তোমার চোখের অনন্ত মায়ায় পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
244

#তোমার_চোখের_অনন্ত_মায়ায়
#গল্পছোঁয়া (Jannatul Ferdous Mahi)
#পর্ব_১৭

গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই হুঁশে আসলো ইয়ানা,খেয়াল করে দেখে ইন্তিহাজ ওর গালে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে,আবেশে চোখ বুজে নিলো ইয়ানা।ইন্তিহাজ ইয়ানা’র দু’গালে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে ওর নাকের সাথে নিজের নাক ঘষা দিতেই এক ঝটকায় চোখ মেলে তাকালো ইয়ানা,ছিটকে সরে আসলো ইন্তিহাজের থেকে,ইন্তিহাজ এগিয়ে গিয়ে ইয়ানা’কে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

—এতো বোকা কেন তুই বলতো,বড় হচ্ছিস,বুদ্ধি কবে হবে তোর
—কি করছো,ছাড়ো আমাকে
—আর কিছুদিন সহ্য কর,তারপর আর তোকে জ্বালাতন করবোনা,স্পর্শ করবোনা,বকবো না,যেটা মন চায় করিস,কেউ বারণ করতে আসবে না
—হ্যাঁ,তখনতো শিমলা’র সাথে রোমান্স করবে,আমাকে কেন জ্বালাতন করতে আসবে।যাওনা যাও,এখন থেকেই প্র্যাকটিস করা শুরু করে দাও,আমাকে ছাড়ো
—তুই কোনোদিনই আমাকে বুঝবিনা ইয়ানা,আমি জানতাম মেয়েদের সিক্সসেন্স অনেক সার্ফ হয়,ইভেন সাইকোলজিও এটাই বলে,কিন্তু তোর ক্ষেত্রে কি থিওরি টা বদলে গেলো নাকি তুই বুঝেও না বোঝার অভিনয় করছিস কোন টা?

—আরে আজবতো,কি বুঝবো আমি,কি বুঝাতে চাও আমাকে?
(যখন খুশি অত্যাচার করবে আমাকে,বকাঝকা,শাস্তি দেওয়া,কিস করা এসবের বেলায় আমি আর বিয়ে করার বেলায় শিমলা,বাহ্,অসাধারণ।আমি আর কিছু বুঝতেও চাইনা,তুমি একটা স্বার্থপর,ঠকবাজ।তানাহলে আমার ফিলিংস নিয়ে এভাবে খেলা করতে না,বিয়েতে অসম্মতি থাকলে প্রথমবারের মতোই রিয়াক্ট করতে কিন্তু না তুমিতো চুপ করে আছো,আর এদিকে জোরকদমে বিয়ের তোরজোর চলছে।হবেইতো,শিমলা সুন্দরী,বাধ্য মেয়ে,আর আমি বেশি কথা বলি,তাইতো ছোট থেকেই আমার সাথে এমন করো,কখনো ভালোবাসোনি,শুধু প্রয়োজনে ইউজ করে গেলে,আই মিন রাগ ঝারার বস্তু হিসেবে।আমায় কাঁদিয়ে শাস্তি দিয়ে মানসিক শান্তি পাও যে)—কথাগুলো মনেমনে বিরবির করলেও মুখফুটে বলার সাহস ওর হলো না।

ইন্তিহাজ ইয়ানা’কে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে বললো,

—একটা কথা বলবি?
—(নিশ্চুপ)
—আমি যদি না থাকি তুই কি ভুলে যাবি আমায়?আমার জায়গাটা কি অন্যকারো হয়ে যাবে বলনা?
—মানে?বুঝলাম না ভাইয়া
—আবার ভাইয়া,আমি কি তোর মায়ের পেটের ভাই (কিছুটা রেগে সরে এসে বললো ইন্তিহাজ)
—ভাইয়া
—যা এখানে থেকে,আমার রুম থেকে বের হ
—কি হলো আবার,আমি কি জেসে আসছি নাকি,তুমিই তো নিয়াসলে,আবার বের করে দিচ্ছো
—ইয়ানা,মাথা গরম করাস না,তোর ভালোর জন্যই বলছি যা এখানে থেকে
—ভাইয়া,আমি ব…

ইন্তিহাজ চোখ গরম করে তাকাতেই ইয়ানা ভয়ে ঢোক গিলে বেড়িয়ে গেলো।


পরদিন বিকালে…
বহ্নি কে বিদায় দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরেছে ইন্তিহাজ, ছেলেরা সহজে কাঁদেনা,তারা অনেক শক্ত প্রকৃতির হয়,কিন্তু আজ নিজের একমাত্র বোন’কে বিদায় দিতে গিয়ে কান্না যেন বাঁধ মানছে না,বহ্নিও কাঁদছে,কিন্তু তাকে তো যেতেই হবে।
বহ্নি’র দুজন ননদ ইন্তিহাজের থেকে বহ্নি’কে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো,হাসান মাহমুদ এসে ইন্তিহাজ কে ধরলো।
আজকে এই শুভ বিবাহের দিনে হাসান মাহমুদ না এসে আর থাকতে পারেনি,ছোটবোন হিসেবে বহ্নিকে সে অনেক ভালোবাসতো,তার এই বিশেষ দিনে না এসে কি উপায় আছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও ইন্তিহাজের মুখোমুখি আসেনি সে,কিন্তু এখন ইন্তিহাজের এমন অবস্থায় সে নিজের ইগো টা ধরে রাখতে পারলোনা,

—ইন্তিহাজ নিজেকে সামলা,তুই এভাবে ভেঙে পরলে আঙ্কেল আন্টির কি হবে,ওদেরকে কে সামলাবে বলতো?আর বহ্নি?ও কি শশুরবাড়ি গিয়ে শান্তি পাবে,মনতো এখানেই পরে থাকবে, কষ্ট পাবে,এমন করিস না ভাই।আমাদের সেই ছোটবোন টা আজ নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে,নতুন জায়গায় পদার্পণ করতে চলেছে,হাসিমুখে বিদায় দে,ওর খুশিটাই তো আমাদের কাছে সব,বল,শান্ত হ,দেখ বহ্নি ও কাঁদছে (হাসান)

হাসানের সাউন্ড পেয়ে অবাক চাহনিতে তাকালো,হাসান কে জড়িয়ে ধরে এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলো ইন্তিহাজ।
ইন্তিহাজের মা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরেছেন,বাবা এখানে উপস্থিত নেই,হয়তো কোনো এক আড়ালে বসে সকলের অগোচরে নিজের একমাত্র মেয়ের জন্য চোখের পানি ফেলছেন।
নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই কান্নারা বুক ফেটে যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে,বহ্নি’র রুমে বহ্নি’র জামাকাপড় গুলো জড়িয়ে কান্না করছে ইয়ানা।মিথিলা ওর পাশে চুপচাপ বসে আছে,কান্না করলে মন হালকা হবে,সেকারণেই ইয়ানা’র কান্না থামানোর চেষ্টা করেনি মিথিলা।
কনে বিদায় হতেই সমস্ত আনন্দ,হাসি গুলো যেন দুঃখে পরিণত হলো,সকলের চোখেই পানি।


রাতে….
কারোরই মনমেজাজ ভালো নেই,মালেকা বেগম,প্রতিবেশি আপা,আমরূপালি জামান সবাই জোর করে সকলকে খাবার ঘরে এনেছে,টেবিলে এতো লোকের বসার জায়গা হবেনা বিধায় টেবিল সরিয়ে ফ্লোর ভালো করে মুছে সেখানেই একসঙ্গে বসেছে সবাই।
মালেকা বেগম সকলকে খাবার পরিবেশন করে নিজেও খেতে-খেতে বললেন,

—যাক,অবশেষে তাইলে বাড়ির বড় মিয়ার বিয়া হয়া গ্যালো,এবার বাকি আছে এই ছুড়িডা।
বলি ভাবি,ইয়ানা’র বয়স তো ১৯ হয়া গেছে,কয়দিন পর ২০হইবো,বিয়া দিবেন কবে,নাকি এইডারেও বড়ডার মতো আধবুড়ি কইরা বিয়া দিবেন

—আহ্,মালেকা।
কি এমন বয়স হইছে ওর,এখনো ইন্টার পরিক্ষাই দেয়নি (শফিক রহমান)

—আমেনা,কচ্ছিলাম যে আমার চেনাজানা একটা ছেলে আছে,দেখতে শুনতে পরিবার জায়গাজমি ভালোই।ছেলের নিজস্ব ব্যবসা আছে ঢাকাতে,আমার বাপের বাড়ির ওখানে ছেলের গ্রামের বাড়ি।আমারে ইয়ানার সাথে দিলে খারাপ হয়না,ভালোই হইবো।

—কি কও তুমি বউমা,ওই ছ্যামড়ার তো অনেক বয়স,আর বড় কথা হলো ওর তো বউ মরা,প্রথম বউ মরছে মাস দু-এক হইলো (আমরূপালি জামান)

—কিহ্,আমার আপুর সাথে বউমরা লোকের বিয়ের কথা বলছেন আপনি,আপনার মেয়ের সঙ্গে দিলেইতো পারেন।এখন বুঝলাম বহ্নি আপু কেন আপনাকে দেখতে পারে না, আপনি আসলেই একজন বদ*মায়েশ মহিলা,আমি বুঝিনা শিমলা আপু আপনার পেট থেকে জন্মালো কি করে,আপনার তো পেটেপেটে শয়তানি বুদ্ধি কিন্তু আমাদের শিমলাপু কতো ভালো,আপনার সঙ্গে কোনদিক দিয়েই কোনো মিল নেই (তৃষা)

—এই ছ্যামড়ি,বেশি কথা কস তুই
—ভাবি,আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা হয়নি,তার বিয়ের বয়স হলে ঠিকই বিয়ে দিব,অনেক ভালো পাত্র দেখে।
আপনার আমার মেয়ের বিয়ের জন্য ঘটকালি না করলেও চলবে (আমেনা খাতুন)

—কিহ্ কস,বিয়ার বয়স হয়নাই মানে?
আরে গ্রামে তো ১৫-১৬বছরেই মাইয়াদের বিয়া হয়া যায়,যদিও জানি দ্যাশের আইন অনুযায়ী ১৮বছর এর নিচে বিয়া দেওয়া ঠিক ল্যা,থানা পুলিশ হইবার পারে,কিন্তু ছ্যামড়ির তো ১৯ও শেষ হইতে চয়ল্লো,কিসের বয়স হয়নাই,হয়াতো বেশি

এসব কথাবার্তা শুনে ইয়ানা আর বসে থাকতে পারলোনা,খাওয়া ছেড়ে হাত ধুয়ে উঠে চলে গেলো রুমে, হাসান মাহমুদ মালেকা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,

—অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া কতোটা হার্মফুল আপনি জানেন?
অল্প বয়সে বিয়ে দিলে শরীরে নানারকম ক্ষতি হয়,মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।১৮বছরের নিচে বিয়ে দেওয়া একদম অনুচিত,তাই বলে ১৮হলেই যে বিয়ে দিতে হবে এটাও ঠিক নয়।
আমার মতে একটা মেয়েকে মিনিমাম ২২বছর বয়স হলে তনে বিয়ে দেওয়া উচিত

—একদম,আমিও সেটাই বলি।
অল্প বয়সে বিয়ে ফিজিক্যালি এন্ড মেন্টালি,অনেক হার্মফুল।যে বয়সে তাদের পড়াশোনা,খেলাধুলা করার সময়,তখন তাদের সেই ছোট্ট মস্তিষ্কের ওপর বিবাহ,সংসার,স্বামী নামক দ্বায়িত্ব এসব চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত,এসবের কি বোঝে তারা।
আমার বহন ক্ষমতা ১০কেজি,আমার ওপরে যদি ৫০কেজি চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমি কি করে সেটা বহন করবো (ইন্তিহাজ)

—ক্যান,আমরা কি বিয়াসাধি করিনি নাকি,আমারতো ১৩বছর বয়সে বিয়া হইছিলো।তোমার দাদির তো ৮বছর বয়েসে,আমরা কি মই*রা গেছি নাকি,এখনো দিব্যি বাঁইচা আছি,দু-হাতে সংসার ছেলেপেলে সামলাইছি (মালেকা বেগম)

—বুঝানো তাদের যায় যারা বুঝতে চায়,আপনাদের মতো মানুষকে বোঝাতে যাওয়া মানে নিজের বোকামির পরিচয় দেওয়া (হাসান মাহমুদ)


বিছানায় মন খারাপ করে বসে আছে ইয়ানা,সিনহা এসে ইয়ানা’র পাশে বসে হাতে হাত রেখে বললো,

—মন খারাপ?
—(নিশ্চুপ)
—আমি বয়সে তোমার অনেক বড়,বড় আপু হিসেবে কিছু কথা বলি শোনো,কখনো অন্যের কথায়,আবেগে বশীভুত হয়ে কোনো ডিসিশন নিবেনা,আপসেট হবে না।যেটা অন্যায় মনে হবে,প্রতিবাদ করবে,প্রতিটি বিষয়ে ভালোভাবে ভাবনাচিন্তা করে তবেই ডিসিশন নিবে।
আমরা চোখের সামনে অনেককিছুই দেখি,যেগুলোর সবটা সত্যি না-ও হতে পারে,হতেও তো পারে সেগুলো তোমার ভ্রম বা কোনো ছলনা।পরিস্থিতির জন্য এমন হয়ে চলেছে,কিন্তু সেটা তো সত্যি নয়,নিজের আপনজনের প্রতি আস্থা রাখতে শেখো।তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো ইয়া,বোধবুদ্ধি জ্ঞান তোমার হয়েছে,আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না,বিবেক ও ব্রেইন দিয়ে ভাবতে হবে বুঝেছো

সিনহা’র কথাগুলো শুনে ইয়ানা সিনহা’র দিকে তাকালো,সিনহা ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে আবারও বললো,

—সত্যি করে একটা কথা বলোতো,কখনো কি কারোর জন্য তোমার মনে অন্যরকম কিছু অনুভব করেছো,আই মিন লাভ?
—এসব কি বলছো তুমি আপু?
—রিল্যাক্সড,আমার সঙ্গে নির্দিধায় শেয়ার করতে পারো,আমি তোমাকে হেল্প করবো প্রয়োজনে,আচ্ছা সে-সব রাখো,ক্লিয়ার করে বলোতো,তুমি কি ইন্তিহাজ কে পছন্দ করো?
—আপু…
—চুপ করে থেকোনা ইয়ানা,হাতে সময় স্বল্প
পরে কিন্তু চাইলেও কিছু করতে পারবে না,ইন্তিহাজ অনেক দূরে সরে যাবে তোমার থেকে।তুমি বলো আমাকে
—(নিশ্চুপ)
—ওকে ফাইন,আমি তোমাকে সময় দিচ্ছি ভাবার জন্য।
তোমার হাতে আজ ও কালকের রাত পর্যন্ত সময় আছে,কাল রাতে ঠিক এইসময় আমি তোমাকে আবারও প্রশ্ন করবো,তুমি উত্তর দিবে আমাকে,এরপর কোনো সময় পাবে না তুমি,হারিয়ে ফেলবে তাকে,সো আশা করি তুমি পজিটিভ আনসার করবে।
আমি আসি


৪দিন পর,রাত ৮টা
জগ থেকে গ্লাসে জুস ঢেলে নিয়ে জুস খাচ্ছে ইয়ানা।
বহ্নি’র বিয়ের ঝামেলা মিটলেও এবারে শিমলা ও ইন্তিহাজের বিয়ে নিয়ে মেতেছে সবাই।
কোনো অনুষ্ঠান নয়,সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাড়িতেই ছোটখাটো আয়োজন করে কালমা-কাবিন করিয়ে রাখা হবে,ইন্তিহাজ দেশে ফিরলে তখন বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।এইতো গতকালই বহ্নি শশুরবাড়ি গিয়েছে,নেক্সট উইকেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হবে।
মালেকা বেগমের খুশি যেন পরেনা,তিনি যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেয়েছে এমন ভাব,কতজনকে যে কল করে বিয়ের সুসংবাদ দিচ্ছে তার কোনো ঠিক নেই।
তৃষা দৌড়ে এসে ইয়ানা’কে বললো,

—আপু,আব্বু অনেকগুলো পাঞ্জাবির কালেকশন এনেছে।
ইন্তিহাজ ভাইয়ার জন্য আমরা পাঞ্জাবি চুজ করবো,চলো
—মানে,কিসের পাঞ্জাবি?
—বিয়ের,তুমি কোন জগতে থাকো বলোতো।
আরে কিছুদিন পরেই তো ইন্তিহাজ ভাইয়া এমবিবিএস ডিগ্রির জন্য কানাডা যাবে ৫বছরের জন্য, তাই সবাই মিলে ডিসিশন নিয়েছে নেক্সট উইকে মানে সামনে সোমবারে কালমা-কাবিন করিয়ে রাখবে।আজ বাদে হাতে আর মাত্র ২দিন আছে বুঝলে

—কোই আমাকে তো কেউ এই বিষয়ে কিছু জানায়নি,ইন্তিহাজ ভাইয়াও আমার থেকে আজকাল দূরে দূরে থাকে,কথা বলে না আমার সাথে।
—তুমিতো গতরাতে খেতে আসোনি তাই জানো না,তখনই সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে
—ওহ্,ইন্তিহাজ ভাইয়াও উপস্থিত ছিলো নাকি?
—হুম,আমিতো ভাবতেই পারিনি ভাইয়া এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে।
—ভালো,আচ্ছা তুই পাঞ্জাবি চুজ কর,আমার ভাললাগছেনা,আমি রুমে যাচ্ছি
—আরে আপু,তুমি তো ভালো চয়েজ করতে পারো,তোমাকে ছাড়া কিভাবে হবে।
ইন্তিহাজ ভাইয়াও কিন্তু বলেছে তোমাকে চুজ করে দিতে

ইয়ানা চলে যাওয়ার সময় তৃষা’র বলা শেষ কথা টা শুনে থেমে গেলো,তৃষা’র দিকে ঘুরে বললো,

—কি বললি?
—হুম,ইন্তিহাজ ভাইয়া নিজেই বলেছে তার বিয়ের পাঞ্জাবি তোমাকে চুজ করতে হবে
—আচ্ছা চল


রাত ২টা…
বহ্নি’র রুমে বহ্নি’র বিছানায় টান হয়ে শুয়ে আছে ইয়ানা,দৃষ্টি তার বন্ধ ফ্যানের দিকে,শীত শীত পড়ায় এখন ফ্যান সেরকম চালানো হয়না,রাতে তো এমনিতেই ঠান্ডা লাগে।
ইয়ানা’র চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে, সেদিন সিনহা’র কাছেও নিজের মনের কথা শেয়ার করতে পারেনি ইয়ানা,এক অপরিচিত মেয়ের কাছে এসব বলতে ভীষন আনইজি ফিল হচ্ছিলো ওর,আর তাছাড়াও ইয়ানা নিজেও শিওর নয় ও আদৌও ইন্তিহাজ কে ভালোবাসে কিনা।আর ইন্তিহাজ,সে-তো ওইদিন গায়ে হলুদের রাতের পর থেকে ইয়ানা’র সঙ্গে কথা বলাতো দূর,সামনেই আসে না,এড়িয়ে এড়িয়ে চলল,দূরত্ব বজায় রাখে।ইয়ানা খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকলে ইন্তিহাজ আসে না,দিনের বেলায় ব্যাপারটা সামলে নেওয়া গেলেও রাতের বেলায় সবাই একসঙ্গে খাবার খায়,ইন্তিহাজের খাওয়া হবে না চিন্তা করেই ইয়ানা রাতে খাবার খায়না,ডায়েট করার অজুহাতে নিজের রুমে বসে থাকে।
আগে ইয়ানা না খেয়ে থাকলে ইন্তিহাজ নিজে এসে খাবার খাওয়াইতো আর এখন তো হাহ্।এরকমই হয়,হবু বউকে ভালোবেসে ফেলেছে যে।আজকাল ইন্তিহাজের রুমে শিমলা’র ভালোই আসাযাওয়া চলে,আগে যেমনটা ইয়ানা যেতো।শিমলা’কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে লজ্জামিশ্রীত হাসি দিয়ে চলে যায়। শিমলা’র ওপর রাগের কারণে ইয়ানা বহ্নি’র রুমে একা থাকে,রাগ,হিংসা,চাপাকষ্টে ইয়ানা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে,চোখের নিচ দিয়ে ডার্কসার্কেল পরেছে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে।।
নিজের ফোনটা নিয়ে ইন্তিহাজের ছবি বের করে নিজের মনের গহিনে থাকা সকল অভিযোগ ব্যক্ত করে একসময় সেভাবেই ঘুমিয়ে গেলো ইয়ানা।
হঠাৎ পেটে কারোর হাতের ঠান্ডা স্পর্শে শিহরিত হয়ে ঘুম ভেঙে গেলো ইয়ানা’র,ঝটপট করে চোখ মেলে তাকালো সে। ড্রিমলাইটের আলোতে এক পুরুষালি অবয়ব স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে,অবয়ব টি ইয়ানা’কে চেপে জড়িয়ে ধরে আছে,ইয়ানা’র পরনে থাকা টপস গেঞ্জি টা সরে যাওয়ায় সেখানে পুরুটির হাতের ছোঁয়ায় ঠান্ডা লাগছে,হঠাৎ নিজের হাতের ওপর ২ফোটা গরম পানি পরতেই চমকে উঠলো ইয়ানা,পুরুষটি কি কান্না করছে।ইয়ানা নড়েচড়ে উঠে ভয়ে জোড়ে চিৎকার দিতে গেলেই পুরুষালি অবয়বটি নিজের হাত দিয়ে ইয়ানা’র মুখ চেপে ধরলো…..

To be continue……

#তোমার_চোখের_অনন্ত_মায়ায়
#গল্পছোঁয়া (Jannatul Ferdous Mahi)
#পর্ব_১৮

ইয়ানা নড়েচড়ে উঠে ভয়ে জোড়ে চিৎকার দিতে গেলেই পুরুষালি অবয়বটি নিজের হাত দিয়ে ইয়ানা’র মুখ চেপে ধরলো,ফিসফিস করে সে বললো,

—হুসস,নো সাউন্ড
আমি ইন্তিহাজ

কথাটা ব’লেই ধীরেধীরে নিজের হাত সরিয়ে নিলো ইন্তিহাজ, ইয়ানা জোরেজোরে কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে ধীরকণ্ঠে বললো,

—তুমি,কিন্তু তুমি আমার রুমে কি করছো? (উঠে বসে বললো ইয়ানা)
—আমি একদম ভালো নেই ইয়ানা,আজ রাতটা তোর সঙ্গে ঘুমাতে দিবি প্লিজ,একদম ডিস্টার্ব করবো না তোকে,শুধু একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই আমি।

—কাল বাদে পরশু শিমলা’র সঙ্গে তোমার বিয়ে,আর তুমি আজকে আমার সঙ্গে রাতে ঘুমাতে এসেছো?ভাইয়া আমরা দু’জনের কেউই আর ছোটো নই,একসঙ্গে রাত কাটানোর মানে বুঝো?তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ভাইয়া,তোমার এধরণের আচরণ শোভা পায় না।

—আমরা কি আগে কখনো একসঙ্গে ঘুমোইনি,আজ যে এভাবে কথা বলছিস,কোই আগেতো কখনো বলিসনি,এক রাতেই অনেক বড় হয়ে গেছিস তা-ই নারে?

—আগের বিষয় আর এখনকার বিষয় টোটালি আলাদা,আই থিঙ্ক এই বিষয়টা আমার চেয়ে তুমি ভালো বুঝবে।
বাড়িতে তোমার উডবি ওয়াইফ,তার বাবা-মা আছে,ঘুনাক্ষরে ও যদি এসব জানতে পারে তখন কি হবে বুঝতে পারছো?

ইন্তিহাজ কোনো কথা না বলে ইয়ানা’র কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো,ইয়ানা’র কেনো কথা ধ্যান না দিয়ে চোখ বুজে বললো,

—ডন্ট ডিস্টার্ব মি,ঘুমাতে দে আমায়।
চুলে একটু বিলি কেটে দিস,আমি আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই,হয়তো এমন সুযোগ আর কখনো হবে না।
আজকের রাতটা শুধু সহ্য কর,এরপর আর তোকে জ্বালাতন করবো না।

—না করাটাই স্বাভাবিক,তখনতো তোমার বউ থাকবে তাইনা?
—একটা কথা বলি,দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য দিতে হয়,তানাহলে পরে আফসোস করেও কুল পাবি না।কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেলেও সেই সময়টা তুই কখনো ফিরে পাবিনা,ইট’স রিয়ালিটি।

—কি বলতে চাইছো,বুঝলাম না ভাইয়া
—বুঝতে হবে না তোকে,যে বুঝতে চায়না তাকে হাজারবার বুঝিয়েও লাভ নেই,কিন্তু হ্যাঁ একদিন ঠিকই বুঝবি,সেদিন হয়তো আমি থাকবো না,অনেক দেরি হয়ে যাবে ইয়ানা।

ইয়ানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

—আচ্ছা ভাইয়া একটা কথা বলোতো।হাজবেন্ড ওয়াইফের ব্লাডগ্রুপ পজিটিভ নেগেটিভ হলে কি সত্যিই বাচ্চা জন্মদানে সমস্যা হয়?বাচ্চা কি মা-রা যায়?বলো না?
মামনি,বহ্নি আপু বলেছে আলাদা ব্লাড গ্রুপের হলে নাকি বাচ্চা নেওয়া যায়না,জন্মের আগেই পেটের বাচ্চা মারা যায়,তাই ডিফারেন্ট ব্লাড গ্রুপের ছেলেমেয়েদের বিয়ে করতে নেই।
কি হলে ভাইয়া,বলো?আমি জানতে চাই,বলো না প্লিজ

ইন্তিহাজের থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ইয়ানা খেয়াল করে দেখে ইন্তিহাজ ঘুমিয়ে গেছে,ইয়ানা ফোঁস করে দম ছেড়ে ইন্তিহাজের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলো।


সকাল ৮টায় ঘুম ভাঙলো ইয়ানা’র,পিটপিট করে চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সে।হঠাৎ গতরাতের কথা মনে হতেই চমকে উঠে ইন্তিহাজ কে খুজতে শুরু করলো,কিন্তু কোথায় ইন্তিহাজ,রুমেতো নেই।এর মানে ইন্তিহাজ হয়তো আরও আগেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে,ভালোই হলো,কেউ দেখে নেয়নি,স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ইয়ানা।


সকাল ৯টা…
খাদিজাতুল নেসা ব্রেকফাস্টের জন্য সকলকে ডাকা-ডাকি করছেন,ইয়ানা চেয়ারে বসে কলার খোশা ছাড়িয়ে কলা খাচ্ছে।একে একে প্রায় সকলেই খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে।

—আজকে লুচি লাচ্ছা করেছি,ইন্তিহাজ কে ডাকো,আমাদের সঙ্গেই খেয়ে নিক ছেলেটা (আয়ুব জামান)
—ও তো আরও বেলা করে খায়,আধঘন্টা হলো ওয়াকিং করে এসেছে (খাদিজাতুল নেসা)
—শিমলা,যা-তো মা,ছেলেডারে ডাইকা আন (মালেকা বেগম)
—আচ্ছা

শিমলা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই ইন্তিহাজ এসে উপস্থিত হলো,ইন্তিহাজের পরনে ব্লাক শার্ট,এ্যাশ কালারের কোর্ট প্যান্ট।ইন্তিহাজ কে এভাবে দেখে খাদিজাতুল নেসা বললেন,

—কিরে,তুই কি কোথাও বেরোচ্ছিস?
—হুম,১১টায় ফ্লাইট আমার।
—ফ্লাইট মানে,কিসের ফ্লাইট? (অবাক হয়ে)
—কানাডা’র,আমি আজকেই কানাডা চলে যাচ্ছি
—হোয়াট,ফাইজলামি করছিস তুই?কাল শিমলা’র সঙ্গে তোর বিয়ে ভুলে গেছিস।কি ধরনের রসিকতা এগুলো? (রেগে বললেন খাদিজাতুল নেসা)
—সরি আম্মু,আমি আগেও বলেছি এখনো বলবো আমার পক্ষে এই বিয়ে করা পসিবল না,আমি এই কিছুদিন চুপ ছিলাম বলে এই নয় যে আমি বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি।আমি চাইনি আমার কারণে আমার বোনের বিয়েতে কোনোপ্রকার সিনক্রিয়েট হোক,তাই চুপ ছিলাম,বিয়ের ঝামেলা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম,এখন সব ঝামেলা শেষ,সে আমি আজকেই চলে যাচ্ছি,আমি আগে থেকেই সব রেডি করপ রেখেছি,১০টায় বের হবো,এয়ারপোর্টেও বেশকিছু ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করতে হবে।

—এসব কি ধরনের রসিকতা ইন্তিহাজ,বিয়ের সব আয়োজন করা হয়ে গেছে,আর তুমি এখন এসব বলছো?
বিয়েতে তোমার সম্মতি নেই সেটা আমাদের আগে কেন জানাওনি,তাহলে আমরা এতো আয়োজন করতাম না।
আর শিমলা,ওর কি হবে বলোতো?মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট করতে পারো না তুমি (আমেনা খাতুন)

—আমি কারোর লাইফ নষ্ট করিনি কাকিয়া,শিমলা’র সঙ্গে এ বিষয়ে আমার প্রথমেই কথা হয়েছে,ও শুরু থেকে সবটাই জানতো।আমিই বলেছিলাম বহ্নি’র বিয়ের ঝামেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকতে।

—এসবের মানে কি,আগে কেন বলিসনি তুই (আয়ুব জামান)
—দাদিমা ইমোশনালি ব্লাকমেইল করেই তোমাদের সবার ব্রেনওয়াশ করে নিয়েছে,আমি তখনই রিফিজড করলে দাদিমা আর শিমলা’র মা দু’জনে মিলে আবারও কোনো কাহিনি করতো,আমি সেরকম কিছু চাইনি তাই একয়দিন এভাবে চুপচাপ ছিলাম।

—এইসব কি হইতেছে,মামার বাড়ির আবদার নাকিগো ভাবি।
আমি আমার বাপের বাড়ির সবাইরে বিয়ার কতা কইছি,এখন আমার মিয়ার কি হইবো,গ্রামে যায়া মুখ দেখামু কি কইরা।
আমি কিছু জানিনা,এই বিয়া করাই লাগবো,আমি এখুনি আম্মারে ডাইকা আনতাছি (ন্যাকা কান্না করে বললেন মালেকা বেগম)
—মা,তুমি থামো।
জোর কইরা তুমি আমার বিয়া দিতে পারবা কিন্তু সুখ কিনতে পারবানা।কেউ যদি আমারে না চায় তাইলে তার সাথে জোর কইরা বিয়া দিয়া কি লাভ কওতো,বিয়ার পর তো আমি জীবনেও সুখি হমু না।তুমি কি চাওনা আমি সুখি হই (শিমলা)

—তুই চুপ কর হারা**দি,প্রথম থাইকা সব জাইনাও কিছু কইসনাই আমারে,পাখা বড় হয়া গেছে তাইনা,মুখে খই ফুটতেছে।আজ এই বিয়া না হলে কি হইবো জানিস,জীবনে তোর আর বিয়া দিতে পারুমনা,মাইনষে কোইবো মাইয়াডার মনে হয় কুনো খুত আছে তাই বিয়া ভাইঙ্গা গেছিলো।
—ইন্তিহাজ,উনি কিন্তু ঠিক বলেছেন,তোমার থেকে এমন ধরনের বোকামি আশা করিনি,রীতিমতো অন্যায় করেছো তুমি,তোমাকে এখন এই বিয়ে করতেই হবে।
বাবা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি,এই ৫বছরে মেয়েটাকে তোমার যোগ্য করে গড়ে তুলবো।

—অন্যায়তো তুমি আমার সাথেও করছো আম্মু,নেহাত হাতে সময় স্বল্প তাই কোনোরকম রেষারেষি তে গেলাম না,কিন্তু মনে রেখো তাকে তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখে যাচ্ছি (নিজের মায়ের সামনে দাড়িয়ে ধীরকণ্ঠে বললো ইন্তিহাজ)

মালেকা বেগম আমরূপালি জামান কে ডেকে আনলে তিনি চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন,

—আমি এইসব কি শুনছি দাদুভাই,তুমি নাকি দেশ ছাইড়া চলে যাচ্ছো,আমার শিমলা রানিরে নাকি বিয়া করবেনা।
—আমিতো শুরু থেকেই বলেছিলাম এই বিয়ে করা আমার পক্ষে পসিবল না,আজকে ১১টায় আমার ফ্লাইট।
—ওরে হতচ্ছাড়া,পালায়া যাবি কোই,বিয়া তোরে করতেই হইবো।
—আম্মা,আমার ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর ওপরে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত আমরা চাপিয়ে দিতে পারিনা,জীবনটা ওর।
বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার,তুমি আর কথা বাড়িওনা প্লিজ। ছেলেটা একটু পর চলে যাবে,যাওয়ার আগে অন্তত কোনোরকম সিনক্রিয়েট করো না কেউ,পরে নিজেরাই অনুশোচনায় ভুগবে (ইয়াকুব জামান)

—তুমিও এই কথা বলছো?
কিন্তু মেয়েটার কি হবে ভেবে দেখছো (খাদিজাতুল নেসা)
—আমার মাইয়ার কিছু হইবো না ভাবি,আমার বউয়ের কথায় আপনেরা কিছু মনে করবেননা।আইজ আপনাদের দয়াতেই বেঁচে আছি,আপনাদের ঋণ আমি মরে গেলেও শোধ করবার পারুমনা।আমার বউ বামন হয়া চাঁদে হাত দিবার চাইছিলো।
বারবার কইরা কইছি এতো লোভ কইরোনা মালেকা,অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু।কিন্তু ওয়ে আমার একটা কতা শুনেনাই,এবার বুঝুক কেমন লাগে।
কে কইছিলো মাতব্বরি কইরা লোকজনদের বিয়ার কথা ঢোল পিটায়পিটায় কইতে,এখন আবার প্যা-ন্দা শুরু করছে (শফিক রহমান)

—থামো তুমি,বলি তুমি বাপ না সত্তুর,নিজের মেয়ের জীবন নিয়া টানাটানি চলতেছে আর তুমি আমারে দোষারোপ করতেছো।
আগে যদি জানতাম এই মাইয়ার লাইগা আমাগো মুখে চুনকালি পরবো তাইলে ওর জন্মের পরেই লবণ খাওয়ায়া মাই*রা ফালাইতাম।

—মা? (অসহায় কণ্ঠে বললো শিমলা)
—চুপ কর হতচ্ছাড়ি,আমারে মা কয়া ডাকবিনা কয়া দিলাম,আজ তোর জন্যি আমাগো মানসম্মান শেষ হয়া গেলো।
আগে ক্যান কইসনি,তাইলে একটা ব্যবস্থা করতাম।
—দোষতো ওর না,দোষ আমাদের ছেলেরও আছে।
আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি,শিমলা’র বিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাদের,আমরা দেখেশুনে ভালো পাত্র দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দিবো।

—হয়,ততদিনে এই ঢিঙ্গি মাইয়ারে ভাত দিয়া পালবো।
এমনেই অভাবের সংসার,নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা,এই ঢিঙ্গি মাইয়ারে পালতে পারুমনা (মালেকা বেগম)
—মালেকা,তুমি কি কও এগুলা,পাগল হয়া গেছো তুমি। শিমলা আমাদের কাছে বোঝা নয়,আমাদের নিজের মেয়ে ও,কি সব কইতাছো তুমি (শফিক সাহেব)
—দু’পয়সা কামানোর তো মুরদ নাই তুমার,সংসার ডা আমি সামলাই,বড়বড় ফুটানিয়ালা কতা বন্ধ করো তুমি।

—থামো তোমরা।
শিমলা আমাদের বাড়িতেই থাকবে,ওর ভরনপোষনের দ্বায়িত্ব আমাদের। (আয়ুব জামান)
—শুনেন ভাবি,আমি স্পষ্ট কতা কইতে ভালোবাসি।
স্ট্রেট কাট কইতাছি,আমাগো গেরামে দেখিতো,মেয়ের বিয়া দিলে পরে জামাই শশুরবাড়িরও দেখাশুনা করে,খরচ দেয়।
আমারও ইচ্ছা ছিল আমাগো শিমলা’র বিয়া দিলে ওর বর আমাগো সংসারটারেও দেখবো,খরচাপাতি দিবো,আমাদের অভাব অনটন ঘুচবো।আপনাগো আশাতেই মাইয়ার বিয়া দিইনাই এতোদিন,কিন্তু এখন কি হইবো।
—মালেকা,তোমার কি লজ্জাসরম বইলা কিছুই নাই,কি কচ্ছো তুমি,মাথা কি খারাপ হয়া গেছে তুমার? (শফিক রহমান)
—হ মাথা খারাপ হয়া গেছে,আমি আর এতো অভাব-অনটনের মধ্যি থাকতে পারুমনা।


বেলকনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে নিরবে চোখের পানি ফেলছে ইয়ানা,ইন্তিহাজ ওকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবে কল্পনাতীত ছিল ওর,ও এতবড় সিদ্ধান্ত নিলো অথচ কিছুই জানালো না।ইয়ানা’র ভাবনার মাঝেই ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রাখলো কেউ,গরম নিঃশ্বাসে চমকে উঠে পেছনে ঘুরতে চেষ্টা করতেই মানুষটি বলে উঠলো,

—হুসস,কাঁদছিস কেন পাগ*লি,আমিতো আজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি না,৫বছর পর আবারও ফিরে আসবো।
কোনো দুষ্টামি করবি না,তোকে যেমন রেখে যাচ্ছি এমনই থাকিস।

ইন্তিহাজের কণ্ঠ পেয়ে ইয়ানা ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্তিহাজ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দিলো,নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।
কিছুক্ষন পরে ইন্তিহাজ ইয়ানা’কে ছাড়িয়ে ওর কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

—তোকে বলেছিলাম তো,সময় আছে,এখনই বুঝে নে।
কিন্তু তুই তো বুঝেও অবুঝ,চলে যাচ্ছি তোকে ছেড়ে,অনেক দূরে,আর তোকে ডিস্টার্ব করবো না,খুশিতো তুই?

ইয়ানা অভিমানে ইন্তিহাজের থেকে সরে এসে উল্টোদিকে ঘুরে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বললো,

—এই জন্যই তুমি গতরাতে ওইসব বলেছিলে তাইনা,আমি কান্না করলেও তুমি আসবে না,অনেক দূরে চলে যাবে,এই সেই কারণ?
তুমি বিয়ে করছো না সেটা আমাকে আগে কেন বলোনি,আমাকে জানালে কি আমি সবাইকে বলে বেড়াতাম।
এতদিন অনেক ইগনোর করেছো,কেন ভাইয়া কেন?
আমার খারাপ লাগে তুমি কি বুঝো না ভাইয়া??

—যেদিন তোর মুখ থেকে এই ভাইয়া শব্দ টা নির্মুল করতে পারবি সেদিন নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি,আমার বলার প্রয়োজন হবে না (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ইন্তিহাজ)

—কি বলতে চাইছো তুমি?
—কিছু না,সময় হলে বুঝবি।
—তুমি কি সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছো ভাইয়া?
—হুম
আমাকে এভাবে বিদায় দিবি তুই,একটু হাস তো দেখি,এভাবে কান্না করলে কিন্তু অমঙ্গল হবে আমার,আমারও মন খারাপ হবে,আমি মরে য…

ইন্তিহাজ পুরো কথা শেষ করার আগেই ইয়ানা নিজের হাত দিয়ে ইন্তিহাজের মুখ চেপে ধরলো,

—বালাইশাট,এসব কি বলছো ভাইয়া,মাথায় একদম নেগেটিভ চিন্তা নিয়াসবে না।
—তাহলে হাসি দে-তো দেখি
—কবে আসবে আবার (মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো ইয়ানা)
—জানিনা
—কিহ্
—আরে আরে,৫বছর পরই আসবো।দেখতে দেখতে সময় চলে যাবে,ততদিনে তুইও অনেক বড় হয়ে যাবি।
—ভাইয়া,যাওয়ার আগে একটা কথা বলবে প্লিজ
—কি?
—ডু ইউ লাভ মি?
—(নিশ্চুপ)
—সত্যি করে বলো প্লিজ
—হঠাৎ এসব কেন বলছিস তুই? (গম্ভীর ভাবে)

—জানো ভাইয়া,মেয়েদের অনুমান শক্তি খুব প্রখর।কোনো পুরুষ যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে সে সেটা খুব সহজেই বুঝতে পারে।কোনো পুরুষ যদি তাকে মিথ্যা বলে তাহলে সে সেটা অনেকটাই অনুমান করে নিতে পারে।মেয়েরা সবকিছু বুঝেও বেশিরভাগ সময়েই কিছু না বুঝার ভান করে থাকে, কেবল সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। (ইন্তিহাজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো ইয়ানা)

এতক্ষণ ইয়ানা’র কথাগুলো মন দিয়ে শুনেছিলো ইন্তিহাজ, এবার কিছুটা সরে এসে বললো,

—অনেক দেরি করে ফেলেছিস ইয়ানা,আমার সময় হয়ে গেছে,যেতে হবে এবার।ভালো থাকিস,নিজের খেয়াল রাখিস।
—আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেনা তুমি…

ইন্তিহাজ কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে চলে যেতে নিলে ইয়ানা দৌড়ে গিয়ে ইন্তিহাজ কে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো…..

To be continue….

#তোমার_চোখের_অনন্ত_মায়ায়
#গল্পছোঁয়া (Jannatul Ferdous Mahi)
#পর্ব_১৯

ইন্তিহাজ কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে চলে যেতে নিলে ইয়ানা দৌড়ে গিয়ে ইন্তিহাজ কে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো,ইন্তিহাজ পেছনে ঘুরে ইয়ানা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে আবারও কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,

—চোখের পানি দ্বারা কাউকে বিদায় দিতে নেই,মুখে হাসি রাখতে হয়।
তোর ওই মায়াভরা চোখে আমি পানি দেখতে চাইনা ইয়ানা,সবসময় হাসিখুশি থাকবি,একদম দুষ্টামি করবি না।তুইতো আবার অল্পতেই সবাইকেই বিশ্বাস করিস,এটা অনুচিত,কে কখন কোন ক্ষতি করে দেয় বলাতো যায়না,বন্ধু সেজে আসবে বুঝতেও পারবি না।বুঝেশুনে চলাফেরা করবি,নিজের খেয়াল রাখিস।আর হ্যাঁ,মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে,পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স না হলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম।আমি সময় পেলেই মাঝেমধ্যে কল করবো তোকে।ভালো থাকিস।

কথাগুলো বলেই উল্টোদিকে ঘুরে ইয়ানা’র আড়ালে নিজের চোখের কার্ণিশে আসা পানিটুকু মুছে নিলো ইন্তিহাজ,বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।


রাত ৮টা
পড়ার টেবিলে বসে কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে ইয়ানা,ইন্তিহাজ বারবার করে বলেছে পড়াশোনা ভালো করে করতে,তানাহলে হবে না।প্লেনে ওঠার আগ মূহুর্তে কল করে পড়ার কথা বলেছে,এখন তো সে প্লেনের মধ্যেই আছে।ইন্তিহাজ রাজশাহী এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে করে ঢাকা ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাংলাদেশ টাইম ১১টায় কানাডা’র প্লেনে চেপে রওনা দিয়েছে।বাংলাদেশ থেকে কানাডা’য় যেতে সময় লাগে সাধারণত ১৩ ঘন্টা ৪৮ মিনিট,টেক-অফ এবং ল্যান্ডিং-এর জন্য অতিরিক্ত ৩০মিনিট, এছাড়াও সময়সীমা বাতাসের গতির ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে।সবমিলিয়ে বলতে গেলে সাড়ে ১৪ঘন্টার মতো লাগার কথা,প্লেন ওভারটেক করার ৯ঘন্টা হচ্ছে,সুতরাং ইন্তিহাজ এখনো প্লেনে-ই রয়েছে।
মনোকষ্ট আর টেনশন সবমিলিয়ে ইয়ানা’র অসম্ভব খারাপ লাগছে,কোনোকিছুতেই মন বসছে না।
পড়ার টেবিল থেকে উঠে ইয়ানা রুমের বাইরে এসে দেখে খাদিজাতুল নেসা ও আমেনা খাতুন কিচেনে রান্না করছে, ইয়াকুব জামান ও আয়ুব জামান সোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখছে।তৃষা আর নাহিদ ফ্লোরে বসে থেকে পাজল গেম খেলছে।
ইয়ানা’কে দেখে তৃষা বলে উঠলো,

—আপু,ভাইয়া কি কল করেছিলো তোমাকে?
—না,এখনও ৫ঘন্টা আপ সময় লাগবে পৌছাতে,ভাইয়া এখনো প্লেনেই আছে
—ওহ্,ভাইয়া কল দিলে বইলো,আম্মু অনেক টেনশন করছে।
—আপুই,আমার বন্ধু কি বলেছে জানো,পরিবারের কেউ বিদেশে গেলে নাকি আমরাও বিদেশে যেতে পারবো,এটা কি সত্যি? তারমানে আমরাও যাব তাইনা?
আমি শুনেছি বিদেশে নাকি আপেল,কমলা এইসব রাস্তায় পরে থাকে,কেউ নেয়না।আমি গিয়ে ওইসব কুড়িয়ে খাব আর বাংলাদেশে নিয়েসে সেগুলো বিক্রি করে বড়লোক হয়ে যাব।বুদ্ধি টা সুন্দর না বলো? (আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললো নাহিদ)

তৃষা নাহিদের মাথায় একটা গাট্টি দিয়ে বললো,

—পাগ*ল কোথাকার,এইসব আজেবাজে কথা কে বলে তোকে,গাঁধা একটা
—আপুই দেখছো,তৃষা আমাকে গাঁধা বললো।
—আহ্ তৃষা,ও ছোট মানুষ,ওরকম করছিস কেন,চুপ থাক।
শিমলা কোথায় রে,ওর সঙ্গে কথা ছিল আমার।
—ওর মা ওকে বের হতেই দিচ্ছে না,ভাইয়া যাওয়ার পরে ওইযে রুমে ঢুকে দরজা লক করছে এখনো বের হয়নি, বেয়াদব মহিলা একটা,ভেবেছিলো আমাদের ভাইয়াকে ফাঁসিয়ে নিজের মেয়ের গলায় ঝোলাবে,এ্যাহ্ শখ কতো (তৃষা)
—তৃষা,আমরা এখানে উপস্থিত আছি।
বড়দের সম্মান দিতে শেখো,তোমাকে এইসব শিক্ষা দিইনি আমরা,ভদ্রভাবে কথা বলো (ধমকে বললো আয়ুব জামান)
—আব্বু আমিতো সত্যিই বলছিলাম।
—আবার মুখেমুখে তর্ক করছো (চোখ রাঙিয়ে বললেন আয়ুব জামান)

আওয়াজ পেয়ে আমেনা খাতুন কিচেন থেকে বেড়িয়ে এসে বললেন,

—কি হয়েছে,এতো চেচামেচি করছো কেন,ইন্তিহাজ কল করেছে?
—না।
তোমার মেয়েকে সামলাও,সারাদিন বাড়িতে বসে থেকে করোটা কি,কোথায় কি বলতে হয়,আদবকায়দা কিছুই শেখাওনি,বেয়ারা হয়ে গেছে মেয়েটা,মুখেমুখে তর্ক করতেও ভয় পায়না,এসব কি আমেনা?
—আহ্ আয়ুব,কি শুরু করলি।
বাচ্চা মেয়েতো (ইয়াকুব জামান)
—ক্লাস টেনে পড়ে,এতোটাও ছোট ও নয়।
আদরে আদরে বাদর হয়ে গেছে,রাতের বেলায় পড়াশোনা নেই,ছোট ভাইয়ের সাথে খেলতে বসেছে।

আমেনা খাতুন রুখে গিয়ে তৃষা’কে টেনে তুলে ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

—শিং ভেঙে বাছুরের দলে যোগ দিয়েছিস তাইনা,পড়াশোনা নাই তোর?
বড়ডার যা রেজাল্ট,কতো স্বপ্ন ছিলো ডাক্তারি পড়াবো,এমন রেজাল্ট করলো যে ইন্টারে সাইন্স-ই নিতে দিলোনা কলেজ থেকে,এখন তোর ভাব-গতীও সেরকম দেখছি।
ইন্তিহাজের পা ধোয়া পানি খাস,ছোট থেকে কতো পড়ুয়া ছেলেটা,আর আজ ওর পজিশন দেখছিস।ডাক্তারি পাশ করছে,এমবিবিএস ডিগ্রির জন্য বিদেশে গেছে,বাড়ির মধ্যে এত ব্রিলিয়ান্ট একজন থাকতেও তোরা দুইবোন শিক্ষা নিতে পারলিনা,টেনেটুনে পাশ করে যাচ্ছিস।
তোদের জন্যে আজ আমার এতো কথা শুনতে হয়,তোদের এতো মা*রি,বকি তবুও শোধরাস না,তোরা রেজাল্ট খারাপ করলে সেই দোষ কি আমার?

—আম্মু,এর মধ্যে তুমি আবার আমাকে টানছো কেন? (ইয়ানা)
—না টানবো না,তোকে তো মাথায় তুলে বসে থাকবো।
মানুষ না হয়ে গরুছাগল হলে কবে বেঁচে দিতাম,পড়ালেখায়ও নেই,কাজকর্মেও নেই,পারিস তো শুধু বসেবসে খেতে আর ফোন টিপতে।
ওগো শুনছো,মেয়েদের জন্যে তো আমাকে দোষারোপ করছো,ভালো কথা।তাহলে মেয়েকে ফোন দিছো কেন,ফোন পাওয়ার পর থেকে মেয়েতো আরও গোল্লায় গেছে।
এখনকার যা যুগ,ফোনে কি করে বেড়াচ্ছে আল্লাহ মাবুদ,আমিকি এতকিছু বুঝি নাকি।পরে কোনো কাহিনি করলে আবার আমাকেই দোষারোপ করবে,মেয়েকে ঠিক রাখতে পারিনি,মায়ের জন্যই মেয়ে খারাপ হয়েছে,সবসময় সব দোষ তো মায়েদেরই হয়।

এতো চেঁচামেচি শুনে খাদিজাতুল নেসা কিচেন থেকে এসে ইয়ানা আর তৃষা কে বললেন,

—এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন,যা ঘরে যা।
তোদের মায়ের মাথা ঠিক নেই এখন,ঘরে গিয়ে পড়তে বস।অনেক পড়াশোনা করতে হবে।
তৃষা এসএসসি তে গোল্ডেন পেতে হবে,তানাহলে কিন্তু ভালো কলেজে চান্স পাবি না,আর ইয়ানা আগে যা করচিস করছিস মা,এবার ইন্টারে অন্তত ভালো কর,পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতে হবে কিন্তু।
আমাদের বংশে কেউ-ই অল্পশিক্ষিত নয়,ম্যাক্সিমামই শিক্ষিত প্লাস গভট জব করে,তোদের কাছেও আমাদের এরকম এক্সপেকটেশন আছে,আশা করি তোরা আমাদের নিরাশ করবি না।

—বাড়ির বড় ছেলে আরও উচ্চতর সাফল্য অর্জনের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছে আর এরা বাড়িতে শোকদিবস পালন করছে,যা পড়তে বস (ধমক দিয়ে বললেন আয়ুব জামান)

ইয়ানা আর তৃষা না দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে রুমে চলে গেলো,এখন হাওয়া গরম আছে,কেটে পরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ইয়ানা পড়ার টেবিলে বসলেও ওর মন পরে আছে ফোনের মধ্যে,কখন ইন্তিহাজ কল করে সেই আশায় নেট অন করে রেখে দিয়েছে।
আমেনা খাতুন প্রায় কান্না কান্না হয়ে গেছে,একে-তো ইন্তিহাজ এতগুলো বছরের জন্য চলে গেলো,মনটা এমনেই ভালো নেই তারওপর স্বামীর থেকে এধরণের ব্যবহার।
অন্যমনস্ক হয়ে জোরেজোরে সবজি কাটতে গিয়ে আঙুলে লাগলো ওনার,মূহুর্তেই ব্লেডিং শুরু হলো।খাদিজাতুল নেসা ঠান্ডা পানিতে ওনার হাত ডুবিয়ে দিয়ে বললেন,

—এরকম করছিস কেন তুই,ভাইজান তো ওইরকমই তুই জানিসতো বল।সবসময় তো এরকম করে না,মাঝেমধ্যেই এরকম রিয়াক্ট করে ফেলে,আজ তো ওনারও মন ভালো নেই তাই এরকম করছে,তুই মন খারাপ করিসনা।দেখতো হাত কেটে ফেললি,এরকমটা কেউ করে,বোকা কোথাকার।

—ভাবি,ইয়ানা’র আব্বু তো ভুল কিছু বলেনি বলো।
আমার দুইটা মেয়ে,দু’জনই এক গোছের হয়েছে।পড়াশোনায়ও ডাব্বা আবার কোথায় কি বলতে হয় সেই জ্ঞানটুকুও নেই।
ওর আব্বু তো আর সবসময় বাড়ি থাকে না,বাড়িতে থাকি আমি,মেয়েরা খারাপ হলে আঙুলতো আমার দিকেই উঠবে, আমি সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি।আমি তো আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি,মা*রতে বকতেও কম ছাড়িনা কিন্তু আমার মেয়েদুটো এমন হলো কেন বলোতো।কোই আমাদের ইন্তিহাজ,বহ্নি তো এরকম ছিলো না।
পড়াশোনায় সারাজীবনই টপে ছিলো,কখনো ওদেরকে কেউ টপকাতে পারেনি।রেজাল্ট শিটে ফার্স্ট থেকে ওদের নাম থাকতো,আর আমার মেয়েদের নাম লাস্টে পাওয়া যায়।
আজকাল বিয়ে দিতে গেলেও পাত্রপক্ষ সুশিক্ষিত ভালো মেয়ে খুঁজে,আমরা যেমন ছেলে চাই,সেরকম ছেলে তো এরকম খারাপ স্টুডেন্ট কে কখনোই বিয়ে করবে না।
ডাক্তার রা মেডিকেল স্টুডেন্টস ছাড়া বিয়ে করে না বললেই চলে,মেয়ে আমার আর্স নিয়ে পরছে,যদি এই সাবজেক্ট নিয়ে পড়েও ভালো রেজাল্ট করতো তাহলেও একটা কথা ছিলো। ডাক্তার ছাড়া অন্যকোনো যোগ্যতাবাণ পাত্র দেখতাম,কিন্তু না ইয়ানা ইয়ার চেন্জ পরিক্ষায় কি করলো,৩সাবজেক্টে ফেইল।
তৃষা অবশ্য ইয়ানা’র থেকে পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো,ও কি করবে আল্লাহ জানে।আর নাহিদকে তো পড়াশোনায় ভালোই মনোযোগী দেখি,বড় হলে এখন কেমন হবে আল্লাহ মালুম।

—চিন্তা করিস না,আমি ইয়ানা’কে নিজে পড়াবো,দেখি কি করে খারাপ করে।
—ব্রেন ভালো হলে তো ভালো করবে।
যাইহোক,তুমি এদিকটা দেখো,আমি মালেকা ভাবি কে ডেকে আনি,ওরা তো কেউ ঘর থেকেই বের হচ্ছে না।
—না থাক,তোর যাওয়ার দরকার নেই।
মালেকা এমনিতেই অনেক রেগে আছে,তুই গেলে তোকে আবার নানান কথা শোনাতে পারে, আমার ছেলের দ্বারাই যখন ওদের এতো সমস্যা তখন আমিই যাই।
—কিন্তু তোমাকেওতো অপমান করবে ভাবি।
—আমি প্রতিবাদ করতে পারবো কিন্তু তুইতো সেটা পারিসনা, তুই চুপচাপ সহ্য করবি পরে কষ্ট পাবি,তুই কতোটা ইমোশনাল আমি জানিতো।তুই রান্নাটা শেষ কর,আমি আসছি।

বলেই কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলেন খাদিজাতুল নেসা।
গেস্টরুমের দরজায় এসে নক করা শুরু করলেন মিসেসঃ খাদিজাতুলনেসা,হাঁকাহাঁকি করার পরেও দরজা খোলার নামগন্ধও নেই।খাদিজাতুল নেসা এবার রেগে গিয়ে বললেন,

—শোন মালেকা,তুই যদি এবার দরজা না খুলিস তাহলে ইন্তিহাজের আব্বু কে বলে দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করবো বলে দিলাম।আমাদের বাড়ি কোনো সার্কাস না যে তামাশা করবি,এই বাড়িটা আমাদের বানানো নিয়মে চলে,এ বাড়িতে থাকতে হলে তোদেরকে আমাদের কথামতোই চলতে হবে, দরজা খুলবি নাকি আ…

খাদিজাতুল নেসা পুরো কথা শেষ করার আগেই দরজা খুললেন মালেকা বেগম,খাদিজাতুল নেসা একবার মালেকা বেগমের দিকে তাকিয়ে হনহন করে ঘরের মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বললেন,

—শিমলা কোথায় মালেকা?
—জাহা*ন্নামে,আমার মাইয়ার খবর আপনাদের না নিলেও চলবো ভাবি।
—এতকিছু শুনতে চাইনি,শিমলা কোথায় সেটা বল।
—কইলামতো আপনাগো জানা লাগবো না।আমার মাইয়ারে আমি মা*রি,কা-টি যা খুশি করি,ওরে জন্ম দিছি আমি,ওর ভালো মন্দ বুঝবোও আমি।
—তোর কথাবার্তা তো আমার সুবিধাজনক লাগছে না,কি-রে মেয়েটার কোনো ক্ষতি করে দিসনি তো।
শিমলা,শিমলা,মা কোইরে তুই,শিমলা তুই আছিস এখানে।
—দেখেন ভাবি,সত্যি করে কচ্ছি শিমলা ঘরে নাই,কুনঠি গ্যাছে জানিনা।

মালেকা বেগমের কথার তোয়াক্কা না করে খাদিজাতুল নেসা ওয়াসরুমের দিকে যেতে লাগলে মালেকা বেগম চিল্লিয়ে বললেন,

—ওইদিকে যাওন লাগবো না ভাবি,কচ্ছিতো কেউ নাই।
ও ভাবি শুনেননা কচ্ছিলাম যে আমার শিমলা মনে হয় চইলা গ্যাছে গা

মালেকা বেগম খাদিজাতুল নেসার সামনে গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে,খাদিজাতুল নেসা সন্দিহান দৃষ্টিতে মালেকা বেগম কে সরিয়ে দিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে শিমলা ফ্লোরে অচেতন অবস্থায় পরে আছে,ওর গালে পাঁচ আঙুলের ছাঁপ স্পষ্ট,ঠোঁটের কোণে রক্তজমাট বেঁধে আছে।
খাদিজাতুল নেসা চিল্লিয়ে উঠলে সবাই এখানে চলে আসলো, ইয়াকুব জামান ও আয়ুব জামান দু’জনে মিলে শিমলা’কে ধরাধরি করে নিয়ে বাইরে আসলো,মালেকা বেগম দূরে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করছে।


শিমলা’কে স্যালাইন করা হয়েছে,ডাক্তার শিমলা’কে চেক-আপ করে উঠে দাঁড়ালেন।

—শিমলা এখন কেমন আছে মিঃ রহমান? (আয়ুব জামান)
—এখন ঠিক আছে,মেয়েটার ওপর এই আক্রমণ টা কে করলো,এটেম টু মার্ডার কেস হতে পারে তার ওপর।
—কেন,কি হয়েছে? (আমেনা খাতুন)
—মেয়েটার গলা চেপে ধরে ওকে কেউ শ্বাসরোধ করে মা*রার চেষ্টা করেছিলো,মেয়েটা সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় খুনি হয়তো ভেবেছিলো মেয়েটা মারা গেছে তাই ছেড়ে দিয়েছে,আর কিছুক্ষণ ওভাবে চেপে রাখলে নিশ্চিত মারা যেত।
—হোয়াট (চেচিয়ে বলে উঠলো খাদিজাতুল নেসা)
—মিঃ রহমান,বলছিলাম যে এটা আমাদের ফ্যামিলি ইস্যু, থানা-পুলিশ করার কোনো প্রয়োজন নেই,আমরাই সব সামলে নেব।
—ওকে মিঃজামান,বাট আই থিঙ্ক কেস করা ভালো ছিল।
এনিওয়েস,মেয়েটির প্রপার কেয়ারের প্রয়োজন,আমি তাহলে আসি।
—চলুন,আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়াসি

ইয়াকুব জামান ডক্টর রহমান’কে বাইরে ছেড়ে দিয়াসলেন, মালেকা বেগম এককোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন।
শফিক রহমান এগিয়ে গিয়ে ঠাঁস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলেন মালেকা বেগমের গালে,

—এতো বাড়বাড়ছো তুমি মালেকা,এতো পাষান তুমি হও কি করে,নিজের মেয়েরেই মা*রতে গেছিলা,একটুও হাত কাঁপলো না তোমার,এই তুমি মা,ওরা থানায় না গেলেও আমি নিজে তোমার নামে কেস করবো,পুলিশ আইসে টেনেহিঁচড়ে লিয়া যাক।
—পু পু পপুলিশ
—হ,আমি এখুনি থানায় যাব
—আহ্ শফিক,শান্ত হ তুই।আমরা দেখছি (আয়ুব জামান)
—কি শান্ত হবো ভাই,এই মহিলা,এই মহিলা আইজ আমার মাইয়াডারে খু*ন করতে গেছিলো,আল্লাহ না বাঁচাইলে এতক্ষণ আমার মাইয়ারে কবরে রাইখা আসা লাগতো।
—তো কি করমু আমি,এই মাইয়ারে লিয়া গ্রামে গেলে পরে লোকজন আমারে গায়ে থুথু দিতো,সবাই কইতো খুব ভাব লিছিলাম মাইয়ারে শহরের ডাক্তার পোলার লগে বিয়া দিমু, কিন্তু কি হইলো বিয়াডাই ভাইঙ্গা গ্যালো।এই মেয়েরে না পারমু ভালো বিয়া দিতে না পারমু মাইনষেরে মুখ দ্যাখাইতে,সারাজীবন মাথা হেঁট কইরা চলন লাগবো।
এইরকম মুখপুরি মেয়ের বাঁইচা থাইকা কি হইবো,ম*রাই ভালো।
—মা হয়ে এধরনের কথা আপনি কি করে বলতে পারেন ভাবি, ১০মাস যাকে পেটে ধরলেন,তিলতিল করে বড় করলেন আর আজ তাকেই এভাবে,ছিছিছি (আমেনা খাতুন)
—আম্মু,শিমলা’র সেন্স আসছে মনে হয়,নড়াচড়া করছে ও (ইয়ানা)
—সবাই বাইরে চলো,এখানে ভীড় করা যাবে না।ওর প্রবলেম হতে পারে,ইয়ানা মা তুই শিমলা’র কাছে বস,আমরা বাইরে আছি।

খাদিজাতুল নেসা কথাটা বলেই সবাইকে নিয়ে বাইরে চলে আসলেন,ইয়াকুব জামান রেগে বললেন,

—আমিতো বলেইছি শিমলার ভরনপোষণ,ওর পড়াশোনা,ওর বিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব সব আমাদের,তারপরেও কিসের এতো সমস্যা।রাগ-ক্ষোভে তুমি নিজের মেয়েকেই খু*ন করতে গেছিলে,ছিহ্ মালেকা।আমার ঘৃণা হচ্ছে তোমার প্রতি,কেমন মা তুমি,নিজে হাতে নিজের মেয়ের জীবনটা শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছো,সত্যিই আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি কিছু বলার।

—আমার পক্ষে ওর মতো মহিলার সঙ্গে সংসার করা সম্ভব না ভাই,আমি ওরে তালাক দিতে চাই,আমি ওর সাথে থাকতে পারমু না।
—তুমি এইসব কি কও শিমলা’র বাপ,আমারে তালাক দিবে মানে,আমি কেই যামু তাইলে,আমার তো কেউ নাই, যাওয়ার মতোন কুনো জায়গা নাই(কাঁদতে কাঁদতে বললেন মালেকা বেগম)
—কেন,আপনার ওইসব লোকজনদের কাছে যান,যাদের জন্য শিমলা আপুকে মা*রতে গেছিলেন,তারাই আপনাকে ভাত দিবে,ওদের সঙ্গেই থাকুন কেমন (তৃষা)
—তুই এখানে বড়দের মাঝে কি করছিস তৃষা,যা ঘরে যা বলছি (ধমক দিয়ে বললেন আমেনা খাতুন)
—এখন কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বলোতো ভাই,থানায় কেস করবো নাকি অন্যকিছু…….

To be continue….

((সবাই রেসপন্স করুন))