ঝরা স্রোতধারা পর্ব-০৩

0
280

#ঝরা_স্রোতধারা
#পর্ব_৩
Tahrim Muntahana

৮.
রিয়াব হাতে একটি চিরকুট নিয়ে বসে আছে। মাথায় কিছুই খেলছে না তার। সবকিছুই ধোয়াশা লাগছে। সত‍্যটা সামনে দেখেও তার কাছে মিথ‍্যে মনে হচ্ছে। কেন এমনটা করবে সে? তার কি প্রয়োজন? কি স্বার্থ লুকিয়ে আছে? এসব ভেবে চিরকুটটা আবার খুললো। সেখানে সুন্দর হাতের লেখায় লিখা,

‘সত‍্য খুঁজছো? সত‍্য তো তোমার সামনে! ভাবছো সামনে কোথায়? একটু ভালোভাবে ভেবে দেখো। হয়তো তোমার কাছের মানুষই তোমার কষ্টের কারণ।
আচ্ছা যাও আরেকটু সহজ করে দিই। তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কোথায়? খুঁজ নিয়েছো? হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো কেন?
আশা করছি আর খোলাসা করতে হবে না। যা বুঝার বুঝে যাবে।’

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো। মেলাতে লাগলো অঙ্ক গুলো। মিলতে গিয়েও মিলছে না। কোথাও একটা গড়মিল তো আছেই। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।

চারপাশটা ভালোকরে দেখতে বের হয়েছিলো সে। পরিবেশটা থাকার উপযোগি কিনা, কোনো খারাপ দিক আছে কিনা সেসব ই দেখতে গিয়েছিলো। বোনকে সে সর্বোচ্চ সেইফে রাখতে চায়। এমনিতেই পরিস্থিতি অত‍্যন্ত খারাপ। মেয়েরা একা নিরাপদে বের ই হতে পারে না। একদল উত পেতে থাকে কিভাবে মেয়েদের হেনস্তা করা যায়। মনে হয় এরই মাঝে একদল লোকের সুখ!
মোড়ে চায়ের দোকানে বসে কেবল চায়ের অর্ডার দিয়েছে। পাশে বসা লোকটার সাথে কুশল বিনিময় করছে এমন সময় সাত বছরের মতো হবে একটি বাচ্চা ছেলে দৌড়ে আসলো রিয়াবের সামনে। ছেলেটা রিয়াবকে দেখে এদিক ওদিক চোখ দিয়ে হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলো। রিয়াব কিছু না বুঝে প্রশ্নে করবে তার আগেই ছেলেটি বলে উঠলো,

আমাকে আপনার মতোই একটা লোক এটা দিতে বললো। এরজন‍্য আমি অনেকগুলো চকলেট পেয়েছি। কত মজা চকলেট গুলো। আমি কোনোদিন খাইনি এমন চকলেট।

ছেলেটির অকপটে জবাবে রিয়াব বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তার বুঝতে বাকি নেই কারো কথায় আর চকলেটের লোভে ছেলেটি কাজটা করেছে। রিয়াব বেঞ্চ থেকে উঠে ছেলেটির সামনে হাটু গেড়ে বসলো। ছেলেটির মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছে। পাওয়ার ই কথা। হয়তো ভাবছে রিয়াব তাকে বকা দিবে না হয় মারবে। রিয়াব বাচ্চা ছেলেটির ভয় ভয় মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। রিয়াবের মুচকি হাসি এক নিমেষেই ছেলেটির ভয় দূর করে দিলো। রিয়াব এবার ছেলেটির গালে আলতো ভাবে হাত রেখে বলল,

আচ্ছা বুঝলাম তোমাকে একটি লোক দিতে বলেছে আর তুমি চকলেটের লোভে নিয়ে এসেছো। কিন্তু বাবা তুমি কি জানো লোভ অত‍্যন্ত খারাপ। এই লোভের কারণেই অনেকের মৃত‍্য হয়।

রিয়াব থামলো। ছেলেটি পরবর্তী কথা শোনার জন‍্য উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে। রিয়ার আর চুপ না থেকে বলল,

ধরো তোমাকে একজন চকলেট দিবে বলে বা মজার মজার চকলেট দেখিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। তারপর তোমাকে অন‍্য জায়গায় পাঠিয়ে দিলো। বাবা-মা থেকে দূরে। আর কখনো চাইলেও বাবা-মা, বন্ধুদের দেখতে পারবে না। তখন কি হবে ভাবোতো! তোমার কষ্ট হবে না? তার থেকে বেশী তোমার বাবা-মা বন্ধুরা কষ্ট পাবে। এটা কি তুমি চাও?

এমন কথায় ছেলেটি দৃঢ় চোখে তাকালো রিয়াবের প্রশ্নাত্মক চোখের দিকে। ধীর কন্ঠে বলল,

আমি আমার বাবা-মাকে ছাড়া একদম থাকতে পারিনা। আমি চাইনা তারা কষ্ট পাক। একা থাকতে খুব ভয় করবে আমার।

রিয়াব হাসলো। বাচ্চাটার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগছে তার। বাচ্চাটাও কেমন বুঝতে পারছে তার কথা। রিয়াব বাচ্চাটাকে কোলে উঠিয়ে বলল,

তাহলে তোমাকে কি করতে হবে? যে কোনো অপরিচিত ব‍্যাক্তি যদি তোমায় ডাকে তাহলে যাবে না। চকলেটের লোভ দেখালেও না। তখন সাহস নিয়ে বলবে আমার চকলেট চাইনা।
তোমার যদি বেশি চকলেট খেতে ইচ্ছে করে আমাকে বলবে। ওইযে দেখেো বিল্ডিং টা তারপরের বিল্ডিংটাই থাকি আমি। ওখানে চলে যাবে। তবুও অপরিচিতদের কথায় কিছু করবে না। মনে থাকবে?

ছেলেটি যেন রিয়াবের সব কথা বুঝতে পেরেছে। ছেলেটি বিস্তর হেসে মাথা দুবার ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। আর রিয়াবকে দারুণ পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর করে বুঝালো তাকে। বাচ্চাটির মুখে হাসি দেখে রিয়াবের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। বাচ্চাটিকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। অনেকটা বেলা হয়েছে। তাকেও ফিরতে হবে। সকাল টা তার দারুণ কাটলো। হালকা লাগছে অনেকটা। বাড়ি ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে চিরকুটটা খুলে দেখতেই তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কে হতে পারে?
রিয়াব আর ভাবতে পারছে না। দেখা যাক সময় আর সুযোগ কি বলে। তার আগে চিরকুটের মালিককে তার খুঁজতে হবে। আবার সেই বা কোথায় হারিয়ে গেলো খুঁজ করতে হবে।

গায়ে শার্ট জড়িয়ে বের হয়ে গেলো রিয়াব। উদ্দশ‍্যে ভার্সিটি ক‍্যাম্পাসে যাবে। অনেকদিন যাওয়া হয়না সেই বাগান টাই। যেখানে বসে দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছে। কত প্রেমময় বানী আওড়িয়েছে দুজনে। ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে দুজন। আজ খুব মনে পড়ছে সময়গুলোর কথা। স্মৃতিগুলো কি ভুলার নাকি!

বাগানের একসাইডে একটি বকুল গাছ ছিলো। তার নিচে বসেই দুজন গল্প করতো। রিয়াব সেখানে গিয়ে নিজের শরীর টা এলিয়ে দিলো। জায়গাটার মতো স্মৃতিগুলোও প্রাণবন্ত লাগছে। রিয়াবের মনে হচ্ছে অনিন্দিতা তার পাশে শুয়ে আছে। খুব করে উপলব্ধি করছে মেয়েটিকে। চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। চোখ পানিও নির্লজ্জের মতো বের হয়ে আসে!

৯.
কেটে গেছে একদিন। এর মধ‍্যে অফিস থেকে ফোন এসেছিলো। আজকে দেখা করার কথা বলেছে। রিয়াব কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই সকাল থেকে মনটা ভালো। কষ্টের মাঝেও একটু খানি আশার আলো পেয়েছে। অফিসের গেট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ানকে বিষণ্ন মুখে বসে থাকতে দেখে রিয়াব কিছুটা ভ্রু কুচকালো। পাত্তা না দিয়ে অফিসের ভেতর ঢুকে পড়লো। লিফট বেয়ে মেইন অফিসে ঢুকতেই একজন এসে এমডির রুমে নিয়ে গেলো। সালাম জানিয়ে বসার অনুমতি নিয়ে বসে পড়লো। এমডি কিছুটা নিরবতা পালন করে বলল,

তুমি করেই বলছি, ছেলের সমান তুমি। তোমার গ্রেট দেখে আমি সত‍্যিই অবাক হয়েছি। তাই সরাসরি কথা বলতে ডেকে নিয়ে আসলাম। ইতিমধ‍্যে বুঝেই গেছো যে তোমার জব কনফার্ম। এখন মেইন কথাটি হলো এখানে তোমার কাজের দক্ষতা দেখবো আমরা। যদি আশানূরুপ ফল পাই তাহলে তোমাকে বাইরের কানট্রিতে ট্রান্সফার করবো ব‍্যবসায়ের সুবিধার্থে। এতে তোমার দ্বিমত আছে?

রিয়াব যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেলো। প্রেয়সীর স্মৃতি থেকে সে বহুদূরে থাকবে এটায় তো চায় সে। পরক্ষণেই বোনের কথা মনে করে বলল,

আমার দ্বিমত একজায়গায় তা হলো আমার বোন। আমার বোনকে ছাড়া আমি কোথাও যেতে পারবো না স‍্যার। দুনিয়াতে আপন বলতে আমার ছোট বোনটাই। যদি আমার সাথে আমার বোনকেও নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন তাহলে আমি শিউরিটি দিতে পারবো আমার দ্বারা আপনার ব‍্যবসায়ের অতি লাভ না হলেও লস হবে না। কাজের ক্ষেত্রে আমি আমার বাবার আদর্শকে ধারণ করি।

রিয়াবের কথা বসের পছন্দ হয়েছে। সে এক গাল হেসে বলল,

তোমার পার্সোনালিটি দেখে আমি খুব খুশি। এরকম একজন ই চাচ্ছিলাম। অলরাইট তুমি কাল থেকেই কাজে জয়েন করো। তোমার কাজের উপর লক্ষ‍্য করা হবে। একটা ডিল কনফার্ম করতে পারলেই তুমি এই সুযোগটা পাবে।তোমাকে কাজ সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবে ম‍্যানেজার।

রিয়াব মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। বসের থেকে বিদায় নিয়ে ম‍্যানেজারের পিছুপিছু হাটা ধরলো। কিছুক্ষণ কাজ বুঝিয়ে দিয়ে একটা খাম ধরিয়ে দিলো রিয়াবের হাতে। রিয়াব অবাক হয়ে কিছু বলবে তার অাগেই ম‍্যানেজার বলে উঠলো,

এখানে যাদের জব কনফার্ম হয় তাদের এডভান্স পেমেন্ট করা হয়। আশা করছি আপনার বেষ্ট টা দিয়ে চেষ্টা করবেন। ব‍্যবসায়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে তবুও কর্মজীবীদের স‍্যার খুশি রাখার চেষ্টা করে। মানুষটা একদম মাটির।

কথাগুলো শুনে রিয়াবের মনে বস আর ম‍্যানেজারের প্রতি আলাদা শ্রদ্ধাবোধ জাগলো। কয়জন বস এমন ভাবতে পারে। কিছুটা দৃঢ়তার সাথে বলল,

আমি আমার সর্বোচ্চ টা দিয়ে চেষ্টা করবো। বিপদের সময় যে প্রতিষ্ঠান আমার পাশে দাড়িয়েছে সে প্রতিষ্ঠানের জন‍্য আমি সর্বদা হাজির। আসি কাল দেখা হবে স‍্যার।

ম‍্যানেজার মুচকি হেসে বিদায় জানালো। এখন দেখার পালা এরপর কি হয়। রিয়াব খুশি মনে অফিস থেকে বের হলো। টাকা গুলো পেয়ে কত যে উপকার হলো বলার বাহিরে। বোনকে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলো কিন্তু এখন প্লেন অন‍্যটা। যদি কাজ দিয়ে নিজেকে যোগ‍্য প্রমাণ করতে পারে তাহলে তো এখান থেকে চলে যাবে। যে দেশে যাবে সে দেশেই ভর্তি করিয়ে দিবে। তার আগে বোনকে একটা স্পোকেন ইংলিশ কোচিং এ ভর্তি করাতে হবে। বাইরের দেশে ইংরেজি না জানলে হবে নাকি। ওতটাও পারদর্শী নয় রিহা ইংরেজিতে। কিছু শপিং ও করতে হবে। কতদিন ভালোমন্দ খায়না বোন টা। কিছু ভালোবাজার ও করতে হবে। বোনকে নিয়ে আজকে দামি রেস্টুরেন্টে যাবে। নিজে তো কাজের ছলে হলেও ঘুরছে, বোন তো সেই যে এসেছে আর বের হয়নি। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন গেট পেরোবে কারো কান্নার আওয়াজ শুনে হকচকিয়ে গেলো রিয়াব। মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো দারোয়ান মুখে হাত চেপে কাঁদছে। কিছুটা ইতস্ততা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,

চাচা কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে আপনার? অসুস্থ আপনি?

কান্নার মাঝে কারো আওয়াজ শুনে দারোয়ান তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো। হাসার চেষ্টা করে কিছু বলবে তার আগেই রিয়াব বলল,

আমাকে বলুন কি হয়েছে? আমি কোনো ভাবে সাহায‍্য করতে পারি কিনা দেখি।

দারোয়ান লোকটি বিষণ্ন মনে বলতে শুরু করলো,

আমার মেয়েটা হসপিটাল ভর্তি। অনেক টাকা লাগবে বাবা। আমি এত টাকা কোথায় পাবো। সাধারণ একজন দারোয়ান আমি। আমি একজন অক্ষম বাবা একজন অক্ষম স্বামী ; না কখনো স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি, না মেয়ের প্রতি।

রিয়াবের মনটা ভিষন খারাপ হয়ে গেলো। একজন মেয়ের জন‍্য বাবার আহাজারি হৃদয়স্পর্শী। রিয়াব একবার নিজের পকেটে হাত দিয়ে দারোয়ান চাচার দিকে তাকালো।

মস্তিষ্ক বলছে, ‘তুই কেন তোর টাকা দিতে যাবি। এগুলো তোর অনেক দরকার। কতকিছু ভেবে রেখেছিলি। তার কষ্ট কেন তুই বুঝবি। সবাই স্বার্থের জন‍্য লড়ে। তুই কেন অন‍্যের কথা ভাববি?’

মন বলছে ‘তুই যদি মানুষ হয়ে থাকিস অবশ‍্যই টাকা গুলো দিয়ে চাচাকে সাহায‍্য করবি। নিজের কথা ভাববি না। তুই ভালো পোষ্ট পেয়েছিস। অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবি। ভবিষ‍্যতে স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবি। অথচ আজ টাকার অভাবে মেয়েটা মারা গেলে চাচা সন্তানহারা হয়ে মৃত‍্য পযর্ন্ত ধুকে ধুকে কষ্ট পাবে।’

রিয়াব চোখটা বন্ধ করে নিলো। বিবেক নাড়া দিচ্ছে খুব করে। পকেট থেকে খামটা বের করে চাচা দিকে এগিয়ে দিলো। চাচা তখন কান্না ভুলে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রিয়াব আশ্বস্ত কন্ঠে বলল,

এখানে কত আছে জানিনা চাচা। আপনারও বা কত হেল্প হবে তাও বুঝতে পারছি না কিন্তু কিছুটা হলেও হেল্প হবে। আপনি এটা রাখুন। ধরে নিন আপনার ছেলে তার বোনের চিকিৎসার জন‍্য টাকা দিয়েছে। না বলবেন না। আপনি হাসপাতাল চলে যান।

রিয়াবের কথায় চমকে উঠলো দারোয়ান চাচা। এমন মানুষও হয়। খুশিতে তার চোখ চিকচিক করে উঠলো। ঝাপটে ধরলো রিয়াবকে। আবার হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

এখন তো যেতে পারবো না বাবা। ডিউটির সময় কোথাও যাওয়া নিষেধ। গেলে সেই রাতে যেতে হবে।

দারোয়ান চাচার কথায় রিয়াব ব‍্যতিব‍্যস্ত হয়ে বলল,

একি কথা চাচা। আপনার আগে মেয়ের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কোম্পানি বুঝবে বললে। নাহয় ওসব বাদ দিন আপনি যান। না আসা পযর্ন্ত আমি এই দিকটা দেখবো। যান যান কথা বাড়াবেন না আর।

বুক ভরা আশা নিয়ে দারোয়ান ছুটলো হসপিটালের দিকে। রিয়াব চারপাশ টা ভালো ভাবে দেখে দারোয়ান চাচার টুলটাই বসে পড়লো। স্বস্তি লাগছে মনে। অজান্তেই মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে চাচার আসার নামই নেই। তবুও রিয়াবের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠে নি তার পরবর্তীতে ফুটে উঠেছে চাচা আর চাচার মেয়ের জন‍্য চিন্তা। এই পযর্ন্ত কয়েকজন আসা যাওয়া করেছে। কেমন করে তাকিয়ে ছিলো সবাই। সেদিকে রিয়াব দৃষ্টিপাত করেনি। মানুষ বসেই থাকে এসবের জন‍্য। মাথা নিচু করে বসে ছিলো রিয়াব। হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনতেই তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে গিয়ে গেট খুলে দিয়ে সালাম দিলো। গাড়িটা পার্কিং সাইডে গিয়ে থামালো। রিয়াব একনজর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো।

গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন মেয়ে। চোখে মুখে রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। কিছুক্ষণ রাগী চোখে রিয়াবের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে হনহন করে ভেতরে চলে গেলো। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে রাগের চরম পর্যায়ে চলে গেছে। রিয়াব বসেই রইলো। বোনকেও ফোন দিয়ে বলে রেখেছে। তাই ওইদিকের চিন্তা হচ্ছে না। সন্ধ‍্যা গড়িয়ে অফিস ছুটির সময় হয়ে এলো দারোয়ান চাচা আসলো না। রিয়াব এবার একটু ধাক্কা খেলো। মস্তিষ্ক বলছে, ‘চাচা কি তাহলে ধোকা দিলো তাকে। এই অফিসের সব তো জানার কথা। সে নিশ্চয়ই জানতো আজ এডবান্সড পাবে তাই এই ফন্দি করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভেগে গেছে।’
মাথা ঝাড়ি দিয়ে উঠে দাড়ালো রিয়াব। আর কেউ নেই অফিসের।এখন তালা দিয়ে নিজেরও বাসায় যেতে হবে। বোন একা আছে। সে ঠকলো তবে মানুষ চিনলো তো। কিন্তু মন বলছে, ‘না কেউ মেয়ের অসুস্থতার কথা বলে এমন করবে। প্রত‍্যেক বাবা মায়ের কাছে সন্তান অন‍্যতম। আসবে চাচা। হয়তো খুব বেশীই কাজ ওখানে।’ মনের কথাকেই সায় জানিয়ে মুখে হাসি টেনে নিলো। বাঁচতে হলে হাসিটা জরুরি। গেট তালা দিয়ে হাটতে লাগলো। সামনের স্টপে বাসে উঠবে। হঠাৎ ই রিয়াবের নিজের বোকামোর কথা মনে পড়লো,

কেন যে হসপিটালের ঠিকানাটা জেনে রাখলাম না। তাড়াহুড়োর ফলে কন্টাক নম্বর নিতেও ভুলে গেছি। কেমন আছে বোনটা কে জানে।

সব ভাবনা বাদ দিয়ে এগোতে লাগলো সে। আরেকটু সামনে যেতেই রিয়াবের চোখ চকচক করে উঠলো। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো। দারোয়ান চাচা এসেছে। হাতে লাইট নিয়ে খুব দ্রুত হাটছে। রিয়াব চাচার হাত ধরে বললো,

আপনার মেয়ে কেমন আছে চাচা। সব ঠিকঠাক তো।

চাচার চোখ পানিতে চিকচিক করে উঠলো। কিসের পানি বুঝতে পারলো না রিয়াব। মেয়ে হারানোর ব‍্যাথা এমন তো না। চাচা রিয়াব কে ঝাপটে ধরে বলল,

সব ঠিকঠাকরে বাবা, সব ঠিকঠাক। তুই যা কালকের পরদিন তোর অফিস। বড় স‍্যার আমাকে জানিয়েছে। আর বড় স‍্যার এই খামটাও দিতে বলেছে। সব কথা সেদিন হবে।

রিয়াবের হাতে খামটা দিয়ে চাচা দ্রুত প্রস্থান করলো। এক প্রকার পালিয়ে গেলো। রিয়াব হাজারটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলো। খাবার খেতে বসে রিয়াবের খামটার কথা মনে পড়লো। খেয়ে তাড়াতাড়ি খামটা নিয়ে বসলো। এখানে কি আছে রিয়াব বুঝতে পারছে। শুধু যে টাকা আছে তা না, অন‍‍্যকিছুও আছে। ভাইকে এমন ভাবতে দেখে রিহা নিজেই খামটা খুলে দেখলো এক বান্ডেল টাকা। যেখানে শুধু এক হাজার টাকার নোট। আর একটা চিরকুট সাথে এক গোছা চাবি। অবাক হয়ে চিরকুটটা হাতে নিলো রিয়াব।

স্বপ্ন গুলো পূরণ করো।
চাবিটা হলো একটি বাংলোর। তোমার জন‍্য গিফট। কালকে বাংলোতে স‍্যাটেল হয়ে যাবে।
সব জয়েনিং এর দিন জানতে পারবে। শুধু মনে রেখো সততা এন্ড পরোপকারিতা সকল কিছুর উর্ধ্বে।

রিয়া হা হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্ল‍্যাট নিশ্চয় বড় হবে।দামি দামি সোফা থাকবে। খাবার খাওয়ার জন‍্য ডাইনিং টেবিল থাকবে। টিভি থাকবে, ফ্রিজ থাকবে। রিয়ার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। কে ভালোভাবে বাঁচতে না চায়? হা সে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে পারে কিন্তু তবুও তো শখ, আহ্লাদ থাকে। রিয়াব বোনের চকচক করা চোখ দুটো দেখে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। অনেকদিন পর বোনের চোখে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখছে। বাজে পরিস্থিতির চাপে পড়ে তো বোনটা সেই কবে থেকে আবদার করা বাদ দিয়েছে। আজকে রাত টা রিয়াব শান্তিতে ঘুমাবে। বোনের হাসি মুখটা মনকে আজ ভিষণ শান্তি দিয়েছে।

চলবে…?