিছু ভাবছে ও।
আরিশ ও আরুর মাতাল করা চাহনিতে নেশাগ্রস্ত। আরু আরিশের বুকে মাথা রাখলো।
আরিশ জড়িয়ে বললো
— কখনো মনের মাঝে কিছু চেপে রেখে নিজে গুমরে মরবে না। আমাকে বলবে। ছাদে তখন আদিবাকে নিয়ে তুমি একটা শব্দ অবধি উচ্চারন করোনি, নিজে গুমরে মরেছো নিজের মাঝে, বিষয়টাকে নিয়ে অনেক অযথা ভেবেছো তুমি। অহেতুক চিন্তা গুলোকে লায় দিয়েছো। আর আমরা যে জিনিসগুলো নিয়ে কঠিন ভাবে বেশি চিন্তা করি সেগুলোই ঘুরে ফিরে আমাদের স্বপ্নের মাঝে এসে বেশি ব্যাথা দেয়। আর কখনো এমনটা করবে না। যা নিয়ে ভাবার প্রশ্ন অবধি আসে না তা নিয়ে আর কখনোই ভাববে না আরুপাখি।

আরু আরিশের বুকে মাথা রেখেই মাথা নাড়িয়ে আরিশের কথাতে সম্মতি জানালো।
আরু ক্লান্ত সুরে বলল
— বিশ্বাস করুন আমি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। আমি,,,

বাকি কথাটুকু শেষ করতে দিলো না আরিশ, আদেশের সুরে বলল
— উহুম! আর কোন কথা না, ঘুমাও। আমি এভাবেই তোমাকে জড়িয়ে থাকবো, এখন আর সারাজীবন।

আরুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে আরিশ আরুর পাশে শুয়ে পড়লো। আরুর হাতটা শক্ত করে ধরে আছে আরিশ। দুজনের চাহনি একে অপরের চাহনিকে ভেদ করে চলেছে। পার হয়ে যাচ্ছে সময় তবুও কারোর চোখের পাতা বুঝছে না।
আরুর চোখ আজ নির্ঘুম- নির্লিপ্ত।

কিছুসময় পর আরু মলীন কন্ঠে বলল
— কি দেখছেন?

আরিশ মলীন হাসলো। তার সোজাসাপটা উত্তর
— তোমাকে।

আরু লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।

আরিশ তখন উষ্ণ আবেগী কন্ঠে বলল
— তোমাকে দেখার এই ভয়ংকর তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না আরুপাখি! কখনোই না।

আরু চোখ বন্ধ করলো। কন্ঠে সাহস আর বহু আকাঙ্খা নিয়ে বলল
— আমাকে ভালোবাসবেন!

আরিশ আরুর মুখশ্রীপানে চেয়ে রইলো অপলক, মেয়েটির চেহারায় লজ্জা ভয় আর শীতলতার একরাশ বেহিসেবি অনুভূতির আনাগোনায় ছেয়ে যাচ্ছে।
আরিশের এহেন নিস্তব্ধতা অনুভব করে আরু খানিক কেঁপে উঠলো, বুক দুরু দুরু করছে তার আর মনে মনে একটা ভাবনাই কেবল উঁকি দিলো
— আমি কি অসময়ে অন্যায় আবদার করে ফেললাম!

ভাবনারা যেন আর ভাবতে পারে না, লজ্জায় মুখ লুকালো গোপন কোঠরে যখন উষ্ন স্পর্শে ছেয়ে গেল আরুর ওষ্ঠযুগল আর ভালোবাসার এক উপমা বহন করেতে শুরু করলো আরুরসমগ্ৰ শরীর ও মন।

#চলবে,,,,