দিওয়ানেগি পর্ব-০৭+০৮+০৯

0
540

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৭+৮+৯
#M_Sonali

দুষ্টু হাসি মুখে নিয়ে মেহরিমার হাত থেকে কফির মগটা হাতে নেয় আলমির। কফির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকায় সে। কফি মগটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মেহরিমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। পিছন দিকে হেলান দিয়ে গালে শাহাদাত আঙ্গুল ঠেকিয়ে চিন্তা করার ভঙ্গিতে বসে। তারপর হেয়ালি কন্ঠে বলে,

“আচ্ছা তোমরা মেয়েদের সমস্যা কি বলতো। নিজেরা সব সময় মিষ্টির ডিব্বা নিয়ে বসে থাকো বলে। ছেলেদের কেও তেমনই মনে করো?”

“মানে, ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”

ওর কথার উত্তরে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আলমির। পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ওর দিকে হাল্কা ঝুঁকে বলে উঠে,

“মানেটা খুব সোজা। তোমরা এই দুধ চিনি মেশানো মিষ্টি কফি খেয়ে খেয়ে শুধু ময়দার বস্তার মত মোটা হতে শিখেছ। কিন্তু আমরা ছেলেরা এসব খাই না। এই কপিটা নিয়ে গিয়ে আমার জন্য দুধ-চিনি ছাড়া ব্লাক কফি নিয়ে আসো।”

মেহরিমার এবার বেশ রাগ হলো। কিন্তু সে রাগটা প্রকাশ করল না। মনে মনে ভাবলো,

“কেমন লোক ইনি! এই কথাটা এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলার কি দরকার ছিল। তাও আবার এভাবে হেয়ালিপনা করে। সরাসরি বললেই হতো তিনি যেমন তেতো, তেমন তেতো জিনিস ছাড়া তিনি খান না। খাম্বা কোথাকার।”

কথাটা ভেবেই কফি মগটা হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল মেহরিমা। আলমির পিছন থেকে বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,

“সবে তো শুরু মিস মেহরিমা, আগে আগে দেখো তুম হারে সাত হোতা হে কেয়া।”

কথাটা বলেই সোফার উপর বসে পড়ে আলমির। তখনই ফোনটা বেজে ওঠে তার। ফোনটা হাতে নিয়ে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে কারো কথা শুনে “আসছি” বলে দ্রুত রেডি হয়ে নেয় সে। তারপর বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশে। মেহরিমা কফি নিয়ে সিড়িতে উঠতেই দেখে আলমির চলে যাচ্ছে। মেহরিমা কিছু বলার আগেই সে বলে ওঠে,

“এখন কফি খাবার সময় নেই। আমার জরুরী কাজ আছে তাই অফিসে যাচ্ছি। দিদুনকে বলে দিও।”

কথাটি বলেই মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যায় আলমির। মেহরিমার ভীষণ রাগ হয় এতে। দু-দুবার কফি বানিয়ে নিয়ে এসেও কোন কাজ হলোনা। শুধু শুধু কষ্ট করে কফি বানাতে হল তাকে। রাগ করে কফি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঢেলে ফেলে দেয়। তারপর কাপটা সঠিক জায়গায় রেখে ফিরে আসে দিদুন এর কাছে। দিদুনের কাছে গিয়ে আলমিরের চলে যাওয়ার কথা জানায়। কিন্তু এতে দিদুনের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। কারণ আলমির এমন সব সময়ই করে। দিলরুবা বেগম যেন মেহেরের সাথে এতটাই মিশে গেছে, যেন তারা দুই বান্ধবী। যেন মেহেরের মত ছোট বাচ্চা হয়ে গেছে একদম। দুজনের গল্প করা দেখে মেহরিমা কিছু বলেনা। পাশে বসে দুজনের সিন দেখে আর মিটিমিটি হাসে। একদিনেই যেনো কত যুগের পরিচিত হয়ে গেছে তারা।
,
,
৭ দিন পর
গত সাত দিনে বদলে গেছে অনেক কিছুই। মেহরিমা আর মেহের যেন দিলরুবা বেগমের বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠেছে। তার সাথে এতটাই ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে গেছে যে, তাদের এখন আপন দাদি-নাতনি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এদিকে আলমির তার অফিসের কাজ নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। সারাদিন রাত মিলে হয়তো এক ঘন্টার জন্যেও বাসায় থাকতে পারে না সে। রাতেও বাসায় আসে না। তাই বাধ্য হয়ে মেহেরকে নিয়ে আলমিরদের বাসায় থাকতে হচ্ছে মেহরিমাকে। দিদুন একা থাকে বলে সারা দিন-রাত তার কাছে থাকতে হচ্ছে।

রাত প্রায় এগারোটা। দিদুন ঘুমিয়েছেন বেশ অনেকটা সময় হয়েছে। মেহেরও তার সাথে গল্প করতে করতে তার পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। মেহরিমা তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে পাশের রুমে ঘুমাবে বলে বেরিয়ে আসে। সবেমাত্র দরজায় পা রেখেছে তখনই তার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে অচেনা নাম্বার দেখে কেটে দেয় সে। তারপর রুমের মাঝে গিয়ে দরজাটা লাগাতে গেলেই আবারও ফোনটা বেজে ওঠে। ধরবে কি ধরবে না এমন সংকচের মধ্যে থেকে বেশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে মেহরিমা। কানের কাছে ধরে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ রাগী গলায় বলে ওঠে,

“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? কখন থেকে কল দিচ্ছি ধরছো না কেনো? কেটে দিচ্ছ কেন বারবার হ্যাঁ?”

ওই পাশ থেকে আলমিরের কন্ঠ শুনে ফোনটা কানের কাছ থেকে একবার সামনে আনে মেহরিমা। নাম্বারটা দেখে নিয়ে আবারও কানের কাছে ধরে শান্ত গলায় বলে,

“সরি স্যার, আসলে আমি বুঝতে পারিনি। অচেনা নাম্বার দেখে কেটে দিচ্ছিল,,,,”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দেয় আলমির। তারপর গম্ভির গলায় বলে ওঠে,

“Whatever, দিদুন কি ঘুমিয়ে পরেছে?”

কথার মাঝখানে এভাবে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ বিরক্ত হয় মেহরিমা। কিন্তু কিছু বলে না সে। শান্ত গলাতেই উত্তর দেয়,

“জ্বি দিদুন অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি একটু পর আসছি তুমি ঘুমাবে না। জেগে থেকে আমার জন্যে ওয়েট করো।”

কথাটি বলেই ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দেয় আলমির। এতে যেনো ভিষন রাগ হয় মেহরিমার। বেশ বিরক্তও হয়। “এত রাতে কেনো জেগে বসে থাকবে ও? সে কি তার বিয়ে করা বউ? যে রাত জেগে তার অপেক্ষা করবে?”

কথাটা মনে মনে ভেবেই মুখ ভেংচি কাটে সে। দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে এসে ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে পরে। আলমিরকে মনে মনে গালি দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না। রাত সাড়ে বারোটার সময় চারজন গার্ড এর সাথে বাসায় ফেরে আলমির।
গার্ডদের রেখে দৌড়ে উপর তলায় চলে যায় সে। নিজের রুমে গিয়ে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর আবার নিচে নেমে আসে। দিদুনের রুমে গিয়ে দেখে দিদুন বিভোরে ঘুমাচ্ছে। তার পাশেই শুয়ে আছে মেহের। দুজনেই বাচ্চাদের মত একে অপরকে জরিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুচকি হাসে আলমির। আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে গিয়ে দেখে দরজা লাগানো। সে কিছু না ভেবেই আস্তে করে ধাক্কা দেয় দরজায়। সাথে সাথে খটখট শব্দে খুলে যায় দরজা।

রুমের মাঝে মৃদু আলো। সেই আলোতে বিছানার দিকে চোখ পড়তেই যেন থমকে যায় আলমির। বিছানায় মেহরিমা ঘুমিয়ে আছে বিভোরে। মাথার ঝলমলে কালো চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে তার। কেমন অপরূপ সুন্দর লাগছে তাকে। যেন কোন ঘুমন্ত পরী। ড্রিম লাইটের আলোতেও যে কাউকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে তা জানা ছিলো না আলমিরের। সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় ঘুমন্ত মেহরিমার কাছে। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে। এক নজরে তাকিয়ে থাকে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে। কতটা নিশ্পাপ লাগছে দেখতে। যেনো সদ্য ফোটা কোনো লাল গোলাপ। সে জানেও না সে কি করছে। যেন কোন এক ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেছে সে। ডান হাত দিয়ে মেহরিমার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয় আলমির। সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায় তার। সে লাফিয়ে উঠে বসে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় সামনে কাউকে বসে থাকতে দেখে চোর চোর বলে চিৎকার করে ওঠে। তখনই আলমির উঠে দাড়িয়ে দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে।

এতে মেহরিমা চুপ করার বদলে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আলমিরের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। হাতে ব্যথা অনুভব হতেই ওর মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নেয় আলমির। সুযোগ পেয়ে খাট থেকে নেমে জোরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করে মেহরিমা,

“কে কোথায় আছ, চোর চোর চোর। বাসায় চোর ঢুকেছে। জলদি আসো কোথায় আছো সবাই। ও দিদুন গো, মেহের কই গেলি আমার রুমে চোর ঢুকেছে।”

ওর চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় দিদুন ও মেহেরের। তারা ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসে। গার্ডগুলো ও কাজের লোকেরা সবাই দৌড়ে আসে সেই রুমে। ততক্ষনে একজন গার্ড গিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। লাইটের আলোয় দিদুনকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মেহরিমা। তারপর চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলে,

“দিদুন দেখো আমার রুমে চোর ঢুকেছে। আমাকে বাচাও এই চোরের হাত থেকে।”

মেহরিমার কথায় সবাই মিলে ফিরে তাকায় পিছন দিকে। তাকাতেই দেখে আলমির দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসম্ভব রেগে আছে সে। সবাই ওকে দেখে দ্রুত মাথা নিচের দিকে করে নেয় ভয়ে। পিছন থেকে একজন কাজের লোক আস্তে করে বলে,”আজ তো মেহরিমা ম্যাম গেলো। তাকে আস্তো চিবিয়ে খাবে ছোট স্যার। ওনার যে রাগ।” কথাটা কানে যায় মেহরিমার। এতে যেনো সে আরো ঘাবড়ে যায়। দিদুন কি বলবে এই মুহূর্তে যেন কিছু বুঝতে পারছেনা সে। এদিকে মেহের আলমিরকে দেখার পর থেকেই মিটিমিটি হাসছে।

চোরকে দেখেও সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এটা ভেবেই সন্দেহ হয় মেহরিমার। সে দিদুনের ঘার থেকে মাথা তুলে ধীরে ধীরে ফিরে তাকায় পিছনে। তাকাতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তার। সামনে যেন কোন ক্ষুধার্থ সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। আর সে তার কাছে এক অসহায় হরিণ। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন এক্ষুনি চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। মেহরিমা এবার চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গেলে। তারপর ধীরে ধীরে দিদুনের পিছনে গিয়ে লুকায়। ভয়ে খামচে ধরে থাকে দিদুনের আচল।

অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে, সবাইকে ইশারায় রুম থেকে চলে যেতে বলে দিলরুবা বেগম। কেউ আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শুধু আলমির মেহের আর মেহরিমা ছাড়া। আলমির যেন এতক্ষণ খুব কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছিল। এবার সে ধেয়ে আসে মেহরিমা কে ধরবে বলে। তখনই তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দিলরুবা বেগম। সে ধমকের স্বরে বলে ওঠে,

“দাঁড়াও আলমির। মেহরিমাকে কিছু বলার আগে, তুমি আমায় বলো। এত রাতে মেহরিমার রুমে কি করছো তুমি? যে ও তোমাকে চোর ভেবে ভয় পেয়েছে?”

চোর শব্দটা শুনতেই রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেলল আলমির। রাগে যেন কপালের সব রগ দাঁড়িয়ে গেছে তার। রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“সামনে থেকে সরে যাও দিদুন। এই মেয়েটিকে তো আজকে আমি খুন করে ফেলবো। ওর এত বড় সাহস আলমিরকে চোর বানিয়ে দেয়। I will kill her.”

“খবরদার বলে দিচ্ছি আলমির। তুমি ওর কাছে একপাও এগিয়ে আসবে না। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি। তুমি তো অফিসে ছিলে। তাহলে এত রাত্রে মেহরিমার রুমে তাও আবার অন্ধকার রুমে তুমি কি করতে এসেছিলে? যে মেয়েটি তোমাকে চোর ভেবে ভয় পেলো? উত্তর দাও আলমির।”

আলমির কিছু বলে না। সেখানে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে কিছুক্ষণ সাপের মত ফোঁসফোঁস করতে থাকে। তারপর দিদুন কে পাশ কাটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। মেহরিমা এখনো ভয়ে চুপসে লুকিয়ে আছে দিদুনের পিছনে। সে বুঝতে পেরেছে কত বড় ভুল করে ফেলেছে সে।

দিলরুবা বেগম পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। মেহরিমার থুতনিতে হাত রেখে মুখটা উপর দিকে টেনে ধরে সে। দেখে মেহরিমার চোখে পানি। এটা কষ্টের নয় অতিরিক্ত ভয়ে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এসেছে। ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানার উপর বসায় দিলরুবা বেগম। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“ভয় পেয়ো না দিদিভাই। কিচ্ছু হবে না তোমার। আমাকে বল কি হয়েছিল যে তুমি এভাবে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করলে?”

দিলরুবা বেগমের প্রশ্নে এবার ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠে মেহরিমা। তার হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে কান্না করতে করতে বলে,

“বিশ্বাস করুন আমি বুঝতে পারিনি এটা উনি। ঘুমের ঘোরে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে এভাবে চিৎকার করে চোর বলে সোরগোল করেছি। যদি জানতাম ওটা আলমির স্যার, তাহলে কখনোই চিৎকার করতাম না।”

দিলরুবা বেগম মৃদু হাসেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“কেঁদনা দিদিভাই কিচ্ছু হয়নি। কোন ভুল করনি তুমি। তোমার জায়গায় আমি হলেও হয়ত এমনটাই করতাম। ভুলটা আলমিরের ছিল। ওর এভাবে তোমার রুমে আসা উচিত হয়নি। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। এমন ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে ও তোমার রুমে কি করছিল। তাও আবার এত রাতে?”

কথাটা বলেই সন্দেহের দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকায় তিনি। এতে যেন আরো ভেঙে পড়ল মেহরিমা। মনের মাঝে লজ্জা ও আতঙ্কে কেঁপে উঠলো তার। সে বুঝতে পারছে না দিদুন তাকে ভুল বুঝল কিনা।

“বিশ্বাস করুন দিদুন আমি সত্যি জানিনা আলমির স্যার আমার রুমে এত রাতে কেন এসেছিলেন। আর কেনইবা ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে আমার পাশে গিয়ে বসে ছিলেন। ঘুমের ঘোরে ওনাকে দেখে এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে নিজের অজান্তে সিনক্রিয়েট করে বসেছি। প্লিজ দিদুন আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি এমন কিছুই করিনি যাতে আপনাদের কারো সম্মানে আঘাত লাগে।”

মেহের এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের কথা শুনছিল। এবার নিজের আপুকে এভাবে কাঁদতে দেখে সে বলে উঠল,

“দিদুন তুমি আমার আপুকে ভুল বুঝনা। আমার মনে হয় দুলাভাই’ই কিছু করেছে। আমার আপু কিছুই করেনি। আমারই ভুল হয়েছে আপুর কাছে না ঘুমিয়ে তোমার কাছে ঘুমিয়েছি।”

মেহেরের কথা শুনে দিলরুবা বেগম মুচকি হাসেন। ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে দু’জনকেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,

” ধুর পাগলী দুটো। আমি তোমাদের উপর রাগ করিনি। বা ভুলও বুঝিনি কাউকে। আমি জানি মেহরিমা কিছুই করেনি। আলমির হয়তো কোন কারনে ওর সাথে কথা বলতে এসেছিল। আমি জানি আমার নাতি কখনো এমন কিছু করবে না। যাতে তার দিদুন কষ্ট পায়।”

“আসলে ভুলটা আমারই দিদুন। ঘুমানোর আগে স্যার আমায় ফোন করে বলেছিল। আমাকে জেগে থাকতে। সে হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিলেন আমায়। কিন্তু আমি’ই নিজের বোকামোর জন্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছি।”

অপরাধীর মত মাথা নিচু করে কথাগুলো বললো মেহরিমা। ওর কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গম্ভির গলায় বললেন,

“হুম বুঝতে পেরেছি। আমার দাদুভাই হয়তো তোমার এই বোকামোতে অনেক কষ্ট পেয়েছে। সে হয়তো তোমায় কিছু বলতে এসেছিলো। তাই আগামি কাল সকালে তুমি তার থেকে ক্ষমা চাইবে। তার মন ভালো করার দায়ীত্ব তোমার।”
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৮
#M_Sonali

সকাল দশটা পাঁচ মিনিট। এখনো নিজের রুম থেকে বের হয়নি আলমির। গতরাতে সেই যে গিয়ে দরজা লাগিয়েছে। তারপর আর তার কোন খোঁজ খবর নেই। এদিকে দিলরুবা বেগম বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন। কাউকে পাঠিয়ে যে ওকে ডেকে আনতে বলবেন সে সাহসও পাচ্ছেন না তিনি। তাই সে অনেক ভেবে মেহরিমা কে বলল আলমিরের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যেতে। আর গত রাতের জন্য তার কাছে সরি বলতে। মেহরিমাও বাধ্য মেয়ের মতো কফি বানিয়ে নিয়ে রওনা হলো আলমিরের রুমের উদ্যেশে।

কফি হাতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মেহরিমা। দরজায় টোকা দিবে কি দিবে না সেটা নিয়ে ভীষণ সংকচে পড়ে গেল সে। কি করবে ভেবে না পেয়ে একবার ফিরে আসতে চাইল। দরজায় টোকা দিতে যেন ভীষণ রকম ভয় হচ্ছে তার। গত রাতের কথা মনে পড়ে বারবার গলা শুকিয়ে আসছে। আলমির যদি সত্যি সত্যি রাগ করে কিছু করে ফেলে। তাহলে কেমন হবে। এসব ভেবে বেশ দুটানায় পড়ে যায় সে। এভাবে বেশ কিছুক্ষন সময় নিয়ে ভাবতে থাকে কি করবে সে। শেষে কোনো উপায়ান্তর না দেখে চোখ বন্ধ করে বিসমিল্লাহ বলে দরজায় টোকা দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়। তখনই ভেতর থেকে খট করে শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়। সাথে সাথে বড় বড় চোখ করে সামনে তাকায় মেহরিমা। দেখে আলমির তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে কফি দেখে রুমের ভিতরে চলে যায় সে। কোন রকম কথা বলে না। এতে বেশ অবাক হয় মেহরিমা।

সে কফি মগটা হাতে নিয়ে এক প্রকার কাঁপতে-কাঁপতে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। কাপটা কাঁপা কাঁপা হাতে টেবিলের উপর রেখে আলমিরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“স্যা স্যার আ আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

আলমির কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ গিয়ে সোফার উপর বসে। তারপর কফির মগটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। মেহরিমা তাকে চুপ থাকতে দেখে দু পা সামনে এগিয়ে যায়। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি কালকে আমার বোকামির জন্য এত কিছু ঘটে যাবে। আপনি ফোন করে বলার পর আমার জেগে থাকা উচিত ছিল। আমার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য এতকিছু হয়ে যাবে জানলে, আমি কখনোই ঘুমাতাম না। প্লিজ স্যার আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কখনো এমন কিছু করবো না। I am really sorry.”

নিচের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে আলমিরের দিকে ফিরে তাকাল সে। দেখল আলমির তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো একদম লাল টকটকে এবং ফোলাফোলা লাগছে তার। দেখে মনে হচ্ছে যেন সারারাত ঘুমায়নি সে। এতে বেশ ঘাবড়ে গেল মেহরিমা। সে ভাবল আলমির হয়তো রেগে গেছে। এখন রাগের মাথায় যদি কিছু করে বসে? তখনই আলমির শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“কফিটা ঠান্ডা হলেও ভালো ছিল। কফির জন্য thanks। তুমি এখন আসতে পারো।”

আলমিরের এমন উত্তরে ও যেনো বিশ্মিত হয়ে গেল। সে কফির মগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। দরজার কাছে এসে হঠাৎ কি মনে করে পিছন দিকে একবার ফিরে তাকাল সে। দেখল আলমির তার পানেই তাকিয়ে আছে। তার চাহনি যেনো ওকে কিছু বলতে চাইছে। সে দেরি না করে কাপটা নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেল। এখনও বুকের মধ্যে ভিষন রকম ধুকধুক করছে তার। যেন হৃদয়টা এখনি বুকচিরে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

দিলরুবা বেগম মেহরিমার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলেন মেহরিমা দরদর করে ঘামছে। আর জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রকম ঘাবড়ে আছে মেয়েটা। ওর অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হলেন দিলরুবা বেগম। সে দ্রুত এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“কি হয়েছে দিদিভাই? তুমি এভাবে হাপাচ্ছো কেন? আলমির কিছু বলেছে তোমায়? ওকে দেখে ভয় পেয়েছো কোনো কারণে?”

উনার কথার উত্তর না দিয়ে মেহরিমা টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। তারপর যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত করে বলল,

” উনি আমাকে কিছুই বলেননি দিদুন। একদম শান্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু উনার চাহনি যেন আমাকে কিছু বলছিলো। যেটা আমি বুঝতে পারিনি। রাতের উনার সাথে যেন এখনকার ওনার কোন প্রকার মিল নেই। আমি ওনাকে এতটা শান্ত রূপে এর আগে কখনো দেখিনি। কেন জানিনা তার এমন চাহনি দেখে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। ঘামতে শুরু করেছি আমি। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে এসব।”

এতোটুকু বলে থামল মেহরিমা। ওর কথা শুনে দিলরুবা বেগম কিছু একটা ভাবলো। তারপর মুচকি হাসলো। সে মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” কিচ্ছু হয়নি, ওর রাগ পড়ে গেছে তাই এখন শান্ত হয়ে রয়েছে। তুমি চিন্তা করো না। এখানে বসে রেস্ট নাও। আমি রুমে যাচ্ছি।”

কথাটি বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন দিলরুবা বেগম। মনে মনে ভাবতে লাগলেন,

“ইশশ আমার মেহেরটা এখন যদি স্কুলে না যেত তাহলে ওর সাথে অনেক মজার কথা শেয়ার করতে পারতাম। ও তো জানলোই না যে, ওর আপু আর দুলাভাই কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে। প্রেমের হাওয়া লেগেছে তাদের গায়ে। যেটা আমি বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারছি। এখন শুধু এই প্রেমটা গাঢ় হয়ে প্রকাশ হওয়ার পালা।”

কথাগুলো ভেবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন দিলরুবা বেগম। তারপর নিজের রুমে গিয়ে বিছানার উপর বসে থেকে প্ল্যান করতে লাগলেন। সামনে কি করলে ওদের দুজনকে আরো কাছে আনা যায়। তখনই দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে সে দিকে ফিরে তাকালেন তিনি। দেখলেন আলমির দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকাতেই দ্রুত এসে তার সামনে বসল আলমির। তারপর তার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলল,

“আমি গতকাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি দিদুন। জানিনা তুমি আমাকে নিয়ে কি ভেবেছো। তবে বিশ্বাস করো আমি খারাপ কোন উদ্দেশ্যে মেহরিমার রুমে যাইনি। আমি ওকে ফোন করে বলেছিলাম জেগে থাকতে। কারণ তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার ছিল। ওর সাথে মিলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাঝখান থেকে এত কিছু ঘটে যাবে বুঝতে পারিনি।”

এতোটুকু বলে মাথা নিচু করে বসে রইল আলমির। দিলরুবা বেগম মুচকি হাসলেন। তার হাতের উপর নিজের হাত আলতো করে বুলালেন। আদুরে গলায় বললেন,

“ধুর পাগল ছেলে এভাবে অপরাধীর মত কেন বসে আছো তুমি? আমি জানি আমার দাদুভাই দুনিয়া উল্টে গেলেও, এমন কোন কাজ করবে না, যাতে তার দিদুন কষ্ট পায়। সে এমন কাজ করতেই পারে না। এবার বল সারপ্রাইজটা কি?”

দিলরুবা বেগমের আশ্বাস পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল আলমিরের। সে উচ্ছাসিত কন্ঠে বলল,

“আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি দিদুন। আগামী পরশু দেশের টপ বিজনেসম্যান এর এ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে আমায়।”

আলমিরের কথায় আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো দিলরুবা বেগমের। তার ছেলে যে সবসময় এই স্বপ্নটাই দেখতো। দেশের টপ বিজনেসম্যান হয়ে দেখানোর। আজ সেই স্বপ্ন তার নাতি পূরণ করেছে। তার ছেলে বেঁচে থাকলে হয়তো কতই না খুশি হতো আজ। আলমির কে বুকে জড়িয়ে ধরল দিলরুবা বেগম। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আমি জানতাম দাদুভাই তুমি পারবে। আজ বাবার স্বপ্ন সত্যি করে সেটা প্রমান করে দিয়েছো তুমি।”

এভাবে আরো বেশ কিছুক্ষন গল্প করে তারা। দরজার কাছে দাড়িয়ে এতক্ষণ সবকিছুই দেখছিল মেহরিমা। কেন জানেনা তার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। দাদি নাতির এমন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ সে। দিদুন এর সাথে কথা শেষ করে রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায় আলমির। দরজার কাছে এসে মেহরিমা কে দেখে ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলে,

“৫ মিনিটের মাঝে আমার রুমে আসো। তোমার সাথে কথা আছে আমার।”

কথাটি বলেই দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে যায় সে। মেহরিমা সেখানে দাঁড়িয়ে বেকুবের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার চলে যাওয়ার দিকে। তখনই দিলরুবা বেগমের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে তার। সে গুটিগুটি পায়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে। দিলরুবা বেগম আনন্দের অশ্রু ঝরিয়ে বলেন,

“আজ আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে কতইনা খুশি হতো। জানো মেহরিমা আজ যে তার স্বপ্ন পূরণ করেছে তার’ই একমাত্র ছেলে। কত স্বপ্ন দেখেছিলো সে এই দিনটার জন্য। আজ সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে আর এই দুনিয়াতে নেই।”

কথাগুলো বলেই চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন দিলরুবা বেগম। মেহরিমা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

“এভাবে কান্না করবেন না দিদুন। আপনার কান্না দেখলে উনিও ভেঙে পড়বেন। আপনি তো জানেন উনি আপনাকে কতটা ভালোবাসেন। আর তাছাড়া আল্লাহ যার যতোটুকু হায়াত দিয়েছে সে ততদিনই বাঁচবে। প্লিজ দিদুন কান্না করবেন না।”

“জানি দিদিভাই। কিন্তু আমার মন যে তবুও মানে না। আমার ছেলেটা যে মারা যায়নি দিদিভাই। তাকে যে মেরে,,,! ”

এতোটুকু বলেই থেমে গেলেন দিলরুবা বেগম। দ্রুত নিজের মুখটা আঁচল দিয়ে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলেন তিনি। আবেগের বশে হয়ত এমন কিছু বলতে গিয়েছিলেন যেটা সে কখনোই বলতে চায়নি। উনাকে থামতে দেখে সন্দেহ হলো মেহরিমার। সে প্রশ্ন করে বললো,

“আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না দিদুন। আপনার ছেলে মারা যায়নি মানে? তবে কি সে বেঁচে আছে?”

ওর এমন প্রশ্নে ভিষন ঘাবড়ে গেলেন দিলরুবা বেগম। কি বলবেন যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ওকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত বলে উঠলো,

“আলমির তোমাকে ওর রুমে ডেকেছে। হয়তো কোনো কাজ আছে। তাড়াতাড়ি যাও দেখো কেন ডেকেছে ও। দেরি হলে আবার রেগে যাবে।”

দিলরুবা বেগম ওর প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও মেহরিমা বেশ ভালই বুঝতে পারল, যে তিনি ওর কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু সে আর দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করল না। এভাবে প্রশ্ন করাটা বেমানান লাগছে তার কাছে। তাই সে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে রওনা হল আলমিরের রুমের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আলমিরের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,

“ভেতরে এসো, দরজা খোলা আছে।”

মেহরিমা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখল আলমির সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে যে তার মনোভাব কিছুই বোঝা গেলো না। মেহরিমা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল,

“স্যার আপনি আমাকে কেন ডেকে ছিলেন?

আলমির নিজের পায়ের উপর থেকে পা নামালো। তারপর হাতে থাকা ঘড়ির টাইম দেখে বলে উঠল,

“আসার সময় তোমাকে বলে এসেছিলাম ৫ মিনিটের মধ্যে উপরে আসতে। কিন্তু এখন পুরো ১২ মিনিট পর তুমি এসেছ। এবার বল এটার জন্য তোমাকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত।”

ওর এমন উত্তরে মেহরিমা ফিরে তাকাল ওর দিকে। দেখল রাগে যেন ফোসফোস করছে সে। চোখ মুখ একদম লাল হয়ে আছে তার। মুহূর্তেই ভয়ে শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল মেহরিমার। ভীষণ রকম ভয় পেতে লাগলো সে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“স্যরি স্যার, আসলে দিদুনের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে,,,,,!”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিল আলমির। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো,

“কোনরকম এক্সকিউজ শুনতে চাই না আমি। তোমাকে টাকা দিয়ে এখানে এ কারণে রাখা হয়নি যে তুমি নিজের মন মত চলবে। এতগুলো টাকা মায়নে দিয়ে অবশ্যই তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ার জন্য রাখেনি। এমনিতেই তোমার জন্য আমার সব রকম প্ল্যান ভেসতে গেছে। কত আশা করে কাল রাতে অফিস থেকে এসেছিলাম আমি। দিদুনকে সকালে উঠে সারপ্রাইজ দেবো বলে। কিন্তু তুমি আমাকে এমন সারপ্রাইজ দিয়েছো যা আমি সারা জীবনেও ভুলবোনা। আর এটার মাসুল তোমাকে দিতে হবে। আগামি পরশুদিন রাতে বাড়িতে পার্টি রেখেছি। আর সেই পার্টির যাবতীয় কাজ তোমাকে করতে হবে। এটাই তোমার শাস্তি। বুঝতে পেরেছ।”

ওর এমন ধমক খেয়ে কাঁপতে শুরু করে মেহরিমা। তার আর কোন রকম কথা বলার মত সাহস নেই। ভয়ে একদম চুপ করে আছে সে। ওর কথায় শুধু মাথা নেড়ে কোনমতে সায় দিল সে। তারপর দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। দু চোখে দু ফোটা জল চলে এসেছে অলরেডি। এর আগে এভাবে তাকে কেউ কখনো ধমকায়নি। জীবনের প্রথম এমন অপমানিত হয়ে ভীষণ লজ্জা লাগছে মেহরিমার। কিন্তু সে মনে মনে ভাবে এটা তারই ভুলের ফল। সে যেমন ভুল করেছে তাতে এমন শাস্তি তার পাওয়া উচিত।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৯
#M_Sonali

সকাল থেকে একের পর এক কাজ করে চলেছে মেহরিমা। এক মিনিটের জন্যও বিশ্রাম নেয় নি সে। এমন কি সকাল থেকে কিছু খায়ও নি সে। এখন বেলা বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। দিলরুবা বেগম তাকে বারবার খাওয়ার জন্য ডেকেছে। কিন্তু সে মানতে নারাজ। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে। যে পর্যন্ত আলমির নিজে থেকে ওকে কাজ করতে মানা না করবে। সে পর্যন্ত সে থামবে না। খাবেও না কিছু। মনে মনে ভীষণ রকম রাগ উঠে আছে তার আলমিরের উপর। একটি মানুষ কি করে এতটা নির্দয় হতে পারে। সামান্য একটা ভুলের কারণে এভাবে কাউকে দিয়ে খাটাতে পারে। মেহরিমার পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর উপর পানি ঢেলে দিয়েছে। তবুও যেন থামার নাম করছে না। পুরো বাড়িটা একা হাতে পরিষ্কার করেছে। বাড়ির প্রতিটা কোনা অনেক যত্নের সাথে পরিষ্কার করেছে সে। কাজের লোকদের হাতও লাগাতে দেয়নি কোনো কাজে।

না খেয়ে একটানা এত কাজ করার ফলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেহরিমা। ক্লান্ত দেহে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। এতক্ষণ সোফার উপর বসে থেকে সবকিছুই তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলো আলমির। মেহরিমার অবস্থা দেখে মুখে তার বাকা হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু মনটা কেন জানি বারবার মায়ায় পড়ে যাচ্ছিল মেয়েটার।
সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় আলমির। মেহরিমার দিকে গম্ভীর নজরে তাকিয়ে বলে,

” অনেক হয়েছে আর কোন কাজ করতে হবে না তোমায়। এবার বাকি কাজগুলো ডেকোরেশনের লোকজন এসে করে দেবে। তুমি এবার গিয়ে ফ্রেশ হতে পারো।”

কথাটি বলে ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা নিজের রুমে চলে যায় আলমির। মেহরিমা সেখানেই বসে থেকে রাগে দুঃখে ফোসফোস করতে থাকে। তারপর কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়ায় সে। দিদুনের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে কান্না জরিত কন্ঠে বলে,

“দিদুন আমি আমার বাসায় যেতে চাই। সন্ধ্যের আগেই আবার ফিরে আসবো। এই সময় টুকু আমাকে ছুটি দিন প্লিজ।”

ওর কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“যাও দিদি ভাই। তবে সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসো। সন্ধ্যার পর পার্টি শুরু হবে। ওই সময় তুমি উপস্থিত না থাকলে আলমির আবার রাগ করতে পারে। আর হ্যাঁ মেহের কিন্তু স্কুল থেকে এখানে আসবে। আমি ড্রাইভার কে বলে দিয়েছি ওকে এখানে নিয়ে আসতে। ড্রাইভার তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে এখন। আর আসার সময়ও তোমায় নিয়ে আসবে। রেডি হয়ে থেকো।”

উনার কথার উত্তরে কিছু বললোনা মেহরিমা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সম্মতি জানালো সে। তারপর আরো কিছক্ষন কথা বলে রেডি হতে চলে গেল।
,
,
,
ঝরনার নিচে বসে থেকে বাবা মায়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কান্না করছে মেহরিমা। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। আজ যদি নিজের বাবা-মা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো কারো বাসায় কাজ করতে গিয়ে এমন অপমানিত হতে হতো না তাকে। জীবনে এত কাজ একসাথে সে কোনদিনও করেনি। বাবা-মা তাকে রাজকুমারীর মত রেখেছে সারাজীবন। মা মারা যাওয়ার পর ঘরের টুকিটাকি কাজ করে সময় কাটিয়েছে। কিন্তু এত কাজ সে কখনোই করেনি। দু’হাত যেন ব্যথায় টনটন করছে তার। আজ যেনো ভীষণ রকম মিস করছে সে নিজের বাবা-মাকে।

“বাবা-মা তোমরা আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে? কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা ফেলে গেলে আমায় আর মেহেরকে? এখানে যে একা বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন। বাবা তুমি না সব সময় আমাকে শিখিয়েছো। কখনো কারো কাছে মাথা নত না করতে। আজ দেখো তোমার মেয়ে মাথা নত করেছে। এক অহংকারীর কাছে হেরে গিয়েছে সে। কারো বাড়ির কাজের মেয়ের মতো কাজ করে এসেছে সে। সত্যি বাবা আমার আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোমাদের দুজনকে বড্ড বেশি মিস করছি আমি। কেন আমাদের একা করে তোমরা চলে গেলে বাবা মা, কেন?”

কথাগুলো বলেই অঝোরে কান্না করে মেহরিমা। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হয় সে। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে একটি ডিম দিয়ে অমলেট বানায়। আপাতত আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না তার। আসার সময় দিদুন অনেক করে খেতে বলেছে তাকে। কিন্তু সে না খেয়েই চলে এসেছে। কেন জানে না আজকে ওই বাসা তে কিছু খেতে ইচ্ছা করছিল না। শুধু রাগ এবং ঘৃণায় শরীর জ্বলে যাচ্ছিল তার আলমির এর উপর।”

অমলেট খেয়ে পানি পান করে মেহরিমা।
তার নিজের রুমে গিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকে। হালকা একটু ঘুমিয়ে নেয় সে। ঘুম ভেঙে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে বিকেল চারটা বেজে গেছে। সে আর দেরী করে না। উঠে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে চিন্তায় পরে যায় সে। কারণ দিদুন আসার সময় তাকে বারবার হুঁশিয়ার করে বলে দিয়েছে, যেন অনেক সুন্দর করে সেজেগুজে ভালো ড্রেস পড়ে পার্টিতে যায় সে। পার্টিতে অনেক বড় বড় লোক আসবে। তাই তাদের সামনে নিজেকে গুছিয়ে রাখতে। ভালো ড্রেস কেনার জন্য টাকাও দিতে চেয়েছিলো তাকে। কিন্তু সে নেয়নি।

মেহরিমা আলমারি খুলে খুঁজতে থাকে সে কোন ড্রেস পড়ে পার্টিতে যাবে। তখনই আলমারির এক কোনায় একটি প্যাকেটের দিকে নজর পড়ে তার। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে এটা কিসের প্যাকেট? একটু ভাবতেই খেয়াল হয় তার বাবা এটা তার জন্য এনেছিল। যখন তার বিয়ে ঠিক হয়। তার হাতে দিয়ে বলেছিল এটা যেন তার গায়ে হলুদের দিন পরে। যদিও এটার ভেতরে কি ছিল খুলে দেখা হয়নি মেহরিমার।

মেহরিমা প্যাকেটটি হাতে নিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে। তারপর যত্নসহকারে প্যাকেটটা খুলে দেখে হলুদ রঙের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। সেটা হাতে নিয়ে তুলে ধরতেই যেন মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। অসম্ভব সুন্দর হলুদ রঙের একটি গাউন জামা। দেখে বোঝা যাচ্ছে জামাটি অনেক দামী। তার বাবা তাকে সবসময় বলত, তার বিয়েতে কোন কিছুর কমতি রাখবে না। আর সেটাই করেছে তার বাবা। এত দামি একটা গাউন জামা নিয়ে এসেছিল তার গায়ে হলুদের জন্য।
কথাগুলো ভাবতেই দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মেহরিমার। সে চোখের জলটা মুছে নিয়ে সময় নষ্ট না করে গাউনটা পরে নেয়। তারপর বেশ সুন্দর করে সাজগোজ করে নেয় সে। চোখে গাঢ় করে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক। মুখে হালকা মেকআপ করে নেয়। গাউনের সাথে ম্যাচিং করে জুয়েলারি পরে। তারপর একটি উচু জুতা পরে আয়নায় নিজেকে আর একবার দেখে নেয় সে।

দিদুন কে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলে মেহরিমা। তারপর বাসায় তালা দিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে গাড়ির জন্য। প্রায় ৫ মিনিট যেতেই একটি কালো রঙের বাইক এসে দাঁড়ায় তার সামনে। লোকটির মাথায় হেলমেট পরা। চোখ ছাড়া কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার। লোকটিকে নিজের সামনে এসে দাড়াতে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় মেহরিমা। সে কিছু বলবে, তার আগেই লোকটি বলে ওঠে,

“আপনি মিস মেহরিমা, তাই না? আপনি আলমিরের দিদুনের দেখাশোনার জন্য তার বাসায় জব করেন। I’m right?”

মেহরিমা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তীক্ষ্ণ নজরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয় তাকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

“জ্বি, কিন্তু আপনি কে? এর আগে আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না। তাহলে আপনি আমার সম্পর্কে এত কিছু কিভাবে জানলেন?”

ওর কথার উত্তরে লোকটি শব্দ করে হাসলো। তারপর শান্ত গলায় বললো,

“ভয় পাবেন না। আসলে আমি আপনার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানিনা। আমার সম্পর্ক আলমিরের সাথে। ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি এতদিন বিদেশে ছিলাম। আজ সকালেই দেশে ফিরেছি। শুনলাম আলমির দেশের টপ বিজনেসম্যান এর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আর সেই উপলক্ষে ওর বাসায় আজকে পার্টি রাখা হয়েছে?”

” জ্বী আপনি ঠিক শুনেছেন। কিন্তু এসব কথা আমাকে বলার মানে কি? আপনি ডাইরেক্ট আপনার বন্ধুর সাথে দেখা করে তাকে বলতে পারতেন!”

” আসলে আমার শরীরে এলার্জির প্রবলেম হয়েছে। যে কারণে আমি ওর পার্টিতে এ্যাটেণ্ড করতে পারব না। আর ডাক্তার বলেছে বেশি মানুষের ভিড়ে না যেতে। তাই আজকে ওখানে যাওয়া সম্ভব হবে না। আপনি যদি আমার একটা হেল্প করে দিতেন। তাহলে আমি ভীষণ উপকৃত হতাম।”

মেহরিমা ভ্রু কুঁচকালো। বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“কি হেল্প?”

ওর কথার উত্তরে লোকটি নিজের জাকেট এর ভেতর থেকে মাঝারি সাইজের একটি প্যাকেট বের করলো। প্যাকেটটা মেহেরিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“বেশি কিছু না। আমার পক্ষ থেকে এটা তাকে দিয়ে দেবেন। আর বলবেন তার কাছের মানুষের পক্ষ থেকে দেওয়া তার জন্য উপহার। সে যেন এটা দিদুনকে নিয়ে একা খুলে দেখে। এর ভেতরে চিঠি দেওয়া আছে। দিদুন আর সে পড়লেই বুঝবে।”

“কিন্তু আপনি এটা আমার মাধ্যমেই কেন দিচ্ছেন? অন্য কারও হাতেও তো পাঠিয়ে দিতে পারতেন। বা নিজে ফোন করে তাকে ডেকে নিয়ে এসে তাঁর হাতে দিয়ে দিতে পারতেন?”

” হ্যা সেটা পারতাম। কিন্তু এতে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়া হতো না। সেজন্যই দিলাম না। প্লিজ আপনি আমার এই ছোট্ট উপকারটুকু করে দেন। আমি সারাজীবন আপনার কাছে ঋণী হয়ে থাকবো। আর হ্যাঁ একটা কথা খেয়াল রাখবেন এটা যেন দিদুন কে সাথে নিয়ে একা দেখে সে। অন্য কেউ যেন পাশে না থাকে। বিশেষ করে আপনি পাশে থাকবেন না।”

কথাগুলো বলেই মেহরিমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্যাকেটটা হাতে দিয়ে দ্রুত বাইক চালিয়ে চলে গেল সে। মেহরিমা যেন বেকুবের মতো তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হলো কিছুই যেন বুঝতে পারল না সে। হাতে থাকা প্যাকেট টা নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখে নিলো। প্যাকেটটা বেশ ভারী। মনে হয় ভিতরে দামি কিছু আছে। বড়লোক মানুষ দামি কিছু থাকাটাই স্বাভাবিক। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষনের মাঝেই গাড়ি এসে দাড়ালো তার সামনে। প্যাকেটটি নিয়েই গাড়িতে উঠে পরলো সে। রওনা হলো দিলরুবা বেগমের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। আলমিরদের পুরো বাসাটা অসম্ভব সুন্দর করে ফুল, টিপটপ লাইট, ও বেলুন দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। একটু পর থেকে লোকজনের আসা শুরু হয়ে যাবে। আলমির দিলরুবা বেগম এবং মেহের সবাই রেডি হয়ে বসে আছে সোফায়। কিন্তু আলমিরের চোখ যেন বারে বারে মেহরিমা কেই খুঁজছে। সে না চাইতেও বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে মেহরিমার অপেক্ষা করছে। ব্যাপারটা বেশ ভাল করে খেয়াল করছেন দিলরুবা বেগম।

“কি হয়েছে দাদুভাই? তুমি এভাবে ব্যাকুল হয়ে কার জন্য অপেক্ষা করছো? অনেক্ষন হলো লক্ষ করছি দরজার দিকে বারবার ব্যাকুল হয়ে তাকাচ্ছ। কাউকে কি খুঁজছো তুমি?”

দিলরুবা বেগমের প্রশ্নে আনমনা হয়ে আলমির বলে ওঠে,

“ঐ স্টুপিড মেয়েটা এখনও আসছে না কেন? সে কি বুঝতে পারছে না আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি?”

কথাটি বলতেই খেয়াল হয় তার। সে বুঝতে পারে আনমনে কি বলে ফেলেছে। তাই কথা ঘুরাতে দ্রুত বলে ওঠে,

“না মানে আসলে আমি ফিরোজ আংকেলের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আজকে ওনার সাথে সরণ আসবে। দীর্ঘ ৫ বছর পর দেখা হবে ওর সাথে আমার।”

কথাগুলো বলেই দিলরুবা বেগম এর দিকে ফিরে তাকায় সে। দেখে তিনি মিটিমিটি হাসছেন। আলমির তার হাসির কারণ বুঝতে পেরে দ্রুত সামনে থেকে উঠে দাঁড়ায়। দিলরুবা বেগম কিছু বলেন না। তার যা বোঝার বুঝে গেছেন তিনি। আলমির দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন ফিরোজ আহমাদ ও তার স্ত্রী এবং তার ছেলে সরণ।
সরণ এসেই আলমির কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তারপর উচ্চ কন্ঠে বলে,

“হেই ব্রো কেমন আছিস তুই? তুই জানিস তোকে আমি কতটা মিস করেছি। আহ কতদিন পর দেখছি তোকে। মাই বেস্ট ফ্রেন্ড মাই ব্রো।”

“উফ সরণ তোর এই গায়ে পড়া ভাবটা এখনো গেল না। তোকে কতবার বলেছি এভাবে জড়িয়ে ধরা একদম পছন্দ করি না আমি। ছাড় আমাকে।”

কথাটি বলেই বিরক্তি নিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো সরণকে। ওদের দুজনের সিন দেখে মিটি মিটি হাসছে বাকি সবাই। আলমির কে ছেড়ে মুখ গোমরা করে ফেললো সরণ। তারপর দিদুনের কাছে এসে হেসে দিয়ে বললো,

“হাই সুইট হার্ট। কেমন আছো তুমি? আই মিস ইউ সো মাচ মাই গার্লফ্রেন্ড।”

দিলরুবা বেগম হেসে দিলেন। ওর মাথায় আস্তে করে চটকানা মেরে বললেন,

“তুমি আর মানুষ হলে না দাদুভাই। ৫ বছর আগের সেই বাঁদর সরণ এখনও বাঁদর’ই রয়ে গেলে।”

“উফ দিদুন তুমি অন্তত তোমার এই গোমরামুখো নাতির মত এভাবে কথা বলো না। কত দিন পরে এসেছি। কোথায় গলায় লাগিয়ে আপ্যায়ন করবে। তা নয় দুজনেই কেমন দূর-দূর করছো।”

কথাটি বলে মুখটা গোমড়া করে ফেলল সরণ। তবে এটা তার মন থেকে নয়। কথাটা সে দুষ্টুমি করে বললো। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ হাসি খুশি আর মিশুক প্রকৃতির সে। তাই তাকে সবাই ভালবাসে। আলমিরের অনেক ছোট বেলার বন্ধু সে। আলমির যতটা রাগি ও গম্ভির প্রকৃতির। ও ততটাই মিশুক ও দুষ্টু।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,