গোধূলীতে তুমি প্রিয় পর্ব-০৫

0
524

#গোধূলীতে_তুমি_প্রিয়
#পর্ব_৫
#লেখানীতে_রুবাইতা_রিয়া

অর্থী—-আমাদের সবার কাছে ভালো সাজার জন্য এই নাস্তাগুলো বানিয়েছো তুমি তাইনা?তোমার মতন একটা সয়তান মনের মেয়ে আর কি বা করতে পারে।আমার মায়ের মাথাটা তো খেয়ে নিয়েছো এক দিনে এখন আমাদেরটা খাওয়ার চেষ্টা করছো তাইনা?লিসেন আমি সবার উদ্দেশ্যে বলছি এই বাড়িতে নেক্সট টাইম যদি এই মেয়েটার বানানো খাবার কেউ আমাকে খেতে দেয় তাহলে সেদিনই আমি এ বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাবো।এভরিবডি গট ইট!

কথাগুলো বেশ জোরেই বললো অর্থী।তার কতা শুনে ইথানের আম্মু একটু রেগে গিয়ে কড়া গলায় বলে উঠলেন,,

ইথানের মা—-অর্থী এগুলো কোন ধরনের অসভ্যতামী।ও তোমার বড়।রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলো।আর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে মানে কি এসবের?চুপচাপ খাবাটটা খেয়ে নেও।

অর্থী এবার আরো রেগে গিয়ে বলে উঠলো,,

অর্থী—-রেসপেক্ট!এই মেয়েটা কালকে যা করেছে তারপরও কি তোমার মনে হয় আম্মু যে ও রেসপেক্ট পাওয়ার যোগ্য।জানিনা কি করে এই মেয়েটা একদিনে তোমাকে বস করে নিয়েছে।এতোটাই বস করে নিয়েছে যে লাবিবার কষ্টটাও চোখে দেখতে পাচ্ছো না।একে নিয়েই মেতে আছো।আর আমি সত্যি হোস্টেলে চলে যাবো যদি এই মেয়েটার বানানো খাবার কেউ আমাকে নেক্সট টাইম খেতে দেয়।আর তোমার আদরের লক্ষী মেয়ের বানানো খাবারটা না হয় তুমিই খাও।

কথাগুলো বলেই গটগট করে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসলো অর্থী ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য।ইথানের মা আটকাতে গিয়েও আটকাতে পারলো না কারন তিনিই জানেন অর্থী রেগে গেলে কারোর কথা শুনে না।তিনি ফারিহার দিকে চেয়ে দেখলেন সে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।টেবিলে বসে থাকা বাকিদের উদ্দেশ্যে ওনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোবা বলে উঠলো,,

লোবা—-কাকিয়া আমার কলেজে দেরী হয়ে যাচ্ছে।আমায় যেতে হবে।আসি।

ইথানের মা—-আসি মানে?আজকে ফারিহা আর ইহানের বউভাত আর তুই কিনা কলেজ যাচ্ছিস??

লোবা—-ফারিহা আর ইহান মানে??

ইথানের মা এবার বুজতে পারলো যে ওনি মুখ ফসকে ইহান বলে ফেলেছে।তাতারি করে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-আরে ইথান হবে।আসলে দুই ভাইয়ের নামটা এতো মিলিয়ে রাখানো হয়েছে যে বলতে গেলে গুলিয়ে যায়।

ইথানের মায়ের কথায় লোবা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,,

লোবা—-কাকিয়া কালকে আমার আপুর বিয়ে ভেঙে গেছে।এরপরও কি তোমার মনে হয় যেই মেয়েটা আমার আপুর বিয়ে ভেঙেছে তার বউ ভাতের অনুষ্ঠানে আমি থাকবো??

লোবার কথায় ইথানের মা চুপ হয়ে গেলো।আসলেই তার এখন কিছু বলার ভাষা নেই।কিছু বলতে গেলে সত্যিটা বলে দিতে হবে যা মোটেও করা যাবে না এখন।কাকিয়ার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে লোবা আস্তে করে তার ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো।এইবার লাবিবার ছোট কাকুর ছেলে রুশান উঠে দাড়িয়ে বলে উঠলো,,

রুশান—-আসলে কাকিয়া আমার না কলেজে অনেক ইম্পর্টেন্ট একটা ক্লাস আছে।তারপর আবার একটা টেস্ট ও আছে।আজকে যেতেই হবে।অলরেডি অনেক দেরী হয়ে গিছে।এখন খেতে গেলে আরো দেরী হয়ে যাবে।আমি বরং ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নিবো।এখন আসি হ্যা।

রুশানের কথা শুনে ইথানের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এখন মনে হচ্ছে ফারিহা খাবারটা বানিয়েছে সেটা না বললেই ভালো হতো।অন্তত সবাই খেয়ে তো যেতো।আস্তে আস্তে লাবিবার বাকি কাজিনরাও নানা বাহানা দিয়ে না খেয়ে চলে গেলো।

ফারিহা এখনো চুপ করে দাড়িয়ে আছে।ইথানের মা এবার ফারিহার কাছে গিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-মন খারাপ করিস না মা।কেউ খায়নি তো কি হয়েছে,আমি খাবো।সবাই এখন তোকে ভুল বুজলে যেদিন সবাই আসল সত্যিটা জানতে পারবে সেদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।যখন সবাই জানতে পারবে তুই ইথানের না বরং এ বাড়ির মেজ ছেলে ইহানের বউ সেদিন সবাই অনেক খুশি হবে দেখিস।

ইথানের মায়ের কথায় ফারিহা কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো,,

ফারিহা—-কাকিয়া এই কথাটা তো আমরা এখনই বলে দিতে পারতাম।তাহলে সবাই এতো কষ্ট পেতনা।কিন্তু এ বাড়ির একটা বাজে নিয়মের জন্য এতো বড় খেলা খেলতে হচ্ছে আমাদের।

ইথানের মা—-হ্যা রে মা।ইথানের সাথে লাবিবার বিয়েটা আমরা আলাদা উপায়ে ও ভাঙতে পারতাম।তোর আর ইথানের এই বিয়ের নাটক টা করতে হতো না এট লিস্ট।বাট এই বাড়িতে এমন কিছু নিয়ম আছে যা আজকে আমাদের এতো বাজে একটা জায়গায় এনে দাড় করিয়েছে।আর ইথানের দিদুন যতদিন বেচে আছে ততদিন এই নিয়ম কেউ হয়তো ভাঙতে পারবে না।কথাগুলো বলেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো ইথানের মা।ফারিহা আর কিছুই বললো না।

লাবিবা সবকিছু পরিষ্কার করে ওয়াশরুমে গিয়ে একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে নিলো।আজকে সে কলেজ যাবে বলে ঠিক করলো।বাড়িতে বসে এইসব আর নিতে পারছে না সে।নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কলেজ যাওয়ার জন্য হলো রুম থেকে।দরজা লাগিয়ে সামনে হাটতেই ইহানকে ঘুমঘুম অবস্হায় ইথানের ঘর থেকে বেরোতে দেখেই চমকে উঠলো সে।মূলত লাবিবার রুমের ঠিক দুই রুম বাদেই ইথানের রুম যার জন্য যেতে আসতে সব সময় দেখতে পায় সে।মনে মনে ভাবতে লাগলো লাবিবা,,

লাবিবা—-এতো সকালে তো ইহান ভাইয়া উঠে না।তাহলে আজকে উঠলো কেনো।তারঅপর আবার ইথান ভাইয়ের রুমে কি করছিলো সে।বেশ অবাক হলো সে।আবার ভাবলো হয়তো কোনো কাজে এসেছিলো।ফারিহা তো আগেই ঘুম থেকে উঠে গিছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে চলে আসলো লাবিবা।

লাবিবা নিচে নামতেই ওর মা এসে ওকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলো।তারপর নিজের হাতে খায়িয়ে দিতে লাগলো।খাবার মাঝপথেই লাবিবার কাশি উঠতে শুরু করলো।মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো সে,,

লাবিবা—-মা আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না।জোর করো না প্লিজ।

লাবিবার মা আর ওকে জোর করলো না।মেয়েটার দিকে তাকাতেও তার কষ্ট হচ্ছে।বসে বসে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ঠিক তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন ইথানের বাবা।নিচে নেমে ফারিহাকে দেখেই তার মেজাজটা বিগড়ে গেলো।তবুও সেদিক না তাকিয়ে লাবিবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,

ইথানের বাবা—-লাবিবা তুমি আজকে আমার সাথেই হস্পিটালে যাবে।আজকে তো তোমাদের নতুন টিচারের সাথে প্রাকটিকাল ক্লাস আছে একটা।তাই বাড়িতে বসে নেকামি না দেখে নিজের পড়াশোনায় মন দেও।চলো এখন এখান থেকে।

ওনি লাবিবাকে নিয়ে চলে আসবে ঠিক তখনই ইথানের মা এসে বলে উঠলো,,

ইথানের মা—-আরে খেয়ে যাবেন তো নাকি?

ইথানের বাবা—-কাল থেকে তোমার আর তোমার ছেলের নাটক দেখতে দেখতে এমনিই পেট ভরে গেছে।এখন আর ক্ষিদে নেই।চল লাবিবা।কথাটা বলেই তিনি লাবিবাকে নিয়ে চলে গেলেন।

এতোক্ষণ লাবিবার ছোট কাকি আর ফারিহা দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো।ইথানের বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তাদের তাই চুপ ছিলো।ওনারা চলে যেতেই ইথানের ছোট কাকি বলে উঠলো,,

ছোট কাকি—-আমার এখানে থেকে কাজ নেই।আমি বরং আমার ছেলেটাকে গিয়ে ডেকে তুলি।এই ইহানটাও না।সারাদিন শুধু ঘুম আর ঘুম।এই ছেলেকে যে কবে বিয়ে দিবো আর বউয়ের মুখ দেখবো।নিজের পায়ে না দাড়ানো পর্যন্ত তো আবার বিয়েও দিতে পারবো না।কথাগুলো বলেই ওনি ইহানকে ডাকতে চলে গেলেন তার ঘরে।

ইথানের সকালেই ঘুম ভেঙে গেছিলো।তার ভালো লাগছিলো না তাই ছাদে গিয়ে একা একা প্রকৃতি অনুভব করছিলো।ঠিক তখনই লাবিবা আর তার বাবাকে নিচে গাড়ি নিয়ে বেরুতে দেখে বেশ অবাক হলো সে।তাতারি করে নিচে নেমে মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,

ইথান—-আম্মু, বাবা আর লাবিবা কোথায় গেলো এখন?

ইথানের মা রান্নাঘরে কাজ করছিলো।ছেলের কথা শুনে শান্ত ভাবেই উত্তর দিলো,,

ইথানের মা—-হস্পিটালে।তোর বাবার একটা ওটি আছে।কাল রাতে বলেছিলো।আর আজকে লাবিবাদের নতুন টিচারের প্রাকটিকাল ক্লাস আছে তাই সেও গিছে।তুই এখন এসব বাদ দে আর বউ ভাতের জন্য রেডি হ।

মায়ের কথা শুনে ইথান অবাক হয়ে বলে উঠলো,,

ইথান—-বউ ভাত মানে?

ইথানের মা—-হুম।বউ ভাতের অনুষ্ঠান হবে আজকে।বিয়ে হলে তো বউ ভাত হবেই।

ইথান—-নো ওয়ে।বউ ভাত কিছুতেই হবে না।আমার আর ফারিহার তে বিয়েই হয়নি।তাহলে কিসের বউ ভাত।আমি এখনই সবাইকে বলে দিচ্ছি যে কোনো অনুষ্ঠান হবে না।

মায়ের কোনো কথা না শুনেই ইথান তরিৎ গতিতে ড্রয়িং রুমে এসে সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো,,

ইথান—-এই সমস্ত লাইটিং খুলে ফেলো।আজকে কোনো অনুষ্ঠান হবে না।কোনো বউ ভাত হবে না।যেসব আত্মীয়রা আছে তাদের বাড়ি চলে যেতে বলো।গট ইট।

ইথানের কথা শুনে ওর ছোট কাকি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইথানের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো সে।চোখ দিয়ে জানো আগুন বের হচ্ছে তার।ইথান আর কোনো কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে রেডি হয়ে নিলো।তারপর হস্পিটালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো।

বাড়িতে সবাই আটকাতে গিয়েও কিছু করতে পারলো না।কারন ইথানের রাগের ব্যাপারে তারা সবাই জানে।ফারিহা ইথানের কাজে বেশ খুশিই হয়েছে।এট লিস্ট আজকের অনুষ্ঠানে যাদের আসার কথা ছিলো তাদের সামনে ইথানের বউ তো আর সাজতে হলো না।

এদিকে হস্পিটালে এসে যে এমন কিছু হবে তা ভাবতেই পারেনি লাবিবা।একটু সকালেই চলে এসেছে তারা তাই বেশি স্টুডেন্ট আসেনি এখনো।লাবিবা এখন নতুন স্যারের কেবিনে যাওয়ার জন্য হাটতে শুরু করলো।আসলে কিছু ফাইল দিয়েছিলো ইথানের বাবা স্যারকে দেয়ার জন্য।লাবিবা সেগুলো নিয়ে যেই না কেবিনে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই কেউ একজন এসে ওর হাতে জোরে কিছু একটা ফুটিয়ে দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।লোকটা মাস্ক পরেছিলো বিধায় তাকে চেনা যায়নি।হাতে কিছু ফুটে যাওয়াই লাবিবা চিৎকার করে উঠে।ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে।লাবিবার চিৎকার শুনে কেবিন থেকে ডক্টর রাহিক বেড়িয়ে আসে।সেই লাবিবাদের নতুন স্যার।কদিন হলো এই হস্পিটালে ডক্টর হিসেবে জয়েন করেছে।বেড়িয়ে এসে লাবিবার হাত থেকে রক্ত পরতে দেকে তাতারি করে ওর হাতটা চেপে ধরে সে।ঠিক তখনই ইথান এসে রাহিককে লাবিবার হাত ধরে থাকতে দেখে রেগে যায়।রাগে কপালের রগ ফুলে উঠে তার।চোখ দিয়ে এবার মনে হয় রাহিককে ঝলসে দিবে সে।কোনোকিছু না ভেবেই রাহিকের কাছে গিয়ে ওর কলার ধরে জোড়ে একটা ধাক্কা দেয় ইথান,,,

#চলবে??