গোধূলীতে তুমি প্রিয় পর্ব-০৪

0
533

#গোধূলীতে_তুমি_প্রিয়
#পর্ব_৪(বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_রুবাইতা_রিয়া

সোফার উপর চোখ বুজে বসে আছে ইথান।কিছুতেই তার ঘুম আসছেনা।আজকের দিনটা জানো একটা সপ্নের মতন লাগছে তার কাছে।জীবনে প্রথমবার সে তার লাবুপাখি কে এতো কষ্ট দিয়েছে।ভাবতেই তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।হঠাৎ রুমের দরজায় নক পরতেই চমকে উঠলো সে।এতোরাতে কে এলো আবার?আর তার থেকেও বড় ভয় হলো যদি ইথানকে এই সময় এখামে কেউ দেখে নেয় তাহলে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে।ইথানের চিন্তার মাঝেই ওর মা দরজার ওপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-ইথান আমি এসেছি।দরজাটা খোল বাবা।

এতোরাতে মাকে এখানে আসতে দেখে বেশ অবাক হলো ইথান।তাতারি করে দরজা খুলে দিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো সে,,

ইথান—-মা তুমি এতো রাতে এখানে?সব ঠিক আছে তো?তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

ইথানের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তার মা রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।মায়ের এমন কাজে ইথান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো।ইথানের মা ইথানকে নিয়ে বিছানার উপর বসিয়ে দিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-সব ঠিক আছে।শুধু আমার ছেলেটায় ঠিক নেই।খুব কষ্টে আছে যে সে।আমি তো তার মা তাই সব বুঝি।

মায়ের এমন কথায় ইথান আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা।মায়ের কোলে মাথা রেখে তার হাতটা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ইথান—-আম্মু আমি ঠিক আছি।তুমি চিন্তা করো না প্লিজ।আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে??ঘুম আসছে না যে একদম।

ইথানের কথায় তার মা মুচকি একটা হাসি দিশে ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।আসলেই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ যদি থাকে তাহলে সে শুধু মা।হাজার কষ্টের সময় কেউ পাশে না থাকলেও মা ঠিক থাকে।মায়ের স্নেহ পেয়ে ইথানের প্রায় ঘুম চলে এসেছে ঠিক তখনই তার মা কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-আচ্ছা ইথান তুই কি একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?তোর বিয়ের দিনই তোকে ডক্টর রিমান ফোন করে বললো যে তুই কখনো বাবা হতে পারবিনা।এই কথাটা তো ওনি আগেও বলতে পারতো।তাহলে হয়তো আজ এতো বড় সিনক্রিয়েটটা হতো না।

হঠাৎ মায়ের কথায় ইথান চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো।কিছুক্ষণ মায়ের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ইথান—-তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো আম্মু?ক্লিয়ার করে বলতো?

ইথানের মা এবার কিছুটা আমতা আমতা করে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-দেখ ইথান,ডক্টর রিমান যে তোর বাবার খুব ভালো বন্ধু তা আমরা সবাই জানি।তাই তো ওনার মেয়ের ডেলিভারির সময় ব্লাডের প্রোয়জন হলে তুই এক কথায় রাজি হয়ে গেছিলি ব্লাড দিতে।রক্ত দেয়ার পর সব মানুষেরই শরীর দূর্বল লাগে কিন্তু পরে সেটা ঠিক হয়ে যায় আস্তে আস্তে।বাট তোর দূর্বলতা কিছুতেই সেরে উঠছিলো না যার জন্য তোকে কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছিলো তোর রিমান আঙ্কেল।এই পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু আমাদের নিজেদের হস্পিটাল থাকা সত্বেও ওনি জোর করে তোর টেস্টগুলো ওনার হস্পিটালে নিয়ে গিয়ে করালেন কেনো?তারপর আবার এই টেস্টগুলোর রিপোর্ট আজকেই দিলো তোকে যেখানে কিনা স্পষ্ট লেখা আছে তুই কোনোদিন বাবা হতে পারবিনা।আমার জানা মতে ওনি তোকে যেই টেস্টগুলো দিয়েছিলো সেগুলোর রিপোর্ট আসতে কিন্তু এতে সময়ও লাগে না।মানে আরো আগে টেস্টের রেজাল্ট আসার কথা।বাট এলো ঠিক তোর বিয়ের দিন।বিষয়টা বেশ অদ্ভুত নয় কি??

এতোক্ষণ মায়ের কথাগুলে মন দিয়ে শুনছিলো ইথান।তার মায়ের গোয়েন্দা ভাবটা এখনো যায়নি তাইতো সব বিষয় এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।ইথান মায়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,,

ইথান—-আম্মু তুমি একটু বেশিই সন্দেহ করছো।আসলে আঙ্কেলের মেয়েকে ব্লাড দিতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি তাই আঙ্কেল নিজে থেকে আমার ট্রিটমেন্টটা করাতে চেয়েছিলো।আর আঙ্কেল তো খুব বিখ্যাত একজন ডক্টর।অনেক পেশেন্ট আসে তার কাছে।খুবই ব্যাস্ত মানুষ।তায় হয়তো আমার রিপোর্টগুলো চেক করে দিতে ওনার এতো সময় লাগছে।তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করছো মা।এগুলো বাবা বাদ দেও আসল সত্যি তো এটাই যে আমি কখনো বাবা হতে পারবো না।

ইথানের মা—-চুপ কর ইথান।রিপোর্ট তো ভুল ও আসতে পারে।মানুষ মাত্রই তে ভুল হয়।আর তাছাড়া তোর মা আমিই।ছোটবেলা থেকে তোকে বড় করেছি।কখনো তোর মাঝে এমন কোনো সনস্যা দেখিনি আমি যাতে মনে হয় যে তুই কোনোদিন বাবা হতে পারবিনা।ইনফেক্ট তোর বাবাও তো একজন ডক্টর।নিজের ছেলের এমনটা হলে সেও তো বুজতো।আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ঘাবলা আছে।

মায়ের কথায় ইথান কোনো উত্তর দিলো না।একন এইসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না তার।আসলে তার মা একটু বেশি সন্দেহ করে।পুলিশে চাকরী দিলে ভালো হতো।এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে গেলো নিজেও টের পেলোনা।আসলে মায়ের কোলে শুলে এক অদ্ভুত শান্তি আসে যা শত কষ্টের মাঝেও আপনাআপনি ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

জানালা ভেদ করে সকালের মিষ্টি রোদের আলো লাবিবার মুখে পরতেই নড়ে উঠলো সে।আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো চারিদিকে।ভালোভাবে লক্ষ করে দেখলো ও মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে।ফ্লোরের টাইলসে রক্ত দেখতেই আঁতকে উঠলো সে।গতকালকে রাতের কথ ভাবতেই মনে পরলো যে সে নিশ্বাস নিতে না পেরে এখানেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলো।কোনোরকমে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের মুখের দিকে তাকাতেই কলিজার পানি শুকিয়ে এলো তার।নাকের সাইডে স্পষ্ট রক্তের ছোপ লেগে আছে।তাতারি করে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো সে।এই অবস্হায় বাহিরে গেলে সবাই নানারকম প্রশ্ন করবে যা মোটেও চাইছে না সে।রুমে এসে মুখ মুছতে মুছতে ফ্লোরের দিকে তাকাতেই একরাশ চিন্তা এসে ভর করলো তার মাথায়।আনমনেই বলে উঠলো সে,,

লাবিবা—-এখন এই রক্তের দাগগুলো কিভাবে উঠাবো আমি?রুমে এসে কেউ দেখে ফেললে আবারো ঝামেলা হবে।একেই সবার মন খারাপ তার উপর এই উটকো ঝামেলা।

লাবিবার মাথায় একটা আইডিয়া চলে এলো।কিছু না ভেবেই ঝট করে রুম থেকে বেড়িয়ে তার দরজা লক করে দিলো।এখন যেহেতু সকাল তাই কেউ হয়তো ঘুম থেকে উঠেনি।আস্তে আস্তে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো লাবিবা।তারপর একটা ডিটারজেন্টের বোতল নিয়ে চটপট সেখান থেকে কেটে পরতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে ইথানের মা সন্দেহের কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-এতো সকালে কিচেনে কি করছিস তুই লাবিবা?আর তোর হাতে ডিটারজেন্টের বোতল কেনো?🤨

পেছন থেকে বড় কাকিয়ার কথা শুনে লাবিবা কিছিটা চমকে উঠলো।পেছনে ঘুরে কিছুটা ঘাবরে গিয়ে বলে উঠলো,,

লাবিবা—-আসলে আমার ওয়াশরুমের ডিটারজেন্টটা শেষ হয়ে গেছিলো তাই আরেকটা নিতে এলাম কাকিয়া।

ইথানের মা—-ওহ!তা সার্ভেন্টকে বলতে পারতি।শুধু শুধু নিজে কেনো কষ্ট করে নিতে এলি?

লাবিবা—-ওই পানি খেতে এসেছিলাম তাই ভাবলাম আমিই নিয়ে যায়।কথাটা বলেই কোনোভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো লাবিবা।আর ইথানের মা কিছুটা অবাক হলো।সাধারণত লাবিবা কিচেনে তেমন একটা আসে না তাহলে আজ হঠাৎ ডিটার্জেন্টের বোতল নিতে কেনো এলো?আনমনেই বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-উফফ আমি হয়তো একটু বেশি সন্দেহ করছি।ইথান ঠিকই বলে।

লাবিবা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবে ঠিক তখনই ফারিহা সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো।লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পড়েছে সে।ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া যেখান থেকে টপটপ করে পানি পরছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য গোছল করে বেড়িয়েছে সে।

ফারিহাকে এভাবে দেখে লাবিবার ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।মনে হলো কেউ তার হৃদয়টা কাঁচের টুকরো দিয়ে বারবার আঘাত করে চলেছে।কাল রাতটা যে খুব ভালোই কেটেছে তাদের তা আর বুজতে বাকি রইলো না।লাবিবা এটা ভেবেই অবাক হচ্ছে কিভাবে একটা মানুষ তার বেস্টফ্রেন্ডের ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিয়ে তার সাথে একরাতেই এতোটা ঘনিষ্ঠ হতে পারে?ভাবতেই ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো তার।চোখের কোণে পানি নিয়েই দ্রুতো ফারিহাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে এলো সে।

অন্যদিকে ফারিহা লাবিবার এমন কাজে কিছুটা অবাক হলো।কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থেকে কিচেনে চলে গেলো সবার জন্য সকালের নাস্তা বানাতে।

লাবিবা রুমে এসে চোখের জল মুছতে লাগলো।কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলে উঠলো,,

লাবিবা—-যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তা জানো অন্যকেউ না পায়।আমার শত্রুও না।

আর কিছু না ভেবে ফ্লোরে ডিটারজেন্ট ছড়িয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পামি নিয়ে এলো সে।বালতিটা উচু করার সময় বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তার।অন্যসময় এমনটা হয়না কিন্তু আজ কি হলো বুজতে পারছে না।নিজের কাভার্ড থেকে পুরোনো একটা জামা নিলো সে।যদিও জামাটা খুব পুরোনো না।জামাটা পানিতে ভিজিয়ে ফ্লোরটা মুছতে রইলো।আস্তে আস্তে রক্তের দাগগুলো উঠে যাচ্ছে কিন্তু লাবিবার নিশ্বাস ও কেমন জানো ভারি হয়ে আসছে।নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর।তবুও খুব কষ্টে ফ্লোরটা মুছে ফেললো সে।বালতির দিকে চেয়ে দেখলো তার মধ্যে থাকা পানিটা লাল হয়ে গিয়েছে একদম।

সকাল ৮টা।বাড়ির সব ছেলে মেয়েরা নিচে খেতে চলে এসেছে।বাকিরা এখনো ঘুমুচ্ছে।আসলে ভার্সিটিতে যাবে তাই এতো তাতারি ওরা উঠে পড়েছে।মুলত ইথান আর ফারিহার বউ ভাতের অনুষ্ঠানে থাকতে চায় না বলে আজকেই ভার্সিটিতে যাচ্ছে তারা।নয়তো তাদেরকে ঠেলে গুতেও সেখানে পাঠানো যায় না।ইথানের মা ছেলে মেয়েদের এতো তাতারি উঠতে দেকে বেশ অবাক হলো।তবুও কিছু না বলে তাদেরকে খাবার দিলো।হয়তো রাতে খায়নি বলে এখন খুব সকালেই খিদে লেগে গিছে।

খাবার টেবিলে খেতে বসে ঘটলো আরেক বিপত্তি।একজন সার্ভেন্ট এসে ওদেরকে খাবার পরিবেশন করে দিলো।অর্থী যখনই একটা সেন্ডুইচ মুখে নিবে ঠিক তখনই ওর মা বলে উঠলো,,

—-আজকে জানিস ফারিহা সব খাবার নিজের হাতে বানিয়েছে।আমি কত করে বললাম নতুন বউ হয়ে এগুলো করা লাগবে না তবুও আমার কথা শুনলো না।বললো আজকে সবার জন্য ও নিজেই খাবার বানাবে।কত লক্ষী মেয়ে দেখলি!

অর্থীর কথাটা শুনেই জানো মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।এই ফারিহাকে এখন তার একদম সহ্য হয় না।সেন্ডুইচটা প্লেটে রেখে ধাক্কা দিয়ে প্লেটটা সরিয়ে দিলো সে।এখন যে এখানে খুব বড় সিনক্রিয়েট করবে অর্থী তা বেশ ভালোই বুজতে পারছে ইথানের মা।ঠিক তখনই অর্থী উঠে দাড়িয়ে রেগে চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

#চলবে??