দিওয়ানেগি পর্ব-১০+১১+১২

0
517

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১০+১১+১২
#M_Sonali

দিলরুবা বেগমের সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ সোফায় বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে নজর পরে সরণের। মেয়েটি একটি টেডি বিয়ার নিয়ে খেলছে। মেয়েটির পরনে সাদা রঙের গাউন। চুলগুলো ছেড়ে রাখা। বেশ সুন্দর করে সেজেছে সে। এক কথায় যেন সাদা পরীর মত লাগছে তাকে।

“হেই দিদুন, এই পিচ্চি পরীটা কে? একে তো আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না?”

ওর কথার উত্তরে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় মেহের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে। কিন্তু তার রাগের কারণটা অজানা। দিলরুবা বেগম মুচকি হাসে। তারপর উত্তর দেয়,

“ওর নাম মেহের। আমাকে দেখাশোনার জন্য যে মেয়েটিকে রাখা হয়েছে। তার ছোট বোন ও। ওরা খুব মিষ্টি মেয়ে। দুজনে যেন এই কদিনে আমার বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠেছে।”

দিদুনের কথায় মিষ্টি হাসে সরণ। মেহেরের কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশাপাশি বসে বলে,

“এই পিচ্চি পরী, এভাবে ফুলে আছো কেন তুমি? কিসের এত রাগ তোমার? এমন মিষ্টি চেহারায় কিন্তু রাগ মানায় না।”

ওর কথার উত্তরে মন ছোট করে নিচের দিকে তাকায় মেহের। কোন উত্তর দেয়না। দিলরুবা বেগম কাছে এগিয়ে এসে বলে,

“আসলে মেহরিমা এখনো আসেনি। তাই ওর মনটা ভীষণ খারাপ। সকাল থেকে বোনকে দেখেনি বলে এমন রেগে আছে সে। পাগলি একটা।”

দিদুন এর কথাটা শেষ হতেই মেহের হাসি দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,

“ঐ তো আপু চলে এসেছে।”

ওর কথা শুনে সবাই পিছন দিকে ফিরে তাকায়। দেখে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে হলুদ গাউন পরা একটি মেয়ে। যাকে দেখামাত্র যেন সকলের হুশ উড়ে যায়। আলমির আর সরণের চোখ যেন তার দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরছে না। মেহরিমা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দিদুন ফিরোজ আহমাদ ও তার স্ত্রীকে সালাম দেয়। ফিরোজ আহমাদ সোফায় বসে গল্প করছিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। তারপর দিদুনের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

” সরি দিদুন আসতে দেরি হয়ে গেল। আসলে রাস্তার মধ্যে জ্যামে পড়েছিলাম।”

দিদুন মুচকি হাসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“মাশাআল্লাহ আমার দিদি ভাইটাকে তো একদম হলুদ পরীর মত লাগছে আজ। কারো নজর না লাগে।”

কথাটি বলেই আলমিরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয় সে। তখনই সরণ দ্রুত এসে সামনে দাঁড়ায় মেহরিমার। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“হাই বিউটিফুল, তোমার কথা বাবার কাছে শুনেছি। কিন্তু তুমি যে এতটা সুন্দরী সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি সরণ, আলমিরের বন্ধু। নামতো শুনেছো নিশ্চই।”

মেহরিমা ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নেয়। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি হাইট এর একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। বেশ সুন্দর চেহারা তার। চোখ গুলো বেশ মায়াবী। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। ছেলেটির আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ প্রাণোচ্ছল। মেহরিমা মুচকি হাসে। তারপর হাত মিলিয়ে বলে,

“নাহ নাম তো শুনিনি। তবে আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আমি মেহরিমা। আমাকে দিদুনের দেখাশোনার জন্য রাখা হয়েছে।”

পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছুই দেখছিল আলমির। কেন জানে না ওদের দুজনের এমন হেসে হেসে কথা বলা দেখে রাগে একদম জ্বলে যাচ্ছিল সে। ইচ্ছা করছিল এখুনি দুজনের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে মেহরিমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিতে। কত বড় সাহস ওর। এভাবে একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে নেয় আলমির। সেখান থেকে দ্রুত চলে যায় দরজার কাছে। ততক্ষণে একজন-দুজন করে মেহমান আসতে শুরু করেছে। আলমিরের অবস্থা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে দিদুন। সে শুধু ওর সিন গুলো দেখে, আর মিটিমিটি হাসে। মনে মনে বলে,
সরণ এর সাহায্য নিয়ে আলমির আর মেহরিমা কে কাছে আনবে সে। কারণ সে আলমির এর মাঝে স্পষ্ট সরণের জন্য হিংসা দেখেছে। যেটা সে মেহরিমার কারণে করছে।
,
,
,
রাত ৯ টা বেজে ৫০ মিনিট। পার্টির অনুষ্ঠান বেশ ভালোভাবেই জমে উঠেছে। চারিদিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়েছে বেশ। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। মেহরিমা আসার পর থেকেই তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে সরণ। এমন ভাবে তার সাথে লেপ্টে আছে যেন কত যুগের পরিচিত তারা। বিষয়টা তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছে আলমির। প্রতিটা সময় শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে তার হিংসায়। ইচ্ছা করছে মেহরিমা কে কষে দুইটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু সেটাও পারছেনা। ভীষণ রাগে শুধু ফোসফোস করছে সে। এদিকে মেহরিমার সাথে একের পর এক ফ্লট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরণ। যেনো এখনই পটিয়ে ফেলবে সে মেহরিমাকে। এতে মেহরিমা হালকা বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারছে না। জোর করে হাসি দিয়ে মন রাখার চেষ্টা করছে সরণের। এভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। মেহরিমা একজন লোকের হাতে একটি গিফট বক্স দেখতে পায়। গিফট বক্স টা দেখতেই তার খেয়াল হয়, সেই বাইকে করে আসা লোকটির গিফট বক্স এর কথা। যেটা সে তাড়াহুড়ায় গাড়িতে ফেলে এসেছে।

খেয়াল হতেই নিজের মাথায় হালকা করে নিজে টোকা মারে মেহরিমা। মনে মনে নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ বকা দেয় সে। তারপর সরণের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত চলে যায় বাইরে। গেট দিয়ে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গিফট বক্স এর দিকে হাত বাড়ায় মেহরিমা। কারো ফিসফিস কথার শব্দে চমকে যায় সে। গিফট বক্সটা হাতে না নিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কি কথা চলছে। তখনই যা শুনতে পায় সে, তাতে যেন তার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে তার। সে শুনতে পায় একজন আরেক জনকে বলছে,

“গিফট বক্স এর আইডিয়াটা ফেল মেরে গেল। জানিনা কি করেছে সেটা ঐ মেয়েটা। লোভে পরে নিজেই কোথাও রেখেছে নাকি অচেনা মানুষ ভেবে ফেলেই দিয়েছে কে জানে। ওটার মাঝের বো-ম টা আর কোন কাজে লাগবে না। এখন আমাদের দ্বিতীয় প্ল্যানটা কাজে লাগাতে হবে। তুই এখানেই বাইক নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমি গিয়ে ওই আলমির এর কিচ্ছা খতম করে দিয়ে আসছি। চিন্তা করিসনা পি-স্ত-লে সাই-লেন্সার লাগানো আছে। কেউ বুঝতেও পারবে না গু-লি টা কে করেছে।”

কথাগুলো শুনে ভয়ে কান্না করে ফেলে মেহরিমা। সে বুঝতে পারে এই গিফট বক্সটা নিয়ে এসে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। সে গাড়িতে অপেক্ষা না করে চুপিচুপি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বাসার মধ্যে চলে যায়। যেভাবেই হোক আলমির কে বাঁচাতে হবে তার।সে জেনে শুনে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে না।

মেহরিমা হাঁপাতে হাঁপাতে বাসার মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আলমির কে খুঁজতে থাকে। তার পাগলের মত কিছু খুঁজতে থাকা দিলরুবা বেগম খেয়াল করেন। তিনি সোফা থেকে উঠে ওর কাছে এগিয়ে আসতে চান। তখনই তিনি দেখেন মেহরিমা দৌড়াতে দৌড়াতে আলমিরের কাছে যাচ্ছে। আলমির একটি লোকের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মেহরিমা দৌড়ে গিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় লোকটাকে। আচমকা ধাক্কা খাওয়ায় লোকটা একটি কাজের লোকের হাতে থাকা ট্রের ওর পরে। মেহরিমা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আলমিরকে কিছু বলতে যাবে, তখনি সে রাগে আগুন হয়ে ওকে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়।

থাপ্পর খেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সরণ এর উপর গিয়ে পড়ে মেহরিমা। সরণ ওকে আলতো হাতে জরিয়ে ধরে। তখনই সবাই খেয়াল করে মেহরিমার পিঠের কাছের হলুদ জামা রক্তে ভিজে লাল টকটকে হয়ে গেছে। রক্তে ভিজে একাকার অবস্থা তার। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই সবাই ভয়ে আঁতকে উঠে। মেহরিমা জ্ঞান হারানোর আগে সরণের কোলে ঢলে পড়ে শুধু একটা কথাই বলে,

“বাইরে গাড়ির মধ্যে গিফট বক্সে বো-ম আছে। ওরা আলমির স্যারকে মেরে ফেলতে এসে,,,,,ছে।”

কথাটি বলেই জ্ঞান হারিয়ে সরণের কোলে ঢলে পড়ে মেহরিমা। দিলরুবা বেগম, মেহের এবং সরণ তিনজনেই মেহরিমা নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে। মেহের এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আলমির যেন সেখানেই স্তব্ধ হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কি হলো কিছু যেন মাথায় ঢুকছে না তার। সে কেনো এভাবে মেহরিমাকে থাপ্পড় মারলো তা নিজেও জানে না।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১১
#M_Sonali

মেহরিমা কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রায় ৩ ঘন্টা হল। এখন পর্যন্ত কোন রকম খবর পাওয়া যায়নি তার। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে কখন থেকে উসখুস করছেন দিলরুবা বেগম, মেহের ও সরণ। মেহের কিছুক্ষণ পরপর কান্না করতে করতে দিলরুবা বেগম এর কাছে জানতে চাইছে। তার আপুকে এখনো কেন বের করছে না ঐ রুম থেকে। দিলরুবা বেগম নীরবে চোখের অশ্রু ঝড়াচ্ছেন। কি বলে মেয়েটিকে সান্তনা দিবেন তার জানা নেই। এই মেয়েটির যে মেহরিমা ছাড়া পৃথিবীতে আর আপন বলে কেউ নেই। সে যে একদম একা হয়ে যাবে মেহরিমার কিছু হলে। ব্যাপারটা ভাবতেই যেন বুকটা বার বার কেঁপে উঠছে দিলরুবা বেগমের। সে কখনো কল্পনাও করেনি এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন তাকে কখনো হতে হবে।

মেহেরকে এভাবে কান্না করতে দেখে সরণ কাছে এগিয়ে আসে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,

“পাগলি মেয়ে এভাবে কান্না করো না। তোমার আপুর কিচ্ছু হবে না। তুমি দেখনি তোমার আপু কতটা স্ট্রং। তার কিছু হতেই পারেনা। সে ঠিক সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। কান্না না করে শুধু দোয়া করতে থাকো আল্লাহর কাছে।”

ওর কথা শুনে মেহের মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। ওর ডান হাতটি নিজের দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে,

“আপনি ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আমার আপুর কিচ্ছু হবেনা। আমার আপু তো অনেক স্ট্রং। সে কখনই কোন কিছুতে ভয় পায় না। আমার আপু ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। আমি আর কাঁদবো না। এই দেখুন আমি চোখ মুছে নিয়েছি। আর কাঁদবো না আমি। আল্লাহ আমার আপুকে আমার কাছে ঠিক ফিরিয়ে দিবেন।”

কথাগুলো বলেই চোখ মুছে নিয়ে ফোঁপাতে থাকে মেহের। সরন আর দিলরুবা বেগম দুজনেই ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। আর কিছু বলে না তারা। তাদের চোখেও যে জল টলমল করছে। তখনই অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে সবাই দ্রুত এগিয়ে যায় তার কাছে। সরণ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে,

“ডাক্তার মেহরিমার এখন কি অবস্থা? অপারেশন করতে এত সময় লাগলো যে। সে সুস্থ হয়ে যাবে তো?”

ওর কথার উত্তরে ডাক্তার নিজের মুখের মাস্ক খুলে উত্তর দেন,

“দেখুন এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা ওনার পিঠ থেকে গুলিটা বের করতে সক্ষম হয়েছি। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। কিন্তু গুলি লাগার কারণে অতিরিক্ত ব্লিডিং হয়েছে ওনার। তাই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুব কম রেসপন্স করছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উনার জ্ঞান না ফিরলে কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

ডাক্তারের কথা সরণ এবং দিলরুবা বেগম বুঝলেও মেহের কিছুই বোঝেনা। তার ছোট্ট মনে প্রশ্ন জাগে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,

“ও ডাক্তার আংকেল, ডাক্তার আংকেল। আমার আপুর পিঠ থেকে তো গুলি বের করে ফেলেছেন। তাহলে আমার আপু একদম সুস্থ হয়ে যাবে তাই না? আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। আমি আপুকে দেখবো।”

মেহেরের কথা শুনে ডাক্তার কোন উত্তর দেয় না। শুধু বলে,
“একটু পর রোগিকে কেবিনে শিফট করা হবে। তখন তাকে দেখে নিও।”

কথাটি বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে যায় ডাক্তার। মেহের পাগলের মত প্রশ্ন করতে থাকে সরণ এবং দিলরুবা বেগম কে। তারা কিছুই বলেন না। শুধু নিরবে কাঁদেন।
,
,
,
“মিস্টার আলমির, আপনার গাড়িতে গিফট বক্সে থাকা বোমটি ডিফিউজ করা হয়েছে। আর আমরা সেই লোকগুলো কেও খুঁজছি। যারা আপনার ওপর হামলা করার জন্য গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু কোনোরকম প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ঠিক তাদের খুজে বের করব। take care Mr Almir.”

কথাগুলো বলেই আলমিরকে বিদায় জানিয়ে ওর বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় ইন্সপেক্টর সুমন। মেহরিমার গুলি লাগার পর। পার্টির সবাই ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। আলমির তখন যে গুলি চালিয়েছে তাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু এত লোকজনের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করতে পারে না সে। ততক্ষণে মেহরিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় সরণ ও দিলরুবা বেগম। আর ফিরোজ আহমাদ ফোন দেন পুলিশকে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে বোম ডিফিউজারকে নিয়ে উপস্থিত হয় ইন্সপেক্টর সুমন। মেহরিমার বলা কথামত গাড়িতে থাকা গিফট বক্স এর বোম ডিফিউজ করতে নেমে যায় তারা।

ইন্সপেক্টর সুমন তার সাথে আসা পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে পুরো বাসাটা তন্ন তন্ন করে প্রমাণ খুঁজে। কিন্তু কোনো প্রমাণ মেলে না। সে বুঝতেই পারেনা গুলি কোথা থেকে কে চালিয়েছে। এদিকে ধীরে ধীরে রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। তাই আলমিরের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় সে। বেশ কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা ভেবে আবারো ফিরে আসে। আলমির এখনো আগের মতোই সোফার উপর চুপচাপ বসে আছে। মাথায় হাত দিয়ে খুব গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চারজন গার্ড। ইন্সপেক্টর সুমনকে আবার এগিয়ে আসতে দেখে মাথা তুলে তার দিকে তাকায় সে।

“আচ্ছা মিস্টার আলমির আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। কেউ কেন আপনার ওপর গুলি চালাবে? আপনার কি কারো সাথে শত্রুতা আছে? আই মিন কোন পুরানো দুশমনি? যার কারণে আপনাকে হত্যা করতে চাইছে কেউ।”

ওনার প্রশ্নের উত্তরে আলমির সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে দু পা এগিয়ে গিয়ে তার দিকে ঘুরে বলে,

” আপনি এখন আসতে পারেন ইন্সপেক্টর। প্রয়োজন পড়লে আমি আপনাকে ডেকে নেব। এ ব্যাপারে এখন আর আমি কোন কথা বলতে চাচ্ছি না।”

ওর কাছ থেকে এমন উত্তর পেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুমন। কিছু একটা ভেবে মাথার ক্যাপটা ঠিক করতে করতে বলে,

“ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু কাল আবার আসব। তখন কিন্তু আপনার আমাকে ইনভেস্টিগেশন এর জন্য সাহায্য করতে হবে।”

কথাটি বলে আর না দাঁড়িয়ে পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায় ইন্সপেক্টর সুমন। আলমির আবারো এসে সোফায় বসে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা সোফার উপর হেলান দেয় সে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে। তখনই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেহরিমার রক্তাক্ত পিঠ। যেটা তাকে বাঁচাতে গিয়ে হয়েছে। আলমির মেহরিমা বলে চিৎকার করে ওঠে। দ্রুত মোবাইল বের করে ফোন করে দিদুন এর নাম্বারে।

ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যায়। কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হয় না। বেশ বিরক্ত হয় আলমির। সে আবারও ব্যাক করে। তখনই একটি কাজের মেয়ে ফোনটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

“স্যার বড় ম্যাডামের রুমে ফোনটা বাজছিলো। উনি মনে হয় ফোনটা ফেলে গেছেন।”

উনার কথার উত্তরে আলমির কিছু বলেনা। গার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“দ্রুত গাড়ি বের করো। হসপিটালে যেতে হবে।”

কথাটি বলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গার্ডদের নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। আলমিরদের বাসা থেকে হসপিটালে পৌঁছাতে ১০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এই দশমিনিট সময়টাকে যেন কত শত ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে আলমিরের কাছে। তার যেন সময় কাটতেই চাইছে না। মেহরিমা কে দেখার জন্য মনটা ভীষণ ভাবে উসখুস করছে তার। সে বারবার ড্রাইভারকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত গাড়ি চালাতে। হসপিটালে পৌঁছেই কাউন্টার থেকে মেহরিমা কোথায় আছে সেটা জেনে নিয়ে দৌড়ে ওর কেবিনে চলে যায় আলমির। গিয়ে দেখে মেহরিমাকে অক্সিজেন দেওয়া অবস্থায় উল্টা ভাবে শুইয়ে রাখা হয়েছে। হাতে তার ক্যানোলা পড়া। যেখান দিয়ে পুশ করা হয়েছে রক্ত। এই নিয়ে তার শরীরে ৩ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হচ্ছে।

মেহরিমার বেডের পাশে আরেকটি বেডের ওপর ঘুমিয়ে আছে মেহের। দিলরুবা বেগম মেহরিমার বেডের পাশে চেয়ার পেতে বসে আছে। আলমিরকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। বেশ রাগী চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসে তার কাছে। ঝাঁঝালো গলায় বলে,

“কেন এসেছ এখানে? এই মেয়েটা মারা গেছে কি না তা দেখতে? যে কিনা তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ এমন অবস্থায় বেডে শুয়ে আছে। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে।”

এতটুকু বলে থামেন দিলরুবা বেগম। উনার কথার উত্তরে আলমির মাথা নিচু করে ফেলে। কিছু বলার মত ভাষা নেই তার। দিলরুবা বেগম আবার বলতে শুরু করেন,

“কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো? একটা থাপ্পর মেরে কি মন ভরে নি তোমার? তাই দেখতে এসেছো মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে না মরে গেছে? আমি জানতাম তুমি মেয়েদের পছন্দ করো না। কিন্তু তাই বলে কখনো ভাবতেও পারিনি আমার নাতি হয়ে তুমি এতটা নিচে নামতে পারো। যে মেয়েটা কিনা তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বাঁচাতে নিজে মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়ালো। তাকেই সবার সামনে এভাবে আঘাত করতে একবারও হাত কাঁপেনি তোমার?”

“প্লিজ দিদুন চুপ করো। আর সহ্য করতে পারছি না আমি। বিশ্বাস করো আমি ওকে থাপ্পর মারতে চাই নি। জানিনা আমার সেই মুহূর্তে কি হয়ে গিয়েছিলো। আমি কেন এভাবে আঘাত করলাম ওকে। তবে যারা ওর এই অবস্থা করেছে, আমি তাদের কাউকে ছাড়বো না। নিজ হাতে খুন করবো তাদের। টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিব। তারা জানেনা তারা কার শরীরে আঘাত করেছে।”

দিলরুবা বেগম আর কিছু বলেন না। দু চোখে অশ্রু ঝড়ে পরে তার। সে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে, চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে,

“জানিনা জীবনে কি এমন ভালো কাজ করেছিলাম। যার ফল সরুপ এমন ফুলের মত দুজন মেয়ে পেয়েছি। যারা এই অল্প দিনেই আমার সব শূন্যতা দূর করে দিয়েছিলো। কিন্তু পেয়েও যদি ওকে হারিয়ে ফেলি। নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা আমি আলমির। আমি যে ওকে নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছি। ওর এই অবস্থার জন্য আমি’ই দায়ী।”

আলমির তার দিদুনের কাছে এগিয়ে আসে। সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। তার ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছিনা দিদুন? কিসের স্বার্থে তুমি ওকে কাজে লাগিয়েছো?”

“তোমার জন্য আলমির। হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার জন্য। আমি চেয়েছিলাম ওর মত একটি লক্ষ্মী সুন্দরী মেয়ে তোমার আশেপাশে রাখলে তুমি ওকে ভালবেসে ফেলবে। বিয়ে করে নতুন সংসার সাজাবে। আর তোমাদের সুখ দেখে আমি শান্তিতে মরতে পারবো। কিন্তু সেটা হলো না। আমার এই স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে এই মেয়েটিকে আজ মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছাতে হল। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। কখনোই না। আমারই ভুল হয়েছে। আমি তোমার মনে ওর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে চেয়েছি। এটা আমারই ভুল। তুমি তো একটি পাথরে পরিণত হয়েছো। কোন মেয়ে সেই পাথর গলিয়ে ভালবাসার ফুল ফোটাতে পারবে না। সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও। চলে যাও এখান থেকে।”

কথাগুলো বলে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে থাকে দিলরুবা বেগম। আলমির বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। চোখটা মুছে নিয়ে মাথা নীচু করে বলে,

“পার্টিতে যখন সবাই ব্যস্ত ছিল। তখন সরণ আমার কাছে আসে। আমাকে বলে সে মেহরিমাকে বিয়ে করতে চায়। আর মেহরিমাও তাকে পছন্দ করে। এই ব্যাপারে আমি যেন ফিরোজ আঙ্কেলকে বোঝাই। যে ওরা একে অপরকে প্রথম দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে। ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে। জানিনা ওর মুখে কথাটি শুনে আমার কি হয়েছিল। ভীষণ রকম রাগ হয়। ইচ্ছে করছিল সেখানেই সরণকে পুতে ফেলতে। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে আমি কিছুই বলতে পারিনি। শুধু রাগে ফুঁসতে থাকি। তার কিছু সময় পরেই মেহরিমা দৌড়ে এসে আমার সামনে থাকা লোকটিকে ফেলে দেয়। তখনই আমি সরণের ওপর হওয়া রাগটা ওর উপরে খাটাই। সজরে থাপ্পর মেরে দেই। যেটা আমার ইচ্ছা ছিল না। বিশ্বাস করো দিদুন আমি কেন এমন টা করেছি নিজেও জানি না। কিন্তু যখন দেখলাম ওর পিঠ রক্তে ভিজে গেছে। যেন পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পরলো আমার মাথার। কিছুক্ষনের জন্যে হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিলো আমার। আমি শেষ হয়ে গিয়েছি দিদুন। ওর কিছু হলে আমি মরে যাব দিদুন। আমি বুঝতে পেরেছি আমি মেহরিমা কে ভালোবাসি। এই কয়দিনে ওর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে আমার মনে। আমার মনের ঘৃণাকে বদলে ও ভালোবাসায় পূর্ণতা দিয়েছে।”
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১২
#M_Sonali

৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি মেহরিমার। শরীরের কন্ডিশন ভালো হওয়ার বদলে ধিরে ধিরে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে তার। দিলরুবা বেগম ও মেহের সহ ডাক্তাররাও ভীষণ চিন্তিত এটা নিয়ে। ডাক্তার ফিরোজ আহমাদ সহ হসপিটাল এর সবচাইতে বড় ডাক্তার মেহরিমাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে। তারা কেউই বুঝতে পারছেনা মেহরিমা আদৌ বাঁচবে কিনা। ওর শরীরের কন্ডিশন এতটাই খারাপের দিকে যাচ্ছে যে, তাকে বাঁচানো মুশকিল। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে সেই কখন থেকে চোখের জল মুছে যাচ্ছেন দিলরুবা বেগম ও মেহের। তাদের যেনো এ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ভয়ে যেন বুকটা বার বার কেঁপে উঠছে দিলরুবা বেগমের। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। মেহরিমার কিছু হলে যে সে সহ্য করতে পারবে না। এই অল্প সময়েই তাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি।

মেহরিমার এমন কন্ডিশনের ব্যাপারে আলমির কিছুই জানেনা। সে সকালেই চলে গেছে গার্ডদেন নিয়ে, কোন একটা জরুরী কাজে। তাকে ফোন করে মেহরিমার কথা বলার মত সাহস নেই দিলরুবা বেগম এর। সে শুধু মনে মনে আল্লাহকে ডাকছেন। আর দোয়া দরুদ পড়ছেন। প্রায় আধাঘন্টা সময় পর ফিরোজ আহমাদ বেরিয়ে আসেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। তাকে দেখেই দিলরুবা বেগম কাছে এগিয়ে যান। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফিরোজ আহমদ মাথা নিচু করে গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন,

“মেয়েটির অবস্থা বেশি ভালো না। আদৌ তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে কিনা জানা নেই। ডাক্তার নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।”

এতটুকু বলে থামলেন তিনি। ওনাকে থামতে দেখে দিলরুবা বেগম উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন,

“কিন্তু আজ সকালেও তো মেহরিমা বেশ ভালো ছিলো। এখন কি এমন হলো যে ডাক্তার এমনটা বলছে?”

“ওর শরীরে যে গুলিটা লেগেছিল। সেই গুলির সাথে একটি বিশেষ ধরনের বিষাক্ত পিন লাগাবো ছিলো। সেই পিনের সাথে এমন কিছু লাগানো ছিল যেটার কারনে ওর শরীরে ইনফেকশন হয়ে গেছে। যেটা অপারেশনের সময় ডাক্তাররা বুঝতে পারেনি। গুলিটা বের করতে পারলেও পিনটা রয়ে গেছে ওর শরীরে। তাই শরীরের একটা অংশে পঁচন ধরেছে।”

কথাগুলো শুনেই মাথায় চক্কর দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েন দিলরুবা বেগম। দু চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়ে তার। মেহেরও সেখানে বসে কান্না করতে শুরু করে আপু আপু বলে। মেহের কে কি বলে সান্তনা দিবেন দিলরুবা বেগমের জানা নেই। ফিরোজ আহমাদ ওনার কাছে বসে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,

“কান্না করবেন না আন্টি। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকুন। আল্লাহ চাইলে মেহরিমা সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কারণ ওর অবস্থা ভীষণ ক্রিটিক্যাল। আদৌ বাঁচানো যাবে কিনা সেটা বলা মুশকিল। এখন দোয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের।”

উনার কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কিছু বলেন না। কিছুক্ষণ কান্না করে চোখের জল মুছে নেন। তারপর ফিরোজ আহমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন,

“আমাকে একটু ধরে উঠাও তো ফিরোজ। একটু আমাকে নিয়ে যাও নামাজের রুমে। আমি আল্লাহর কাছে মেহরিমার জান ভিক্ষা চাইবো। আমি জানি আল্লাহ আমার হাত কখনোই খালি ফেরাবেন না। মেহরিমা কে তিনি ঠিক সুস্থ করে দেবেন।”

ফিরোজ আহমাদ ওনার হাত ধরে ওনাকে টেনে তুললেন। তারপরে নিয়ে যান হসপিটালের এক সাইডে থাকা নামাজের রুমে। দিলরুবা বেগম ওযু করে এসে জায়নামাজে বসে পরেন। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অঝোড়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। মেহের ও তার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে বসে পড়ে। তার ছোট ছোট হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে। বোনের জন্য দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অঝোরধারায় পানি।

কেটে যায় আরো একঘন্টা। ফিরোজ আহমাদ অপারেশন থিয়েটার থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসেন নামাজের রুমে। দিলরুবা বেগম কে ডেকে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন,

“আন্টি আল্লাহ আপনাদের দোয়া কবুল করেছেন। মেহরিমা এখন আউট অফ ডেঞ্জার।”

দিলরুবা বেগম মোনাজাত ছেড়ে হাসিমুখে তাকায় ফিরোজা আহমাদের দিকে। অনেক কষ্টে জায়নামাজের থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

” তুমি সত্যি বলছো ফিরোজ? আমার মেহরিমা সুস্থ হয়ে গেছে? তার আর কোন ভয় নেই? সে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবে আমাদের সাথে তাই না। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন।”

ফিরজ আহমাদ আবারও মাথা নিচু করে ফেলে। শান্তকণ্ঠে উত্তর দেয়,

“আন্টি মেহরিমা এখন আউট অফ ডেঞ্জার ঠিকই। বাট সি এজ ইন এ কোমা।”

কথাটি শুনতেই দিলরুবা বেগমের হাসিমুখটা নিমিষেই চুপসে যায়। সে পিছন দিকে পরে যেনে নিলেই ফিরোজ আহমাদ তার হাত ধরে ফেলেন। তাকে ধরে নিয়ে পাশে একটি চেয়ারের উপর বসিয়ে দেন। তারপর সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,

“আপনি ঘাবড়াবেন না আন্টি। মেহরিমা কোমায় চলে গেলেও তার শারীরিক কন্ডিশন অনেক ভালো। এটা যেন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে তার সাথে। কিছুক্ষণ আগেও ডাক্তারদের মনে হয়েছে তাকে বাঁচানো ইম্পসিবল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে হঠাৎ করেই তার শরীরের কন্ডিশন আপনা আপনি ভালো হতে শুরু করে। যে অংশটাতে বিষাক্ত পিনটা ছিল, সেই অংশটা কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটার ঘা শুকাতে একটু সময় লাগবে। তবে আর কোন ভয় নেই। মেহরিমা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।”

উনার কথায় দিলরুবা বেগম যেন একটু আশার আলো দেখতে পায়। সে নিজের চোখের জলটা মুছে নিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ ভালো করবেন। তুমি একটু আলমির কে ফোন দাও তো ফিরোজ। ছেলেটা সেই সকালে গেছে, এখন বিকেল হতে চললো তবুও এলো না। এতক্ষণ চলে আসার কথা। আর মেহরিমার এমন অবস্থার ব্যাপারেও ওকে জানানো দরকার।”

” আচ্ছা আপনি চিন্তা করবেন না আমি ওকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি। আপনি দুপুরে কিছু খেয়েছেন আন্টি? আর মেহের?”

” হ্যাঁ খেয়েছি আমরা। বাসা থেকে খাবার দিয়ে গিয়েছিলো। হয়ত আলমির পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না তোমাকে যেটা বললাম সেটা করো।”

ফিরজ আহামাদ আর কিছু বলেন না। সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যান।
,
,
,
অপারেশন থিয়েটার থেকে নিয়ে এসে মেহরিমাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। নানা রকম যন্ত্রপাতি লাগানো আছে তার শরীরে। মেয়েটার অবস্থা যেন একদমই নাজেহাল। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে এই কদিনেই। মুখটা কেমন চুপসে গেছে ওর। মুখের দিকে তাকাতেই যেন দিলরুবা বেগমের অঝোরে কান্না পাচ্ছে। মেহের বার বার কান্না করছে আর আপু আপু বলে ডাকছে। তাকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছেন দিলরুবা বেগম। এদিকে আলমিরের জন্যও চিন্তায় আছেন দিলরুবা বেগম। তার মনটা ভাল নেই, বারবার মনটা কু গাইছে। ফিরোজ আহমাদ বিকেল থেকে অনেকবার চেষ্টা করার পরেও আলমিরকে ফোনে পায়নি। বার বারই ফোনটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শেষে বাসায় কল দিলে জানতে পারে আলমির গার্ডদেন নিয়ে কোথাও গিয়েছে। এখনো বাসায় ফেরেনি সে।
,
,
হঠাৎ হুড়মুড় করে কেবিনের মাঝে প্রবেশ করে সরণ। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে মেহরিমার কাছে। উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“মেহরিমা এখন কেমন আছে দিদুন? বাবার কাছে শুনলাম ওর অবস্থা নাকি খুবই খারাপ ছিল? এখন ও কোমায় চলে গেছে। আমার মেহরিমা সুস্থ হয়ে যাবে তো দিদুন?”

ওর কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম ভ্রু কুচকায়। মনে মনে ভীষণ রকম রাগ হয় তার। মনে মনে বলেন, “আজ মেহরিমার এমন অবস্থার জন্য কিছুটা হলেও তুমি দায়ী সরণ।” কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করে না সে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয়,

“এখন ঠিক আছে মেহরিমা। তোমার চিন্তা করতে হবে না ওকে নিয়ে।”

“কি বলো দিদুন এসব তুমি? ওকে নিয়ে আমি না চিন্তা করলে করবে কে? আলমির তোমায় বলেনি, মেহরিমা আমাকে, আর আমি মেহরিমা কে ভালবাসি। আমরা দুজন-দুজনকে বিয়ে করতে চাই। প্রথম দেখাতেই আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে গেছি। আর এটা বাবাকেও বলেছি আমি। বাবার কোন অমত নেই। সে বলেছে মেহরিমা সুস্থ হয়ে গেলে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে।”

সরণের কথা শুনে ভীষণ রকম রাগ হয় দিলরুবা বেগমের। তিনি কিছু বলতে গিয়েও বলেন না। নিজেকে সংযত করে রাখেন। হাতের মুঠো শক্ত করে উত্তর দেন,

“এখন এসব কথা বলার সময় নয় সরণ। তুমি দেখতে পাচ্ছো না মেহরিমা অবস্থা? তুমি কেন বিয়ের আনন্দ নিয়ে পড়ে আছ? এখন আসতে পারো। তোমার সাথে এ ব্যাপারে পরে কথা বলব।”

সরণ কোন উত্তর দেয় না। বাঁকা চোখে দিলরুবা বেগমের দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে যায়। দিলরুবা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে বসে থাকেন। মেহেরকে বিকেলে ড্রাইভার ও একজন গার্ড এর সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।

বিশাল এক রুমের মধ্যে চেয়ারের সাথে বাধা অবস্থায় বসে আছেন দুজন লোক। দুজন লোকের’ই মুখে টেপ লাগানো। হাত পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। দুজন ছোটার জন্য অনেক বেশী ছটফট করছে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। রুমের ভেতরে চারিপাশে গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। উপরে বেশ কয়টি লাল লাইট জ্বলছে। যার লাল আলোয় পুরো রুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। লোক দুটোর ঠিক মুখোমুখি পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে আলমির। চোখে তার রাগ স্পষ্ট। হাতে তার গুলি ভর্তি পিস্তল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে লোক দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের সামনে এগিয়ে আসে। লোক দুটির মুখের টেপটা একটানে খুলে ফেলে দেয়। সাথে সাথে লোক দুটি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। আলমির হাতের পিস্তল ঘুরাতে ঘুরাতে ওদের চারিপাশে কয়েকবার পাক দেয়। লোক দুটি ভয়ে শুকনো ঢোক গেলে। ভয়ে আতঙ্কে কান্না করতে করতে বলে,

“প্লিজ স্যার আমাদের মারবেন না। আমরা কিছু করিনি। আমাদের ক্ষমা করে দিন স্যার। আর কখনো এসব কাজ করবো না আমরা। আমাদের অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।”

আলমির উত্তর দেয় না। ওদের চারপাশে ঘুরে আবারও চেয়ারের উপর বসে। পায়ের উপর পা তুলে তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় ওদের দিকে। হাতে থাকা পিস্তলটা আঙ্গুলের সাথে ঘুরাতে ঘুরাতে জিজ্ঞেস বলে,

“আমি জানি তোরা আমাকে নিজ থেকে মারতে চাস নি। তোদেরকে আমাকে মারার জন্য পাঠানো হয়েছিল। শুধু এটা জানতে চাই কে পাঠিয়েছিল তোদের? কে সেই ব্যক্তি যে আমার ওপর গুলি চালানোর জন্য তোদের টাকা দিয়েছে? সত্যি করে বল, নইলে এই পিস্তলটা দেখছিস? এর মধ্যকার প্রত্যেকটি গুলি তোদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে একটুও মায়া হবে না আমার।”

লোকগুলো ভয়ে অঝোরে কান্না করতে শুরু করে। কান্না করতে করতে উত্তর দেয়,

” দয়া করে আমাদের কিছু করবেন না স্যার।বিশ্বাস করুন আমরা আপনাকে নিজ থেকে মারতে যাইনি। আমাদের অনেক টাকা দেওয়া হয়েছিল আপনার ওপর গুলি চালানোর জন্য। আর যে আমাদের টাকা দিয়েছে তাকে আমরা দেখিনি। সে অন্ধকারে ছিল। তার কন্ঠটাও শুনিনি।”

আলমির বাঁকা হাসে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“সে কি তবে ভুত ছিলো? যে অন্ধকারে থেকে তোদের টাকা দিয়েছে? আর তার কন্ঠ না শুনলে কিভাবে টাকা নিয়েছিস তোরা?”

“আমরা প্রফেশনাল কিলার। কিছুদিন আগে আমাদের কাছে ফোনে একটি ম্যাসেজ আসে। সেখানে লেখা ছিল আপনাকে মারতে পারলে আমাদের ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। এত বড় ডিমান্ড দেখে আমরা সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু যে নাম্বার থেকে মেসেজটা এসেছিল সেটা দেখা যায় না। সেখানে পার্সোনাল নাম্বার লেখা ছিল। আমরা কিভাবে মেসেজের রিপ্লাই দেবো বুঝতে পারিনি। তখনই আবার মেসেজ আসে। আমাদের একটি জায়গায় যেতে বলে। যেখানে এডভান্স ২৫ লক্ষ টাকা এবং যে অস্ত্র দিয়ে আপনাকে খুন করবো সেটা দেওয়া থাকবে। মেসেজটা পেয়ে আমরা দেরি না করে দ্রুত সেখানে চলে যাই। গিয়ে দেখি সেখানে একটি ব্যাগের মধ্যে 25 লক্ষ টাকা, যেটা দিয়ে আমরা গুলি চালিয়ে ছিলাম, সেই পিস্তল। আর একটি গিফট বক্স রাখা আছে। আর ব্যাগের টাকার ওপর ছিল একটি বড় চিঠি। সেটাতে কি দিয়ে কি করতে হবে লেখা ছিল। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি গুলিটা আপনার না লেগে ঐ মেয়েটির লাগবে।”
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,