দিওয়ানেগি পর্ব-০১+০২

0
956

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১+২
#M_Sonali

সিএনজি থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে হসপিটালের মধ্যে প্রবেশ করে মেহরিমা ও তার ছোট বোন মেহের। দুজনের চোখ দিয়েই অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে। পাগলের মত ছুটছে তারা হসপিটালের ভিতরে এদিক থেকে ওদিক। মেহরিমা দ্রুত হসপিটাল কাউন্টারের কাছে গিয়ে, কাউন্টারে থাকা মেয়েটিকে অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করে,

“একটু আগে এখানে একজন এক্সিডেন্ট হওয়া ব্যাক্তিকে ভর্তি করা হয়েছে। আপনি কি বলতে পারেন সে এখন কোথায়?”

কথাগুলো বলার সময় যেন গলার মাঝে বারবার আটকে যাচ্ছিল মেহরিমার। কষ্টে যেন কথা বের হতে চাইছিলো না গলা দিয়ে। তার এমন আহাজারি মাখা কথা শুনে কাউন্টারে থাকা মেয়েটি আর সময় বিলম্ব করলো না। শান্ত স্বরে দ্রুত বলে উঠলো,

“জি একটু আগে একজন মর্মান্তিক এক্সিডেন্ট হওয়া রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। সে এখন ICU তে আছে। আপনারা দোতালায় ICU রুমের কাছে চলে যান।”

ICU এর কথা শুনে যেন বুকের মাঝে কেঁপে ওঠে মেহরিমার। সে মেহেরের হাত ধরে ছুটে চলে দোতালার উদ্দেশ্যে। ছুটতে ছুটতে ICU রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা। মেহরিমা দরজার কাচের ভিতর দিয়ে ভিতরে উকি দেয়। ভেতরের দৃশ্য দেখতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তার। ভিতরে তার বাবাকে ইলেক্টিক শক দেওয়া হচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল। মেহরিমা দ্রুত মেহেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। তারপর পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। তাকে এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। তার ছোট বোনকে সামলাতে হবে তাকে। বাবার এমন অবস্থা দেখলে মেহের ভয় পেতে পারে। তাই যেভাবেই হোক নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।

মেহরিমা নিজের কান্না চেপে রেখে, মেহেরকে সান্তনা দিতে লাগল। মেহের কান্না করতে করতে বলে উঠলো,

“বাবার কি হয়েছে আপু? সকালে তো বাবা হাসিখুশি ভাবে তোমার বিয়ের কার্ড নিয়ে বের হয়েছিল। তাহলে হঠাৎ করে এসব কি হয়ে গেল আপু? বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? চলনা বাবাকে দেখি। তুমি এখানে এসে বসলে কেন, চলো আমরা এই রুমের ভিতরে যাই।”

” না মেহের এভাবে পাগলামি করিস না। এটা ICU, এখানে এভাবে ঢুকতে দেবেনা। দেখিস বাবার কিচ্ছু হবে না। আমাদের বাবা আবার সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবে। তুই একটু সান্ত হ।”

কথাগুলো বলতে বলতেই ICU থেকে একজন ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওনাকে দেখেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো মেহরিমা। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,

“ডাক্তার আমার বাবা এখন কেমন আছেন? উনি সুস্থ হয়ে যাবেন তো।”

ডাক্তার কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“যিনি এক্সিডেন্ট হয়েছেন উনি আপনার বাবা! আপনার বাবার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তার যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে। নইলে ওনাকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। ওনার অপারেশন করতে দেড়লক্ষ টাকা লাগবে। আপনি টাকা এ্যারেঞ্জ করে কাউন্টারে জমা দিন। আমরা অপারেশন এর প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

কথাগুলো বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে যান ডাক্তার। ডাক্তারের কথা শুনে যেন মাথায় বাজ পড়ে মেহরিমার। সে কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। সে দুপা পিছিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। তার মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এতগুলো টাকা এই অল্প সময়ের মাঝে কোথায় পাবে সে।
কিছু একটা চিন্তা করে দ্রুত নিজের ফোনটা বের করে। তারপর সেখানে একটি নাম্বার ডায়েল করে কানের কাছে ধরে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরে না। মেহরিমা বেশ বিরক্ত হয়। সে আবারও ফোন করে। এবার ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয়। মেহরিমা উত্তেজিত কণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,

“হ্যালো মৃদুল ভাইয়া, ভাইয়া কোথায় তুমি? আমাদের বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমি আর মেহের বাবার সাথে ,,,,,,,,,,,,,,,,, হসপিটালে আছি। ভাইয়া বাবার অপারেশন করাতে হবে। নইলে বাবা কে বাঁচানো যাবেনা। প্লিজ তুমি কিছু করো। ডাক্তার বলেছে অপারেশন এর জন্যে দেড় লক্ষ টাকার প্রয়োজন। তুমি যেভাবে হোক একটু ব্যবস্থা করে দাও ভাইয়া প্লিজ।”

মেহরিমার কথার উত্তরে ঐ পাশ থেকে কিছুক্ষণ চুপ থাকে মৃদুল। তারপর বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে ওঠে,

“তুই কি পাগল হয়েছিস মেহরিমা? এতগুলো টাকা আমি কোথায় পাব। দেড় লক্ষ টাকা কি গাছের গোটা নাকি যে চাইলেই পাওয়া যায়। তুই এক কাজ কর। বাবাকে কোনো সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যা। যেখানে আছিস সেখানে খরচ অনেক বেশি। আমি আসছি দেখি কি করা যায়।”

কথাগুলো বলেই ওপাশ থেকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দেয় মৃদুল। এতে মেহরিমা ভীষণ অবাক হয়। সে বেশ ভালো করেই জানে তার ভাই মৃদুল চাইলেই সব টাকা দিতে পারতো। তখনই তার মনে পড়ে তার ভাই তো আর আগের মত নেই। সে তো বদলে গেছে দুই বছর আগেই। যখন সে বড়লোক ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে তাদের ছেড়ে আলাদা হয়ে গেছে। কথাটা ভাবতেই আরো বেশি চিন্তায় পরে যায় মেহরিমা। এবার কী করবে সে? কিভাবে বাঁচাবে তার বাবাকে। কান্না যেন চোখ ঠুকরে বেরিয়ে আসছে তার। এদিকে মেহেরও কখন থেকে কান্না করে চলেছে। আর মেহরিমা কে বারবার প্রশ্ন করছে কিভাবে তার বাবাকে বাঁচাবে তারা।

মেহরিমা নিজের মাথা দুই হাতে চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়ে। ভাবতে থাকে কি করবে সে। তখন’ই খেয়াল হয় ওর বিয়ের জন্য ওর বাবা 2 লক্ষ টাকা রেখে ছিলো। যেটা ওকে গতকাল সকালেই দেখিয়েছিলেন তিনি। কথাটা মনে পরতেই চোখ মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে তার। সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,

“মেহের তুই এখানে থাক। এখান থেকে এক পা ও কোথাও যাবি না। আমি বাসায় যাব আর আসব। আমাদের বাবার কিছু হতে দেবো না। যেভাবেই হোক বাবাকে বাঁচাতে হবে।”

কথাটা বলেই মেহের কে সেখানে বসিয়ে রেখে দ্রুত ছুটে যায় হসপিটালের বাইরে। তারপর সিএনজি করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।



বিশাল বড় এক বাড়ির দরজার সামনে কালো রঙের একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে দুজন কালো পোশাক পরা গার্ড বেড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। গাড়ি থেকে নেমে গার্ডদের ইশারায় সেখানেই থালতে বলে, দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে আলমির। মুখটা একদম লাল টকটকে হয়ে আছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণরকম টেনশনে আছে সে। বাসার মধ্যে প্রবেশ করেই দিদুন, দিদুন বলে চিৎকার করতে থাকে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপর তলায় উঠে যায় সে। তার চিৎকারে বাসায় থাকা সকল কাজের লোক যেন কেঁপে ওঠে ভয়ে। আলমির উপর তলায় পৌছে সোজা তার দিদুনের রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে দিদুন বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। তার পাশে বসে আছেন ডক্টর ফিরোজ আহমাদ। তিনি আলমিরদের ফ্যামিলি ডাক্তার। ওদের ফ্যামিলির সকলের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন কাজের লোক। লোক দুটো আলমিরকে দেখে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে।

আলমির দ্রুত হেটে যায় তার দিদুন এর কাছে। তাকে গভির ঘুমে দেখে, ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ডাক্তার আংকেল কী হয়েছে আমার দিদুনের? দিদুন এভাবে শুয়ে আছে কেন?”

ওকে এত হাইপার হতে দেখে ডাক্তার ফিরোজ আহমাদ মুচকি হাসেন। উঠে দাঁড়িয়ে আলমিরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলেন,

“রিলাক্স আলমির। তোমার দিদুন এর তেমন কিছুই হয়নি। উনি হয়তো কোনো কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তাই ব্লাড প্রেসার টা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। এখন উনি ঠিক আছেন। আমি ওনাকে ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। উনি এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠলে সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।”

” কিন্তু আঙ্কেল, দিদুন কি নিয়ে এত ডিপ্রেশন করে, যে এতটা অসুস্থ হয়ে পরলো? আপনি জানেন আমি কতটা টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। দিদুনের অসুস্থতার কথা শুনে? ড্রাইভারকে দ্রুত আসার জন্য তারা দেওয়ায় রাস্তায় একটুর জন্যে এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেছে। দিদুন ছাড়া পৃথিবীতে আর কে আছে আমার। দিদুনের কিছু হলে আমি কিভাবে রিলাক্সে থাকবো। বলুন আঙ্কেল।”

ডাক্তার ফিরোজ আহমাদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তারপর আলমিরের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে, পাশে থাকা সোফার উপর সামনা সামনি বসেন। ছোট করে নিশ্বাস নিয়ে শান্ত গলায় বলেন,

“দেখো আলমির, তোমার কাছে আমি কিছু লুকাতে চাই না। আমি জানি তুমি তোমার দিদুন কে কতটা ভালোবাসো। কিন্তু,,!”

এতোটুকু বলেই থেমে যান তিনি। তাকে থামতে দেখে আলমির যেন আরো বেশি হাইপার হয়ে ওঠে। টেনশনে দরদর করে ঘামতে থাকে সে। ধরা গলায় জিগ্যেস করে,

” কি হয়েছে আঙ্কেল? বলুন না, কি লুকাচ্ছেন আপনি আমার থেকে? দিদুনের খারাপ কিছু হয়নি তো?”

“আলমির তোমার দিদুনের বয়স হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার শরীরের কন্ডিশন দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর সে তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি টেনশন করে। যার ফলস্বরূপ সে আজকে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি জানি না তোমাকে নিয়ে সে কি এমন টেনশন করে। তবে আমি তোমাকে এটাই বলব যে, তুমি যতটা সম্ভব তাকে টেনশনমুক্ত রাখ। হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করো। তাকে সময় দাও। তার কথা শোনো, গল্প করো। এমন কিছু করো যাতে তিনি অনেক খুশি থাকেন। সেটাই ওনার জন্য সবচাইতে ভালো হবে। নয়তো যে কোনো সময় যা কিছু হতে পারে।”

উনার কথার উত্তরে একদম নিরব হয়ে যায় আলমির। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,

“আঙ্কেল আপনি তো সবই জানেন। সারাদিন আমাকে কতটা ব্যস্ত থাকতে হয় বিজনেস নিয়ে। আপনি তো জানেন এই বিজনেস নিয়ে বাবার কত স্বপ্ন ছিল। তার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য এতটা ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। আমায় যে বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান হতেই হবে। তাই চাওয়া সত্ত্বেও দিদুনকে ঠিকমতো সময় দিতে পারি না।”

” হ্যাঁ আমি সবই বুঝি আলমির। আমাকে এসব বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু তোমাকে এটাও বুঝতে হবে, তোমার দিদুনের বয়স হওয়ার কারণে, সে এখন একদম ছোট বাচ্চার মত হয়ে গেছেন। তাই সে তোমার এই ব্যস্ত থাকাটা, তাকে সময় না দেওয়াটা একদম নিতে পারেন না। তুমি একটা কাজ করতে পারো আলমির। একটা বিয়ে করে নাও। নাতি বউকে কাছে পেলে হয়তো উনি অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবেন। ওনার একটা সঙ্গিও হবে।”

বিয়ের কথা শুনতেই মুখে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে আলমিরের। সে উঠে দাঁড়ায়। রাগী গলায় বলে,

” এটা সম্ভব নয় আঙ্কেল। অন্য কোন উপায় থাকলে বলতে পারেন। আমি দিদুনের জন্য এমন ব্যবস্থা করবো যেন তিনি সব সময় হাসি খুশি থাকেন। আর আমিও কিছু সময় বের করবো তার সাথে কাটানোর জন্য। তবে বিয়ের কথাটা আমার কাছে দ্বিতীয় বার বলবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে সম্মান করি আঙ্কেল। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

কথাগুলো বলেই দিদুনের দিকে একবার তাকিয়ে হন হন করে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় আলমির। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ফিরোজ আহমাদ। তিনি জানেন না আলমিরের বিয়ের কথা শুনে রেগে যাওয়ার কারণ।
,
,
,
বাসায় ফিরে সবকিছু তন্নতন্ন করে টাকাগুলো খুঁজছে মেহরিমা। সে জানে তার বাবা টাকাগুলো আলমারিতে রেখেছে। কিন্তু পুরো আলমারি তন্নতন্ন করে খুঁজেও টাকাগুলো পেলো না। একসময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল সে। দু চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। চোখ তুলে দেওয়ালের সাথে টাঙানো বাবা মার ছবির দিকে তাকালো সে। আজকে মাকে বড্ড বেশি মিস করছে মেহরিমা। বড্ড ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু অঝোরে কান্না করে নিতে। বাবার এমন অবস্থায় কিছুই করতে পারছে না সে। এই কথাটা মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করছে তার। সে একটু দম নিয়ে চোখটা মুছে নেয়। তারপর আবারো আলমারির কাছে গিয়ে একটা একটা করে কাপড় চোপড় নামিয়ে খুঁজতে শুরু করে। বেশ অনেকক্ষণ সময় খোঁজার পরও টাকাগুলো পায় না। এবার নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় লাগছে মেহরিমার।

কি করে বাঁচাবে সে তার বাবাকে। শেষ সম্বল টুকুও যে হাতছাড়া হয়ে গেল। কথাগুলো ভাবতেই চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করল মেহরিমা। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো তার। সে চোখের জল মুছে কান্না থামিয়ে কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে বাবা বলে চিৎকার করে মেহেরের কান্নার শব্দ ভেসে আসলো মেহরিমার কানে। সাথে সাথে বুকটা কেঁপে উঠল তার অজানা আতঙ্কে। ওপাশ থেকে মৃদুল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“মেহরিমা আমাদের বাবা আর নেই। সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে পরপারে।”

কথাটা শুনতেই হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল মেহরিমার। এই মুহূর্তে যেন পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় মেয়ে বলে মনে হচ্ছে তার নিজেকে। সে ফ্লোরে ঠাস করে বসে পড়ে অঝোর ধারায় কান্না করতে লাগল। চিৎকার করে কান্না করছে সে। তাকে থামানোর বা সান্তনা দেওয়ার মতো আশেপাশে কেউ নেই।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_২
#M_Sonali

মাঝরাতে বাবা-মায়ের ছবি বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে কান্না করছে মেহরিমা। পাশেই ঘুমিয়ে আছে মেহের। মেয়েটা গত সাত দিনে শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না যেন। মেহরিমা মেহেরের সামনে কখনোই কান্না করে না। মেহের ভেঙে পড়বে বলে। মাঝ রাতে যখন সে ঘুমিয়ে পড়ে তখনই যেনো দু চোখের জল আর বাধা মানে না। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে তার নিঃশব্দে। বাবা মারা গেছে সাত দিন হয়ে গেল। কিন্তু এখনো যেন এক মুহূর্তের জন্যও বাবার কথা ভুলে থাকতে পারেনা সে।

বাবা-মার ছবিটা সামনে ধরে তাতে হাত বুলাতে বুলাতে দু’বছর আগের স্মৃতি গুলো মনে করতে লাগল মেহরিমা। কত সুখের ছিল ওদের পরিবারটা। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও যেন খুশির কোন অভাব ছিল না। বাবা মা আর তিন ভাইবোন মিলে অনেক বেশি আনন্দে কাটতো তাদের দিন। মেহরিমার বাবা আতিকুর রহমান ছিলেন একজন স্কুল টিচার। আশেপাশের সবাই তাকে অনেক সম্মান করতো। নিজের ছেলে মেয়েকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করতেন তিনি। আশেপাশের সবাই বলতো, আতিক মাস্টার যেমন ভালো তার ছেলে মেয়েগুলোও তেমনই ভদ্র সভ্য। কিন্তু সেই গর্ববোধ কে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় মৃদুল।
কোন এক বড়লোকের ঘরের মেয়ের প্রেমে পরে সে। তার প্রলোভনে পরে আতিকুর রাহমানের তিল তিল করে জমানো ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে ভেগে যায় সে। যে টাকাটা আতিকুর রহমান একটি স্কুল বানানোর জন্য অনেক কষ্টে জমিয়ে ছিলেন। সেটা ছিলো তার স্বপ্ন।

এ ঘটনার পর আতিকুর রহমান ভীষণরকম ভেঙে পড়েন। সে কখনো কল্পনাও করতে পারেননি, তার উচু মাথা এভাবে নিচু করে দিবে তার’ই একমাত্র ছেলে। আশেপাশের মানুষ কানাঘুষা শুরু করে। যদিও আতিকুর রহমান ঘরের কথা বাইরে কিছুই জানায়নি। কিন্তু তবুও কথাগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে জানাজানি হয়ে যায়। সমাজের মানুষ ছি ছি করতে থাকে, আতিকুর রহমানের ছেলেকে দেওয়া শিক্ষা নিয়ে। মেহরিমার মা ছিলেন একজন হার্টের রোগী। তিনি এসব সহ্য করতে পারেন না। এক রাতে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান তিনি।

মেহরিমার আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা। মৃদুল টাকার লোভে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, শেষবারের মতো মাকেও দেখতে আসেনি। এমনকি কবর দিতেও আসেনি সে। সেদিনের পর থেকে মৃদুলের নাম নেওয়া ওদের বাড়িতে বন্ধ হয়ে যায়। ভেঙে যায় সুখে ভরা পরিবারটা। আতিকুর রহমান সবাইকে বলে তার কোন ছেলে নেই। স্ত্রীর সাথে তার ছেলেও মারা গেছে। তার শুধু দুইটা মেয়ে। হাসিখুশি পরিবার টা যেন এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে খুব কমই হেসেছে তারা।

মৃদুল বরাবরের মতো ওদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে। কখনই কোন যোগাযোগ রাখে না। সে এমনভাবে বদলে যায় যেন কখনো তার কোনো পরিবার ছিল না। হঠাৎ একদিন রাস্তায় মেহরিমার সাথে দেখা হয় মৃদুলের। দুই ভাই বোন অনেক কথা বলে সময় কাটায় একসাথে। মৃদুল ক্ষমা চায় মেহরিমার কাছে। তখনই মৃদুলের থেকে ওর নাম্বারটা নিয়ে আসে মেহরিমা। চুপিচুপি বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলত সে গোপনে। কিন্তু কখনই বাবার সামনে কথা বলার সাহস পায়নি।

এখন দুবছর পর যখন বাড়িটা নতুন করে হাসি খুশিতে ভরে উঠেছিল। তখন’ই যেন সবকিছু আবারও এলোমেলো হয়ে গেল। আতিকুর রহমান মেহরিমার বিয়ে ঠিক করেন। তারই এক ছাত্রের সাথে। নতুন জামাইকে বাইক কিনে দেবার কথা ছিলো। তাই তিনি দুই লাখ টাকা অনেক কষ্টে জমিয়ে ছিলেন। তিনদিন পরেই ছিলো মেহরিমার শুভ বিবাহ। আর সেই বিয়ের কার্ড নিয়ে আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বেরিয়ে ছিলেন আতিকুর রহমান। রাস্তায় এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে সেটা যেন কল্পনাও করেনি কেউ। আতিকুর রহমানের মৃত্যুর পর মেহরিমার বিয়েটা ভেঙে যায়। তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলে মেহরিমা অলক্ষুণে। আর বাইক দিতে পারবে না বলেই বিয়েটা ভেঙে দেয় তারা। এতে অবশ্য মেহরিমার কোন আফসোস হয়নি। বরং সে মনে মনে খুশি হয়। এমন একটা লোভি পরিবারের হাত থেকে বেঁচে গেছে বলে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখের জলে বাবা-মায়ের ছবির ফ্রেম টা ভিজে একাকার হয়ে যায়। মেহরিমা নিজের ওড়না দিয়ে সযত্নে ফ্রেমটা মুছে আগের জায়গায় রেখে দেয়। তারপর পানি খাওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরে বের হয় সে। দু এক পা সামনে এগিয়ে যেতেই ভাই ভাবির রুম থেকে কিছু কথা কানে ভেসে আসে তার। বাবার মৃত্যুর পর থেকে মৃদুল তার বউকে নিয়ে ওদের বাড়িতেই থাকছে। সাথে সাথে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় মেহরিমা। কথাগুলো ভালো করে বোঝার জন্যে এগিয়ে যায় সেই রুমের দরজার সামনে। ভেতরের কথাগুলো কানে আসতেই যেন বুকটা হু হু করে কেঁপে ওঠে তার। মৃদুল তার বউ মোহিনী কে বলছে,

“তুমি যাই বল না কেনো মোহিনী! আমি কালকে এ ব্যাপারে মেহরিমার সাথে কোন প্রকার কথা বলতে পারবো না। বাবা মারা গেছে মাত্র ৭ দিন হয়েছে। এখনই বাড়িঘর সম্পত্তির ব্যাপারে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। এমনিতেই আমার বারবার মনে হচ্ছে বাবার মৃত্যুর জন্য কোথাও না কোথাও আমি দায়ী। সেদিন যদি বাবার থেকে ওই দুই লাখ টাকা জোর করে না নিতাম তাহলে হয়ত বাবা এভাবে মারা যেত না।”

মৃদুলের কথার উত্তরে ভীষণ রকম রেগে যায় মোহিনী। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“বোকার মতো কথা বলো না মৃদুল। ওনার মৃত্যুর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহ যার যখন যেভাবে মৃত্যু রেখেছে, সে সেভাবেই মরবে। আর তাছাড়া তুমি ওনার টাকা নিয়ে কোন ভুল কাজ করোনি। তুমি তার একমাত্র ছেলে। সে কিনা তোমাকে বাইক কিনে দেওয়ার বদলে তোমার বোনের জামাইকে বাইক কিনে দিতে চেয়েছিল। সে তোমায় ঠকাচ্ছিলো মৃদুল। তাই এটা নিয়ে আফসোস করার কিছু নেই। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। কাল সকালেই তুমি মেহরিমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে। নইলে যা বলতে হয় আমি বলব। তোমাকে কিছু বলতে হবেনা। তুমি নিজের বাবার যতটুকু সম্পত্তি পাও, তা বুঝে নিয়ে বিক্রি করে আমরা এখান থেকে চলে যাবো। আমি সারা জীবন তোমার ওই বোনদেরকে নিজের ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। এই আমার শেষ কথা।”

এতোটুকু শুনেই মেহরিমা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মুখ চেপে ধরে নিজের রুমে চলে আসে। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে সে। বালিশ দিয়ে মুখ চেপে অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকে। সে কল্পনাও করতে পারেনি তার ভাই এতটা নিচে নামতে পারে। এতদিন সে বাবার মুখে শুনেছে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য মৃদুল দায়ী। কিন্তু সে কখনও তার ভাইকে দোষি মনে করেনি। মায়ের মৃত্যুটা শুধু এক্সিডেন্ট ভেবেছে। কিন্তু আজ যেন তার বারবার মনে হচ্ছে। মৃদুল তার বাবা-মাকে খুন করেছে। মৃদুল যদি এই কাজগুলো না করতো তাহলে হয়তো তার মা বাবা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো।

বালিশে মুখ চেপে অনেকক্ষণ কান্না করে মেহরিমা। তারপর কিছু একটা ভেবে উঠে বসে। চোখ মুছে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে মনে মনে কিছু একটা ভাবে। তারপর চুপচাপ মেহেরের পাশে শুয়ে পড়ে। যদিও তার আর সারারাত ঘুম হবেনা।

সকালে মৃদুল ও মোহিনী ঘুম থেকে ওঠার আগেই মেহেরকে টেনে তোলে মেহরিমা। ওকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে বলে। তারপর তাড়াতাড়ি নাস্তা বানিয়ে মেহেরকে খাইয়ে দেয়। খাওয়া শেষে মেহেরকে নিয়ে পাশের বাসায় ওর বান্ধবীর কাছে রেখে আসে। এবং বলে আসে যতক্ষণ না ও মেহেরকে নিতে আসবে ততক্ষণ যেনো মেহের বাসায় না ফেরে। যদিও মেহের অনেকবার জানতে চেয়েছে কি হয়েছে। কিন্তু মেহরিমা ওকে কোনো কিছুই বলেনি।

মেহেরকে রেখে বাসায় ফিরে এককাপ কফি বানায় মেহরিমা। কফি মগটা নিয়ে চেয়ারের উপর বসে মৃদুলের রুমের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে সে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে বেলা দশটা বেজে গেছে। এবার মেহরিমার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। কারণ সে জানে মৃদুল ও মোহিনী রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে। তারা প্রতিদিনই ঠিক বেলা দশটার সময় ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হয়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে মৃদুল ও মোহিনী। মেহরিমাকে দেখে মৃদুল মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে আসে। মাথায় আলতো করে টোকা দিয়ে বলে,

“কিরে মেহরিমা কফি একা একা খাচ্ছিস যে। আমার আর তোর ভাবির কফি কই?”

মেহরিমা মৃদুলের কথার কোন উত্তর দেয়না। কফির মগে চুমুক দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে বসে। এতে মৃদুল বেশ অবাক হয়। এর আগে কখনোই মেহরিমার এমন আচরণ দেখেনি সে। তাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“কিরে কি হয়েছে, কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে?”

এবারেও মেহরিমা নীরব থাকে। কফির মগে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরের দিকে দৃষ্টি রাখে সে। এবার যেন আরও বেশি অবাক হয়ে মৃদুল। সে পিছন দিয়ে ঘুরে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে মেহরিমা? তুই এমন আচরণ করছিস কেন?তোর কি শরীর খারাপ?”

কথাটা বলেই মেহরিমার কপালে হাত রাখে মৃদুল। সাথে সাথে ওর হাতটা ঝাড়ি মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয় মেহরিমা। দু পা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বলে,

“খবরদার আপনি আমার কপালে হাত রাখবেন না। আপনার মুখে নিজের নাম শুনতেও ঘৃনা হচ্ছে আমার।”

“মেহরিমা তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কি বলছিস এসব যা তা?”

মোহিনী ওদের কথা এতক্ষণ চিপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুনছিল। এবার আর চুপ থাকতে পারেনা সে। কাছে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো গলায় বলে,

“সমস্যা কি তোমার? এভাবে কথা বলছ কেন তোমার ভাইয়ের সাথে?”

এবার যেন মেহরিমা বজ্রপাতের মত গর্জে ওঠে। চিৎকার করে বলে ওঠে,

“একজন খুনীর সাথে এর চাইতে ভালোভাবে কথা বলতে পারিনা আমি। আপনারা বের হয়ে যান আমাদের বাড়ি থেকে। আপনাদের দুজনকে আর এক মুহূর্তের জন্যও এখানে সহ্য করতে পারছি না আমি।”

কথাগুলো বলেই রাগে থর থর করে কাঁপতে থাকে মেহরিমা। রাগ যেন মাথায় চড়ে বসেছে তার। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে মোহিনী এবং মৃদুল কে নিজ হাতে খুন করতে। সে রাগ কন্ট্রোল করার জন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে লাগলো। কিন্তু এত কিছুর পরেও মৃদুল কে রাগতে দেখা গেলো না। সে শান্ত গলায় মেহরিমার কাছে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“মেহরিমা তুই শান্ত হ। এখানে বসে বল, কি হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন হঠাৎ?”

মৃদুলের কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলার আগেই মোহিনী হায় হায় করে বলে উঠল,

“দেখেছো, দেখেছো মৃদুল। আমার কথা মিললো তো। কত বড় সাহস দেখো তোমাকে আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায়। এই তোর স্পর্ধা তো কম না। আমার খেয়ে আমার পরে আমাদের কেই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাস। আজকে তোকেই আমি বাড়ি ছাড়া করবো। ভুলে যাস না, শশুর মশাই এর পর এই বাড়ির মালিক এখন মৃদুল।”

কথাগুলো বলেই মেহরিমার কাছে এগিয়ে আসে মোহিনী। এতে মেহরিমা যেন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,

” মিস্টার মৃদুল, আপনাকে ভালোয় ভালোয় বলছি, আপনার বউকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না। অন্যায় কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমি রাখি। আমার বাবা আমাকে সে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আপনাদের মত মানুষরূপী অমানুষদের এ বাসায় কোন জায়গা নেই।”

ওর কথাগুলো শুনেই মোহিনী দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“কি বললি তুই, তোর এত বড় সাহস?”

কথাটি বলেই মেহরিমা কে থাপ্পর মারার জন্য হাত তোলে সে। সাথে সাথে মেহরিমা হাতটা উল্টো করে ফেলে ওকে ঘুরিয়ে পিছনে আটকে ফেলে। মোহিনী হাতে ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। আর গালিগালাজ করতে থাকে। মেহরিমা সেদিকে তোয়াক্কা না করে ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“দেখুন মৃদুল, এই বাড়িটা অনেক আগেই বাবা আমার আর মেহেরের নামে করে দিয়ে গেছেন। তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন আপনি কতটা বদলে গেছেন। মানুষ থেকে অমানুষে পরিনত হয়েছেন। এই বাড়ির ওপর আপনাদের কোনো রকম অধিকার নেই। আমি চাইনা আপনাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে নিজের সম্মান নষ্ট করতে। কাল রাতে আপনাদের বলা প্রতিটি কথা আমি শুনেছি। আমার মা বাবার মৃত্যুর জন্যে আপনারা দায়ী। ইচ্ছা করলে আপনাদের দুজনের নামে কেস করে দিয়ে দু’জনকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারি। কিন্তু সেটা আমি চাইনা। তাই ভালই ভালই বলছি আপনারা এই বাড়ি থেকে চলে যান। নয়তো আমি পুলিশের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।”

কথাগুলো বলে ঝাড়ি মেরে মোহিনীর হাত ছেড়ে দেয় মেহরিমা। মোহিনী নিজের হাত কচলাতে কচলাতে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। কিছু একটা ভেবে দ্রত মৃদুলের কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলে,

“চলো মৃদুল, এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাব। এসো আমার সাথে।”

কথাটা বলেই মৃদুলের হাত ধরে টানতে টানতে রুমের মাঝে নিয়ে যায় মোহিনী। তারপর দরজা লাগিয়ে দেয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুলিশের নাম শুনে বেশ ভয় পেয়েছে মোহিনী। ওরা রুমে গিয়ে দরজা লাগাতেই মেহরিমা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকে অঝোরে। তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পায় সে। তাকিয়ে দেখে মেহের অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এতক্ষন যা ঘটেছে সবকিছুই দেখে ফেলেছে মেহের।

মেহরিমা উঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দুজনেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এভাবে কেটে যায় কিছুক্ষণ। মেহরিমা নিজে শান্ত হয়ে মেহেরকেও শান্ত করে। দুজনে চুপচাপ বসে থাকে চেয়ারে। একটু পর মৃদুল আর মোহিনী ব্যাগপত্র নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। মোহিনী চলে যাওয়ার আগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

“কাজটা তুই ভালো করলি না মেহরিমা। তোকে আমি দেখে নিবো।”

কথাটা বলেই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় মোহিনী। মৃদুল অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে এগিয়ে আসে ওদের কাছে। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। তারপর মেহরিমার দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,

“ভালো থাকিস তোরা। নিজের ও মেহেরের খেয়াল রাখিস। আর পারলে এই ভাইটাকে ক্ষমা করে দিস।”

কথাগুলো বলেই চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায় মৃদুল। সাথে করে মেহরিমার কষ্টটা যেন আরও শত গুণ বাড়িয়ে দিয়ে যায়। বুকটা চিরে যাচ্ছে মেহরিমার। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে। আজ যেন সত্যিই নিজেকে বড্ড বেশি একা মনে হচ্ছে পৃথিবীতে। ভিষন অসহায় লাগছে। যেন পৃথিবীর বুকে ওদের আর আপন বলে কেউ রইল না। পাশ থেকে মেহের কান্না করতে করতে বলে ওঠে,

“জানো আপু, আগে মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে থেকে প্রতিবেশীদের গল্প শুনতাম। তারা মায়ের কাছে এসে বলত ছেলেরা বিয়ের পর বদলে যায়। বাবা-মাকে একদম সহ্য করতে পারে না। তাদের অনেক কষ্ট দেয়। তখন মা তাদের কথায় হেসে দিয়ে বলতো, আমার ছেলে তেমন হবেনা। মৃদুল বিয়ে করার পর আমাদের তেমনি ভালোবাসবে যেমন এখন ভালোবাসে। ভালো হয়েছে আপু যে আজ বাবা মা বেঁচে নেই। নইলে তারা এইসব দেখে কষ্টে আবার মরে যেত। তাই না বলো?”

কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো মেহের। ওর কথায় যেনো বুকে তীর এসে আঘাত করলো মেহরিমার। সে মেহেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে শুরু করল।



দিদুন এর সাথে বাগানে বসে কফি খাচ্ছে আলমির। দুজনে বেশ অনেকক্ষণ হলো হেসে হেসে গল্প করছে। দিদুনের শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। গত সাত দিনে আলমির তার দিদুনকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। সারাক্ষণ দিদুনকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এভাবে বসে বসে সময় কাটালে তো সে তার বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবে না। তাই কফি খেতে খেতে দিদুনের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“দিদুন, আমি ভাবছি তোমার সাথে সারাক্ষণ থাকার জন্য দুজন মেয়েকে রাখবো। যারা সারাক্ষণ তোমার সাথে থাকবে। তোমাকে হাসিখুশি রাখবে। তোমার সব আদেশ নিষেধ মেনে চলবে। তোমার সেবা করবে।”

ওর কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিদুন। তারপর ছোট করে নিশ্বাস নিয়ে বলেন,

“হুম জানি দাদুভাই, তুমি তো এভাবে আমার সাথে বাসায় বসে বসে সময় কাটাতে পারো না। তোমার তো অনেক কাজ। কিন্তু কি করি বল তো। আমার বয়সটা এখন নাতির ঘরের ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা করে কাটানোর। কিন্তু আমার কপালে হয়তো সেটা নেই। তুমি তো আর বিয়ে-শাদী করবেনা। তাই তোমার যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো।”

“দিদুন প্লিজ এভাবে বলোনা। অন্য কেউ না বুঝলেও তুমি তো আমাকে বোঝো। তুমি ভালো করেই জানো আমি কেন বিয়ে করতে চাই না। মেয়েদের প্রতি ঘৃণা কাজ করে আমার। আর মনের মধ্যে ঘৃনা নিয়ে কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করা সম্ভব নয়। আমি চাই না কোন মেয়েকে বিয়ে করে তার জীবন ও নিজের জীবন নষ্ট করতে। তাই আমি কালকেই নিউজপেপারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি। তুমি নিজে দেখে শুনে দুজন মেয়েকে তোমার জন্য রেখ। যারা সারাক্ষণ তোমার সাথে থাকবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।”

কথাগুলো বলেই ফোন হাতে নিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে যায় আলমির। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দিদুন। তারপর মনে মনে কিছু একটা ভেবে দুষ্টু হেসে বলেন,

“নিউজপেপারে বিজ্ঞপ্তি দেবে দাও দাদুভাই। তবে এবার আমি আমার জন্য মেয়ে দেখব না। বরং এমন মেয়ে পছন্দ করব। যাকে তুমি বিয়ে করবে। যে হবে আমার একমাত্র নাতবউ। যতদিন না এমন মেয়ে পাই ততদিন হাল ছাড়ছিনা আমি। আমার নামও দিলরুবা বেগম।”

,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,