তখন অপরাজিতা পর্ব-০৩

0
44

তখন অপরাজিতা -৩


অয়নি ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসেছিল।লাহিড়ী স্যার ইংলিশ পড়াতে আসেন আটটার দিকে।স্যারের কাছে পড়ার মাঝেই শুনল ল্যান্ডফোনে নায়েরা ফোন করেছে।ও ইচ্ছে করেই কথা বলল না৷ আপুমণিকে বলল, বলো যে আমি পড়ছি।
পড়া শেষ হলেও অয়নি ফোন করল না।
এদিকে কী হয়েছে, নায়েরা মিনিট বিশেক পর এসে দেখে অয়নি নেই।ও মারাত্মক চিন্তায় পরে যায়। সুতপা আর তন্বী ওই ছেলের সাথে ফাস্টফুডের দোকানে বসেছিল।নায়েরা বেশিক্ষণ বসেনি।কিন্তু এসে অয়নিকে না পেয়ে বাসে উঠে বাসায় চলে এসেছে।
নায়েরা খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে, একা একাই সব কিছু করতে অভ্যস্ত।বাসায় এসে অয়নিকে ফোন করে কিন্তু অয়নি কথা বলল না!
অয়নিকে নায়েরা খুব পছন্দ করে। ওদের মধ্যে অয়নিই একমাত্র বিত্তবান পরিবারের, মানে অয়নির মা বড় চাকরি করেন। বাকিরা সবাই সাধারণ।কিন্তু অয়নি বা ওর মা দুজনই ভীষণ ভালো।নায়েরার মন খারাপ লাগছিল।
অয়নির সাথে বাকিরা একটু দূরত্ব রেখে মেশে,
নায়েরা বাদে।নায়েরা আবার ফোন করল, আপুমণি রিসিভারটা নিয়ে এলো।অয়নি কথা বলল এবার।
নায়েরা বলল, তুই ভীষণ রাগ করেছিস কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি চলে এসে তোকে পাইনি!
অয়নির মন এত জটিল না।ও বলল, বিশ্বাস করলাম।
আর কিছু বলবি?
নায়েরা বলল, তুই তো আসল ঘটনাটাই শুনিস নি, সুতপা যার সাথে কথা বলত না, ওই ছেলে এসেছিল! শুকনা ঠ্যাংরা কাঠির মতো লম্বা হিহিহি!সুতপার মুখের অবস্থা যদি দেখতি!
অয়নি বলল, দেখব কিভাবে, তোরা তো আমাকে নিলি না, একা রেখে চলে গেলি! কী বাজে অবস্থা!আচ্ছা নায়েরা, সুতপা ঠিক আমাকে পছন্দ করে না, তাই না?
-আরে না না, তেমন কিছু না!ও তো একটু ওইরকম জানিস না, ফোনে কথাটথা বলে, তোকে এসব জানাতে চায় না।
অয়নি বলল, বুঝছি!
-বাই দ্যা রাস্তা, তুই ফিরলি কিভাবে? রিকশায়?
হাসিব ভাইয়ের কথা মনে হতে অয়নির মন ভালো হয়ে গেল। নায়েরাকে মনে মনে একটা থ্যাংকস দিলো, ওরা না রেখে গেলে আজ তো হাসিব ভাইয়ার সাথে দেখা হতোই না!ওই ঠ্যাংরা কাঠি ছেলেকে দেখতে হতো! ভাইয়া কত কেয়ারিং, অয়নিকে বাসায় পৌছে দিলো।
অয়নি বলল, আমার টিচারের সাথে দেখা হয়েছিল, উনি পৌছে দিয়েছেন।
নায়েরা বলল, ওই হ্যান্ডসাম টিচার, তোর হাসিব ভাইয়া! মাই গড!
-আরে যাহ, তেমন কিছু না! কিছু ছোকরা টিজ করছিল, ভাইয়া দেখতে পেয়ে পৌছে দিলেন।
নায়েরা বলল, যাক বাবা, আমি যে কী চিন্তায় ছিলাম!
পাশ থেকে শোনা গেল, নায়েরার দাদী বলছে, এত কথা বললে, বিল হবে না! যত দোষ সব আমি কথা বললে!
-রাখি রে, দাদী ক্যাট ক্যাট শুরু করেছে- বলে নায়েরা ফোন রাখল।
নায়েরাদের বাসাটা ছোট্ট, দুই রুমের।এতে তিনভাই বোন, দাদী, বাবা মা সবাই থাকে। নায়েরা কোন আলাদা রুম নেই।সামনের রুমে দাদী ঘুমায়। রুমটা যা করে রাখে না!
নায়েরার মাঝে মাঝে মনে হয়, অয়নির বাসাটা কি সুন্দর সাজানো, ছবির মতো!ওদের যদি এমন একটা বাসা থাকতো!
অয়নির আলাদা স্টাডি রুমও আছে, আর নায়েরা পড়ে ডাইনিং টেবিলে বসে, কত পার্থক্য দুজনের!
অয়নিও ভাবে, নায়েরার বাবা মা একসাথে থাকে, ওরা তিন ভাইবোন এক রুমে থাকে, কী মজা, সারাদিন গল্প করে।ছুটির দিন সকালে ওরা একসাথে পাতলা খিচুড়ি খায় সবাই একসাথে বসে। অয়নি একদিন গিয়েছিল।
ওরা কত গল্প করে তখন।অয়নির ছুটির দিন কাটে একা একা।মা সেদিন রেস্ট নেন। বিকেলে বাইরে যেতে পারেন, অয়নির টিচার আসলে আর ওর যাওয়া হয় না।
নায়েরার ফোন রাখার পর অয়নির হাসিব ভাইয়ার কথা মনে হলো! ইশ, আজকের মতো যদি হাসিব ভাইয়া সব সময় ওর পাশে থাকতেন!
অয়নি চিন্তা করে, একটা ছোট বাসা থাকতো দুজনের।
অয়নিকে নিয়ে হাসিব ভাইয়া কোন নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতেন, গল্প করতেন! যেদিন অনেক বৃষ্টি হতো, দুজনে একটা দোলনায় দোল খেতে খেতে ভিজত! বিকেলে কফির মগ হাতে একসাথে গান শুনত।অয়নির আর কখনো একা লাগত না!জীবন কেন এমন হয় না, কল্পনার মতো!একটা জগৎ যদি আলাদা হতো, যে জগতে হাসিব ভাইয়া অয়নির জন্য থাকবে!
এসব ভাবতে ভাবতে অয়নি খাতায় আঁকিবুঁকি করছিল।
আপুমণি এসে রাতে খেতে ডাকলেন।চিন্তার সুতো কেটে গেল।
হাসিব বাসায় ঢুকল আটটার কিছু পরে।পাপাই দৌড়ে এলো হাসিবকে দেখে।ছেলেটা একদম বাপ পাগল।
বাপ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।
রাণী জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার এত দেরী করলে কেন!
এটার উত্তর আসলে রাণী চায় না। শুধু এমনিতেই জিজ্ঞেস করা।
হাসিব উত্তর দিলো, আর বলো না, আমার একটা স্টুডেন্ট আছে না যাকে দুদিন বাসায় পড়াই, বান্ধবীদের সাথে নিউমার্কেট এসে সবাইকে হারিয়ে ফেলেছে!
-আচ্ছা, অয়নিতা? রাণী বলল।
-হুম, ওর সাথে দেখা হয়ে গেল, মেয়েটা কখনো একা বেড়িয়েছে বলে মনে হয় না, ওকে পৌছে দিয়ে এলাম।
-ওর তো বাবা মা সেপারেটেড, তাই না?
-হু, হাসিব উত্তর দিলো!
রাণী হাসতে হাসতে বলল, এই বয়েসী মেয়েরা কিন্তু খুব আবেগি হয়, সাবধান!
হাসিব হাসল, রাণী ওর ক্লাশমেট ছিল , ওরা বিয়ে করেছে মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরপরই, মেয়েটা খুব ভালো, এই যে ও চাকরি করতে চায়নি, কখনো ওকে জোরও করেনি। নিজে একটা স্কুলে চাকরও করেছে।পাপাই, সংসার, চাকরি সবকিছু একা হাতে সামলে যাচ্ছে!
রাণীর কথাটা হাসিব ভাবল, অয়নিতার পরিবর্তনটা ও বুঝতে পারছে, তবে মেয়েটা প্রাণপন চেষ্টা করছে অনুভূতিটা লুকিয়ে রাখতে। ওর সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে ওকে একটু বোঝাতে হবে।
এমনিতেই দুঃখী মেয়ে, বুক হয়তো চাপা কষ্ট নিয়ে ঘোরে।
কোনভাবেই যেন নতুন কষ্ট যোগ না হয় ওর জীবনে।

অয়নির মা বাসায় ঢুকলেন তখন ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চান্ন।অয়নির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন লাইট অফ।
দরজা খুলেছেন তার মা, অয়নির আপুমণি হাজেরা বেগম।
তিনি বললেন, নানুমণি ঘুমিয়েছে।
-রাত বেশি হয়ে গেল ফিরতে! সেই রেডিসন থেকে পুরো রাস্তা জ্যাম।একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু হবে, তাই ইউএন থেকে প্রতিনিধি দল এসেছে, ওদের সাথেই কয়েকদিন ধরে মিটিং চলছে। তাই রোজ ফিরতে রাত হচ্ছে।
অয়নির মা একা একাই কথাগুলো বলছিলেন।যদিও এ বয়সে এসে কাউকে জবাবদিহি করার কোন জায়গা নেই, তবুও সংসারের কিছু অলিখিত নিয়ম আছে। সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে, মানুষ সেগুলো মেনে চলে।
হাজেরা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, রাতে খেয়েছিস তো?
-হুম, খেয়ে এসেছি। শুধু ওষুধ খেতে হবে।
হাজেরা বেগম বসলেন ড্রয়িং রুমে। মনির সাথে কথা বলতে হবে কিছু। মণিকা অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলেন।
বের হয়ে দেখলেন, মা ঢুলছে সোফায় বসে, তিনি বুঝতে পারলেন, মা কিছু বলবেন।অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালেও বলা যেত। এমন কী বলতে চান যে এত রাত জেগে আছেন!
-মা,
মণিকার ডাকে হাজেরা বেগম চোখ মেললেন।
-গোসল করেছিস?
-হ্যা, কী বলবে বলো!
হাজেরা বেগম ভণিতা করলেন না। সরাসরি বললেন, নানুমনিকে একটু সময় দাও তুমি!
গম্ভীর কথা বলার সময় মা তুমি করে বলেন।
– কেন, ওর কী কোন সমস্যা হয়েছে, ওকে তো সময় দেই মা, ছুটির দিনে ওকে নিয়ে বাইরে যাই। এই কয়েকদিন তো নতুন প্রজেক্টের কাজ নিয়ে আমি খুব ব্যস্ত! আর বাসায় তো তুমি আছোই!
হাজেরা বেগম বললেন, তোমার বাবা বেঁচে থাকতে তোমাকে আবার বিয়ে করার কথা বলেছিল, তুমি শুনলে না!
– আমি আবার বিয়ে করলে কী অনির ভালো হতো মা?
হাজেরা বেগম বেশি কথা না বলে শুধু বললেন ওর হয়তো আরেকটা ভাই বোন থাকতো!মেয়েটা বেশিরভাগ সময় একা থাকে। চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে।
– মা এখন সব বাচ্চারাই এমন। নিজেকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসে।
হাজেরা বেগম বললেন, তুমি কী ভাবছ, বিয়ের চিন্তা কী পুরোপুরি বাদ দিয়েছ?
মনি হেসে বললেন, মা ছাদনাতলায় আমার আর যাওয়ার শখ নেই, আমি ভালো আছি, অনিকে নিয়েই থাকতে চাই!
হাজেরা বেগম উঠতে উঠতে বললেন, অনিকে নিয়ে থাকতে চাও, আদৌ সেটা থাকছ কী?
বলে চলে গেলেন রুমের দিকে.
মণিকা ড্রয়িংরুমে একা বসে রইলেন কিছুক্ষণ। সে কী ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না!এই তো দু সপ্তাহ আগে অনিকে পাঁচটা টপস কিনে দিয়েছেম, গল্পের বই, সিডি, গিটার যা যা চেয়েছে। বাইরে গেলে ওকে নিয়ে যায়। ওর রেজাল্ট একটু খারাপ হলো বলে টিচার বাসায় নিয়ে এসেছে। তাহলে অনির কী সমস্যা হচ্ছে? এমন না যে অনির বাবার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ বলে মন খারাপ হবে।প্রতি সপ্তাহে তার সাথেও দেখা হচ্ছে!
অনির সাথে কথা বলতে হবে একবার।
অনি অবশ্য খুব চুপচাপ, নিজের সমস্যার কথা বলবে না, তাহলে?
দিন দশেক পরে একটা ট্যুর আছে কক্সবাজারে।প্রজেক্টের কাজ হয়ে গেলে ইউএন রিপ্রেজেনটেটিভ দের নিয়ে কক্সবাজারে যাওয়ার কথা।অনিকে নিয়ে যাবে। তাহলে ওর মনটা নিশ্চয়ই ভালো হবে!
আর টিনএজ বয়সটা এমনই। একটি অস্থির, নিজেকে নতুনভাবে চেনার সময়।এই সময় থাকবে না!এসব ভেবে মনিকা মনটা শান্ত করলেন।কতক্ষণ টিভি দেখলেন।
আসলে অয়নির বাবার সাথে এত অশান্তি হয়েছে যে সংসার করার ইচ্ছেটাই আর হয় না।
কাজ আর অয়নি, এই দুটোই তার জীবনের প্রায়োরিটি!
মনিকা ঘুমুতে গেলেন তখন রাত দেড়টা বাজে।

চলবে
শানজানা আলম