দিওয়ানেগি পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
494

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৬+১৭+১৮
#M_Sonali

পড়ন্ত বিকেলে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে মেহরিমা। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে তার। আর উড়তে উড়তে বারে বারে এসে মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। এতে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সে। চুল গুলো দুহাতে খোঁপা করে বেঁধে নিতে চায় সে। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো যেন বাঁধা অবস্থায় থাকতে নারাজ। তাই বারবার খুলে গিয়ে বাতাসে উড়তে থাকে। একসময় বেশ বিরক্ত হয়ে যায় মেহরিমা। তাই সিদ্ধান্ত নেয় ছাদ থেকে নেমে যাবে।

যখনই সে ছাদ থেকে নেমে যাবে ভেবে পিছন দিকে ঘুরতে নেয়। তখনই হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এভাবে জরিয়ে ধরায় বেশ ঘাবড়ে যায় সে। রাগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহের খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে,

“আপু, আপু দেখো আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি পরীক্ষায় ফাষ্ট হয়েছি।”

মুহূর্তেই যেন মেহরিমার রাগ সব পানি হয়ে যায়। সে মুচকি হেসে মেহেরের হাত থেকে রেজাল্টের কাগজটা নেয়। ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,

“মাশাআল্লাহ, আমার ছোট বোনটা অনেক ভাল রেজাল্ট করেছে দেখছি। এই না হলো আমার বোন। আমার জান তুই মেহের। আজ আমি অনেক খুশি।”

দুবোন মিলে ছাদের উপর বেশ কিছুক্ষন গল্প করে সময় কাটায়। তারপর একসাথে নিচে নেমে আসে। মেহরিমা কোমা থেকে বের হয়েছে আজ ১৫ দিন হলো। সে এখন পুরপুরি সুস্থ। গত ১৫ দিনে প্রায় সব সময় নিজের রুমেই কাটিয়েছে সে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথাও বলেনি। আর আলমির ও সরণ আসলে তাদের যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেছে সে। তাদের সাথে কথা বলেনি বললেই চলে।

সন্ধ্যার পর মেহরিমা দিদুন এর রুমে যায়। দেখে দিদুন বিছানার উপর বসে তাজবিহ তেলাওয়াত করছে। মেহরিমা তার পাশে গিয়ে বসে। ওকে দেখে হাতে থাকা তাজবিহ পাশে রেখে দেয় তিনি। তারপর মুচকি হেসে বলেন,

“কিছু বলবে দিদিভাই? অনেকদিন পর এভাবে দিদুনের কাছে এসে বসলে যে?”

মেহরিমা নিচের দিকে দৃষ্টি রাখে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বলে,

“আপনাকে একটি কথা বলতে চাই দিদুন। যদি কিছু মনে না করেন!”

দিলরুবা বেগম মৃদু হাসেন। ওর দিকে হাল্কা এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“কিছু মনে করব না, একবার বলেই দেখো। কি বলতে চাও।”

“আসলে দিদুন মেহেরকে নিয়ে আমি এখানে থাকছি অনেকদিন হয়ে গেলো। কোমা থেকে বেড়িয়ে সুস্থ হয়েছি আজ ১৫ দিন। তাই বলছিলাম কি আমি মেহেরকে নিয়ে বাড়িতে যেতে চাই। এখানে আর থাকতে চাইছি না। মেহেরকে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যেতে চাই। আর,,,!”

এতটুকু বলে থামল মেহরিমা। ওর কথা শুনে দিদুন গম্ভির কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

“আর কি বল?”

“আমি এই জবটা আর করতে চাই না দিদুন। এমনিতেও গুলি লাগার পর থেকে আমি আপনার বা এ বাড়ির কোনো কাজ’ই করছি না। এভাবে মেহেরকে নিয়ে বসে বসে খেতে আমার আর ভালো লাগছে না। তাই বলছিলাম, আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি মেহেরকে নিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরে যেতে চাই। তবে হ্যা আপনার থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি সেটার ঋন হয়তো কখনোই শোধ করতে পারবো না। আমি আর মেহের মাঝে মাঝে আপনার সাথে দেখা করতে আসবো ইনশাআল্লাহ।”

দিলরুবা বেগম খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথাগুলো শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করলেন,

“তোমার কি মনে হয় মেহরিমা তোমাকে এবাড়িতে শুধু আমার কাজের মেয়ে হিসেবে রাখা হয়েছে? যে আমার সেবা যত্ন করবে আর আমাকে দেখাশোনা করবে? গত পনেরো দিন হলো তোমার কোমা থেকে বেরিয়ে আসার। এর মাঝে কি একবারের জন্যও তোমার মনে হয়েছে যে তোমাকে আমি এ বাড়ির কাজের মেয়ে মনে করি?তুমি কি করে ভাবলে যে তুমি বসে বসে খাচ্ছ বলে তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে দেবো? আমার আলমিরের মত তুমি আর মেহেরও আমার নাতিন। তোমাদের ছাড়া আমি একমুহুর্তও থাকতে পারবো না। এখান থেকে যাওয়ার কথা ভুল করেও কখনো বলবে না। দরকার পরলে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো বুঝতে পেরেছ। তোমরা চলে গেলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবো।”

“কিন্তু দিদুন এভাবে মেহের কে নিয়ে এ বাড়িতে থাকাটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। আর তাছাড়া আমি একটি যুবতী মেয়ে। এখানে এভাবে থাকাটা লোকে কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। যদি আমার বাড়ি ঘর না থাকতো সেটা আলাদা কথা ছিল। কিন্তু আমার তো বাড়ি আছে। তাই এভাবে এখানে থাকাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আমি এখান থেকে একেবারে যাব না। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আগের মত সকালে আসব আর রাত্রে চলে যাব। সারা দিন আপনার কাছেই থাকব এখানে। প্লিজ দিদুন আপনি আর আপত্তি করবেন না।”

দিলরুবা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। কিছু একটা ভেবে শান্ত গলায় বলেন,

” আচ্ছা ঠিক আছে এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো। আলমির যদি অনুমতি দেয় তাহলে তুমি তোমার বাড়ি ফিরে যেতে পারো। আলমির আসুক ওর সাথে কথা বলে দেখছি কি করা যায়।”
,
,
রাত দশটা, খাবার টেবিলে বসে আছে সবাই। সবাই একদম চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। আলমির এসে মেহরিমার পাশের চেয়ারে বসেছে। এতে মেহরিমা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। যদিও কিছু বলতে পারছে না। চুপচাপ খাচ্ছে সে। হঠাৎ সকলের নীরবতা কাটিয়ে দিলরুবা বেগম বলে উঠলেন,

“দাদুভাই, মেহরিমা কিছু কথা বলতে চায় তোমাকে।”

দিলরুবা বেগমের কথায় খাবার ছেড়ে উৎসুক দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকাল আলমির। এতে মেহরিমা যাও একটু খাবার খাচ্ছিল। তাও যেন আটকে গেল তার গলায়। সে না পারছে গিলতে না পারছে বের করে দিতে। ভীষণরকম অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। তার অবস্থা দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো আলমির। তাই এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এই নাও পানিটা খেয়ে নিয়ে তারপর বল কি বলতে চাও।”

মেহরিমা খপ করে ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিল। তারপর চুপচাপ বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। ওর অবস্থা দেখে পাশে থেকে বেশ মজা নিচ্ছে আলমির। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। সে আরেকটু মেহরিমার দিকে ঘুরে বসে বাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এতে যেন আরো বেশী অস্বস্তিতে পড়ে গেল মেহরিমা। কেনো জানে না তার হৃদস্পন্দন মুহুর্তেই বেড়ে গেছে। ওকে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে দেখে পাশ থেকে মেহের বলে উঠলো,

“কি হয়েছে আপু, তুমি এভাবে নিশ্বাস নিচ্ছো কেন? তোমার কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?”

মেহেরের কথা শুনে দিদুন হকচকিয়ে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহরিমা ফটাফট বলতে শুরু করলো,

“দেখুন স্যার, আমি আর এ বাড়িতে থাকতে চাচ্ছি না। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাই। নিজের বাড়িতে চলে যেতে চাই মেহের কে নিয়ে। এভাবে থাকা আর আমার সম্ভব হচ্ছে না। লোকে খুব খারাপ চোখে দেখছে আমাদের। আমার যেহেতু নিজের বাড়ি আছে। তাই এখানে থাকাটা কেউ ই ভালো চোখে দেখবে না। প্লিজ আপনি আমাদের নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিন।”

এক নিঃশ্বাসে চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে ফেলল মেহরিমা। তার কথা শুনে এবার উৎসুক দৃষ্টিতে আলমিরের দিকে তাকালেন দিলরুবা বেগম। সে কেমন রিয়েক্ট করে তা দেখতে। কিন্তু তার মাঝে কোন রকম ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে একদম স্বাভাবিক হয়ে চুপ করে বসে তাকিয়ে আছে মেহরিমার দিকে। মেহরিমা চোখ খুলে ভয়ে ভয়ে তাকালো ওর দিকে। ওকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেন হৃদস্পন্দন দিগুন বেড়ে গেল তার। আলমির কিছু না বলে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

“আমার রুমে এক কাপ কফি নিয়ে এস। ৫ মিনিটের মধ্যে। পাঁচ মিনিট থেকে যেন এক সেকেন্ডও বেশি না হয়।”

কথাটি বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল আলমির। মেহরিমা সেখানে বসে থেকে বোকার মত তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে, করুন দৃষ্টিতে তাকাল দিলরুবা বেগম এর দিকে। দিলরুবা বেগম কোনরকম ভাবান্তর না দেখিয়ে চাপা গলায় বলল,

“দ্রুত ওর জন্য কফি নিয়ে যাও। নইলে তুমি কিন্তু জানো আমার দাদু ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে। কফি নিয়ে গিয়ে তাকে মানাও। সে হয়তো তোমাকে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার পার্মিশন দিতেও পারে।”

উনার কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলল না। সোজা খাবার ছেড়ে উঠে গেল কিচেনে। এক মগ কফি বানিয়ে নিয়ে এসে আবারও সামনে দাঁড়ালো। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বলল,

“প্লিজ আমার সাথে চল না মেহের। আমার একা একা স্যারের সামনে যেতে কেনো জানি না ভীষণ ভয় করছে।”

ওর কথা শুনে মেহের হা হা করে হাসতে লাগলো। একটু পর হাসি থামিয়ে বললো,

“আমি আমার বান্ধবীদের কাছে তোমার নামে কত প্রশংসা করি আপু। যে আমার আপু অনেক সাহসী। সে কোনো কিছু দেখেই ভয় পায় না। আজকে সব প্রশংসা জলে ডুবিয়ে দিলে তুমি। বলি আলমির ভাইয়া কি বাঘ না ভাল্লুক যে তাকে দেখে ভয় পাচ্ছো। আমার বা বা ভীষন ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। তুমি গিয়ে কফি দিয়ে আস।”

কথাটা বলেই টেবিল ছেড়ে উঠে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল মেহের। মেহরিমার ভীষন রাগ হতে লাগলো ওর উপর। পিচ্চি একটা মেয়ে, অথচ কথাগুলো এমন ভাবে বলে গেলো যে মেহরিমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। মেহরিমা আর সেখানে দাঁড়ালো না। এই মুহূর্তে দিদুনের চোখের দিকে তাকাতেও ভীষণ রকম লজ্জা লাগছে তার। তাই দ্রুত কফির মগটা হাতে নিয়ে উপরতলায় চলে গেল। আলমিরের রুমের দরজার সামনে গিয়ে থমকে গেল সে। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে আলমির বলে উঠলো,

“ভিতরে আসো দরজা খোলাই আছে।”

মেহরিমা দরজা ঠেলে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কফির মগটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এই নিন স্যার আপনার চা।”

আলমির ভ্রু কুচকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,

“আমি কি তোমাকে চা আনতে বলেছিলাম? এমনিতেই দুই মিনিট দেরি করে এসেছ। তার ওপর আবার চা নিয়ে চলে এসেছো। এবার বলো তোমায় কি শাস্তি,,!”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে মেহরিমা চট করে বলে উঠলো,

“সরি স্যার আমি আসলে কফি’ই নিয়ে এসেছি। তাড়াহুড়ায় ভুলবশত চা বলে ফেলেছি।”

আলমির এবার পিছনদিকে হেলান দিয়ে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে ইশারায় ওকে পাশে বসতে বলল। মেহরিমা মাথা নাড়িয়ে না করে দিয়ে বললো,

“বসবো না স্যার, আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। আমি এখন গিয়ে ঘুমাব। আপনি আপনার কফিটা নিন।”

আলমির ওর হাত থেকে কফির মগটা নেয়। তারপরে চুমুক দিয়ে একটু খেয়ে এমন ভাব করে যেন অনেক টেস্টি হয়েছে কফিটা। মেহরিমা সুযোগ বুঝে দৌড়ে চলে যেতে চাইলেই, পিছন থেকে ডাক দিয়ে ওকে আটকে দেয় আলমির।

“কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি? এখানে এসে দাঁড়াও।”

মেহরিমা গুটিগুটি পায়ে মাথা নিচু করে আবারও সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওড়নার সাথে নিজের হাত প্যাঁচাতে লাগল। আলমির ওর দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এই নাও তোমার resignation letter, তোমাকে এই চাকরি থেকে মুক্তি দেওয়া হল। তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দিলাম আমি।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৭
#M_Sonali

“এই নাও তোমার resignation letter, তোমাকে এই চাকরি থেকে মুক্তি দেওয়া হল। তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দিলাম আমি।”

আলমিরের কথায় যেন খুশিতে গদগদ হয়ে গেল মেহরিমা। সে খপ করে হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ভালো করে পড়ে নিল। তারপর খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। আমিতো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে চাকরিটা ছাড়তেই দিবেন না। কিন্তু আপনি তো অনেক ভালো। আমি কালকে সকালেই মেহেরকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যাব।”

কথাগুলো বলেই কাগজটা নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো। তখন’ই আলমির তাকে ডেকে বললো,

“কোথায় যাচ্ছো তুমি? আমি কি এখনই চলে যাওয়ার অর্ডার দিয়েছি তোমায়? এদিকে আসো।”

মেহেরিমা থমকে দাড়ালো। ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে গুটিগুটি পায়ে আবারও সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল,

“জ্বি স্যার বলুন, আবার কেন ডাকলেন?

আলমির আরো একটি কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এই নাও তোমার appointment letter. আগামি কাল সকাল আটটা থেকে নতুন চাকরিতে জয়েন করে নিবে।”

ওর এমন কথায় মেহরিমা যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে কাগজটা হাতে নিল। ওটা পরেই শুকনো ঢোক গিললো সে। তারপর আবারও আলমিরের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাল। দেখল সে বাঁকা হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেহরিমা কিছু বলবে তার আগেই সে সোফার সাথে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। তারপর বাকা হেসে বলতে লাগলো,

“তুমি কি ভেবেছো মিস মেহু। এত সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবে? এই যে এতদিন ধরে তোমার জন্য যে আমার এতগুলো টাকা গচ্ছা গেছে, সেগুলো কি আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো? আমার পরিপূর্ণ টাকা শোধ করার পরেই তুমি এখান থেকে যেতে পারবে। তার আগে নয়। আর বাসায় এভাবে শুয়ে বসে থাকলে তোমাকে কোন বেতন দেওয়া হতো না। তাই দিদুনের চাকরি থেকে রিজাইন দিয়ে, কাল থেকে তুমি আমার অফিসে জয়েন করবে। আমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে।”

মেহরিমার এবার নিজের চুলের মুঠি ধরে নিজের ই টানতে ইচ্ছে করছে। সে যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। যার থেকে পালাবে ভেবে এত কিছু করল। এখন যেন তার আরো কাছে আসার কাজ করে ফেলেছে সে। মেহরিমা করুন চোখে ওর দিকে তাকাল। করুন গলায় বলে উঠল,

“স্যার আপনি এমনটা করতে পারেন না। আমি আপনার কাজ করতে বাধ্য নই। প্লিজ আমাকে এই জব থেকে মুক্তি দেন। আমি এটা করতে পারবো না।”

আলমির কোন উত্তর দিল না। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একদম ওর সামনা সামনি এসে দাড়ালো। তারপর চাপা গলায় বললো,

“কিন্তু তোমাকে তো এই জবটা করতেই হবে। কারণ তুমি নিরুপায়। তুমি কি ভুলে গেছো তুমি কোমায় চলে যাওয়ার পর হসপিটাল এবং বাড়িতে আনার পর তোমার জন্য আমার অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে। প্রায় ১০ লাখেরও বেশি। সেই টাকাগুলো কে শোধ করবে হুম? যদি তুমি টাকাগুলো শোধ করে দিতে পারো তাহলে ঠিক আছে, যাও তোমাকে আর জবটা করতে হবে না। কিন্তু তুমি তো এতগুলো টাকা কখনোই দিতে পারবে না। তাই চাকরি করে তোমাকে টাকা শোধ করতে হবে। এবার তোমার ইচ্ছা। তুমি’ই ভাবো কি করবে। তবে হ্যাঁ চাকরিটা তোমাকে করতেই হবে। সেটা মাথায় রেখ।”

এই মুহূর্তে রাগে মেহরিমার ইচ্ছা করছে আলমির এর প্রত্যেকটি চুল টেনে টেনে ছিড়ে ফেলতে। ইচ্ছে মত কিল ঘুষি মেরে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে। সে ভীষণ রেগে গেল। আগুনের মত জ্বলে উঠে বললো,

“কি ভেবেছেন কি আপনি? আপনি যা বলবেন আমি তাই মেনে নেব? কখনোই না। সেদিন যদি আপনাকে বাঁচাতে না যেতাম, তাহলে গুলিটা আমার লাগতো না। আর আপনার এতগুলো টাকা খরচও হতো না। তাই আমি যেহেতু আপনাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খেয়েছি। সেজন্য আমার চিকিৎসা করাটা আপনার দায়ীত্ব ছিলো। তাই আমি আপনাকে কোন টাকা দিতে পারবোনা।”

কথাগুলো বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে, ওর হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এল আলমির। তারপর ওর হাতটা উল্টো করে ধরে বলল,

“আমি কি তোমাকে একবারের জন্যও বলেছিলাম যে, আমাকে বাঁচাতে এসো? আমার জন্য নিজে গুলি খাও? সেটা তুমি ইচ্ছা করে করেছো। আর যেহেতু ইচ্ছে করেই গুলিটা খেয়েছো, তাই তোমার জন্য টাকা খরচ করা আমার কোন দায়িত্ব ছিল না। তবুও আমি মানবতার খাতিরে সেটা করেছি। এখন সেই টাকা শোধ না করা অব্দি তুমি কোথাও যেতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ। এখন যাও কাল সকাল থেকে নতুন জব এ জয়েন করবে।”

কথাগুলো বলেই ওর হাত ছেড়ে দিল আলমির। মেহরিমা আর কিছু না বলে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে সেখান থেকে চলে গেল। ও চলে যেতেই আলমির মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো,

“এ কদিন অনেক আদর এবং ভালোবাসা দিয়ে তোমার কাছে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি ভালবাসা পেয়ে কাছে আসার মেয়ে নও। তাই এখন থেকে তোমাকে কিভাবে নিজের কাছে রাখতে হয়। সেটা আমি দেখে নেব। প্রস্তুত হও মিস মেহু, এবার দেখবে আলমিরের ভালবাসাময় জ্বালাতন। তোমার প্রতি আলমিরের দিওয়ানেগি।”
,
,
,
আলমিরের রুম থেকে নিজের রুমে এসে দেখে মেহের ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহরিমা সোজা গিয়ে বিছানার উপর ধপ করে বসে। রাগে যেন সারা শরীর জ্বলসে তার। হাতে থাকা কাগজ দুটি দেখে আর নিজের উপর নিজের রাগ হয় তার। মনে মনে নিজেকে বোকা দিয়ে বলে,

“কি দরকার ছিল ভাব দেখিয়ে এই চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলার। এখন কি হলো, যার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য এত কিছু করলাম। তার কাছেই সারাক্ষণ থাকতে হবে। কি কুলক্ষণেই যে চাকরিটা ছাড়ার কথা মাথায় এসেছিল, আল্লাহ জানে। এবার কি করবো আমি। কিভাবে রক্ষা পাবো ওই রাক্ষসটার হাত থেকে। সে কি বোঝে না তার আশেপাশে থাকলে আমার হার্টবিট বাড়তে থাকে। সব কাজ গুলিয়ে ফেলি আমি। এমনটা কেনো হয় সেটা নিজেও জানি না। তাই তো ওনার থেকে দূরে যেতে চাকরিটা ছাড়তে চেয়েছিলাম।”

না এভাবে বসে থেকে আর কাজ হবে না। তাই মেহরিমা উঠে দাঁড়ালো। কাগজ দুটি বালিশের পাশে রেখে কিচেনে চলে গেল। এই মুহূর্তে একটি আইসক্রিম খাওয়ার খুব দরকার। মাথাটা ঠান্ডা করতে হবে তাকে। তারপর চিন্তা করতে হবে কি করা যায়। তাই কিচেনে ফ্রিজের মধ্যে থেকে একটা আইসক্রিম বের করলো। সেটা নিয়ে আবারো নিজের রুমে ফিরে এসে আইসক্রিম খেতে খেতে ভাবতে লাগলো। কি করা যায়। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে এবার মুচকি হেসে মনে মনে বলল,

“কি ভেবেছেন মিস্টার আলমির? আপনি আমাকে যা বলবেন আমি তাই করব? একদম’ই না। কাল থেকে আপনার চাকরিতে জয়েন করব ঠিক’ই। কিন্তু আপনার কোনো কথাই মানবো না। এমন কাজ করব যে আপনি নিজে থেকেই আমাকে চাকরি ছেড়ে যেতে বলবেন। আপনার পুরো মাথাটা চিবিয়ে খাব আমি। দেখে নেবেন এই মেহরিমা কি করে।”

কথাগুলো ভেবে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে বিছানায় নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল মেহরিমা। তারপর রওনা দিলো ঘুমের দেশে।
,
,
সকাল আটটা ত্রিশ মিনিট,
সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়লেও, এখনো ঘুম থেকে উঠেনি মেহরিমা। নিজের রুম থেকেও বের হয়নি সে। আলমির তাকে সকাল আটটা থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে সাথে নিয়ে অফিসে যাবে বলে। কিন্তু তার যেন রুম থেকে বের হওয়ার নামই নেই। আলমির বেশ ভালোভাবেই জানে যে এটা সে ইচ্ছে করেই করছে। যেন তাকে ও নিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু আলমিরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে অফিসের জন্য রেডি হয়ে সোজা এসে হাজির হয় মেহরিমার রুমে। মেহের অনেক্ষন আগেই ঘুম থেকে উঠে দিদুনের কাছে চলে গেছে।

মেহেরিমা আলমির কে আসতে দেখেই দ্রুত শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান ধরে। যদিও সে এতক্ষণ জেগেই ছিল। আলমির ওর রুমে এসে দেখে ও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তবে ওর মুখ দেখে বুঝতে পারে ও আসলে ঘুমের অভিনয় করছে। আলমির বাকা হাসে, আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজে। দেখে টেবিলের উপর এক গ্লাস পানি রাখা। সে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে পুরো গ্লাসভর্তি পানি ঢেলে দেয় মেহরিমা মুখে। সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বসে মেহরিমা। দু চোখ কচলে রাগী গলায় বলে,

“কি করছেন কি আপনি এসব? এটা কোন ধরণের অসভ্যতা স্যার।”

আলমির উত্তর দেয় না। হাতে থাকা ঘড়ি টা একবার দেখে নিয়ে বলে,

“এখন সকাল ৮ টা ৪০ মিনিট। তোমাকে আমি দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মাঝে রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসো। নইলে এখন তো জাস্ট এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়েছি। এরপর তোমাকে পুরো পুকুরে ডুবাবো। মনে রেখো অনলি টেন মিনিটস।”

কথাটি বলেই রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায় আলমির। মেহরিমার যেন রাগে কান্না চলে আসে। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের উপরে কিছুক্ষণ রাগ ঝাড়ে। তারপর ওয়াশ রুমে চলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। কাপড়-চোপড় বদলিয়ে দ্রুত চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। গিয়ে দেখে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই মেহের বলে ওঠে,

“কি ব্যাপার আপু তুমি না বললে তুমি আজকে দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবে না। তাহলে এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে?”

মেহরিমা কোন উত্তর দেয় না। শুধু চোখ রাঙিয়ে একবার তাকায় আলমিরের দিকে। আলমির ওকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মত খাওয়া শুরু করে। এদিকে দিলরুবা বেগম মুখ টিপে হাসছে। কারণ সে তো সবকিছুই জানে। আলমির যা কিছু করছে সবকিছু তার সাথে পরামর্শ করেই করছে। সে মেহরিমা দিকে তাকিয়ে বলে,

“দিদিভাই আর দেরি করো না। তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নাও। তোমাদের অফিসে যাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মেহরিমা দিলরুবা বেগম এর পাশে বসে। তার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“প্লিজ দিদুন আমি এই জবটা করতে চাই না। আমি আগের মতো আপনার দেখাশোনা করবো। প্লিজ ওনাকে বলুন আমি চাকরিটা করতে চাইনা। আমার ভুল হয়ে গেছে।”

ওর কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কিছু বলার আগেই আলমির বলে ওঠে,

“এখন আর এসব কথা বলে লাভ নেই। এটা গতকাল ভাবা উচিত ছিল। আর আমি দিদুনের দেখাশোনার জন্য নতুন লোক রেখেছি। এখন কথা না বাড়িয়ে দ্রুত খেয়ে নাও। আমাদের এখনি বের হতে হবে।”

“হেই ব্রো কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”

হঠাৎ সরণের আগমনে সবাই ফিরে তাকায় তার দিকে। আলমিরের মুখটা মুহুর্তেই মেঘে ঢেকে যায়। রাগে জ্বলে ওঠে তার পুরোটা শরীর। কিন্তু সে সেটা বুঝতে দেয় না। খাবারের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়,

“আজ থেকে মেহরিমা আমার PA, তাই ওকে নিয়ে অফিসে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি এত সকাল-সকাল এখানে কি করছো?”

“ওয়াট, এসব তুমি কি বলছো ব্রো? মেহরিমা তোমার অফিসে তোমার PA হয়ে কাজ করবে মানে,,!

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে আলমির রাগী গলায় বলে উঠে,

“মেহরিমা তোমার খাওয়া হয়ে থাকলে দ্রুত গিয়ে রেডি হয়ে আসো। আমার কিন্তু একদম সময় নেই।”

কথাটি বলে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমার দিকে। সে আর কিছু বলার সাহস পায় না। মাথা নিচু করে উঠে যায় নিজের রুমে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে কিছুক্ষনের মাঝেই বেরিয়ে আসে। এদিকে সরণ একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে আলমির ও দিদুনকে। আলমির কিছু প্রশ্ন ইগনোর করছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

“স্যার আমি রেডি।”

কথাটা শুনেই আলমির ও সরণ দুজনে ফিরে তাকায় মেহরিমার দিকে। সাথে সাথে যেন দুজনেই থমকে যায় সেখানে। কালো রঙের একটি জরজেট এমব্রয়ডারী করা সালোয়ার-কামিজ পড়িয়েছে মেহরিমা। কপালে ছোট্ট করে একটি কালো টিপ পরেছে সে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিয়েছে। ওড়নাটা সুন্দর করে হিজাব বেঁধে নিয়েছে মাথায়। বা হাতে একটি সুন্দর লেডিস ঘড়ি পরেছে। তাকে দেখতে যেন অপরূপা লাগছে এই সাজে। আলমির কিছুক্ষণ তার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে সরণের দিকে ফিরে তাকায়। দেখে সরণ হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে ওকে। এতে যেন জ্বলে ওঠে আলমিরের শরীর। সে ওর সামনে দিয়ে দ্রুত হেটে গিয়ে মেহরিমার হাত ধরে বলে,

“আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। জলদি চলো।”

কথাটি বলেই ওর হাত ধরে দ্রুত হেঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সে। এদিকে সরণ যেনো বোকা বনে যায়। সে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের চলে যাওয়ার দিকে।
,
,
,
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_১৮
#M_Sonali

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে মেহরিমা ও আলমির। রাগে রক্ত লাল হয়ে আছে আলমিরের চোখ। সে জানালার বাইরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রাগ যেন মাথায় চড়ে বসেছে তার। ওর সাথে কথা বলার মত সাহস হচ্ছে না মেহরিমার। যদিও সে জানে আলমিরের রাগের কারণ সরণ। তবুও সে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না।

ওরা যে গাড়িতে আছে সেই গাড়ির সামনে এবং পিছনে আরো দুটি গাড়ি আসছে। আর সে গাড়ি দুটোতে আলমিরের গার্ডরা রয়েছে। মেহরিমার গুলি লাগার পর থেকে এভাবে গার্ডদের প্রটেকশনে চলাফেরা করে আলমির। কারণ ও জানে ওর চারিপাশে বিপদ লুকিয়ে আছে। যখন তখন হামলা হতে পারে ওর ওপর। যদিও মেহরিমার গুলি লাগার পর থেকে এখন অব্দি আর কোনো হামলা হয়নি। তবুও নিজেকে সবসময় প্রটেকশনে রাখার জন্য এই ব্যবস্থা।

দেখতে দেখতে একটি বিশাল বড় বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়ালো ওদের গাড়ি। গাড়ি থামতেই একজন গার্ড এসে আলমিরের পাশের গাড়ির দরজা খুলে দিলো। তারপর মেহরিমার পাশের দরজা খুলতে চাইলে সে ইশারায় মানা করলো। আলমির গাড়ি থেকে নেমে মেহরিমার পাশে এসে দরজা খুলে বললো,

“নেমে এসো, আমরা অফিসে চলে এসেছি।”

মেহরিমা ওর কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। আলমিরের এমনিতেই রাগ উঠেছিল। তাই সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা ওর হাত টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলো। তারপর টানতে টানতে সোজা নিয়ে গেল ভেতর দিকে। অফিসে সবাই আলমিরকে দেখে উঠে দাড়িয়ে “গুড মর্নিং স্যার” বলে সম্মোধন করতে লাগলো। কিন্তু ও কাউকে উত্তর না দিয়ে সোজা মহরিমাকে নিয়ে নিজের ডেস্কে চলে গেল। অফিসের সবাই হা করে বেকুবের মত তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

ডেস্কের এর ভিতরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল আলমির। সাথে সাথে মেহরিমা নিজের হাতটা ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে নিল। তারপর রাগী গলায় বলে উঠলো,

“আপনি কোন সাহসে আমার হাত ধরেছেন?এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসার মানে কি? আপনার কোন মান সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। আমি মোটেও চাইবো না কোনো পরপুরুষ আমার হাত ধরে সম্মান নষ্ট করুক।”

মেহরিমার কথা শেষ হতেই আলমির এমন ভাব করলো, যেন সে কিছু শুনতেই পায়নি। সে চুপচাপ গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পরলো। তারপর ইশারায় মেহরিমাকে চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বলল,

“আজ থেকে তুমি ঐ চেয়ারে বসবে। আর সারাক্ষণ আমার ডেস্কে আমার পাশাপাশি থাকবে। যাও গিয়ে নিজের জায়গায় বসো। অফিসে অতিরিক্ত কথা একদম পছন্দ করি না। যা বলার আছে বাসায় গিয়ে বলবে।”

মেহরিমা বুঝতে পারল এভাবে উনার উপর রাগ দেখিয়ে কাজ হবে না। কেননা তিনি এভাবে কথা শোনার মানুষ নয়। তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। দেখলো তার সামনে টেবিলের উপর রাখা বড় একটা ফুলের তোড়া। আর সেখানে একটি কার্ডে অনেক সুন্দর করে লেখা আছে, “ইউ ওয়েলকাম টু মাই অফিস মিস মেহু।”

মেহরিমা কার্ডটা হাতে নিয়ে একবার দেখল। তারপর সেটাকে আগের জায়গায় রেখে অন্য দিকে ঘুরে চুপচাপ বসে রইল। আলমির এতক্ষণ সবকিছুই লক্ষ্য করছিল। সে ভেবেছিলো মেহরিমা ফুল এবং কার্ড দেখে অনেক খুশি হবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে ভ্রু কুচকালো। একবার ভাবল ওকে ডাকবে কিন্তু কিছু একটা ভেবে চুপ করে নিজের কাজে মন দিল। এভাবে কেটে গেল বেশ অনেকটা সময়। আলমির এখন নিজের কাজে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। মেহরিমা চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে ভীষণ বোরিং হয়ে গেছে। তাই এদিক ওদিক দেখছে আর বার বার হাই তুলছে। আলমিরের ডেস্কটা অনেক বড়। বেশ সাজানো গোছানো ও পরিপাটি। ডেস্কের বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখা বা শোনা যায় না। তবে ভেতর থেকে বাইরের সবই দেখা যায় সিসিক্যামেরার মাদ্ধমে। যা আলমিরের সামনে হাতের বা পাশে একটি বড় কম্পিউটারে দেখা যাচ্ছে। সব কিছু বেশ তিক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করলো মেহরিমা।

কিন্তু না এভাবে আর বসে থাকা যায় না। এবার যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। তাই সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সরাসরি আলমিরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর জোরে একটা থাপ্পর মারল। থাপ্পরের শব্দ শুনে ধ্যান ভাঙলো আলমিরের। সে ল্যাপটপ এর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেহরিমা সময় বিলম্ব না করে রাগি গলায় বলে উঠলো,

“কি ভেবেছেন কি আপনি। আমাকে এখানে নিয়ে এসে সো পিচ এর মত সাজিয়ে রাখবেন। নাকি স্ট্যাচু বানিয়ে টাঙিয়ে রাখবেন? আসার পর থেকে চুপচাপ বসে আছি। না দিচ্ছেন কোনো কাজ, না দিচ্ছেন এখান থেকে কোথাও যেতে। অনেক বোরিং হয়ে গিয়েছি আমি। তার উপর অনেক বেশি ক্ষুধা লেগেছে। সকালে তো খাবার টাও খেতে দেননি। সরণকে দেখে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এসেছেন। জানিনা কোন জনমের শত্রুতা নিভাচ্ছেন আমার সাথে।”

ওর কথার উত্তরে আলমির কিছু বললোনা। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। হাতে একটি কলম নিয়ে ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে তিক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে রইল মেহরিমার দিকে। এতে মেহরিমার খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। সে নিজের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিল। তারপর থতমত করে বলল,

“কি দেখছেন কি এভাবে?”

আলমির মৃদু হাসল। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ওর সামনে এসে টেবিলের ওপর এক পা তুলে বসলো। তারপর বাঁকা হেসে বলল,

“দেখছি তোমাকে। আর ভাবছি তোমাকে এখন থেকে না খাইয়েই রাখবো। না মানে তুমি না খেয়ে থেকে রেগে গিয়ে কথা বললে তোমাকে দেখতে না একদম পেত্নীর মত লাগে। ছোটবেলা থেকেই পেত্নী দেখার খুব শখ ছিল আমার। তাই তোমার মাঝে পেত্নী দেখে শখটা পূরণ করে নিবো।”

“কি বললেন আপনি? আমি পেত্নী? পেত্নী কিন্তু ঘাড়ও মটকায় সেটা তো জানেন? এখন আমাকে খাবার না এনে দিয়ে বেশি কথা বলবেন তো ঘাড়ে কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খাব বলে দিলাম। ভীষণ খিদে পেয়েছে প্লিজ কোন খাবার অর্ডার করুন। আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না।”

কথাটি বলেই পেটে হাত দিয়ে চেয়ারের উপর বসে পড়ল মেহরিমা। আলমির মৃদু হাসলো। ওর কোন কথার উত্তর দিলো না। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে কাউকে ফোন করে খাবারের অর্ডার দিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই একজন খাবার নিয়ে এসে দরজায় টোকা দিল। আলমির গিয়ে দরজা খুলে তার কাছ থেকে খাবার নিয়ে এসে মেহরিমার সামনে রাখলো। আর বলল,

“এই নাও এবার মন ভরে খেয়ে নাও। তারপর আমার রক্ত খেও।”

মেহরিমা ওর কথার উত্তর দিল না। খাবারটা নিয়ে খেতে শুরু করলো। ভিষন রকম খিদে পেয়েছিল তার।
,
,
,
“দিদুন তুমি কিন্তু এখনও বললে না মেহরিমা কে হঠাৎ আলমির নিজের সাথে ওর অফিসে নিয়ে গেল কেন? ওকে তো তোমার দেখাশুনার জন্য রাখা হয়েছিল তাই না? তাহলে আলমিরের অফিসে কি করছে ও?”

বেশ গম্ভির গলায় কথাগুলা বলে থামলো সরণ। তার কথা শুনে দিদুন কিছু একটা ভাবলেন। তারপর চাপা গলায় বললেন,

“দেখো সরণ তুমি তো ছোটবেলা থেকেই আলমির কে চেন। তার যখন যেটা ঠিক মনে হয় সে সেটাই করে। আসলে ওর জন্য মেহরিমার গায়ে গুলি লেগেছিল। তাই সে মেহরিমার প্রটেকশনের জন্য সারাক্ষণ ওকে নিজের কাছাকাছি রাখতে চায়। এছাড়া আর কিছুই না। তাই মেহরিমাকে ও পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এতে তোমার রাগ হওয়ার কারণ কি? বারবার কেন জিজ্ঞেস করছো একই কথা?”

“এটা কেমন কথা হলো দিদুন? যেখানে আলমির এর জন্যই এর আগে মেহরিমার গায়ে গুলি লেগেছিল। তাহলে ও কিভাবে ভাবলো ওর সাথে মেহরিমা থাকলে সে সেভ থাকবে? বরং এমনও তো হতে পারে। ওর সাথে থাকার কারণে মেহরিমার আবার কোন ক্ষতি হল। এটা কিন্তু আলমির মোটেও ঠিক করেনি দিদুন। আমার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না বিষয় টা। প্লিজ তুমি ওকে ফোন করে বলো মেহরিমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে। ওর সাথে কথা আছে আমার।”

ওর এমন কথায় বেশ বিরক্ত হলেন দিলরুবা বেগম। তিনি অন্যদিকে ঘুরে বসে মুখটা গম্ভীর করে বললেন,

“দেখো দাদুভাই আমি তোমার সাথে এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলতে চাই না। তুমি এখন নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারো। আর এখানে থাকতে চাইলেও থাকতে পারো অসুবিধে নেই। কিন্তু আলমির যেটা করেছে সেটা ওর ভালোর জন্যই করেছে। আর এই কাজে আমারও মত ছিলো।”

সরণের বেশ রাগ হল দিলরুবা বেগমের কথায়। তবে সে রাগটা প্রকাশ করলো না। শুধু বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমি এখন আসছি।”

কথাটা বলেই দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে আলমিরের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হল সে।
,
,
খাওয়া শেষ করে একের পর এক ঢেকুর তুলে চলেছে মেহরিমা। সে আলমিরকে বিরক্ত করার জন্য যেন উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু ওর মাঝে কোন রকম ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। সে নিজের মত ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে একমনে। রুমের মধ্যে যে, সে ছাড়াও আর কেউ আছে, সেটা যেন ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না। মেহরিমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওর ল্যাপটপটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে একটি আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু সেটা সে তো করতে পারবে না। তাই মনে মনে একটা বুদ্ধি আটলো সে। তারপর দুষ্টু হেসে এগিয়ে গেল ওর কাছে। এদিক-ওদিক ঠাস ঠাস করে চড় মারতে মারতে বলতে লাগলো,

“ইশ রুমের মাঝে কি বড় বড় মশা। একেকটা যেন হেলিকপ্টারের সমান। বুঝিনা স্যারকে মশাগুলো কেন কামড়াচ্ছে না। স্যারের কি তবে গন্ডারের চামড়া? এই তো একটা মশা বসে আছে।”

বলতে বলতেই সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে দিল আলমিরের গালে। সাথে সাথে অগ্নিদৃষ্টিতে ফিরে তাকাল তার দিকে আলমির। মেহরিমা ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো,

“ইয়া আল্লাহ, কি করে ফেললাম আমি এটা? মজা করতে গিয়ে এভাবে স্যারের গালে থাপ্পর মেরে দেবো কখনো তো কল্পনাও করতে পারিনি। এবার কি হবে, স্যার তো আমাকে আস্ত গিলে খাবে। আল্লাহ আমাকে এই রাক্ষসটার হাত থেকে রক্ষা করো প্লিজ।”

মনে মনে কথাগুলো বলছে। আর ভয়ে চোখ বন্ধ করে হাতের মুঠো শক্ত করে রইলো সে। ওর অবস্থা দেখে আলমির সোজা এসে ওর সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো সে। মনে মনে ভাবলো,”মেয়েটা বড্ড বেশি ভয় পায় আমাকে। কিভাবে চোখ বন্ধ করে কাঁপছে দেখো। দাঁড়াও তোমার ভয় ভাঙানোর ব্যাবস্থা করছি।” কথাগুলো মনে মনে ভেবেই মৃদু হাসলো। তারপর আচমকা ই মেহরিমার কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিল। সাথে সাথে মেহরিমার কাপাকাপি থমকে গেল। সে একদম স্থির হয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার হৃদস্পন্দন থেমে গেল। তখনই দরজা খুলে প্রবেশ করল সরণ। আলমির আর মেহরিমাকে এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল সে। রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। চিৎকার করে “মেহরিমা” বলে ডেকে উঠলো সে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,