ঝরা স্রোতধারা পর্ব-০২

0
333

#ঝরা_স্রোতধারা
#পর্ব_২
Tahrim Muntahana

৪.
সকাল সাতটা! মলিন মুখে বাস কাউন্টারের সামনে বসে আছে রিয়াব, রিহা। আজ তারা টাংগাইল ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্য বেরিয়েছে। যদিও ঢাকা রিয়াবের কাছে অপরিচিত নয়। জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো মার্কস পেয়ে অর্নাস কমপ্লিট করেছে। বহুকষ্টে পড়াশোনাটা শেষ করতে পেরেছে রিয়াব। জীবনে সংগ্রাম ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। বাঁচতে হলে একপ্রকার যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে। হয় নিজের সাথে না হয় অন‍্যের সাথে!
এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে রিয়াব। মায়ের রেখে যাওয়া বেশ কয়েকটা টাকা ছিলো যা এখন কাজে লাগছে। বাস এসে পড়েছে। দুজনে উঠে বসলো। নরম সিটটাই বসে একবার জানালা দিয়ে মুখ বের করে নিজের গ্রামের শেষ সীমানাটা দেখে নিলো। আর এই গ্রামে পা দিবে না। এই শহরটা তাকে শুধু কষ্ট ই দিয়েছে। নতুন ভাবে বাঁচার তাগিতে যাচ্ছে। বাঁচতে হলে এবার বোনের জন্য বাঁচবে সে। বোনকে ভালো পাত্রস্ত করতে পারলেই সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। দুনিয়াটা যে ভালো না। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে মানুষ নিকৃষ্ট হতেও পিছুপা হয়না। স্বার্থে সবাই বাঁচে। কিন্তু সে কখনো স্বার্থপর হবে না। যতদিন বেঁচে থাকবে নিজের সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। উপর ওয়ালা খুশি হলে যে তার বোনটাও সুখে থাকবে। নিজের চিন্তা কে করে!

৫.
শেষরাতের দিকে চোখটা লেগে এসেছিলো তাহিবের। সকাল সাতটাই উঠতে হবে তাকে। জরুরি একটা মিটিং আছে। এলার্মেল শব্দে ধরফর করে উঠে মাথাটা চেপে ধরলো। ইশ কেমন ব‍্যাথা করছে। পাশে অনিন্দিতা কে না দেখে তাড়াতাড়ি বেলকনিতে গিয়ে চমকে দু পা পিছিয়ে গেলো সে। অনিন্দিতা এখনো ওইভাবেই দাড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। সারা টা রাত এইভাবে ছিলো ভাবতেই তাহিবের নিজেকে দোষ দিতে লাগলো। সে কেন ডেকে নিয়ে গেলো না? সে তো জানে মেয়েটির মনের অবস্থা। কোনো কিছু না ভেবে তাহিব অনিন্দিতার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো।অনিন্দিতার কোনো রেসপন্স নেই। ওকে যেভাবে নেওয়া হচ্ছে সেভাবেই চলছে। ঘরে এসে হাতে কাপড়ের ব‍্যাগ ধরিয়ে দিয়ে তাহিব বসে পড়লো বিছানাই। সে ভাবতে পারছে না একটা মানুষ মন থেকে কতটা ভেঙে পড়লে সারাটা রাত ওইভাবে দাড়িয়ে কাটাতে পারে। অনিন্দিতা নিজের জন‍্য কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। তাহিবের একটু মনক্ষুণ্ন হলো। একটু কি কথা বলা যেত না?

ফ্রেশ হয়ে আসতেই তাহিবের চোখ গেলো অনিন্দিতার স্নিগ্ধ মুখের দিকে। কি মায়া এই মুখে। যা তাকে বার বার কাছে টানে। এক অজানা আকর্ষণ কাজ করছে তাহিবের মনে। কেমন পাগল পাগল লাগছে। ঘোরের মধ‍্যে থেকেই এগিয়ে গেলো অনিন্দিতার দিকে। এত কাছে তাহিবকে দেখে অনিন্দিতা দৃঢ় চোখে একপলক তাকালো। কি ছিলো সেই চোখে! তাহিব সরে আসলো। আর এগোনোর সাহস হলো না তার। অনিন্দিতা কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। অনিন্দিতা যেতেই তাহিব ধপ করে বসে পড়ে মাথাটা চেপে ধরলো। বাকিটা দিন তার জন‍্য কি দুর্বিষহ হবে সে ভালোয় বুঝতে পারছে। তার ই বা কি করণীয়!

অনিন্দিতা ঘর থেকে বের হয়েই শুনতে পেলো হাসি ঠাট্টার আওয়াজ। সেই দিকেই এগিয়ে গেলো। কালকের মেয়েগুলো আড্ডা দিচ্ছে নিজেদের মতো করে। অনিন্দিতাকে দেখেই তারা মিটিমিটি হাসতে লাগলো। অনিন্দিতা পাত্তা না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। এতে মেয়েগুলো ভেবে নিলো অনিন্দিতা লজ্জা পেয়েছে। তাই সবগুলো হো হো করে হাসতে লাগলো। এটাই তো মজা! অনিন্দিতা রান্নাঘরে যেতেই তার শাশুড়ি বলে উঠলো,

নতুন বউ এখানে কি? কিসের কাজ! আজকে রিসেপশন আছে। বাবার বাড়ি যেতে হবে তোমার। এরপর এসে সংসারের হাল ধরলেও চলবে। এ দুটোদিন আমি সামলে নিতে পারবো। এতদিন আমিই সামলেছি। আমার ছেলেকে সামলানোর দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করতে হবে। সংসারের দিকটা আমিই দেখবো। যাও ছেলের কাছে যাও!

অনিন্দিতা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বের হয়ে আসলো। ঘরে না গিয়ে মেয়েগুলোর পাশে বসলো। আজ আবার ওই বাড়িতে যেতে হবে। ভাবতেই অনিন্দিতার কপালের রগ ফুলে উঠলো। না ও করতে পারবে না। এমন সময় বৃদ্ধ একজন মহিলা অনিন্দিতার সামনে এসে তীক্ষ্ম চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। অনিন্দিতা খানিকটা ভরকে গেলো। এভাবে দেখছে কেন তাকে? কে এই বৃদ্ধা? কি হয় তার? কিছু কি বলবে? কিন্তু কি বলবে? এসব ভেবেই পাঁচমিনিট কাটিয়ে দিলো অনিন্দিতা। হঠাৎ করেই হেসে উঠলো আপন মনে। সে এত ভাবছে? প্রত‍্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা মেয়েটিও এখন একটুখানি বিষয়ে এত ভাবছে। তার এই পরিবর্তন কেন? রিয়াবের জন‍্য? সে তো ছায়ার মতো আগলে রাখতো অনিন্দিতাকে! রিয়াবের কথা মনে পড়তেই অনিন্দিতার মুখ মলিন হয়ে এলো। কি করছে কে জানে? ঠিক আছে তো তার প্রাণটা? কতই না কষ্ট দিলো সে রিয়াবকে! এসব ভাবতে এতই বিভোর ছিলো যে বৃদ্ধাটা কখন চলে গেছে টেরই পায়নি। অনিন্দিতা আবার হাসলো। বর্তমানে তার অকারণেই হাসি পাচ্ছে। হাসিটা কেমন? অনিন্দিতার জানা নেই!

৬.
রিসেপশন প্রায় শেষের দিকে। অনিন্দিতার বাড়ির সবাই অনেক আগেই চলে এসেছে। একমাত্র ইশার সাথেই কথা বলেছে অনিন্দিতা। আর কারোর সাথেই কথা বলেনি। অভিমানটা তীব্র সাথে রাগ! অনিন্দিতার বাবা-মা মুখ মলিন করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো পুরো সময়টাই। একদিনে মেয়েটা কেমন হয়ে গেছে। মুর্তির মতো থাকে। প্রয়োজনেও নড়ে না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহিবের বাবার সাথে কথা বলতে শুরু করলো। মেয়ে জামাইকে নিয়ে রওনা হবে এবার। ভালোয় পথ। যেতে যেতে অনেকটা রাত হবে।

রওনা হওয়ার আগে অনিন্দিতার মা হাসিমুখে এগিয়ে গেলো অনিন্দিতার দিকে। যা দেখে অনিন্দিতার ভ্রু কুচকে এলো। বর্তমানে অনিন্দিতার কাউকেই সহ‍্য হচ্ছে না। নিজের উপরেই বিরক্ত সে। অন‍্যদিকে তাহিব অনিন্দিতার পাশে বসে অপলক দেখছে তাকে। অপরূপা এই নারীটি তার বউ ভাবতেই মনের মধ‍্যে একরাশ ভালোলাগা কাজ করে। আবার যখন মনে হয় নারীটি নিজের মনে অন‍্যকাউকে বসিয়েছে তখন নিজেকে সবচেয়ে ব‍্যর্থ মনে হয়। কেন সে আগে এলো অনিন্দিতার জীবনে!

অনিন্দিতার মা এসে মেয়ের পাশে দাড়ালো। অনিন্দিতা নড়লো না, একটুও তাকালো না। এতে অনিন্দিতার মার খুব খারাপ লাগলো। মেয়ের উপেক্ষা কিভাবে সে সহ‍্য করবে। তারা কি বেশী অন‍্যায় করে ফেলেছে? বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?
আবার ভাবে; আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সংসার করতে শিখবে, মানিয়ে নিতে শিখবে! আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। তাদের এখন কিই বা করার আছে! এই আশায় বুকে ধারণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাদের! অন‍্যায় তো করেই ফেলেছে!

৭.
গুড, আপনার ইডোকশনাল কোয়ালিফিকেশন হাই। এবার আপনি আসতে পারেন। ফলাফল খুব তাড়াতাড়ি আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।

এমন কথায় রিয়াব অবাক হলো। ইন্টারভিউ রুমে বসে আছে। দুদিন হলো ঢাকা এসেছে। ভাড়া বাসায় উঠে গোছাতে একদিন সময় লেগে গেছে। এইতো
কালকে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। কিন্তু মনে হয়না চাকরিটা হবে । সবার আগে তাদের কথা হলো টাকা আছে! না থাকলে আসতে পারেন! রিয়াব চলে এসেছিলো কারণ রিয়াবের কাছে কর্তৃপক্ষের ডিমান্ড মেটানোর এত টাকা নেই। হাইরে দুনিয়া! নিজের যোগ‍্যতা থাকতেও টাকার জন‍্য চাকরি হয় না। এমন দুনিয়াকে রিয়াব ধিক্কার জানায়। এসব ভেবে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

আপনাদের কোনো ডিমান্ড নেই?

রিয়াবের এমন কথায় উনারা রাগ না করে হালকা হাসলো। রিয়াব আবারো অবাক হলো।

জি না আমাদের কোনো ডিমান্ড নেই। আমরা যোগ‍্যতা দেখে এমপ্লয় নিই টাকা দেখে না।

রিয়াব আর কিছু বলল না। মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে চলে আসলো। মনে হচ্ছে চাকরীটা হয়ে যাবে। অফিস থেকে বের হয়ে হেটে হেটে বাস স্ট‍্যান্ড চলে আসলো। লোকাল বাসে চেপে বসে ভাবতে লাগলো চাকরি না হওয়া পযর্ন্ত এভাবেই চলতে হবে। বোনকে কখনো সে কষ্ট পেতে দিবে না। জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি টা পার করতে গিয়ে রিয়াবের মনের মধ‍্যে ধাক্কা খেলো সেই দিনটার কথা….

সেদিন ছিলো ভার্সিটিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা। রিয়াব রা সবে চতুর্থ বর্ষে উঠেছে। কয়েকদিন আগে নবীনবরণ হয়ে গেছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতা টা হবে অন‍্য ভার্সিটির সাথে। সিনিয়রদের মধ‍্যে ২ জন রিয়াব আর রিয়াবের বন্ধু আসান। তৃতীয় বর্ষ থেকে একজন আর প্রথম বর্ষ থেকে একজন। সবাই চলে আসলেও প্রথম বর্ষের প্রতিযোগি আসছে না। সবাই টেনশনে পড়ে গেছে। হঠাৎ সবাইকে চিন্তার হাত থেকে বাঁচাতে একজন মেয়ে বলে উঠলো,

আপনারা চাইলে আমি অংশ নিতে পারি।

পাশ থেকে একজন মেয়ে ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,

এটা কি তুমি দৌড়ের প্রতিযোগিতা ভেবেছো। ‍যে না পারলেও অংশ নিতে সমস‍্যা নেই। এটি বিতর্ক। এখানে পারতে হবে!

মেয়েটি আর কাউকে কিছু না বলে আসনে বসে পড়লো। প্রিন্সিপাল মাথায় হাত দিয়ে বসলো। কি হবে এখন? এতকিছুর মাঝে একজন এখনো শকড হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে আর কেউ না রিয়াব। দীর্ঘদিনের সেই পরিচিত মেয়েটি আজ এতদিন পর তার সামনে। কি করে! এইতো রিয়াবের মনে আছে মেয়েটি যখন স্কুলে যেতো রিয়াব তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। রাস্তায় দেখা হলেই মেয়েটির ভুবন ভুলানো হাসিতে রিয়াবের বুক ধকধক করতো। মনের ভেতর অপার্থিব এক আনন্দ খেলা করতো। ভাসিয়ে নিয়ে যেতো অচেনা এক রাজ‍্যে। যে রাজ‍্যের রাজা রিয়াব আর রানী হলো মেয়েটি। কিন্তু সে রাজ‍্যটা একটু পরেই ধোয়াশা হয়ে যেতো যখন মেয়েটি তাকে ক্রস করে চলে যেতো। হালকা খারাপ লাগা যুক্ত হতো। আবার কালকে দেখা হবে ভেবেই নিমিষেই খারাপ লাগাটা কেটে যেতো। মনে মনে মেয়েটির নাম আওড়া তো। অনিন্দিতা! এ যেন ভালো খারাপ অনুভূতির সংমিশ্রন।

এতোদিন পর মেয়েটিকে নিজের ভার্সিটিতে দেখে রিয়াব যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের অবস্থান মনে করে নিজেকে সংযত করে নিলো। এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে। এবার তাকে যেতে হবে।

পক্ষে দলের বিরুদ্ধে শক্ত যুক্তি তুলে ধরে রিয়াব অনিন্দিতা বিজয়ী সেরোপা টা অর্জন করে নিলো। সবাই অবাক হয়ে অনিন্দিতার পারফোমেন্স দেখছে। প্রেকটিস ছাড়া এত সুন্দর বিতর্ক সম্ভব না। অনিন্দিতা বাইরে এসে ঠেস মারা মেয়েটিকে বলল,

আপনি হয়তো আমাকে ভালো করে খেয়াল করেন নি। কলেজ থেকে জেলা পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সেরা বিতর্কিত আতিয়া অনিন্দিতা। ভালো কিছুতে উৎসাহ দিতে না পারলে এমন কিছু বলবেন না আশাহত হয়ে পড়ে।

অনিন্দিতা মেয়েটির কাছ থেকে চলে আসলো। প্রিন্সিপাল এসে ধন‍্যবাদ সহ কিছু উপাহার তুলে দিলো অনিন্দিতার হাতে। প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও না নিলে বেয়াদবি হবে ভেবে নিয়ে নিলো উপাহার। সেদিন আর ক্লাস হলো না। বাড়ি ফেরার জন‍্য যখনই অনিন্দিতা রিকশাই চেপে বসবে, হুরমুর করে আরেকজন রিকশাটাই অনিন্দিতার পাশে বসে পড়লো। প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে পরিচিত সেই মুখ দেখে অনিন্দিতা মুচকি হাসলো। ঝটকা খেলো রিয়াব। ভেবেছিলো অনিন্দিতা অপমান করবে তাকে। কিন্তু হলো উল্টোটা। রিয়াবকে ভালোভাবে বসার জায়গা দিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে যেতে বলল। রিয়াব যেন ঘোরের মধ‍্যে আছে। তাই দেখে অনিন্দিতা শব্দ করে হেসে দিয়ে বলল,

মি. রিয়াব মুখটা বন্ধ করেন। এত অবাক হওয়ার কিছু নেই।

রিয়াব থতমত খেয়ে মুখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। তারপর অনিন্দিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,

তুমি আই মিন আপনি এখানে? ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েও!

তুমি করেই বলো। আমি আপনি আপনি করতে পারবো না। একজনের জন‍্য ঢাকা ভার্সিটি ছেড়ে এই ভার্সিটিটা সিলেক্ট করলাম।

রিয়াব আরেকটু ঝটকা খেলো। কার জন‍্য! তবে অনিন্দিতার বফ আছে! তার জন‍্যই এখানে! মনটা খারাপ হয়ে গেলো রিয়াবের। সেই খিলখিল হাসির আওয়াজ যে রিয়াব এখনো ভুলতে পারিনি। অনিন্দিতার মায়াময়ী রূপটা মনে হলেই রিয়াবের হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায়। নিষিদ্ধ সব ইচ্ছে মনের মধ‍্যে জেকে বসে। যা কোনোদিন সম্ভব না । না এসব রিয়াব অনিন্দিতাকে বলতে পারবে, না এসব কখনো সত‍্য হবে। দুজনের মধ‍্যে ব‍িস্তর ব‍্যবধান। যদিও ভালোবাসা ধনী গরিব জাত দেখে হয়না কিন্তু সমাজ! সমাজ যে মানবে না। বারবার মনে করিয়ে দিবে রিয়াবের অবস্থান নিচুতে। আর ভাবতে পারছে না। এতদিন মনের মধ‍্যে একজনকে রেখে জীবন পার করছিলো কিন্তু এখন মনে হয়না সম্ভব হবে। তার মায়াময়ী যে তার সামনে। কিভাবে তার অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেড়াবে। রিয়াবের জল্পনা কল্পনার মধ‍্যেই অনিন্দিতা রিয়াবের হাত শক্ত করে ধরে বলল,

জানো রিয়াব আমি সেই আগের রিয়াবকে এখনো ভুলতে পারিনি। সাইকেল করে যাওয়া, হঠাৎ করেই আমাকে দেখে হুরুমুর করে নেমে পড়া, আমি যখন হাসতাম তখন নিবিড় চোখে দেখা খুব মিস করি দিনগুলো। ভুলতে দিতো না আমাকে। তোমার অনুপস্থিতে তোমাকে মনের মধ‍্যে বাঁচিয়ে রেখেছি। বিষাদ লাগতো সব। তোমার আশেপাশে থাকার জন‍্য পড়াশোনা শুরু করলাম। জানোই তো আগে খুব ফাঁকি দিতাম। ঢাকা ভার্সিটি তে চান্স পেলাম বাড়িতে জানায়নি। অপেক্ষা এই ভার্সিটির। অবশেষে চান্স পেলাম। সেদিন মনে হয়েছিলো আমি হাতে চাঁদ পেয়ে গেছি। সেদিন থেকে অপেক্ষা করেছিলাম আজকের দিনটার জন‍্য। মনের মধ‍্যে এত পরিমান হালকা লাগছে কি বলবো। যাই হোক সেই ছোট্ট মেয়ের মনে আগেই জায়গা করে নিয়েছো। এখন আর ছোট নেই। যথেষ্ট বড় হয়েছি। আবেগ মোহ ভেবে আমার ভালোবাসাকে অপমান করো না।

অনিন্দিতার বাসা আসতেই ভাড়া মিটিয়ে অনিন্দিতা নেমে গেলো। মনের মধ‍্যে কেমন ভয় ভয় করছে। রিয়াবকে হারিয়ে ফেলবে নাতো। অন‍্যদিকে রিয়াব এখনো জমে বসে আছে। অন‍্যকিছু তার মাথায় ই ঢুকছে না। শুধু অনিন্দিতার বলা কথাগুলো ঘুরছে। আজকে এতবড় একটা প্রাপ্তি পাবে সে ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ ই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। মেসে ঢুকার আগে প্রকৃতিটা উপভোগ করার জন‍্য পার্কসাইড থেকে ঘুরে আসলো। ফুরফরা লাগছে আজ। মনে হচ্ছে নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে সে। সেই কৈশর বয়সে প্রেমিকের মতো লাগছে তাকে। এই গাইতে ইচ্ছে করছে, এই নাচতে ইচ্ছে করছে, এই অনিন্দিতা কে হাজার টা কল্পনায় সাজাতে ইচ্ছে করছে। আনমনেই রিয়াবের মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো,

প্রিয় তুমি আসলে হঠাৎ করে
রাঙিয়ে দিলে ভুবনটা
তোমার মায়াজাদুতে
তুমি এসেছো আমার ভুবনে
একটু খানি সুখ নিয়ে

রিয়াবের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ম‍্যাচিউর থেকে ইমম‍্যাচিউর লাগছে। কবি কবি ভাব এসে গেছে। হঠাৎ ই রিয়াব শব্দ করে হেসে দিলো। এত আনন্দ লাগছে কেন আজ! নিজেকে ঠিকঠাক করে মেসেতে ঢুকে পড়লো রিয়াব।

কন্টাক্টারের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো রিয়াব। এতক্ষণ সে অতীত নিয়ে ভাবছিলো। কত না ভালোছিলো দিনগুলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো বুকচিঁড়ে। পাশে দাড়িয়ে থাকা কনটাক্টারের মুখটাও আধাঁরে ঢেকে গেলো। রিয়াব বুঝলো না ব‍্যাপারটা। ভাবলো হয়তো সেও এই দীর্ঘশ্বাসের সাথে সুপরিচিত। হয়তো দিনশেষে তার বুক হাহাকারের ঢেকে যায়। সবাই যে ভালোবাসার কাঙাল। কেউ পায়, কেউ হারায় আবার কেউ ধরে রাখতে পারেনা। দুনিয়ার নিয়ম!
বাস থেকে নেমে আস্তে আস্তে হাটা ধরলো রিয়াব। আর পাঁচমিনিটের রাস্তা। হাটতে ভালো লাগছে। বিকেল হয়ে গেছে। একটু পর জ্বলে থাকা সূর্যটা রক্তিম হয়ে মিলে যাবে বিশাল আকাশের বুকে। রিয়াব ভাবে সূর্যেরো তো মাথা গুজার ঠাই আছে। আকাশের বুকে কেমন জ্বলজ্বল করে আবার একসময় আকাশের বুকেই মিলিয়ে যায়। সেও তো কোনো একসময় কারো মনে সূর্যের মতোই জ্বলজ্বল করতো আবার অনায়েসেই প্রেয়সীর কোলে মিলিয়ে যেতে পারতো। সবটাই অতীত হয়ে গেছে। যার সাথে বর্তমানের কোনো সম্পর্ক নেই।
কলিং বেল বাজানোর আগে মুখে হাসি টেনে নিলো। বোনকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। হাসিমুখে দরজা খুলে দিলো রিহা। বিনিময়ে রিয়াব ও হাসি ফিরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। টুকটাক কথা বলে ফ্রেশ হতে গেলো। সন্ধ‍্যার দিকে একটু বের হবে। রাতের পরিবেশে দুঃখটা মিলিয়ে দিবে!

চলবে..?