গোধূলীতে তুমি প্রিয় পর্ব-০৯

0
475

#গোধূলীতে_তুমি_প্রিয়
#পর্ব_৯
#লেখিকা_রুবাইতা_রিয়া

ইথান একবার লাবিবার দিকে অসহায় ভাবে তাকায় যা দেখে লাবিবা মুখ ফিরিয়ে নেই।ইথান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে একে বলতে শুরু করে,,

ইথান—-বিয়ের দিন সকালেই আমার ফোনে একটা মেসেজ আসে রিমান আঙ্কেলের।তার সাথে জানো আমি যত দ্রুত সম্ভব দেখা করি।অনেক জরুরি কথা আছে নাকি তার।আমিও তাই মাকে বলে তার সাথে দেখা করতে যায়।কিন্তু গিয়ে জানতে পারি সে আমাকে আমার রিপোর্ট দেয়ার জন্য ডেকেছিলো।রিপোর্ট দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো কারন সেখানে লেখা ছিলো আমি কোনোদিন বাবা হতে পারবো না।নিজের বিয়ের দিন এমন কোনো খবর পেলে যে কারোরই অবাক হওয়ার কথা।আমার মাথায় তখন একটা কথায় ঘুরছিলো যে করেই হক লাবিবার সাথে আমার বিয়েটা ভাঙতে হবে নয়তো ওর ভবিষ্যত একেবারে নষ্ট।আমার মাথায় কিছু আসছিলো না তাই মাকে ফোন করে সবকিছু বলি।আম্মু তো আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছিলো না।পরে আমাকে বললো আগে জানো বাড়িতে আসি আমি।আমি গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়িতেই আসছিলাম ঠিক তখনই আমাকে ইহান ফোন করে বলে ও নাকি ফারিহাকে বিয়ে করেছে।যত তাতারি সম্বব আমি জানো ম্যারেজ রেজিষ্ট্রি অফিসে যায়।আমার মাথায় কাজ করছিলো না তখন কি করবো।কারন আমাদের বাড়িতে ছেলেদের বিয়ে করার জন্য শর্ত আছে।প্রথমত আগে ছেলেকে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে।নিজের ফিউচার সেটেল্ড করতে হবে।তাকে প্রফেশনালি টাকা উপার্জন করতে হবে।তারপর সে বিয়ে করতে পারবে।এর আগে যদি সেই ছেলে বিয়ে করে তাহলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।ইহান আমার নিজের ভাই না হলেও চাচাতো ভাই তো।ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি আমরা।আমি কখনোই চাইতাম না যে ও এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক।তাছাড়া ও এখনো স্টুডেন্ট।বাড়ি থেকে বের করে দিলে ও কি করতো,কিভাবে থাকতো?তাই আমি ভেবেছিলাম ওদের এই বিয়েটা লুকিয়ে রাখবো যতদিন পর্যন্ত না ইহান নিজের ফিউচার সেটেল্ড করছে।তাই আমি ফারিহার সাথে মিথ্যে বিয়ের নাটক করি সবার সামনে।এতে কেউ ইহান আর ফারিহার উপর সন্দেহ করবে না আর লাবিবাও আমাকে মন থেকে ঘৃণা করতে শুরু করে দিবে।আমার থেকে দূরে সরে যাবে আর নিজের জীবন নিজের মতন করে গুছিয়ে নিবে।তারপর ইহান যখন নিজের পায়ে দাড়িয়ে যাবে তখন সবাইকে সত্যিটা বলে দিবো ভেবেছিলাম আমি।আমার কাছে তখন মনে হয়েছিলো এটাই বেস্ট উপায় লাবিবার মনে আমার জন্য ঘৃণা সৃষ্টি করার।পরে আমি মাকে ফোন করে সবকিছু বুঝায়।মা তখন আমার কথায় রাজি হয়ে যাই।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো ইথান।তার কথা শুনে সবাই স্তব্দ হয়ে গেছে।লাবিবার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।ধীর পায়ে সে ইথানের সামনে গিয়ে ওর সার্টের কলার ধরে রেগে কটমট করে বলে উঠলো,,

লাবিবা—-আপনি একবার বলতে তো পারতেন সবকিছু আমাকে।সবাই মিলে ডিসিশন নিতাম।কিন্তু আপনি সেটা না করে একা একা এতো বড় একটা নাটক করলেন শুধুমাত্র আমার মনে আপনার জন্য ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য।কিন্তু আপনি কি জানেন এই কয়দিনে আমার মনে আপনার জন্য ঘৃণার বদলে অভিমান বেশি জন্মেছে।প্রতিটা মুহূর্ত কষ্টে কেটেছে।এমন কষ্ট যেটা আমি কারোর সাথে শেয়ার করতে পারিনি।একা একা ডুকরে কেঁদেছি।বারবার মনে হতো কেউ আমার হৃদয়টাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে।প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারোর সাথে দেখার কষ্ট কেমন সেটা যে দেখছে সেই বুঝছে।আপনি আমার থেকে অনেক বড় সত্যি লুকিয়েছেন।আর সত্যি লুকানো আর মিথ্যা বলা দুটোই সমান অপরাধ।আপনিও আপনার এই অপরাধের শাস্তি ঠিক পাবেন একদিন।আপনিও একদিন প্রিয় মানুষটাকে হারানোর জ্বালা বুঝবেন।আমার মতন প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে শেষ হবেন।

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে সেখান থেকে দৌড়ে লাবিবা নিজের ঘরে চলে গেলো আর কিছু না শুনেই।ইথান এখনো মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় দাড়িয়ে আছে।কিছুক্ষন ড্রইং রুমে নিরবতা বিরাজ করলো।ইথান নিজেই এই নিরবতা ভেঙে সবার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

ইথান—-আমার মনে হয় না আমি যা করেছি তা ভুল ছিলো।আমার সাথে বিয়ে করলে লাবিবা কোনোদিন মা হতে পারতো না।আর আমি আমার ভাইকেও কখনো কষ্টে দেখতে চায়নি।তাই সবদিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।দেখো দিদুন তোমরা তো সবটা জেনেই গেছো।এখন প্লিজ ফারিহা আর ইহানকে মেনে নেও।আমি আর নিতে পারছি না এইসব।জাস্ট অসয্য লাগছে।

ইথানের কথা শুনে তার দিদুন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,,

—-ইথান একজন ভাই হিসেবে যেটা করছে সেটা একদমই ঠিক করছে।কিন্তু আমাদের সবটা বলতে পারতো একবার।সবকিছু লুকিয়ে সবাইকে কষ্ট দিয়েছে সে।বিশেষ করে লাবিবাকে।তবুও ওর কথা বাদ দিলাম কারন ও পরিস্থির চাপে সবটা করছে।কিন্তু ইহান তো সবকিছু জেনে বুঝে করছে।শুধুমাত্র ইথান দাদুভাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ফারিহা আর ইহানকে মেনে নিলাম।কিন্তু ইহানের এমন কাজের জন্য আমি কখনোই ওকে ক্ষমা করবো না।বাড়িতে ইহান আর ফারিহার রিসিপশনের ব্যাবস্হা করো সবাই।সবার সত্যিটা জানা দরকার।

ইথান ওর দিদুনের কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।ইথান ওর দিদুনের সাথে খুব ক্লোজ।ইথানের দিদুন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।অন্যদিকে ইহানের প্রচুর রাগ লাগছে।এই লাবিবা তাদের ম্যারেজ সার্টিফিকেট না দেখলে আজ এতো কিছু হতো না।এখন তো লাবিবা আর ইথানের মাঝে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।সবাই আবার এই ইথানেরই সুনাম করবে যেটা তার একদমই অসয্য লাগে।

ইথান ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

ইথান—-এইবার খুশিতো তুই?দেখ সবাই তোকে আর ফারিহাকে মেনে নিয়েছে।আর তুই এ বাড়িতেই থাকবি।আমার ভাই আমার কাছেই থাকবে।কথাটা বলেই ইথান ইহানকে জড়িয়ে ধরলো।আসলে ইথানের নিজের কোনো ভাই নেই।তাই ইহানকে সে খুব ভালোবাসে।নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি।

ইহানও ইথানকে জড়িয়ে ধরলো।বাড়ির বড় যারা আছে তারা এখনও চুপ করে আছে।সবাই ইথান আর ফারিহার বিয়ে হয়নি কথাটা শুনে যেমন খুশি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ইথান বাবা হতে পারবে না শুনে আরো বেশি কষ্ট পেয়েছে।কেউ জানো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।ইথানের কাজিন যারা ছিলো তারা তাদের সকালের করা মিসবিহেভ টার জন্য অনুতপ্ত বোধ করলো।ইথান আর ফারিহার বিয়ে হয়নি শুনে খুশিও হয়েছিলো।কিন্তু ইথান বাবা হতে পারবেনা শুনে তাদের মুখের হাসিটা নিমেষেই বিলিন হয়ে গেলো।ইথান বুঝতে পারলো সবার মন খারাপের কারনটা।

তখন ইথান সবার উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠলো,,

ইথান—-আমি জানি তোমাদের মন খারাপের কারনটা।আমি বাবা হতে পারবো না শুনে তোমরা মন খারাপ করছো তাই না?কেু হয়তো বিশ্বাস ও করতে পারছো না।আমিও জানো প্রথমে এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।তাই তো পুরো শিওর হওয়ার জন্য আজকে আবারো টেস্ট করায়।আর টেস্টের রিপোর্টে কি আসছে জানো?

সবাই ইথানের কথা শুনে আশ্চর্য হলো।অধীর আগ্রহে তার কথা শোনার জন্য চেয়ে রইলো।আর ইহানের তো সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।এই ইথান যে চালাকি করে রিপোর্ট করাবে আবার তা সে ভাবতেই পারেনি।ইহান অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,,

ইহান—-কি আসছে রিপোর্টে?

ইহানের কথা শুনে ইথান একটা ডেভিল হাসি দিয়ে বলে উঠলো,,

ইথান—-রিপোর্ট এখনো আসেনি।তিনদিন পর আসবে।আর আমার মনে হয় এইবারের রিপোর্টে পজেটিভ কিছুই আসবে।রিমান আঙ্কেলের রিপোর্ট হয়তো ভুল ছিলো তোমরা সবাই ধৈর্য ধরো আর ইহানের রিসিপশনের জন্য আয়োজন কটা শুরু করো।আমি চায় না আমার ভাইয়ের রিসিপশনে কেউ মন মরা হয়ে থাকুক।

ইথানের কথা শুনে সবার মনেও একটা আশার আলো জাগলো।সবাই খুশি মনেই ইহান আর ফারিহার রিসিপশনের আয়োজন করতে শুরু করলো।ইথানের বাবা আর দিদুন এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।অর্থী এসে ওকে আর ফারিহাকে সরি বললো।ফারিহার কাছে তো সবটা স্বপ্নের মতন লাগছে।তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কতটা খুশি।ইথানের দিদুন তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,

দিদুন—-লাবিবা দিদিভাই খুব আঘাত পেয়েছে রে।তুই ওর কাছে গিয়ে ওকে একটু সামলা।

দিদুনের কথায় ইথান একটা চোখ টিপ দিলো ওর দিদুনকে।ইথানের দিদুনও ওকে একটা চোখ টিপ দিলো।ইথান ডাইনিং টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখানো দু প্লেট খাবার নিয়ে লাবিবার রুমের উদ্দেশ্যে যেতে গিয়েও ইহানকে দেখে থেমে গেলো।ওর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,

ইথান—-কিরে মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতন করে রেখেছিস কেনো?তোর তো খুশি হওয়ার কথা।সবকিছু ঠিক হয়ে গেলো।এবার শুধু আমার রিপোর্ট আসার পালা আর আমার লাবু বেবির সাথে বাসর করার পালা🙈🙈।

ইথানের কথা শুনে ইহান জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,,

ইহান—-কোন হস্পিটালে আবার গিয়েছিলি টেস্ট করাতে?

ইহানের কথায় ইথান একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,,

ইথান—-কেনো রে?আমার রিপোর্ট ভুলভাল বানাবি নাকি??

ইথানের এমন কথায় চমকে উঠলো ইহান।চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে সে ইথানের দিকে।ভিতু কণ্ঠে বলে উঠলো সে,,

ইহান—-এইগুলো কি বলছো তুমি ভাইয়া?আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।

ইহানের কথায় ইথান হো হো করে হেসে দিলো।ইহানের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো,,

ইথান—-আমি তো মজা করছিলাম।তুই ভয় পেলি নাকি আবার?

ইথানের কথায় ইহান এবার ঘামতে শুরু করলো।ইথান ঠোঁটের কোণায় একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে লাবিবার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো,,,

#চলবে??