কারনে অকারনে ভালোবাসি0২ পর্ব-০৪

0
748

#কারনে_অকারনে_ভালোবাসি0২
#সুরাইয়া_আয়াত

৪.

ঘুমন্ত আরিশের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরু, আরিশ ঘুমিয়েছে অনেক আগেই কিন্তু ওর চোখের ঘুমেরা আজ পাড়ি জমিয়েছে দূর দেশে। রোজ রাতের যেমনটা বাধা ধরা নিয়ম থাকে আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। আরিশের কথা অনুযায়ী রোজ রাতে আরিশের দিকেই মুখ করে ঘুমিয়ে থাকে আরু, আরু আরিশ কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে না ঘুমালেও আরিশ আষ্টেপৃষ্ঠে নেয় আর একটা ছোট্ট নিউ বর্ন বেবির মতোই ওকে আগলে রাখে সবসময়।
আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে এসে থামলো আর টংটং করে তিনটা ঘন্টা বাজতেই আরু বুঝতে পারলো যে রাত তিনটা বাজে, একটা ঢোক গিলে আরিশের পিঠে হাত দিয়ে আলতো স্পর্শ করলো, কিছুখন আগেই আরিশ কে অনেক আঁচড় দিয়েছে পিঠে, আজ কি ভেবে আঁচড় দিয়েছে আরু নিজেও জানে না, যদিও আঁচড় দেওয়ার সময় উপলব্ধি করতে পারেনি ততটাও যে আঁচড় দিচ্ছে কিন্তু একসময় অসাবধানতা বশত আরিশের পিঠে জোরে আঁচড় দিতেই আরিশ আরুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল

— আজ মনে হচ্ছে আমাকে সবদিক থেকে ঘায়েল করেই ছাড়বে।

আরু তখন উপলব্ধি করলো যে বেশ অনেক কয়টা খামচি দিয়েছে তবে আরিশের তাতে বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিলো না।
আরু আরিশের পিঠের খামচি দেওয়া স্থানে হাত দিয়ে বলতে লাগলো

— আমি এমন রাক্ষসী কবে হলাম! আরু তুম তো আব সুধার যাও।

কথাটা নিজের মনে মনে বলে আরু হাতটা বিল বিল করে ওর ফোনটার দিকে বাড়াতে গেল, কারন আরিশের দিকেই আরুর ফোনটা রয়েছে, ডঃ মিতার এস এম এস আরু এখনো দেখেনি তাই তিনি কি লিখেছেন তার কৌতুহল একটা থেকেই যায়। আরু হাতটা বিল বিল করে ফোনটা ধরতে গেলেই হঠাৎ আরিশ আরুর হাতটা চেপে ধরলো, রাগী চোখে তাকিয়ে বলল

— ঘুমাও নি কেন তুমি এখনও?

হঠাৎ আরিশ জেগে যেতেই আরু ভয় পেয়ে গেল, কি বলবে তা নিয়ে একেবারে ভাবলেশহীন ও, আমতা আমতা করে বলল

— না মানে ঘুমাচ্ছিলামই তো।

আরিশ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো

— ইউ নো যে আমি মিথ্যা বলা পছন্দ করি না, তুমি ফোন নিতে যাচ্ছিলে আমি জানি।

আরু অবাক হয়ে বলল

— আপনি কি করে বুঝলেন যে আমি ফোন নিতে যাচ্ছিলাম আর তাছাড়া আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন তাহলে!

আরিশ আরুর ফোনটা বিছানা থেকে সরিয়ে দূরের টেবিল এ রেখে দিতে দিতে বলল

— নাহ ঘুমাইনি আমি?

আরু ভ্রু কুঁচকে বলল

— তাহলে কি পাহারা দিচ্ছিলেন আমাকে? পালিয়ে যায় কি না!

আরিশ দাঁত কিছু কিড় করে বলল

— আমি কোন পেঁচা না যে রাত জেগে পাহারা দেবো। রোজ যতখন না তুমি ঘুমাও ততখন আমি ঘুমাই না।

আরু অবাক হয়ে বলল

— তার মানে রোজ রাতে আপনি আমার আড়ালে আমাকে লুকিয়ে দেখেন, তাইতো?

আরিশ চোখে মুখে বিরক্ত ভাব নিয়ে বলল

— নিজের বউকে লুকিয়ে কেন দেখতে যাবো স্টুপিড।

আরু ঠোঁট উল্টে বলল

— সে যাই হোক, ফোনটা দিন না একটু, মিতা ম্যামের এস এম এস টা দেখবো।

আরিশ ভ্রু কুঁচকালো আরুর দিকে তাকিয়ে তবে কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে আরুর ফোনটা নিয়ে ডক্টর মিতার চ্যাট বার করতেই দেখলে প্রেসক্রিপশনের ছবি যা আরিশ কালকে বিকালেই এনে রেখেছে আর সেটার ছবি আরু তুলে পাঠিয়েছে ওনার কাছে, আর রিপোর্টের রেজাল্ট কি জিজ্ঞাসা করেছে। ফোনের থেকে চোখ সরাতেই আরুর দিকে তাকালো আরিশ, আরু ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে এই বুঝি আরিশ গগনবিদারী একটা চিৎকার দিয়ে না ওঠে সেই আশায়।
আরিশ আগের তুলনায় নরম সুরে বলে উঠলো

— ওপেন ইউর আইজ আরুপাখি।

আরু এক কথাতেই চোখ পিটপিট করে খুলতেই দেখলো আরিশের আগুন চাহনির দৃষ্টিতে কেও যেন পানি ঢেলে দিয়েছে এক বালতি, আরু মনে মনে বললো
— ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্তটা এমন শান্তই হয়।
কিন্তু তেমন কিছুই হলো না, আরুর খাতায় যুক্ত হলো অতিরিক্ত একটা পানিশমেন্ট যা ও রোজ বেশ অনেকগুলোই পায়।

আরিশ আরুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো বেশ কিছুখন কিন্তু কিছু বলল না, বিছানা থেকে উঠে ফোনটা ওর ফোনের পাশে নিয়ে রেখে এলো, আরু ভাবলো যে আরিশ হয়তো রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তাই ও কনভিন্স করতে যাবে ঠিক তখনই আরিশ কে আবার বিছানার দিকে ফিরতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
আরিশ বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো আরুকে জড়িয়ে, আরু অবাক হলো বেশ। আরিশ বললো

— নেক্সট টাইম যেন এমনটা আর কখনো না দেখি। তোমার যদি কিছু জানারই থাকে তবে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে বাইরের কাওকে না সে তোমার যতোই প্রিয় হোক না কেন। আমি মিথ্যা বলতে কখনোই পছন্দ করি না তবে তোমাকে যদি কখনো বলে থাকি তো ভাববে তার পিছনে আমার স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কিন্তু যদি কখনো দেখি যে এমন কিছু করেছো তো তোমার সেদিন খবর আছে।

আরু আরিশের বুকের ভিতর গুটিশুটি মেরে ঝিমধরা কন্ঠে বলল
— আপনার তো কখনোই কোন স্বার্থ ছিলো না তাহলে হঠাৎ এমন বললেন যে।

আরিশ ও আরুকে আগলে নিয়ে বলল

— স্বার্থ ছাড়া এই পৃথিবী অচল এই পৃথিবীর প্রতে্্যকটা মানুষই স্বার্থ পর তেমনি আমারও স্বার্থ আছে যাতে আমি তোমাকে ভালো থাকতে ও নিজের দু চোখের সামনে তোমাকে দেখতে পাই। এটুকুই।

আরিশের স্বার্থতে আরু বাকহারা হলো কিছু মুহূর্তের জন্য। নিজেকে স্পেশাল অনুভব করাতে আরিশের বলা কয়েক লাইনই যথেষ্ট যা পৃথিবীর অন্য সব কিছুর আনন্দকেও হার মানায়।

—–

— আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না, আপনি কি একটু সহজ ভাবে কথা বলতে পারেন না?

খানিকটা রেগে কথাগুলো বললো সানা। সানার কথা শুনে আরাভ বলে উঠলো,

— রেগে যাচ্ছেন কেন ম্যাডাম কুল কুল। আপনি রেগে গেলে চলবে?

সানা কথার অর্থ না বুঝতে পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলো

— মানে?

আরাভ মুচকি হেসে বলল

— মানে এখন ধরে এই বলতে চাইছিলাম ,যে মেয়ে ডেটে আসে তার ভাবীকে নিয়ে সে আর যাই হোক প্রেম করার যোগ্য না।

কথাটা শুনে সানা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো, রেগে গিয়ে বলল

— কি ভাবছেন টা কি আপনি, আমি কি স্টুপিড নাকি? আর কি সব ডেট ফেট এর কথা বলছেন হ্যাঁ? আপনাকে কে বলেছে এসব ফালতু কথা!

একটু থতমত খেয়ে সানা কথাগুলো বললো।

আরাভ খানিকটা হেসে দেওয়ালে গা এলিয়ে বললো

— কে বলেছে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! শোনো তুমি যেই কলেজে এতোদিন পড়ে এসেছো আমি সেই কলেজের প্রিন্সিপাল বুঝেছো তো?

সানা আগা মাথা কিছু না বুঝে বলল

— মানে কি? বুড়ো নাকি আপনি?

আরাভ দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো

— স্টুপিড তোমাকে শখ করে বলি নাই। তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক প্রেম হবে না। ডাফার একটা। ভাবীকে দেখেও তো শিখতে পারো নাকি, দেখো না ওনার মুখে কেমন প্রেমিকা প্রেমিকা ভাব থাকে।

কথাটা শুনে সানা কটকট করে বলল

— আরুও ভাইয়াকে অনেক ভয় পায় বুঝেছেন আর ও হলো দুষ্টু ভীষন, বিয়ে হয়েছে তবে ও বাচ্চাদের মতোই। আমার ভাইয়া বলেই সামলাতে পারে না হলে অন্য কেও হলে।

কথাটা বলে হঠাৎ সানা উপলব্ধি করলো যে কলটা আরাভ কেটে দিয়েছে অনেক আগেই। সানা কান থেকে ফোন নামিয়ে গজগজ করতে লাগলো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। বিরক্ত হয়ে বললো

— আরু কি রে লেট করছিস কেন আয়।

গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে সানা পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো আরিশ গাড়ি নিয়ে বার হচ্ছে আর আরু গাল ফুলিয়ে আছে, কোন বিষয় নিয়ে রেগে আছে বোঝা যাচ্ছে। ডাইনিং টেবিলে খাওয়া অবধি তো ঠিকই ছিলো তারপর আবার কি হলো ভেবেও আর ভাবলো না ও কারন আরু আর আরিশের এমন ক্যাটফাইট সারাদিন চলে। আরিশ গাড়ি থামাতেই সানা গাড়িতে উঠে বসলো, আরিশ কে প্রশ্ন করলো

— ভাইয়া আম্মু আর বাবা কবে ফিরবে জানিস?

আরিশ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল

— আসার কথা তো পরশু এবার ওরা যদি একদিন বেশি থাকে তো সমস্যা কি!

সানা আর কথা বাড়ালো না, আরুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাগ করে আছে। সানা আরুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল

— দোস্ত কোন সমস্যা?

আরু মাথা নাড়িয়ে বলল

— না।

সানা আর কিছু বললো না। আরিশ আরুর দিকে একবার তাকিয়ে ড্রাইভ শুরু করলো। আরূ জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো, আরিশের বিপরীতমুখে, আরুকে দেখে মনে হচ্ছে আজ আরু যেন দৃঢ় পণ করেছে যে আরিশের দিকে তাকাবে না। আরিশ সানাকে নামিয়ে দিয়ে আরুকে নামানোর জন্য সালিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে গেল, সেখান থেকে আরিশ ঢাকা মেডিকেল এ যাবে। আজকে ও ঢাকা মেডিকেল থেকে সলিমুল্লাহ মেডিকেল এ ট্রান্সফার নেওয়ার জন্য ব্যাবস্থা করবে তাই আজকে হয়তো ফিরতে দেরি হবে কিন্তু এসব বিষয়ে আরুকে কিছু জানায়নি আরিশ, সারপ্রাইজ দিতে চায় ও, আরু সামনে হয়তো আরিশ কে বলবে যে ও খুশি হয়নি কিন্তু মনে মনে নিশ্চয়ই খুশি হবে তা আরিশ বোঝে। আরিশ গাড়ি থামিয়েছে কলেজের সামনে, আরু বা আরিশ কেও কথা বলছে না একপ্রকার নিরবতা চলছে, সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে আরিশ বলল

— আরুপাখি কলেজে যাও, আই এম গেটিং লেট।

আরু আরিশের দিকে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে বলল

— আমার ফোনটা দিন।

আরিশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল

— ক্লাস শেষ করে নাও, লাঞ্চ টাইমে আমি আসবো তখন নিয়ে নেবো।

আরু তবুও শান্ত থেকেই বললো

— কলেজে আসার আগেও ফোন চেয়েছিলাম আপনি দেননি, এখন চাইছি তাও দিচ্ছেন না, সমস্যা কি আপনার?

আরিশ এবার রুক্ষ কন্ঠে বলল

— বললাম তো লাঞ্চ টাইমে দেবো। এনাফ, এখন যাও আর ডক্টর মিতার সাথে সামনা সামনি দেখা করে কথা বলে নিলেই তো এ এম এ সিন করার প্রয়োজন পড়ে না। যাও তোমার লেট হবে আরো দেরি করলে।

আরু আরিশের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল, দরজাটা জোরে ধাক্কা মারলো হয়তো আরিশ কে বোঝানোর চেষ্টা করলো সে রেগে আছে। মানুষ রাগ হলে এমনটাই করে। আরু হাটছে আর বিড়বিড় করছে

— আজ যদি তোর বাসায় আমি গেছি আবরার আরিশ তো আমার নাম ও আরুশি খান থুড়ি আরুশি রহমান না।

আরুর কলেজে ঢোকা অবধি আরিশ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিশ বিশ্বাস করে যে দিন শেষে সব রাগ আর মান অভিমান ভালোবাসা দিয়ে পূরন করা যায়।

#চলবে,,,