চিলেকোঠার প্রেম পর্ব-০২

0
652

#চিলেকোঠার_প্রেম
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব_২

জানালা দিয়ে দূরের দশতলা ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে সায়েন। সময়টা তার পার হচ্ছে না যেন। তাই সে ভবনের দিকে তাকিয়ে আছে। শাফিন সকালেই ভার্সিটি চলে গেছে। ক্লাস করে সেখান থেকে অফিসে যাবে। সায়েনের বাবা শফিকুল ইসলাম তার চেম্বারে চলে গেছে। এখন বাকি সায়েনের মা জয়নব বেগম। তিনি একটু পর বাজারে যাবেন। সেই ফাঁকে সায়েন ছাদে চলে যাবে। পেট ব্যাথার দোহাই দিয়ে আজকে কলেজে যায়নি সায়েন। রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
আর বাইরের সব কিছু দেখছে। ওদের বাড়ির চারপাশে বড়বড় সব ভবন। শুধু ওদের বাড়িটাই একতলা। এটা শফিকুল ইসলামের নিজস্ব বাড়ি। বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার।
সায়েন আস্তে করে দরজা খুলে উঁকি দিলো। জয়নব বেগমকে আশেপাশে দেখতে না পেয়ে তার রুমে গিয়ে উঁকি দিলো। জয়নব বেগম রেডি হচ্ছেন বাইরে যাওয়ার জন্য। সায়েন দ্রুত নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লো। কারণ এখনই মা আসবে ওকে দেখতে। তাই হলো, জয়নব বেগম সায়েনের রুমে এসে বললেন, ‘সায়ু আমি বাজারে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ করে দে!!আর চুপচাপ শুয়ে থাকবি। আমি আসার সময় তোর বাবার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসবো।’
সায়েন অসুস্থতার ভান করে মাথা নাড়লো। জয়নব বেগম বেরিয়ে যেতেই সায়েন দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছুটলো মায়ের রুমে। ছাদের চাবি নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। চিলেকোঠার ঘরের দরজা খুলতেই চোখ কপালে সায়েনের। ছেলেটা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। সায়েন দ্রুত ছেলেটার পাশে বসে বলল,’কি হয়েছে আপনার??মাথা ব্যথা করছে??অসুস্থ লাগছে??কিছু লাগবে??’
সায়েনের কথা শুনে ছেলেটা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,’অনেক কিছু হয়েছে। আগে আমি ওয়াশরুমে যাব। অনেক এমার্জেন্সি।’

সায়েন তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে নিয়ে নিচে নামলো। নিজের বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো।

তখন খাওয়ার সময় কোকিলের ডাক শুনে সায়েনের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ছেলেটা যে তাকে ডাকছে। কিন্তু সে যেতে পারছে না। শফিকুল ইসলাম অবাক হয়ে বললেন,’এই অবেলায় কোকিল কোথা থেকে আসলো??আর এখন তো নভেম্বরের শুরু। শীত কালের পর বসন্ত কাল। তখন কোকিল ডাকবে। কিন্তু এখন কোকিল ডাকছে কেন??’

সায়েনের তো হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়েছে। মা রান্নাঘরে তাই সে কিছু শোনেনি।সায়েন কম্পিত কন্ঠে বলল,’ক কে বলেছে যে ক কোকিল শুধু বসন্ত কালে ডাকে??অন্য ঋতুতে কি সে ডাকতে পারে না নাকি??ভুল ভাবছো তুমি। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। নাহলে মা এসে যদি দেখে তাহলে জোর করে খাওয়াবে।’
শফিকুল ইসলাম মাথা নেড়ে বললেন,’ওহ হ্যা আমার তো আবার চেম্বারে যেতে হবে।’
তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। খাওয়া শেষে চলে গেলেন। সায়েনও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু তারপর আর সে কোকিলের কন্ঠে ডাকেনি। এতে সায়েন প্রশান্তির শ্বাস ফেললো।

দরজা খোলার শব্দ অতীত থেকে ফিরে আসে সায়েন। ছেলেটা এলোমেলো পায়ে হেঁটে এসে খাটের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। সায়েন চকিতে তাকিয়ে বলল,’একি!!!কি করছেন?? শুয়ে পড়লেন কেন?? আমার মা একটু পরেই এসে পরবে। তাড়াতাড়ি চিলেকোঠার ঘরে ফিরে যান।’

ছেলেটা খুবই ক্লান্ত। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লান্ত দৃষ্টিতে সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’ওই ঘরে কি মানুষ থাকে??’

সায়েন অকপটে জবাব দিলো,’আগে থাকতো না তবে এখন থাকে। আর সেটা হলো আপনি।’
ছেলেটা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি ওখানে থাকবো কিভাবে??দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। এখানে কিছুক্ষণ থাকি না??’

‘এই না না। মা এখুনি চলে আসবে। উঠুন উঠুন। এই যে শুনছেন??’

ছেলেটা উঠে বসে বলল,’আমি আমার জন্য একটা নাম ঠিক করেছি।’
সায়েন চোখ কুঁচকে তাকালো। ছেলেটা ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আরাদ!!কেমন হয়েছে নামটা।’

টেনশনের মধ্যে থেকেও সায়েন হেসে ফেললো। কারণ ছেলেটার হাসিটাও মন কাড়ার মতো। আপাতত এসব চিন্তাভাবনা সাইডে রেখে বলল,’খুব সুন্দর নাম রেখেছেন। তো মিস্টার আরাদ আপনি চিলেকোঠার ঘরে ফিরে যান নয়তো আমি শেষ।’

আরাদ অস্থির হয়ে বলল,’কিন্তু আমার খিদে পেয়েছে। কাল থেকে কিছু খাইনি।’

‘ওহ!!ওয়েট আমি খাবার আনছি।’ সায়েন রান্নাঘরে গিয়ে দুটো রুটি আর ভাজি আনলো। সাথে একটা ডিম ভেজে আনলো।এসব দেখে আরাদ মুখ কুঁচকে নিলো। কারণ সে এসব খাবার খায় না। ব্রেড ডিম বা স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার খায়। কিন্তু কিছু করার নেই। সে খেতে লাগল। সামনেই সায়েন গালে হাত দিয়ে বসে আরাদের খাওয়া দেখতেছে। আরাদ খেতে খেতে সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানলাম না। নাম কি আপনার??কিসে পড়েন??’

আরাদের কথায় সায়েন কিন্ঞ্চিৎ হাসলো। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার আরাদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমার নাম সানজিদা ইসলাম সায়েন। ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাবা মা আর ভাইয়ার সাথে এখানেই থাকি।’
আরাদ টেবিলে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে শব্দ করে গ্লাসটা রেখে বলল,’ডক্টর হওয়ার ইচ্ছা???’
আরাদের কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো সায়েনের। সে বলল,’হঠাৎ এই প্রশ্ন??’

আরাদ খানিকটা হেসে বলল,’না মানে আমার হাত পা মাথায় যেভাবে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন তাই বললাম। একজন ডক্টরের থেকেও ভালো ব্যান্ডেজ করেছেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
সায়েন বড় একটা দম ফেললো। খাটের উপর থেকে বালিশটা নিয়ে কোলের উপর রেখে বলল,’ডক্টর হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার বাবা একজন ডক্টর। সামনের বাজারে একটা ফার্মেসির দোকান আছে বাবার। সেখান থেকেই চিকিৎসা করেন। বলতে পারেন ছোটখাটো ডক্টর। তাই আমি ডাক্তারির টুকিটাকি কাজ পারি ওই আরকি।’

আরাদ আবার বলল,’ওহ!!ডক্টর হওয়ার ইচ্ছা নেই। তাহলে কি হতে চান??’

সায়েন আবার হাসলো আরাদের কথায়। তারপর বলল,’আমি ভবিষ্যৎ এ কি হবো তা আমি ঠিক করতে পারব না। সেটা সম্পূর্ণ আমার মায়ের উপর ডিপেন্ড করে। মা চায় আমি সাইকোলজিস্ট হই। আমি তাই করছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা আমি ফ্যাশন ডিজাইনার হবো। ছোটবেলা থেকে এটাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। এমনকি ভাইয়ার ও নেই। ভাইয়া একজন ফটোগ্রাফার হতে চায়। ফটোগ্রাফি খুব পছন্দ করে ভাইয়া। কিন্তু মায়ের এক কথা ভাইয়া পড়াশোনা শেষ করে যেন ব্যাংকে চাকরি নেয়। তবে আপাতত ভাইয়া একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। পনের হাজার টাকা বেতন পায়। সাথে পড়াশোনাও কন্টিনিউ করছে।’

সায়েনের কথায় বড়সড় ধাক্কা খায় আরাদ। এটা কেমন পরিবার??মায়ের কথায় সবাই ওঠে বসে!!!তাহলে ওর মা নিশ্চয়ই জল্লাদ প্রকৃতির হবে। আরাদ বিড়বিড় করে বলে,’কি মা?? আমার বাড়িতে তো আমার মুখের উপর একটা পাখিও কথা বলতে পারে না।’

সায়েন একটু ঝুঁকে বলল,’কিছু বললেন??’

‘নাহ!!!অদ্ভুত পরিবার আপনার। আচ্ছা চলুন আমাকে ওই ঘরে দিয়ে আসুন। কষ্ট হলেও থাকতে হবে।’

আরাদ উঠে দাঁড়ালো সাথে সায়েন ও। আরাদ বলল,’আচ্ছা আপনি তো আমার ছোট। দেখতেই বোঝা যাচ্ছে। তুমি করে বলতে পারব তো??’
সায়েন মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,’হুম।’

‘আর কখন দেখা করবে আমার সাথে??’

‘দিনে সময় হবে না। রাতে দেখা করব সবাই ঘুমিয়ে পড়লে।’
আরাদের চোখে বিষ্ময় নেমে এলো। অবাক হয়ে সে বলল,’এতোক্ষন আমি একা থাকব?? আমার যদি এমার্জেন্সি কল আসে তখন কি করব??’
আরাদের কথায় লজ্জা পেলেও হেসে ফেললো সায়েন। এই ছেলের দেখি লজ্জা শরম কম। সায়েন হাসি থামিয়ে বললো,’নাম্বার এক হলে ছাদেই কাজ চালিয়েন। আর নাম্বার দুই হলে কোকিলের সুর ধইরেন তাহলেই হবে। আর হ্যা দুইবারের বেশি ডাকবেন না। আর দিনের বেলায় ছাদে হাঁটাহাঁটি করবেন না। আশেপাশের বিল্ডিং গুলোর কাকিরা সব সিসি ক্যামেরা। খবর ছড়াতে এক সেকেন্ড টাইম নেবে না।’

আরাদ মাথা দোলায়। পরক্ষণেই কিছু মনে পড়তেই সে বলে,’চিলেকোঠার ঘরে খুব মশা। কাল রাতে তো মশা মারতে মারতে আমার জান শেষ।’
‘আচ্ছা আমি কয়েল দিয়ে আসব। এখন তাড়াতাড়ি যান।’
আরাদ চিলেকোঠার ঘরে ঢুকতেই সায়েন দরজা ভেজিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি ছাদের দরজায় তালা মেরে চাবি মায়ের রুমে রেখে এলো। বিছানায় বসে বসে ভাবছে পরবর্তীতে কিভাবে ছাদে যাবে সে??এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ছাদে গেলে ওর মা কিছু না বলে। কিন্তু কিভাবে যাবে??মেজাজ টাই গরম হয়ে গেল সায়েনের। খাটের উপর বসে সে আরাদের কথা ভাবতে লাগলো।

কলিং বেলের শব্দে হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে দিল সায়েন। বাজারের ব্যাগ ভর্তি করে এসেছেন জয়নব বেগম। সায়েন মায়ের থেকে ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে রাখলো। একগ্লাস পানি নিয়ে সে মা’কে দিলো। জয়নব বেগম পানি খেয়ে জোরে শ্বাস ফেলে বললেন,’মানুষের গলা হচ্ছে গাছের মতো। পানি দিলে ভিজে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার শুকিয়ে যায়।’

মায়ের কথা শুনে সায়েন হাসলো। হঠাৎ মনে পড়ল গাছ!!হ্যা একমাত্র গাছই পারবে ছাদে যাওয়ার পথ বেছে দিতে। কিন্তু এখন গাছ কোথায় পাবে সায়েন??হাতে তো তেমন টাকাও নেই গাছ কেনার!! কিছু একটা ভাবতে ভাবতে সায়েন রুমে চলে গেল।

আজ সারাদিন রুম থেকে বের হতে পারলো না সায়েন। কারণ মা’কে তো দেখাতে হবে যে সে অসুস্থ। তাই সুস্থ হয়েও অসুস্থতার অভিনয় করতে হচ্ছে তাকে। সারাদিন কেটে গেল কিন্তু সায়েন আরাদের কাছে একটুও যেতে পারলো না। মা’কে উপেক্ষা করে যেতে সে পারবেই না। জয়নব বেগমের চক্ষু জোড়া সিআইডি ফেল। তাই সারাদিন ছটফট করে কাটিয়ে দিল সায়েন। রাত হতে ছটফটানি আরো বেড়ে গেল। কারণ আরাদ সারাদিন না খেয়ে আছে। এইভেবে সায়েন ও কিছু মুখে তুলতে পারলো না। অসুস্থের অজুহাত দিয়ে খেল না সে।
রাত সাতটার পরে শাফিন আসলো। নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে সে ফোন চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সায়েন মায়ের রুমে উঁকি দিলো। জয়নব বেগম ব্লাউজ সেলাই করছে। খুশি হয়ে সায়েন শাফিনের রুমে গেল। শাফিন সায়েনকে দেখেও না দেখার ভান করে ফোন টিপতে ব্যস্ত। সায়েন গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। শাফিন বিরক্ত হয়ে সায়েনের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি হয়েছে কিছু বলবি??’
সায়েন দাঁত বের করে হেসে বলল,’টাকা লাগবে!!!’

শাফিন ওয়ালেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলে,’এই নে!!!’
সায়েন টাকাটা হাতে নিয়ে বলে,’উহু একশ টাকায় কিছু হবে না। আমার এক হাজার টাকা লাগবে।’
সায়েনের এমাউন্ট শুনে বড়বড় চোখে তাকিয়ে শাফিন বলল,’এতো টাকা দিয়ে কি করবি তুই??’
সায়েন কটমট করে শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে,’সেটা দিয়ে তুই কি করবি?? আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছিস কোন সাহসে??’

শাফিন গলা ঝেড়ে বলে,’আমি এতো টাকা দিতে পারব না। একশ টাকা নিলে নে না নিলে ভাগ এখান থেকে।’
সায়েন একশো টাকার নোট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,’ওহ আচ্ছা?? তাহলে ফুচকা খাওয়ার ছবিটা কি মা’কে দেখাবো নাকি??’

শাফিন ফোন ফেলে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘দেখ বোন আমার এরকম করিস না। আমার কাছে এতো টাকা নেই।’

সায়েন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাফিন উপায় না পেয়ে একহাজার টাকার চকচকে নোট বের করে সায়েনের হাতে দিল। সায়েন টাকাটা নিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কস শাফিন ইসলাম।’
শাফিন মুখটা গোমড়া করে বেলে,’এখন ওই একশো টাকা দে??’

সায়েন মুখ বাঁকিয়ে বললো,’সরি!! এতক্ষণ ধরে আমার সাথে বেয়াদবি করার জন্য একশ টাকা জরিমানা করা হয়েছে তোকে। আসি হ্যা??’
সায়েন দুষ্টু হাসি দিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেছে। শাফিন কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে উঠলো,’এমন বোন থাকলে শত্রুর দরকার হয় না। কোথায় ভাইকে হেল্প করবে তা না করে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নেয়।’
রাগে গজগজ করতে করতে শাফিন ফোন হাতে নিলো। দুমাস আগে গার্লফ্রেন্ড এর সাথে ফুচকা খাওয়ার সময় সায়েন দেখে ফেলেছিল। শুধু দেখেনি বরং কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছে। এখন সেটা নিয়েই রাতদিন ব্ল্যাকমেইল করে বেড়ায়।আগে কথায় কথায় সায়েনের মাথায় চাটি মারতো কিন্তু এখন সায়েন মারে। এই দুঃখ শাফিন কোথায় লুকাবে??

সায়েন টাকা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। এগারো শত টাকা পেয়ে সে খুব খুশি। একশ টাকা দিয়ে সে চকলেট কিনবে আর একহাজ টাকার গাছ কিনবে। ব্যাস হয়ে গেল হিসাব। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে সায়েনের।

গভীর রাত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সায়েন প্লেটে খাবার বেড়ে ঢেকে নিলো। পানির বোতল হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ছাদে গেল। খুব সাবধানে দরজা খুলে এগিয়ে গেল চিলেকোঠার ঘরে। দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে তড়িঘড়ি করে ফোনটা লুকিয়ে ফেলে আরাদ। সে বুঝতে পারে যে সায়েন এসেছে। সায়েন নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আরাদ পা ভাঁজ করে মেঝেতে বসে আছে। সায়েন খাবারের প্লেট আর পানির বোতল তোশকের উপর রেখে বলল,’কোন সমস্যা হয়েছে??এমার্জেন্সি কল??’

আরাদ মুচকি হাসলো। চিলেকোঠার ঘরে কোন আলো নেই। সায়েনের ফোনের ফ্লাশ অন করা। সেই আলোতে আরাদের মুচকি হাসি দেখে আরেকদফা ক্রাশ খেলো সায়েন। আরাদ বলল,’নাহ!! আপনার কথামত ছাদেই কাজ সেরেছি।’

সায়েন নাক কুঁচকে বলল,’ইয়াক থু। আচ্ছা আপনি ছাদে বের হয়েছিলেন কেন??কেউ দেখেনি তো???”
আরাদ মাথা নেড়ে বলল,’সন্ধ্যার পর বের হয়েছিলাম। সারাদিন কিছু খাইনি তাই এমার্জেন্সি কল আসবে কিভাবে বলো??’

সায়েন আবার লজ্জা পেল। মাথা নুইয়ে বলল,’মেমোরি লস হয়ে আপনার লজ্জা শরম সব ডুবে গেছে দেখছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। আমি রুমে চলে যাব।’

কিছু একটা ভেবে সায়েন আরাদের কপালে হাত দিয়ে শিউরে উঠে বলে,’একি আপনার দেখি ভিশন জ্বর। আপনি খেতে থাকুন আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।’
সায়েন দ্রুত নিজের রুমে আসে। ওষুধ পত্র আর কয়েল নিয়ে আবার চিলেকোঠার ঘরে ফিরে যায়। ততক্ষণে আরাদের খাওয়া শেষ।সায়েন আরাদকে ওষুধ খাইয়ে দিল। তারপর বলল,’এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কালকে সকালে আসতে পারব কিনা জানিনা তবে আসার চেষ্টা করব। কাল কলেজ যেতে হবে। রাত ছাড়া তো এখানে আসতেও পারব না। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না??এক বেলা খাবার পাচ্ছেন তো অন্যবেলা পাচ্ছেন না।’

আরাদ সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,’ইটস্ ওকে। আমার জন্য তোমাকে বিপদে পড়তে হচ্ছে। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়ো।’
সায়েন উঠে চলে যেতে নিলে আরাদ বলে উঠলো,’ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখো। সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে আমাকে একবার ওয়াশরুম থেকে ঘুরিয়ে এনো।’

সায়েন পিছনে না ঘুরে মাথা দুলিয়ে চলে যায়। আবার সে লজ্জায় পড়েছে। ছেলেটা কি ওয়াশরুম ছাড়া কিছুই বোঝে না। পরক্ষণে মনে পড়লো যে দৈনন্দিন জীবনে ওয়াশরুমে যাওয়াটা প্রয়োজন। সায়েন দরজায় তালা মেরে আবার রুমে ফিরে যায়। আরাদের জন্য ওর খুব খারাপ লাগছে। ছেলেটার এতো জ্বর অথচ ছেলেটা ওই নোংরা ঘরে থাকছে। তাছাড়া সারা শরীরে তার ক্ষত। মুখটা গোমড়া করে ঘুমিয়ে পড়ে সায়েন।

ভোর চারটার এলার্ম দিয়ে রেখেছিল সায়েন। যদিও এতো সকালে ওঠার অভ্যাস নেই তবুও উঠতে হলো। আস্তে আস্তে সে চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে আরাদকে ডেকে তুলল। তখনও চারিদিকে অন্ধকার। আরাদ ঘুমে বিভর ছিল। সায়েন ডাকতেই সে উঠে পড়লো। ওয়াশরুম থেকে ঘুরে এসে মেঝেতে বসতেই ফোনটা কেঁপে উঠলো। আরাদ ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,’ভাইরে ভাই, তোর লাইগা দুইদিন খাওয়া দাওয়া ঘুম সব ফেলে দৌড়াদৌড়ি করছি। এখন সব কটাকে ধরে আনছি। এখন কি করবি কর!!আর তুই কোথায় এখন??’

আরাদ হেসে জবাব দিল,’ছোট্ট একটা রাজ্যের রাজকন্যার প্রেমের জালে ফেসে গেছি। তাই শাস্তিস্বরূপ রাজকন্যা আমাকে তার চিলেকোঠার ঘরে বন্দি করে রেখেছে। আমি এখন সেখানেই আছি।’

ওপাশ থেকে ছেলেটা বলল,’আরাদ তুই ঠিক আছিস ভাই??পাগল হয়ে গেলি নাকি??মজা করিস না?? কোথায় তুই??’

‘দেখা হচ্ছে কাল রাতে। গোডাউনে থাকিস। আমি এসে ওদের শাস্তি দেব।’
আরাদ খট করে ফোনটা কেটে দিলো। টানটান হয়ে শুয়ে চোখটা বুজে ফেলল সে। সাথে সাথে সায়েনের ঘুমন্ত মুখখানা ভেসে আসে আরাদের চোখে। চোখ বুজে থাকা অবস্থাতেই হেসে ওঠে আরাদ।

আরাদকে বিদায় দিয়ে সায়েন আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমে যে তার পোষাচ্ছে না। আসার সময় দুই প্যাকেট কেক ও পানি দিয়ে এসেছে আরাদকে। যাতে সারাদিন সে অভুক্ত না থাকে। কিছুক্ষণ পর নরম কিছুর উপর হাত পড়লো সায়েনের।ভালোই লাগছে সায়েনের। বস্তুটাকে টেনে কাছে আনতেই হাঁচি দিলো ও। সাথে সাথে চোখ জোড়া খুলে উঠে বসে। বিড়ালটাকে দেখে সায়েনের মাথা গরম হয়ে গেল। রেগে বলল,’শফিকুলের বাচ্চা শাফিন!!তোর কালা বিলাই আবার আমার কাছে আসছে।’

সায়েন দুহাতে বিড়ালটাকে ধরে বাইরে আসতে আসতে বলল,’ভাইয়া,,,কোথায় তুই??বের হ,,’

শাফিন শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে এসে বলল,’কি হয়েছে???’
সায়েন বিড়ালটা ছুড়ে মারে শাফিনের দিকে। শাফিন দুহাতে বিড়ালটা ধরে সায়েন রাগে কটমট করে বলে,’তোর কালা বিলাই আবার আমার রুমে গেছে কেন??জানিস না এই কালা বিলাই তে আমার এলার্জি আছে??’

‘এই ওরে কালা বিলাই বলবি না। ওর নাম সল্টু।’

‘রাখ তোর সল্টু বল্টু। মানুষ সুন্দর দেখে সাদা বিড়াল পোষে। আর তুই কালো পেত্নির মতো বিড়াল পুষছিস?? ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’

শাফিন সল্টুর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই। সর এখান থেকে।’
শাফিন চলে যায়। সায়েন কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেল। রেডি হয়ে সে কলেজে গেলো। কিন্তু দিশা আসেনি তাই সায়েনের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেছে।

বাড়ি ফেরার পথে সে অনেক গুলো ফুলগাছ কিনে আনলো। রিকশাওয়ালা কাকু গাছগুলো ওর বাড়ির দরজার সামনে রেখে গেল। সায়েনের হাতে কাঠগোলাপের চারা। দরজা খুলে জয়নব বেগম রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো সায়েনের দিকে। সায়েন মুখে হাসির রেখা টেনে মায়ের দিকে তাকালো। ভাবতে লাগলো মা মানবে তো???

#চলবে,,,,,,,,,