দিওয়ানেগি পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
500

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৩+১৪+১৫
#M_Sonali

“গুলি তো আপনার বাড়ির ঐ কাজের মেয়েটার লেগেছে। আপনার তো কিছু হয় নাই স্যার। আমাদের ক্ষমা করে দিন। সারা জীবনেও আমরা এমন কাজ করবো না আর। আমাদের কিছু করবেন না প্লিজ। লোভে পড়ে ভুল করে ফেলেছি। আর কখনো এসব কাজ করবো না। প্লিজ স্যার আমাদের ক্ষমা করে দেন। ছেড়ে দেন আমাদের কে।”

কথাগুলো বলতেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঐ লোকটির থুতনিতে একটি ঘুষি মেরে দিল আলমির। সাথে সাথে লোকটির জিব্বা ও ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। পাশে বেঁধে রাখা চেয়ারে থাকা লোকটি ভয়ে শিউরে উঠলো। তার আর কিছু বলার মত সাহস নেই। শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো সে। আলমির উঠে দাঁড়িয়ে ওই লোকটির চুলের মুঠি ধরে বললো,

“তোরা জানিসও না, তোরা কার শরীরে গুলি করেছিস। ও আমার বাসার কাজের মেয়ে নয়। সে আমার প্রাণ ভোমরা। আর আলমিরের প্রাণ ভোমরায় আঘাত করেছিস তোরা। তোদের সাহস হয় কি করে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার? বল কি করে সাহস হয়?”

কথাটি বলেই চুল ধরে একটি ঘাতুনি মারলো লোকটিকে আলমির। তারপর এলোপাথাড়ি ঘুষি দিতে শুরু করলো দুজনের মুখে। কিছুক্ষণের মাঝেই দুজনের পুরো মুখটা রক্তাক্ত হয়ে গেল। তারা চিৎকার করে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। একসময় ক্লান্ত হয়ে চেয়ারের উপর বসে পড়ল আলমির। ততক্ষণে দুজনের অবস্থা ভীষণ খারাপ। চোখ নাক মুখ ফুলে একাকার অবস্থা। জায়গায় জায়গায় ফেটে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। সেদিকে যেন দেখার সময় নেই আলমিরের। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হুংকার দিয়ে বলে ওঠে,

“তোদের মাঝে গুলিটা কে চালিয়েছিল?”

ওর হুংকারে কেঁপে উঠে দুজন। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। কি বলবে তা যেন পেট থেকে মুখ পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছে না ভয়ে। আলমির উঠে দাঁড়ায়। গার্ডকে ডেকে চিৎকার বলে বলে প্লাস নিয়ে আসতে। একজন গার্ড দ্রুত একটি প্লাস নিয়ে এসে তার হাতে দিয়ে যায়। ওর হাতে প্লাস দেখে অজানা আতঙ্কে শিওরে ওঠে দুজন। ওদের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে যেন আরো বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে যায় আলমির। খুধার্থ সিংহের মত গর্জে ওঠে সে। প্লাস দিয়ে একজনের হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে চেপে ধরে। অসম্ভব যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে লোকটি। ওর এমন অবস্থা দেখে পাশে থাকা লোকটা ভয়ে পেশাব করে ফেলে। তার পেশাবের দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। এতে যেন আলমির আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এবার ওর হাত থেকে প্লাস সরিয়ে এর হাতে নিয়ে এসে ধরে। দুজনেই অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাফ চাইতে থাকে। কিন্তু আলমির যেনো মাফ করার পাত্র নয়। সে যেন এখন হিংশ্র জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। এভাবে ওদের প্রতিটি আঙ্গুলে চেপে ধরে রক্তাক্ত করে ফেলে আলমির। তারপর আবারও চেয়ারে বসে প্লাসটা হাতের সাথে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

“এখনো সময় আছে, সত্যি কথা বল। কে পাঠিয়েছিল তোদের, আমাকে মারার জন্য?”

ওরা কথা বলতে পারে না। দুজনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যন্ত্রণায়। ওদের অজ্ঞান হতে দেখে আলমির রেগে উঠে দাঁড়ায়। ওদের বাধা অবস্থায় রেখে গার্ডদের নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে যায় সে।

গাড়ি নিয়ে কিছুদূর যেতেই কিছু একটা ভাবে আলমির। গার্ডকে বলে গাড়ি ফিরিয়ে আবারও সেখানে যেতে। ১০ মিনিটের মাঝে ফিরে এসে দরজার তালা খুলে ভিতরে গিয়ে লোকদুটির সামনে বসে আলমির। গার্ডদের হুকুম দেয় ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে। তারা বরফ ঠাণ্ডা পানি এনে সামনে রাখে আলমিরের। সে বালতি ভরা পানি ঢেলে দেয় দুজনের মাথায়। কিন্তু তবুও কারো জ্ঞান ফেরে না। এতে আলমির ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গার্ডদের চিৎকার করে বলে ওদের জ্ঞান ফেরাতে। দুজন গার্ড এগিয়ে এসে চেষ্টা করতে থাকে ওদের দুজনের জ্ঞান ফেরানোর। কিন্তু কোনভাবেই তাদের জ্ঞান ফেরানো যায় না। কিছুক্ষণ পর একজন গার্ড তাদের পালস্ চেক করে বলে,

“স্যার এরা দুজনের একজনও বেঁচে নেই। দুজনেই মারা গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।”

গার্ডের কথায় পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আলমির। ভ্রু কুচকে তাকায় ওদের দিকে। এগিয়ে এসে দুজনের গালে এলোপাথাড়ি থাপ্পর দিতে দিতে কথা বলতে বলে। কিন্তু ততক্ষণে তারা চলে গেছে পরপারে। আলমির বুঝে উঠতে পারেনা তারা কিভাবে মারা গেল। ও যেভাবে ওদের মেরেছে তাতে এত অল্পতেই মারা যাওয়ার কথা নয়। তাহলে মারা যাওয়ার কারণ কি? তবে কি এই অল্প কিছু সময়ের মাঝে কেউ ওদের মেরে ফেলে চলে গেছে? কথাটা ভাবতেই দ্রুত ওদের শরীরের জামা কাপড় টেনে ছিড়ে ফেলে আলমির। ভালোভাবে চেক করতে থাকে শরীরে কোনো দাগ আছে কি না। যার মাধ্যমে ওদের মেরে ফেলা হয়েছে।

তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওদের সারা শরীরে কোন কিছু খুঁজে পায়না আলমির। রাগের বসে মাথার ওপর জোরে একটা থাপ্পড় মারে সে। সাথে সাথে হাতে তারকাটার মত কিছু একটার আঘাত লাগে তার। সে দ্রুত লোকটির চুলের মাঝে হাত দিয়ে সেটা টেনে বের করে। টেনে তুলতেই দেখে বড় একটা শুচালো তারকাটা মাথার মধ্যে ঢোকানো ছিল। আলমিরের চোখ যেন কপালে উঠে যায়। সে আবার আরেকজনের মাথাতেও চেক করে। আর ওনার মাথাতেও একইভাবে একইরকম তারকাটা পাওয়া যায়। তারকাটা দ্রুত সংগ্রহ করে কাছে রাখে সে। ততক্ষণে সে বুঝে গেছে, তারা চলে যাওয়ার পর এখানে কেউ এসেছিল। যে এমন নৃশংসভাবে মেরে গেছে এদের। কিন্তু এদের মারার কারণ কি তার? নিজের ধরা পড়ার ভয়ে?

কথাগুলো ভেবেই যেন মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে আলমিরের। সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, ১০ মিনিট আগে তালা দিয়ে যাওয়ার পর, ঘরে তালা থাকা অবস্থাতেই এত অল্প সময়ের মাঝে কে কিভাবে ভিতরে ঢুকে খুন করল এদের? আলমির চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে। তারপর কয়েকজন গার্ডকে বলে দ্রুত লাশ দুটি কোথাও গায়েব করে ফেলতে।
,
,
,
গাড়িতে বসে তারকাটা দুটোর দিকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে আলমির। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, ঐখানে এত অল্প কিছু সময়ের মাঝেই তারকাটা গুলো তাদের মাথার মধ্যে গেল কিভাবে? নিজের উপর বড্ড বেশি রাগ হচ্ছে তার। তার উচিত ছিল সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখা। এত বড় বোকামি কিভাবে করলো সে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হসপিটালে পৌঁছে যায় আলমির। তারপর দ্রুত হেঁটে চলে যায় মেহরিমা কেবিনের কাছে। সেখানে যেতেই দিদুনকে বাইরে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। এগিয়ে গিয়ে বলে,

“দিদুন তুমি এভাবে বাইরে বসে আছো কেন?মেহরিমা কোথায়? ওর জ্ঞান ফিরে আসেনি এখনো?”

ওর কথা শুনে দিলরুবা বেগম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ঝাঝালো কন্ঠে বলে,

“মেহরিমার খবর নেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করো তুমি? আমার তো সেটা মনে হয় না। বিকাল থেকে কতবার ফোন করা হয়েছে তোমাকে। একটিবারের জন্যও ফোন ধরার প্রয়োজন মনে করেছো? একবারও ভেবেছো মেয়েটির এখানে কি অবস্থা হয়েছে?”

দিলরুবা বেগমের কথায় দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে আলমির। দেখে ফোনের মাঝে ৫২ টা মিসডকল উঠে রয়েছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে খেয়াল করেনি। নিজের উপর বেশ রাগ হয় আলমিরের। সে ফোনটা পকেটে রেখে হাটু গেড়ে বসে দিদুন এর সামনে। কান ধরে বাচ্চাদের মত করুন গলায় বলে,

“সরি দিদুন ক্ষমা করে দাও। আসলে একটু কাজে ব্যাস্ত থাকায় খেয়াল করিনি। এবার বলো আমার মেহরিমা কোথায়? ওকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে তো। এখন সুস্থ তো ও?”

কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ায় আলমির। কেবিনের মধ্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে। তখন’ই পিছন থেকে দিলরুবা বেগম মনে ওঠে,

“মেহরিমা কবে সুস্থ হবে সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না আলমির। ও যে কোমায় চলে গেছে। ভীষণ ক্রিটিক্যাল অবস্থা হয়েছিল ওর।”

কথাগুলো শুনতেই যেন সেখানেই জমে গেল আলমিরের পা। সে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল তার দিদুনের দিকে। দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে আবারও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তার হাত ধরে বলল,

“এসব তুমি কি বলছো দিদুন? সকালেও তো আমি ওকে একদম সুস্থ দেখে গেছি। তাহলে এতটা অসুস্থ হলো কিভাবে ও? আর কোমায় গেছে মানে কি? এটা হতে পারে না আমার মেহরিমা সুস্থ হয়ে যাবে। কোমায় যেতে পারে না সে। ডাক্তার, ডাক্তার কি করছে, তারা কোথায় ছিলো তখন?”

কথাগুলো বলে রাগে উঠে দাঁড়ালো আলমির। তখনই ওর হাত টেনে ধরল দিলরুবা বেগম। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আলমিরের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“এভাবে উত্তেজিত হইওনা দাদুভাই। আল্লাহ যেটা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। তুমি শুধু শুকরিয়া আদায় করো যে আমাদের মেহরিমা এখনো বেঁচে আছে। নইলে ডাক্তারেরা ওর বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। ওর শরীরে যে গুলিটা লেগে ছিল সেটার সাথে একটি পিন লাগানো ছিল। যেটা ছিল অসম্ভব বিষাক্ত। যে কারণে মেহরিমা শরীরের মাঝে পঁচন ধরে যাচ্ছিলো। যেটুকু জায়গায় পিন লাগানো ছিল সেটুকু কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা প্রথমে বুঝতে না পারলেও ওর অবস্থা ধীরে ধীরে বেগতিক হতে দেখলে তারা নতুন করে অপারেশন করেছে। কিন্তু ও কে বাঁচানো গেলেও ও কোমায় চলে গেছে। তবে ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। ওকে শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আর নিয়মিত ড্রেসিন করে দিতে হবে অপারেশনের জায়গাটায়।”

ওনার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো আলমির। কোনরকম উত্তর দিল না সে। তারপর কিছু একটা ভেবে দিদুনকে সেখানে বসিয়ে রেখে চলে গেল ডাক্তারের চেম্বারে। প্রায় আধ ঘন্টা পর চেম্বার থেকে ফিরে এলো সে ডাক্তার ও নার্সদের সাথে নিয়ে।

ডাক্তার এবং নার্সদের সাহায্য নিয়ে মেহরিমা কে বাসায় নিয়ে আসলো আলমির। রাস্তার মাঝে অনেকবার প্রশ্ন করেছে দিদুন সে এমনটা কেন করলো। বাসায় যদি তার কোনো রকম সমস্যা হয় সেখানে কে দেখবে? কিন্তু আলমির কোনরকম উত্তর দেয়নি। শুধু দিদুন কে বলেছে চুপ থাকতে বাসায় গেলে সবকিছু জানতে পারবে। দিদুন তেমন কোনো প্রশ্ন করে নি আর। বাসায় নিয়ে এসে মেহরিমাকে তার রুমে শিফট করা হলো। আর মেহরিমার দেখাশোনার জন্য দুজন নার্সকে সাথে নিয়ে এসেছে আলমির। তারা ২৪ ঘন্টা ওর দেখাশোনা করবে। ওর যেনো কোনরকম প্রবলেম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে। এটার জন্য মোটা অঙ্কের বেতন দেবে তাদের আলমির।

রাত প্রায় ১২ টা বাজতে চললো,
ফ্রেশ হয়ে মেহরিমার রুমে আসে আলমির। নার্সদের বলে আধ ঘন্টার জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে। এই সময়ের মাঝে যেন অন্য কেউ না আসে রুনে। তারপর সে চেয়ার টেনে নিয়ে মেহরিমার পাশে বসে। তার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সেটাতে একট চুমু এঁকে দেয়। তারপর এক নজরে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মনে মনে ভাবে,

“কি আছে এই চেহারায়? যে চেহারার মায়ায় পড়ে তাকে ভালবেসে ফেলেছে আলমির? যার মনে কখনো ভালোবাসার বিন্দুমাত্র অংশও ছিল না। আজ সেই মনটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা পেয়েছে এই মেয়েটার কারণে।”

আলমিরের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দিনগুলো। যে দিনগুলোতে সে মেহরিমা কে কষ্ট দিয়েছে। পুরা বাসার কাজ করিয়েছে। পার্টিতে সকলের সামনে থাপ্পড় মেরেছে, যখন কিনা সে তাকে বাঁচাতে এসেছিল। কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আলমিরের। সে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয়। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“আর কত ঘুমিয়ে থাকবে মেহু? আর কত শাস্তি দেবে আমায়? দেখো তোমাকে কষ্ট দিয়ে তার চাইতে হাজার গুণ বেশি কষ্ট আমি পাচ্ছি। প্লিজ আগের মত সুস্থ হয়ে ফিরে আসো। কথা দিচ্ছি আর কখনো বিন্দু পরিমাণ কষ্টও দেবো না তোমায়। আমার রাজ্যের রানী করে রাখবো তোমায়। ভালবাসার চাদরে জরিয়ে নিবো বুকে। কখনো আলাদা হতে দিবো না। কষ্টের ছিটে ফোটাও পরতে দিবো না তোমার জীবনে। প্লিজ মেহু ফিরে আসো আর একটি বার।”

মেহরিমা উত্তর দেয় না। সে আগের মতই পরে থাকে অজ্ঞান অবস্থায়। আলমির একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারারাত আর ঘুম হয়না তার। সে সারারাত ভাবতে থাকে তার এমন শত্রু কে আছে? যে কিনা এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারতে চেয়েছিল তাকে? গুলির সাথেও বিষাক্ত পিন লাগিয়ে দিয়েছিল তাকে হত্যার জন্যে। এমন কে আছে যার সাথে তার এতটা শত্রুতা হয়েছে?

নাহ আলমির কোন কূলকিনারা খুঁজে পায় না। তার জানা মতে তার এমন কোন শত্রু নেই। যে তাকে এভাবে খুন করার চেষ্টা করতে পারে। তাহলে কে করছে এমন? আর কেনই বা করছে? সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা তার কাছে। তবে এসবের উত্তর তাকে বের করতেই হবে। যেভাবেই হোক বের করতেই হবে তাকে।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৪
#M_Sonali

“মেহরিমার অবস্থা গত একমাসে অনেকটাই ভালো হয়েছে। সে হয়তো খুব শীঘ্রই কোমা থেকে বেরিয়ে আসবে আন্টি। ওকে দেখে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ওর সবকিছুই নর্মাল। শারীরিক কন্ডিশনও অনেক ভালো। আর পিঠের ঘা টাও অনেকটাই শুকিয়ে গেছে।”

ফিরোজ আহমাদ এর কথা শুনে আশার আলো দেখতে পেলেন দিলরুবা বেগম। গত একটি মাস হলো এভাবে বিছানায় পরে আছে মেহরিমা। সে সুস্থ হবে জেনে, তিনি উৎফুল্ল মনে বলে উঠলেন,

“সত্যি বলছো তুমি ফিরোজ! আমাদের মেহরিমা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে? ইশ ওকে আগের মতো হাসিখুশি সুস্থভাবে দেখার জন্য আমার মনটা যেন সবসময় আনচান করছে। কবে যে মেয়েটা আবার আগের মত কথা বলবে।”

ওনার কথা শুনে মৃদু হাসেন ফিরোজ আহমাদ। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,

“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। মেহরিমা যখন-তখন কোমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ওর শারীরিক কন্ডিশন একদম নরমাল।”

“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।”

ফিরোজ আহমাদ এর কথায় দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন দিলরুবা বেগম। তারপর মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো দিদিভাই। তোমার সাথে অনেক কথা বলার আছে আমার। তোমাকে ছাড়া বড্ড একা হয়ে গেছি আমি। আজ মেহের পাশে না থাকলে হয়তো তোমার এমন অবস্থার সাথে আমিও মারা যেতাম।”

ফিরোজ আহমাদ যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে আসেন। দিলরুবা বেগম এর সামনে বসে হালকা গলা খাকারি দেন। মৃদু গলায় বলেন,

“আন্টি আপনাকে একটা কথা অনেকদিন হলো বলতে চাই। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা। আসলে তেমন সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি কখনো। আমার মনে হয় এখন কথাটা বলার সময় এসেছে।”

ওনার কথায় ভ্রু কুচকায় দিলরুবা বেগম। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

“কি এমন কথা ফিরোজ? যেটা বলার আগে তুমি এতটা ইতস্ততা বোধ করছ?”

“আসলে আন্টি আপনি হয়তো জানেন আমাদের সরণ মেহরিমা মাকে পছন্দ করে। সেটা প্রথম দেখা থেকেই। আর সরণ বলেছে মেহরিমাও তাকে পছন্দ করে। তাই আমি চাচ্ছি মেহরিমা যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। তখন খুব দ্রুতই ওদের দুজনের বিয়েটা করিয়ে দিতে। মেহরিমা কে আমার এবং সরণের মায়েরও ভীষণ পছন্দ। আর এখনতো ওর গার্জিয়ান বলতে শুধু আপনিই আছেন। আমি যতদূর জানি ওর কোন আত্মীয়-স্বজন নেই শুধু ছোট বোনটা ছাড়া। তাই আপনার কাছে পারমিশন টা চাই। আপনি কি বলেন আন্টি?”

উনার কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কি বলবেন বুঝে পান না। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবেন। তারপর গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন,

“দেখো ফিরোজ, মেয়েটা এখনো কোমা থেকেই বের হয়নি। তাকে সুস্থ হতে দাও। সবার সাথে আগের মত স্বাভাবিক হতে দাও। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। আর তাছাড়া আমি তার জীবনের এত বড় ডিসিশন নিতে পারব না। সেটা একমাত্র তাঁর ইচ্ছার ওপরেই হবে। সে যখন সুস্থ হয়ে যাবে তখন এই ব্যাপারে তার সাথে কথা বলে দেখব। সে যদি সরণকে আদৌ পাত্র হিসাবে পছন্দ করে থাকে তাহলে কথা আগানো যাবে।”

দিলরুবা বেগম এর উত্তরে মনঃক্ষুন্ন হলেন ফিরোজ আহমাদ। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে চাপা গলায় বললেন,

“দেখুন আন্টি আপনার কাছে কথাটা আমি অনেক আশা নিয়ে বলেছিলাম। আপনি তো জানেন সরণের কোনো চাওয়া আমি কখনোই অপূর্ণ রাখি না। তবে আপনার কথাও ফেলে দেওয়ার নয়। ঠিক আছে তাহলে ওর সুস্থ হয়ে ওঠার অপেক্ষাতেই রইলাম। আমি জানি মেহরিমা ঠিক রাজি হবে। আমার ছেলের মত ছেলে বাংলাদেশের মধ্যে আর একটাও পাবে না সে? ওর কপাল ভালো তাই সরণ ওকে পছন্দ করেছে। সে যাই হোক আন্টি, আমি এখন আসি।”

কথাটি বলেই গোমরা মুখে উঠে চলে গেলেন ফিরোজ আহমাদ। দিলরুবা বেগম আর তাকে কিছু বললেন না। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখানেই বসে রইলেন। এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওনাদের সবগুলো কথাই শুনেছে আলমির। আর রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। ফিরোজ আহমাদ চলে যেতেই সে রুমের মাঝে প্রবেশ করল। দিলরুবা বেগম এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“এসবের মানে কি দিদুন? তুমি আঙ্কেলের কথাতে সম্মতি জানালে কি করে?”

দিলরুবা বেগম চুপ থাকেন। কোন উত্তর দেন না। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহরিমার দিকে ফিরে তাকান। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে যেতে যেতে বলেন,

“আমি যা বলেছি ঠিক বলেছি আলমির। একবার চিন্তা করে দেখো, মেহরিমা সুস্থ হওয়ার পর সে যদি সত্যিই সরণকে পছন্দ করে। তাহলে আমি কি করে তাদের বিয়েটা আটকাবো। আমি কখনই চাইব না তোমার সাথে তার বিয়ে হোক। কেননা বিয়েটা তার নিজের ইচ্ছায় হবে। জীবনটা তার, তাই সে সারাজীবন কার সাথে কাটাতে চায়। কাকে নিজের জীবনসাথি বানাতে চায়। সেটা শুধুমাত্র তারই ডিসিশনে হবে। কোন জোরজবরদস্তিতে নয়। তাই যদি পারো মেহরিমা সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে তার মনে তোমার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করার চেষ্টা করো। এর বেশি আর কিছু তোমায় বলতে হবে না আশা করি।”

কথাগুলো বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন দিলরুবা বেগম। তার কথা শুনে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো আলমির। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করল সে। তারপর মেহরিমার দিকে তাকিয়ে হাতের মুঠো ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“মেহু, তুমি শুধু আমার। তোমাকে অন্য কারো হতে দেখা কখনোই সম্ভব নয়। অন্য কারো কথা কখনো চিন্তা করলেও সবকিছু তছনছ করে ফেলবো আমি। এতদিন তুমি আমার মাঝে তিল তিল করে যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছো। সেই ভালোবাসা কখনোই অন্য কারো হতে দিবো না। পৃথিবীতে মেহরিমা যদি কারো হয়, সেটা শুধু আলমিরের হবে। আলমির ছাড়া অন্য কারো হওয়ার অধিকার নেই মেহরিমার। কথাটা মাথায় রেখো তুমি। সুস্থ হওয়ার পর শুধু আমার কথাই ভাববে। অন্য কারো কথা মাথায় আনলেও এই মাথাটাই ফাটিয়ে দিবো বলে দিলাম।”

কথাগুলো বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেল আলমির। যাওয়ার আগে সেই নার্স দুজনকে রুমের মধ্যে ওর পাশে থাকতে বলে গেল। আলমির এমনভাবে কথাগুলো বলল, যেন মেহরিমা তার কথা শুনতে পাচ্ছে। রাগে কেন জানেনা তার শরীর পুড়ছে। সে মেহরিমার পাশে অন্য কারো কথা কল্পনাও করতে পারেনা। মেহরিমা শুধু তার। মরলেও তার। বাঁচলেও তার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক শুধু তার। অন্য কারো নয়।
,
,
তিন দিন পর বিকেল ৫:০০ টা,
নিজের রুমে বসে আছেন দিলরুবা বেগম। ভীষণ চিন্তিত লাগছে তাকে। কপালে হাত দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। কোনদিকে কি হচ্ছে কোন কিছুতেই যেন নজর নেই তার। তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেহরিমা সুস্থ হওয়ার পর যদি সত্যি সত্যি সরণের সঙ্গে বিয়ে করতে চায়? সরণের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়! তাহলে আলমিরের কি হবে? তবে কি সে নিজ হাতে তার নাতির জীবনটা নষ্ট করবে? কথাগুলো ভেবে যেন মনের মাঝে হাহাকার শুরু হচ্ছে দিলরুবা বেগমের। কারণ তার ধারণা অনুযায়ী মেহরিমা আলমিরকে পছন্দ করে না। আলমির তার সাথে যে আচরণগুলো করেছে তাতে পছন্দ না করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে সরণকে যে পছন্দ করে এমনটাও নয়। তবে সত্যিই যদি মেহরিমা সুস্থ হওয়ার পর সরণ কে বিয়ে করতে চায়? আলমিরকে ভালো না বাসে? তাহলে কেমন হবে? আলমির কি এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে? নাকি মেহরিমাকেও ঘৃনা করবে তার মায়ের মত?
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই যেন মাথা ধরে যাচ্ছে দিলরুবা বেগমের। সে কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।

“কি হয়েছে দিদুন, তুমি এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ? তুমিও কি আপুর মতো অসুস্থ হয়ে চুপ করে শুয়ে থাকবে? আমার সাথে আর কথা বলবে না?”

পাশ থেকে মেহেরের কথা শুনে ধ্যান ভাঙ্গে দিলরুবা বেগম এর। পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মেহের। ওর কথা শুনে যেন বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়ে যায় তার। সে ওর হাত ধরে পাশে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“না সোনা, আমার কিছুই হয়নি। এই দেখো আমি একদম সুস্থ।”

“তাহলে এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলে কেন? তুমি জানো আমি স্কুল থেকে ফিরে তোমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে কতটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল তুমিও আপুর মত আমার সাথে আর কথা বলবে না। আচ্ছা দিদুন আমার আপু কথা বলবে কবে? কবে আমায় আগের মত আদর করবে, শাসন করবে সে? তুমি আপুকে বলো না দিদুন, আমি তাকে আর কখনো জ্বালাবো না। তবুও সে আমার সাথে কথা বলুক। আমার যে আপুকে ছাড়া কিছু ভাললাগে না।”

কথাগুলো বলেই কান্না করতে শুরু করে মেহের। ওর মুখের এসব কথা যেন তীরের মত বিধছে দিলরুবা বেগমের বুকে। সে যে এই ছোট্ট মেয়েটিকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। মেয়েটির তোতাপাখির মতো কথা বলা তার মন কেড়ে নেয়। ওর মুখের মিষ্টি হাসি দিলরুবা বেগম এর মুখে হাসি ফোটাতে সহায়তা করে। সেই মেয়ের চোখের পানি যে তার সহ্য হচ্ছেনা। দিলরুবা বেগম ওর চোখের পানি মুছে দেয়। বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

“কেঁদো না সোনা, তোমার আপু খুব শীগ্রই সুস্থ হয়ে যাবে দেখে নিও। তোমাকে অনেক অনেক শাসন করবে আর আদর করবে। তখন আবার আমাকে ভুলে যেও না কিন্তু।”

উনার কথার উত্তরে মেহের কিছু বলবে তখনই একজন নার্স দৌড়ে এসে বলে,

“ম্যাম, ছোট ম্যাডামের জ্ঞান ফিরেছে। সে আপনাদেরকে ডাকছে। জলদি আসুন।”

মেহরিমার জ্ঞান ফিরেছে শুনেই যেন দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠে। দ্রুত দুজন রুম থেকে বেরিয়ে মেহরিমার রুমে চলে যায়। দেখে মেহরিমা বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। দিদুন আর মেহেরকে দেখেই তার মুখে কিঞ্চিত হাসি ফুটে ওঠে। মেহের দৌড়ে গিয়ে তার আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। মেহরিমা ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীর দুর্বল হওয়ায় একা উঠতে পারেনা। নার্স তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে। মেহরিমা মেহেরের মাথায় হাত বুলায়। তাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু মেহের যেন কান্না থামানোর নাম করছে না। সে একমনে কান্না করে চলেছে। আর একের পর এক অভিযোগ করছে মেহরিমার প্রতি। সে কেন এতদিন এভাবে পড়ে থাকল, কেন মেহেরকে আদর করলো না। কেন ভালোবাসলো না। মেহরিমা মনোযোগ দিয়ে শোনে আর অশ্রু ঝরায় দু চোখে। কিছু বলার মতো শক্তি নেই তার।

দিলরুবা বেগম দু’বোনের পাশে এগিয়ে আসে। দুজনের মাথায় দুই হাত বুলায়। মেহরিমা তার দিকে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। তিনিও ওকে জরিয়ে নেয় বুকে। তারপর নার্স এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“দ্রুত গিয়ে ফিরোজ আহমাদকে ফোন করে আসতে বলো। বলো মেহরিমার জ্ঞান ফিরেছে”
,
,
,
ফিরোজ আহমাদ এসে মেহরিমা কে চেকআপ করে গেছেন। তার ভাষ্যমতে মেহরিমা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার আর কোন সমস্যা নেই। শুধু শরীর একটু দুর্বল। যেটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। ফিরোজ আহমাদ চলে যেতেই সরণ আসে। আর এসেই পাগল হয় মেহরিমার সাথে দেখা করার জন্য। যদিও দিলরুবা বেগম তাকে মেহরিমার কাছে এখন পর্যন্ত যেতে দেয়নি। আটকে রেখেছে সে অসুস্থ বলে। কিন্তু সরন যেন মানতে নারাজ। একপ্রকার জোর করেই মেহরিমার সাথে দেখা করতে তার রুমে চলে যায় সে। দেখে মেহরিমা খাটের উপর চোখ বন্ধ করে বসে আছে। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে। রুমে আর কেউ নেই। আসলে সে”ই চেয়েছিল একটু একা থাকতে। তাই রুম থেকে সবাইকে বের হতে বলেছে। সরণ ডাইরেক্ট গিয়ে তার পাশে বসে বলে ওঠে,

“কেমন আছো মেহরিমা? তুমি জানো তোমার সুস্থতার জন্য আমি কতটা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করেছি? তোমাকে সুস্থ দেখে কতটা ভাল লাগছে বলে প্রকাশ করতে পারবো না।”

ওর কথা শুনে চোখ খুলে তাকায় মেহরিমা। ওর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বলে,

“আমি ঠিক আছি, আপনি কেমন আছেন?”

“এত দিন ভালো ছিলাম না। তোমাকে সুস্থ দেখে এখন অনেক ভালো আছি। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা দুজন বিয়ে করে নিবো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মেহরিমা। আই লাভ ইউ।”

কথাটি বলে আচমকাই মেহরিমা কে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে যেতে নিল সরণ। সাথে সাথে তাকে হাত দিয়ে বাঁধা দিলো মেহরিমা। থামিয়ে দিয়ে বললো,

” কি করছেন কি সরণ? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?”

“এখানে পাগলামির কি দেখলে মেহরিমা? আমি বলছিতো আমি তোমায় ভালোবাসি। আর তাছাড়া বাবা, আম্মু সবাই জানে। দিদুনকেও বলা হয়ে গেছে। আমাদের বিয়েও তো প্রায় পাকা হয়ে গেছে। যদি রাজি থাকো আজকেই তোমাকে বিয়ে করে নিজের করে নিবো।”

দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে সরণের মুখের কথাটা শুনে থমকে যায় আলমির। নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে রাগে আগুন হতে থাকে সে। তখনই মেহরিমা বলে ওঠে,

“আপনার মাথা ঠিক আছে সরণ? আপনি কি থেকে কি বলছেন এসব? আমি সবেমাত্র সুস্থ হয়েছি। এই মুহূর্তে কোন রকম কথা বলার এনার্জি নেই আমার মাঝে। প্লিজ আপনি এখান থেকে চলে যান। আমি একটু একা থাকতে চাই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাব। শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি জানি প্রথম দেখায় আমি যেমন তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তেমনি তুমিও আমার ভালবেসে ফেলেছ। তাই না মেহরিমা? তুমিও আমায় বিয়ে করতে চাও। আমার প্রপোজ একসেপ্ট করেছো তাই না?”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৫
#M_Sonali

“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাব। শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি জানি প্রথম দেখায় আমি যেমন তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তেমনি তুমিও আমার ভালবেসে ফেলেছ। তাই না মেহরিমা? তুমিও আমায় বিয়ে করতে চাও। আমার প্রপোজ একসেপ্ট করেছো তাই না?”

ওর কথার উত্তরে মেহরিমা কি বলবে তা যেন ভেবে পাচ্ছে না সে। এই মুহূর্তে ভীষণরকম রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু সে রাগ না দেখিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিল। তারপর সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বলে উঠলো,

“দেখুন সরণ আপনি জানেন আমি অল্প কিছু সময় আগেই কোমা থেকে বের হয়েছি। আর আমার শারীরিক অবস্থাও অনেক খারাপ। এখন কি এই কথাগুলো বলার খুবই প্রয়োজন? প্লিজ সরণ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”

কথাগুলো বলেই নিজের মাথা দুহাতে চেপে ধরল মেহরিমা। সরণ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আর কিছু যেনো বলার মত জায়গা পাচ্ছে না সে। তাই একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। তবে হ্যাঁ, উত্তরটা কিন্তু হ্যাঁতেই শুনতে চাই। তুমি থাকো আমি এখনকার মতো চলে যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব তোমায় বউ করে নিয়ে যেতে।”

কথাটি বলেই উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে যেতেই আলমিরের মুখোমুখি হলো সে। ওকে দেখে যেন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেল সরণ। ওকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরার ভান করে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

“উফ ব্রো তুমি একদম ঠিক সময় এসেছো। প্লিজ ব্রো আমার জন্য মেহরিমাকে মানাও। তুমি তো জানো সেই প্রথম দিন দেখার পর থেকে ওকে আমি ভালবাসি। ওকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু ও কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাইছে না। ওকে মানাও যেন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। আমি জানি তুমি আমার সত্যি কারের বন্ধু। আমার এই কাজটা শুধু তুমি’ই করতে পারবে। প্লিজ ব্রো হেল্প মি।”

কথাগুলো বলেই আলমিরকে ছেড়ে দিল সরণ। তারপর একটি চোখ টিপ মেরে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আলমির নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রইল। এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে বড় একটি রড নিয়ে গিয়ে সরণের মাথায় বারি মেরে দিতে। কত্ত বড় সাহস ওর, তার মেহরিমা কে ওর জন্য মানানোর দায়িত্ব তাকেই দিয়ে যায়। সে যতটা সম্ভব নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠো শক্ত করে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর চোখ খুলে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্ত হলো। মেহরিমা অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। আলমির ধীরে ধীরে ওর পাশে এসে বসল। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“এখন কেমন আছো মেহু?”

মেহরিমা কোন উত্তর দিল না। সে আগের মতই চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। যেন কোনো কিছু শুনতেই পায়নি সে। আলমির কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও প্রশ্ন করল,

“মেহু এখন কেমন আছো তুমি? আর ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছো? তাকাও আমার দিকে!”

মেহরিমা এবার অন্য দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় বললো,

“কি চাই এখানে আপনার? কেন এসেছেন এখানে? আমি কেন বেঁচে গেলাম সেটা দেখতে?”

“এসব কি বলছ মেহরিমা? আমি কেন এমনটা দেখতে আসবো? আমি তোমার খবর নিতে এসেছি। কেমন আছো তুমি? তোমার শরীর এখন কেমন? তুমি জানো এতদিন তোমার এই অবস্থা দেখে আমার কতটা ক,,,!”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে মেহরিমা বলে উঠল,

“প্লিজ স্যার এখান থেকে চলে যান। আমি একটু একা থাকতে চাই। এখন আমার মনে হচ্ছে কোমা থেকে বের না হলেই ভাল হতো। আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না আমার কিছু ভালো লাগছেনা। আমি একটু একা থাকতে চাই। প্লিজ স্যার লিভ মি এ্যালোন।”

ওর এমন কথায় আলমির যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে কল্পনাও করতে পারেনি মেহরিমা তার সাথে এভাবে কথা বলবে। তাও আবার কোমা থেকে বের হওয়ার পর। আলমির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

“চলে যাচ্ছি আমি। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। কোন কিছু দরকার পড়লে আমাকে বলো।”

মেহরিমা কোন উত্তর দিল না। সে চুপচাপ বিছানায় অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ল। আলমির একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। দরজার পাশেই দিদুন কে দেখে চমকে গেলো সে। দিদুন তার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলমির আর দেরী করলো না। সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল। ওকে চলে যেতে দেখে দিলরুবা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন,

“তাহলে কি আমার ভয়টা সত্যি হতে যাচ্ছে? আমি কি নিজে হাতে আমার দাদুভাই এর জীবনটা নষ্ট করতে যাচ্ছি? মেহরিমা কি কোনদিনও আলমিরকে ভালবাসবে? আর সে যদি সত্যি সত্যি সরণের প্রপোজালে রাজি হয়ে যায়? তাহলে আমার আলমিরের কি হবে? সে তো শেষ হয়ে যাবে দ্বিতীয় বারের মতো।”

কথাগুলো ভাবতেই যেন এক অজানা ভয় গ্রাস করে নেয় দিলরুবা বেগমের মন। সে নিজের বুকের উপর হাত রেখে নিজেকে শান্তনা দেয়। তারপর রুমে চলে যায়। দেখে মেহের ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনিও ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়েন।
,
,
,
রাত প্রায় পৌনে চারটা।
নিজের রুমে একটি ড্রিংকস এর গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে আলমির। তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে রাগে। তার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু ছবি। যাতে তার বাবা-মা ও তার ছোট বেলার ছবি রয়েছে। প্রতিটি ছবিতেই তার মায়ের ছবির ওপর ক্রস চিহ্ন করে কেটে দেওয়া। আলমির অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই ছবিগুলোর দিকে। যেন চোখের আগুনে এখনই পুড়িয়ে ফেলবে ছবিগুলো। দাঁত কিড়মিড় করে দেখছে ছবিগুলোকে। ইচ্ছে করছে সবগুলো আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে। কিন্তু এত বছরেও সে এই কাজটা পেরে ওঠেনি।

সে বেশ কিছুক্ষণ ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে হাতে থাকা গ্লাসটা সজোরে ছুড়ে মারল সেই ছবিগুলো ওপর। সাথে সাথে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরল গ্লাসটা। সে উপর হয়ে একটি ছবি হাতে নিল। তারপর ওর মায়ের ছবি দুমড়ে মুচড়ে বলে উঠলো,

“পৃথিবীতে সব চাইতে বেশি যদি কাউকে ঘৃনা করি। সে তুমি। শুধুমাত্র তোমার জন্য, তোমার জন্য পৃথিবীর প্রত্যেকটা মেয়েকে ঘৃণা করতাম আমি। যে মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসার অন্ত থাকে না। সন্তান যে মাকে ছাড়া কিছু বোঝোনা। ছোটবেলা থেকে সেই মায়ের প্রতি আমার মনে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই জন্ম নেয়নি। কেমন মা তুমি, ছলনাময়ী। ছলনা করেছ আমার আর বাবার সাথে। স্বার্থপরের মত চলে গেছো বাবাকে আর আমাকে একা ফেলে। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না। কোনো দিন না। আই জাস্ট হেট ইউ।”

কথাটি বলেই ছবিটি ছুড়ে ফেলল দূরে। তারপর রাগে ফ্লোরে বেশ কয়েকটা ঘুষি মারলো সে। এই মুহূর্তে এতটাই রাগ হচ্ছে ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে। সে যখনই তার মায়ের কথা ভাবে। তার মায়ের ছবি দেখে। তখন’ই তার এমনি রাগ হয়। তাই সে মায়ের ছবি গুলো লুকিয়ে রাখে। কখনোই দেখে না। কিন্তু আজ কেন জানে না বারবার দেখতে ইচ্ছে করছিল তাকে। তাই রাতের বেলায় না ঘুমিয়ে ছবিগুলো বের করে দেখতে বসে ছিল সে। কিন্তু যতই দেখছে ততই যেন রাগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে তার ভেতর। সে যে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ঘৃণা করে তার মাকে। আর এটাই কারণ পৃথিবীর সব মেয়েকে ঘৃণা করার।

এত বছর পর যখন তার মনে ভালোবাসার ফুল ফুটল। সে একজনকে ভালবাসতে চাইলো। তখনই কেন সে তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে? তার আচরণ বলে দিচ্ছে সে আলমিরকে চায়না। আলমিরকে পছন্দ করে না। কিন্তু এটা সে কখনোই মেনে নেবে না। সে সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে হলেও মেহরিমা কে নিজের করে ছাড়বে। মেহরিমা শুধু তার। অন্য কারো হতে পারে না। তাকে অন্য কারো হতে দেবে না সে। তার বাবা যে ভুল করেছে সে কখনোই সে ভুল করবে না। দরকার পড়লে মেহরিমা কে মেরে ফেলবে। তবুও অন্য কারো হতে দেখতে পারবে না সে।

আলমির ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। মায়ের ছবি গুলো হাতে নিয়ে মোচড়াতে মোচড়াতে এদিক-ওদিক ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল ১১ টায় দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ঘুম ভাঙে তার। সে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে উঠে বসে। মাথাটা প্রচন্ড রকম ব্যথা করছে তার। গতকালের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করে। সবকিছু মনে পড়তেই রাগে যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিজেকে শান্ত করে উঠে দাঁড়ায় সে। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দেখে দিলরুবা বেগম রাগি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আলমির দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ভিতরে হেঁটে গিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে। দিলরুবা বেগম রুমের মাঝে প্রবেশ করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তার সামনে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো গলায় বলে,

“এসব কি আলমির? এই দিন দেখার জন্য এত কষ্ট করে তোমায় বড় করেছি আমি? কি করছো এসব? তুমি মদ খেয়েছ? এভাবে তুমি মন জয় করবে মেহরিমার? তোমার চোখের সামনে দিয়ে যখন সরন ওকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। তখন বুঝবে কেমন লাগে। এসব কি করছো কি তুমি? আমি তোমার থেকে এমনটা কখনোই আশা করিনি।”

আলমির করুন দৃষ্টিতে দিলরুবা বেগম এর দিকে তাকায়। আচমকা তার কোমর জড়িয়ে ধরে হু হু করে বাচ্চাদের মত কান্না করতে শুরু করে। দিলরুবা বেগম যেনো সেখানেই পাথর হয়ে যায়। চুপ করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। এই মুহূর্তে কি করা উচিত তার জানা নেই। সে খুব অল্প সময়’ই ওকে কান্না করতে দেখেছে। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুটা সময়। একপর্যায়ে আলমির নিজেকে শান্ত করে চোখের জল মুছে নেয়। দিলরুবা বেগম কে ছেড়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আমি কি করবো দিদুন? বলো কি করা উচিত আমার? আমি গতকাল রাতে গিয়েছিলাম মেহরিমার কাছে। তার চোখে আমার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। আমি ওকে অনেক বেশী চাই দিদুন। ওকে অন্য কারো সাথে কল্পনাও করতে পারি না। সরণ যতবার ওর নাম নিজের মুখে উচ্চারণ করে। আমার ততবার মনে হয় ওকে সেখানেই পুঁতে ফেলতে। খুন করে ফেলতে। মেহরিমা কে অন্য কারো হতে দেখা তো দূর ওর মুখে অন্য কারো কথা শুনলেও পাগল হয়ে যাই আমি। ইচ্ছে করে সবকিছু তছনছ করে ফেলি। কি করব আমি বল দিদুন।”

দিলরুবা বেগম আলমিরের মাথায় হাত বুলান। ওর পাশে বসে শান্তনা দিয়ে বলেন,

“শান্ত হও দাদুভাই, এভাবে হাইপার হয়ে কোন কিছুই উদ্ধার হবে না। আমি এখনো বুঝতে পারিনি মেহরিমার মাথায় ঠিক কি চলছে। ও আসলেই সরণকে পছন্দ করে কিনা? বা তোমাকে সত্যিই ঘৃণা করে কি না। এখনো সময় আছে তার মনে তোমার প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি করার চেষ্টা করো। ও যদি সরণকে সত্যি সত্যি একসেপ্ট করে, তাহলে এখানে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। কেননা কারো উপর জোর করে কখনো ভালোবাসা ফলানো যায় না।”

এতোটুকু বলতেই হুঙ্কার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আলমির। রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

“কখনোই না, কখনোই না দিদুন। মেহরিমা শুধু আমার। অন্য কারো হওয়ার অধিকার নেই ওর। ও যদি একবারও অন্য কারো হওয়ার কথা চিন্তাও করে, খুন করে ফেলবো। সাথে নিজেও মরে যাব। ও আলমিরের মনে ভালোবাসা জন্মিয়েছে। যে মনে কখনো মেয়েদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া ভালো লাগাও কাজ করে নি। সেই মনে ও ভালোবাসার ফুল ফুটিয়েছে। এর হিসাব তো তাকে দিতেই হবে। সে অন্য কারো হওয়ার কথা কল্পনা করলেও আমি শেষ করে দেবো সবকিছু। সবকিছু তছনছ করে ফেলব দেখে নিও তুমি।”

“শান্ত হও দাদুভাই। এভাবে নিজেকে সহ অন্য কেও কষ্ট দিও না। কেন বোঝনা ভালবাসা কখনো জোর করে পাওয়া যায় না। এটা যে মন এর মিলন থেকে হয়। তোমাকে চেষ্টা করতে হবে ওর মনে তোমার জন্য ভালোবাসা তৈরি করার। এভাবে রাগারাগি করে কখনোই কারো ভালোবাসা জেতা যায় না। নিজের মনের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে ওর ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করো। আমি জানি মেহরিমা তোমাকে পছন্দ করবে। তোমাকেই ভালবাসবে। তোমার প্রতি এত টুকু বিশ্বাস আছে আমার। তোমার প্রতি হওয়া ওর অভিমানগুলো ভেঙে দাও। ওকে নিজের করে পাওয়ার জন্য সব সীমা পার করে দাও। আমি তোমার হয়ে ওর সাথে কথা বলব। কিন্তু হ্যাঁ তোমাকে একটা কথা দিতে হবে। তুমি সরন কে বা মেহরিমা কে কিছুই করবে না। ওদের সাথে কোন রকম রাগ দেখাবেনা। মনে রেখো রাগ সব সময় ধ্বংস করে। আর ভালবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়।”

আলমির আর কিছু বলেনা। শান্ত হয়ে যায় সে। দিলরুবা বেগম উঠে দাঁড়ায়। ওর হাত ধরে বলে,

“আমি বুয়া কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রুমটা পরিস্কার করে ফেলবে সে। তুমি ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার টেবিলে এসো। আমি চাইনা তুমি এই অবস্থায় মেহরিমার সামনে যাও। কোন মেয়েই চায় না সে যাকে বিয়ে করবে সেই মানুষটা এভাবে মাতাল হয়ে রাগারাগি করুক।”

কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে যান দিলরুবা বেগম। আলমির সেখানে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার কথাগুলো ভাবে। তারপর ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,