তখন অপরাজিতা পর্ব-০২

0
61

তখন অপরাজিতা -২


অয়নি বাসায় ঢুকলো তখন একটা বাজে। হাসিব ভাইয়া তিনটায় আসবেন বলেছেন।
লাঞ্চের পরে অয়নির মনে হলো, হাসিব ভাইয়াকে একটা ফোন করা যেতে পারে, আজ আসবেন কিনা জানতে।
অয়নি ল্যান্ডফোন থেকে হাসিব ভাইয়াকে ফোন করল।
যতক্ষণ রিং বাজল, ওর হার্টবিট বেড়ে গেল।একটু ভয় করতে লাগল, যেন কেউ বুকের ভেতরের শব্দটা শুনে ফেলবে।প্রথমবার রিং বেজে ফোন কেটে গেল। দ্বিতীয় বারে হাসিব ভাইয়া ফোন ধরলেন।
অয়নি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কেমন আছেন?
-হ্যা ভালো আছি, অয়নিতা, হঠাৎ ফোন করলে? কোন সমস্যা?
-না না কোন সমস্যা নয়, আজ কী আসবেন?
-হ্যা আসব না কেন, তুমি তো জানো অকারণে আমি পড়ানো মিস করি না!
– জি ভাইয়া, একটু সিওর হতে ফোন দিয়েছিলাম, ঘুমাব ভেবে।
-অ্যালার্ম দিয়ে রাখো, আমি তিনটা দশের মধ্যে চলে আসব।
-জি ভাইয়া।
অয়নির গলা কেঁপে গেল।ও ফোন রেখে বই পত্র নিয়ে বসল। স্নেলের সূত্রের ব্যাখ্যাটা আরও একবার বুঝে নিতে হবে!ভাইয়া ছবি একে বুঝিয়েছেন, তার পরেও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!
হাসিবের বয়স একত্রিশ। বেশ ভালো ছাত্র হলেও চাকরি বাকরি খোজার চেষ্টা করেনি। “প্রয়াস কোচিং সেন্টার” টা হাসিব আর কয়েকজন বন্ধু মিলে চালায়। বেশ নামকরা কোচিং, এখন ভার্সিটি ভর্তি কোচিং করানোও শুরু হয়েছে।
ছাত্রজীবন থেকে কোচিং থেকে বেশ ভালো ইনকাম হওয়ায় অন্য চাকরির চেষ্টা করতে ইচ্ছে করেনি।মএখনো বেশ ভালো টাকা আসছে।
হাসিব বাসায় গিয়ে টিউশনি করায় না। তবে গতবার অয়নির মা নিজে ওর অফিসে গিয়ে অনুরোধ করেছেন।
এত বড় চাকরি করেন, তিনি নিজে থেকে অনুরোধ করেছেন, তার সম্মান রাখতে রাজি হয়েছে বাসায় এসে পড়াতে, তবে সপ্তাহে দুদিন। আর মেয়েটার মা সময় দিতে পারেনা, বাবা সেপারেটেড, একটা সিম্প্যাথিও কাজ করেছে হাসিবের মনে। তবে ইদানীং একটা বিষয় ওর চোখ এড়ায় নি।একত্রিশ বছর বয়সে এসে চৌদ্দ বছরের কিশোরীর হঠাৎ একটা অন্য ধরনের পরিবর্তন হাসিব বুঝতে পারছে। তবে পাত্তা দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
এ বয়সটাই এমন। একটা ঘোরের মধ্যে থাকে মেয়েরা এসময়ে। বড় হতে হতে নিজেকে বিশাল বড় মনে করে ফেলে। একটা মোহ তৈরি হয়! তবে পড়া শোনা ভালোই করে মেয়েটা।খেয়াল করে শোনে, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিছু বিষয় বুঝেও না বোঝার ভান করাটাই শ্রেয় বলে হাসিবের মনে হয়।
হাসিব ঢুকল সোয়া তিনটার দিকে। অয়নি ঘুমায়নি।
হাসিব জিজ্ঞেস করল, ঘুমাও নি কেন?
-এমনিতেই ভাইয়া।
একটু থেমে বলল,বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আজ।
হাসিব বুঝতে পারল অয়নির একটু মন খারাপ।ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাগুলোর এই দোটানাটা খুব কষ্টের।
হাসিব তাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল
-কোন সমস্যা আছে আলোর প্রতিসরণ নিয়ে?
অয়নি হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বলল, স্নেলের সূত্র…
হাসিব রাফ খাতা নিয়ে আবার বোঝানো শুরু করল। অয়নির খাতার এক কোণায় লেখা,
“হে অজানা কবে
তোমার দেখেছিলেম অনুভবে”
টিনেজ পাগলামি! এ বয়সেই এসব গান কবিতা খাতায় লিখতে মনে হয়!
-অয়নিতা, ফিজিক্স খাতায় গানের লাইন লিখেছ কেন!
-এমনিতেই ভাইয়া।
-আর লিখবে না, এগুলো কনসেনট্রেশান ব্রেক করে।
-ওকে ভাইয়া!
একটু থেমে অয়নি জিজ্ঞেস করল, আপনাদের রিইউনিয়ন কেমন হলো?
-ভালো হয়েছে!
-হ্যা ছবি দেখেছি!
-আচ্ছা, সোশ্যাল মিডিয়ার সময় যত কম দেওয়া যায়!
অয়নি কথা বলল না, আসলে ও সময় দেবে কোথায়, বাইরে কোথাও যাওয়া হয়না, গল্প করারও কেউ নেই!
অয়নি ভাবল, একটা ভাই বোন যদি থাকত! হাসিব দেড় ঘন্টা পড়িয়ে উঠল। আবার পরের বৃহস্পতিবার আসবে।
হাসিব চলে যাওয়ার পরে অয়নি ঘুমাতে গেল।
আপুমণি বললেন, অবেলায় ঘুমুবে তুমি নানুমণি?
অয়নি বলল, রাতে লাহিড়ী স্যার আসবেন, তার আগে একটু না ঘুমালে চলবে না।


আজ অয়নির স্কুল ছুটি হয়ে গেছে টিফিন ব্রেকে। নায়েরা, তন্বি, সুতপা সবাই বললো নিউমার্কেটে যাবে। অয়নি কখনো একা নিউমার্কেটে যায়নি। এখন বাসায় গিয়ে কোন কাজ নেই৷ তার চাইতে ওদের সাথে যাওয়া যায়। নায়েরার বাসা অয়নির বাসা থেকে একটা গলি পরে, একসাথে রিক্সা করে চলে আসবে।
অয়নি তাই বলল, আমিও যাবো।
কিন্তু সুতপা একটু আমতা আমতা করল। বিষয়টা হচ্ছে, একটা ছেলের সাথে সুতপার কথা হচ্ছে ফোনে, নায়েরা আর তন্বি জানে কিন্তু অয়নিকে বলেনি! অয়নি একটু চুপচাপ ধরনের বলে এধরনের কথা গুলো সুতপা ওকে বলেনি। ওই ছেলে বলেছে নিউমার্কেটে আসবে। সুতপার ইচ্ছে না অয়নি যাক!
সুতপা নায়েরাকে ডেকে বলল, তোর বন্ধুকে বল, যেতে হবে না।
নায়েরা বলল, না করব কিভাবে, মন খারাপ করবে।এমনিতেই ওর মনটা খারাপ থাকে।নিয়ে চল, ওকে কোথাও দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা দেখা করে আসব। বেশি সময় তো এমনিতেই থাকতে পারব না।
সুতপা মুখভার করে রাজি হলো।
অবশ্য স্কুল থেকে বেড়িয়ে আর কারো কিছু মনে রইল না, হইচই করতে করতে সিটি বাসে উঠে পড়ল সবাই।
অয়নির খুব ভালো লাগছিল। এমনিতে ও খুব একটা বাইরে টাইরে যায় না।মায়ের সাথে মাঝে মাঝে অফিসিয়াল ডিনারে যাওয়া হয়, সেখানে তো চুপচাপ খেয়ে চলে আসা হয়।ওরা নিউমার্কেটে পৌছে গেল অল্প সময়েই। ফুটপাতের হকার থেকে এটা সেটা কিনে ঘুরল কিছুক্ষণ।সুতপা নায়েরাকে ইশারা দিলো একটু পরে।
মার্কেট থেকে বের হয়ে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের মোড়ে দাঁড়িয়ে নায়েরা অয়নিকে বলল, অয়নি তুই এখানে থাক।আমার একটু কাজ আছে। তুই তো দৌড়ে যেতে পারবি না, অভ্যাস নেই, আমরা যাবো আর আসব।অয়নি সরল বিশ্বাসে রাজী হলো।ওরা দ্রুত চলে গেল।
অয়নি একটি সরে দাঁড়াল একটা দোকানের সামনে।
দোকানটায় রডের ফার্নিচার বিক্রি হয়। অয়নি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছিল। বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে যাবার পরে অয়নি ঘড়ি দেখল, মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে।
একা একা সময়গুলো এত লম্বা হয়ে যায়।এতসময় বসে মাত্র পাঁচ মিনিট!আরো পাঁচ মিনিট কেটে গেল।
অয়নির মনে হলো, ও অনন্তকাল এভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
ঢাকা শহরে এভাবে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, তার দিকে আসেপাশের মানুষ তাকানো শুরু করে!কয়েকটা ছোকরা ধরণের ছেলে টিটকারি মারলো, কী, একা নাকি!
অয়নি প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগল।ওর কাছে টাকা আছে, একটা রিক্সা করে বাসায় চলে যাবে? সাথে ফোন নেই, থাকলে ওদের কল করা যেত। মা জানতে পারলে প্রচন্ড রেগে যাবেন।
কী করবে এখন!ওরাও তো আসছে না! অয়নি মনে মনে অস্থির হয়ে পড়ল।ছোকরা গুলো একবার পাশ থেকে হেটে গেল, ইচ্ছে করে গা ঘেঁষে!অয়নির এবার কান্না পাচ্ছে।
কী দরকার ছিল এখানে আসার!রিক্সায় করে বাসায় ফিরবে একা একা?যদি রিক্সাওয়ালা ভাল না হয়, যদি অন্য কোথাও নিয়ে চলে যায়!
-অয়নিতা, তুমি এখানে কী করছ?
পরিচিত কণ্ঠস্বরে অয়নি পাশ ফিরে দেখে হাসিব ভাইয়া। একটা আটপৌরে পাঞ্জাবী পরে আছেন, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা!হাতে বাজারের ব্যাগ। ঘেমে একাকার হয়ে আছেন!অয়নি যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
হাসিবকে বলল , ভাইয়া, বান্ধবী দের সাথে এসেছি, ওরা কাজ আছে বলে কোথায় গেল, এখনো আসছে না!
হাসিব দেখল প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এখানে মেয়েটাকে ফেলে যাওয়া যায় না! এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও যাবে না। ভীড় বাড়ছে।
হাসিব বলল, চলো আমার সাথে, বাসায় বাজারের ব্যাগটা দিয়ে তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।অয়নি কথা বাড়াল না।হাসিবের পেছন পেছন হাঁটতে লাগল। হাসিব একটা রিক্সা ঠিক করল।তার বাসা জিগাতলা।
বাসায় ব্যাগটা রেখে এই রিক্সায়ই অয়নির বাসায় দিয়ে আসবে। অয়নিতার বাসা লালমাটিয়ায়।
অয়নির খুব অস্বস্তি লাগছিল হাসিব ভাইয়ার পাশে অবশ্য নিশ্চিন্তও লাগছিল।ভাগ্যিস হাসিব ভাইয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল! নাহলে কী যে হতো!বন্ধুদের উপর খুব রাগ লাগছে।
হাসিব এমনিতে অয়নির সাথে খুব বেশি কথা বলে না।
এখন ওকে সহজ করার জন্য জিজ্ঞেস করল, স্কুল আগে ছুটি হয়েছে?
এমনিতে অয়নি স্কুল পালানোর মেয়ে না। সে মাথা নেড়ে “হ্যা” বলল। তারপর চুপচাপ দুজনেই, হাসিব আর কিছু বলল না।জিগাতলা হাসিবের বাসার গেটে দারোয়ানকে ব্যাগটা দিয়ে বলল, বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে।তারপর আবার রিক্সায় উঠল। রিক্সায় উঠে ফোন করল রানীকে।
-হ্যালো, রানী, বাজারটা দারোয়ান দিয়ে আসছে বাসায়, আমার ঘন্টাখানের দেরী হবে আসতে। একটু কাজ আছে।
এটা বলে ফোন রাখল!
সাত মসজিদ রোডে উঠে হাসিব জিজ্ঞেস করলো, অয়নি, আইসক্রিম খাবে? অয়নি আবারও মাথা নেড়ে “হ্যা” বলল।
হাসিব রিক্সা থামিয়ে ভ্যান থেকে কোন কিনে জিজ্ঞেস করল, কী ফ্লেভার খাবে?
অয়নি ম্যাংগো ফ্লেভার পছন্দ করে।হাসিব নিলো চকোলেট।
রিক্সায় উঠতে উঠতে হাসিব বলল, ভার্সিটি লাইফে অনেক আইসক্রিম খেতাম, এখন তেমন খাওয়া হয় না!
অয়নি হাসল একটু।হাসিবের এক মুহুর্তে মনে হলো, মেয়েটা ভারী মিষ্টি!চোখগুলো টানাটানা। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো সাদা রাবার দিয়ে বেণী করা। এই বয়সে মেয়েদের উপর ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এসে পরে।
আহারে, হয়তো ওর মনে কত কষ্ট জমা হয়ে আছে, কাউকে বলতেও পারে না!
অয়নির বাসায় যখন পৌছাল, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
হাসিব বলল, আমি উপরে যাবো না। তুমি চলে যাও।
অয়নি বলল, ভাইয়া, একটা কথা ছিল!
হাসিব হেসে বলল, ওকে তোমার মা কে কিছু বলব না, ঠিক আছে?
অয়নি চমকে উঠল, তারপর একটু শুকনো হাসল, ভাইয়া মাইন্ড রিডিং জানে নাকি! হাসিব চলে গেল।
অয়নি মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে উপরে উঠল। অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে আজ।

চলবে

শানজানা আলম