দিওয়ানেগি পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
438

#দিওয়ানেগি #পর্ব_২৮+২৯+৩০
#M_Sonali

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে মেহরিমা। একটু আগেই আলমির এর সাথে বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে তার। যদিও এই বিয়েতে মন থেকে রাজি

ছিল না মেহরিমা। সে কখনোই চায়নি এভাবে হঠাৎ করে জোরপূর্বক তার বিয়ে হোক। সে আলমিরকে ভালোবাসে এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এমন ভাবে বিয়েটা কখনোই আশা করেনি সে। চুপচাপ বসে থেকে কত শত চিন্তায় মগ্ন আছে সে। মা-বাবার কথা বড় বেশি মনে পরছে তার। আজ মা বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এই দিনটা দেখতে হতো না।

প্রতিটি মেয়েরই মনের মাঝে নিজের বিয়ে নিয়ে অনেক রকম স্বপ্ন থাকে। অনেক আশা নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু সেই স্বপ্নটা যেন মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেছে মেহরিমার। কিছুতেই তার মনটাকে শান্ত করতে পারছেনা সে। এভাবে বিয়েটা যেন কল্পনাতীত ছিল তার।

মেহরিমা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কান্না করে। তারপর চোখের জল মুছে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে, টেবিলের উপর থেকে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘড়ির টাইম দেখে। দেখে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা রেখে আবারো বিছানার উপর আসতে নেয় সে। তখনই মোবাইলটা টুংটাং শব্দে বেজে ওঠে। মেহরিমা ফিরে তাকায়। দেখে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠেছে একটি ম্যাসেজ। নাম্বারের জায়গায় unknown নাম্বার লেখা। মোবাইলটি হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে মেসেজ সিন করে সে। দেখে ম্যাসেজে লেখা আছে,

“congratulation mises almir.”

মেসেজটা দেখে বেশ অবাক হয় সে। তার জানা মতে বাড়ির সবাই ছাড়া আর কেউই জানেনা আলমিরের সাথে তার বিয়ের কথা। তাহলে কে এই ব্যক্তি যে তাকে মেসেজ দিল। আর ওর নাম্বার’ই বা পেল কোথায়? ব্যাপারটায় বেশ অবাক হয় সে। মনে মনে ভাবে আলমির হয়তো দুষ্টামি করছে তার সাথে। তাই ফোনটা কে রেখে আবারো বিছানার উপর যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই আবার টুংটাং শব্দ করে ওঠে ফোনটা। এবার সে বেশ বিরক্ত হয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। দেখে একই নাম্বার থেকে আরেকটি মেসেজ এসেছে। না চাওয়া সত্ত্বেও মেসেজটা সিন করে সে। সেখানে লেখা,

“সাবধান, সামনে অনেক বিপদ। সবার সহ নিজের সেফটিও বজায় রেখো।”

লেখাটা পড়তেই এবার বেশ চিন্তায় পড়ে যায় মেহরিমা। সে ভাবতে থাকে এভাবে কে তাকে আড়াল থেকে সাবধান করছে। আর কেনই বা এত সাবধানে থাকতে বলছে ওদের। তখনই আবারও ফোনটা বেজে ওঠে। সে দ্রুত মেসেজ সিন করতেই দেখে সেখানে লেখা,

“ম্যাসেজ গুলোর কথা কাউকে বলো না। পারলে ডিলিট করে দাও। মনে রেখো, আমি তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী।”

এবারকার মেসেজটা পড়ে যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেল মেহরিমা। সে ভাবতে লাগল, গিফট বক্স পাঠানো ওই লোকটি’ই নিশ্চয়ই এই লোক। যে মেসেজগুলো করছে। কিন্তু কে সে? কেন কোনো পরিচয় দিচ্ছে না নিজের। মেহরিমা যে কল দিবে বা মেসেজ দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে সে উপায়ও নেই। কারণ নাম্বারই তো নেই। তাহলে কল করবে কিভাবে।

“এই আপু এখানে দাঁড়িয়ে কী ভাবছো? তাড়াতাড়ি রেডি হও। চলো আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব। দুলাভাই বলেছে তোমাকে আর আমাকে নিয়ে এখন ঢাকা শহর ঘুরতে বের হবে।কি মজা হবে ভাবতেই আনন্দ লাগছে।”

লাফাতে লাফাতে এসে হাসিমুখে কথাগুলো বলে উঠলো মেহের। ওর কথায় ধ্যান ভাঙলো মেহরিমার। সে দ্রুত মেসেজটা সরিয়ে ফেলে ফোনটা লক করে দিল। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এত রাতে ঢাকা শহর ঘুরতে যাবি মানে? আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুইও কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে এসে চুপচাপ শুয়ে পর। আমার ভীষন ঘুম পেয়েছে।”

কথাটি বলে সামনে দু পা এগিয়ে যেতেই আলমির এসে সামনে দাঁড়ালো ওর। তারপর আবেগি গলায় ফিসফিস করে বললো,

“আজকে রাতে কেউ ঘুমায় নাকি। পাগল মেয়ে। তুমি কি ভুলে গেছো আজকে আমাদের বাসর রাত। এবার কথা না বাড়িয়ে কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে সিম্পল কিছু পড়ে নাও। চলো আজ আমরা পুরো ঢাকা শহর ঘুরে আসবো। মনটা যেন হালকা হয় তোমার। আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করে আছো। বাইরের ঠান্ডা বাতাস খেলে সব রাগ ভেঙ্গে যাবে।”

ওর কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলবে তার আগেই মেহের আবেদন করে বলল,

” প্লিজ আপু মানা করো না। তাড়াতাড়ি রেডি হও চলো। কতদিন হলো কোথাও ঘুরতে যাই না। আজ দুলাভাই আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে তাও আবার রাতের বেলা। ভাবতেই কতটা এক্সাইটিং লাগছে বলতো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

মেহেরের এমন আকুতি-মিনতি শুনে মেহরিমা আর মানা করতে পারলো না। ফোনের ম্যাসেজের কথা ভুলেই গেল সে। না চাওয়া সত্ত্বেও চলে গেল চেঞ্জ করার জন্য। ও চলে যেতেই আলমির মুচকি হেসে মেহেরের গাল টিপে দিয়ে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ, আমার বউটাকে রাজি করানোর জন্য। মাই ডিয়ার কিউটি শালিকা।”

কথাটি বলেই সে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। মেহেরও একগাল হেসে দিয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করার জন্য চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো তারা। দিদুনের থেকে অনুমতি নিয়ে দিদুনকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পরলো তারা। দুই গাড়ি গার্ড সাথে নিলো সেফটির জন্য। গার্ডদের গাড়ির মাঝখানে ওদের গাড়ি রেখে ঢাকা শহর ঘুরতে বের হলো।

ঢাকা শহরের সবচাইতে সুন্দর সুন্দর জায়গা গুলো দিয়ে ঘুরতে লাগল তারা। এভাবে কেটে গেল প্রায় একঘন্টা। একসময় গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে মেহের বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,

“দুলাভাই এভাবে গাড়িতে বসে ঘুরতে আর ভালো লাগছে না। চলো না কোথাও গিয়ে কিছু একটা খাই। আমার ভীষণ ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে।”

ওর কথার উত্তরে আলমির মুচকি হাসলো। বললো,

“ঠিক আছে, চলো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”

মেহরিমা কিচ্ছু বলছে না। আসার পর থেকে চুপচাপ গাড়িতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। গাড়ির প্রতিটি জানালার কাঁচ লাগিয়ে দেওয়া। হয়তো সেফটির জন্য লাগিয়ে রেখেছে। তাই সে আর খুলে দিতে বলেনি। তারওপর মনে মনে বেশ ভয়ও পাচ্ছে মেহরিমা। তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আশেপাশে কোনো বিপদ আছে। তারওপর এখন মেহেরের এমন আবদার শুনে সে বেশ বিরক্ত হলো। সে মেহেরের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“কোথাও যেতে হবে না। আমরা সোজা বাসায় যাব। এত রাতে কোথাও যাওয়া ঠিক হবেনা।”

কিন্তু মেহের যেনো নাছোড়বান্দা। সে তো ফুচকা খাবেই খাবে। আলমির মেহরিমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, কিছু হবে না তারা যথেষ্ট সেফটির সাথেই রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে।
যে কথা সেই কাজ। বিশাল বড় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। আলমির গাড়ি থেকে প্রথমে নেমে তারপর মেহরিমা আর মেহেরের পাশের গাড়ির দরজা নিজে হাতে খুলে দিল। মেহের রেস্টুরেন্ট এর দিকে তাকিয়ে গোমড়া মুখে বলল,

“দুলাভাই এখানে কি ফুচকা পাওয়া যাবে?”

ওর কথায় আলমির মুচকি হেসে বলল,

“মাই ডিয়ার শালিকা এখানে হয়তো ফুচকা পাওয়া যাবেনা। কিন্তু তার চাইতেও ভালো কিছু পাবে। চলো তোমার ইচ্ছামত তোমাকে খাওয়াবো আজ।”

ওর কথা শুনে মেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তারপর আর দেরি না করে ওদের নিয়ে ও গার্ডদের কে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে গেল আলমির। তারা একটি আলাদা রুমে গিয়ে বসলো। যেখানে শুধু ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। আলমির মেহেরকে বললো ইচ্ছে মত খাবার অর্ডার দিতে। মেহের খুশিতে নাচতে নাচতে একের পর এক খাবার অর্ডার দিতে লাগল। আলমির লক্ষ করলো মেহরিমা বেশ কিছুক্ষণ হলো কেমন উসখুশ করছে। ওকে এভাবে অস্বস্তিতে থাকতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

“কি হয়েছে মেহু! তুমি এমন করছ কেন? এনি প্রবলেম?”

মেহরিমা মাথা নিচু করে, নিচু স্বরে বলল,

“আসলে আমি একটু ওয়াশ রুমে যেতে চাই।”

আলমির মৃদু হাসলো। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“এসো আমার সাথে।”

ওকে নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে যাওয়ার সময় মেহেরকে বলে গেল এখানে চুপচাপ বসে খেতে। সাথে গার্ডদের বলে গেল ওর দিকে খেয়াল রাখতে। মেহরিমাকে নিয়ে ওয়াশ রুমের সামনে চলে গেল সে। তাকে দুষ্টুমির স্বরে বলল,

“ভিতরে কি তুমি একাই যেতে পারবে! নাকি আমিও সাথে আসবো? ভয় পেলে বলো আমি সাথে আসছি।”

মেহরিমা চোখরাঙালো। ওর চোখ রাঙানি দেখে মুচকি হেসে আলমির বলল,

“ঠিক আছে আমার যেতে হবে না। আমি এখানে দাঁড়িয়েই বউকে পাহারা দিচ্ছি।”

মেহরিমা আর কিছু বলল না। বেশ লজ্জা পেয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে। ওয়াশরুমে নিজের কাজ শেষ করে হাত মুখ ধোয়ার সময় হঠাৎ মেহরিমা লক্ষ্য করলো। আয়নার সামনে একটি ভাজ করা কাগজ রাখা। যার ওপরে ইংরেজিতে for Mehrima লেখা।

কাগজটা দেখে বেশ অবাক হলো মেহরিমা। সে এবার পুরো ওয়াশরুম টা ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। এখানে সে ছাড়া আর কেউ আছে কিনা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সেখানে আর কেউ নেই। সে চিন্তায় পরে গেলো যে কাগজটা হাতে নেবে কি নেবে না। ভাবতে ভাবতেই হাতে তুলে নিল কাগজটা। খুলে দেখল তার মাঝে লেখা,

“রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে সাবধান। শত্রুর অভাব নেই। খাবারে বিষ থাকলেও থাকতে পারে।”

লেখাটুকু পড়তেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। মেহেরকে খাবার খেতে দেখে এসেছে সে। সে দ্রুত কাগজটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পরলো। আলমিরকে কিছু না বলে দৌড়ে চলে গেল মেহেরের কাছে। গিয়ে দেখল সে চুপচাপ করে বসে খাবার খাচ্ছে। ওকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে আলমির বেশ অবাক হল। ওকে ডাকতে ডাকতে পিছুপিছু এসে বেশ রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“এখানে এভাবে আসার মানে কি মেহরিমা? তুমি জানো তোমায় এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে আমি কতটা ঘাবড়ে গেছি। কি হয়েছে এভাবে দৌড়ে এলে কেন?”

মেহরিমা উত্তর দেয়না। হাতে থাকা কাগজটা আলমিরের দিকে বাড়িয়ে দেয় সে। তার শরীর যেন এখনও কাঁপছে ভয়ে। মেহেরের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে সে। মেহেরও খাওয়া বাদ দিয়ে ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলমির কাগজটা হাতে নিয়ে ভেতরে লেখাটা পড়তেই দ্রুত ফিরে তাকায় মেহেরের দিকে। ছুটে এসে ওর সামনে থাকা খাবারের প্লেটটা দূরে সরিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে,

“মেহের তোমার কি কোনো রকম খারাপ লাগছে? খাবার খাওয়ার পর? সত্যি করে বল।”

মেহের বেশ অবাক হয় সেইসাথে বিরক্তি নিয়ে বলে,

“কি হয়েছে দুলাভা?ই আমি তো একদম ঠিক আছি তোমাদের সামনে। তাহলে এমন প্রশ্ন করছো কেন? আর আপু কি হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন হঠাৎ।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_২৯
#M_Sonali

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এবং সকল স্টাফদের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে একের পর এক জেরা করে যাচ্ছে আলমির। কেউই বলতে পারছে না ওই চিরকুটটা ওয়াশরুমে কোথা থেকে এলো। ওদিকে মেহের একদম সুস্থ স্বাভাবিক আছে খাবার খাওয়ার পরেও। তার কিছুই হয়নি। কিন্তু ওই চিরকুট টা কে রেখে গেছে সেটা আজ বের করেই ছাড়বে আলমির। যেভাবেই হোক তাকে জানতেই হবে কে তাদের এভাবে পদে-পদে সতর্ক করছে আড়ালে থেকে। সে কি সত্যিই তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, নাকি সে’ই আসলে তাদের গোপন শত্রু।

“স্যার আমাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। রাত অনেক হয়ে গেছে দয়া করে আপনি এখন আসতে পারেন। রেস্টুরেন্ট বন্ধ করতে হবে। আর আমরা সত্যিই জানি না ওই চিরকুট টা ওখানে কি করে গেল। প্লিজ আপনি আমাদের কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন।”

কথাগুলো বেশ ভয়ার্ত গলায় বলল ম্যানেজার। সে অনেকক্ষণ হলো আলমিরের জেরার উপর আছে। ওনার কথা শুনে আলমির যেন আরও রেগে গেলো। হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

“কেমন দায়িত্বশীল ম্যানেজার ও কর্মচারী আপনারা। রেস্টুরেন্টে কে এলো কে গেলো, কে কোথায় কী করল, সেগুলো যদি না জানেন কোন দায়িত্ব থেকে ম্যানেজার হয়েছেন আপনি। আপনি জানেন আমি চাইলে এই মুহূর্তে আপনাদের রেস্টুরেন্ট সিলগালা করে দিতে পারি। কোন কিছু শুনতে চাই না। যতক্ষণ না জানতে পারছি ওই চিরকুট ওখানে কি করে এলো ততক্ষণ এখান থেকে যাচ্ছি না। আর না আপনি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করতে পারবেন। যা করার জলদি করুন।”

কথাগুলো বলতে বলতে এদিক ওদিক তাকালো আলমির। হঠাৎ করে তার চোখ গেলো সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে। সে দেখলো রেস্টুরেন্টের কোনায় কোনায় অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। ওয়াশ রুমের সামনেও একটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। যেটা থেকে ওয়াশরুমে কে যাচ্ছে এবং কে বের হচ্ছে সব কিছুই রেকর্ড করা হচ্ছে। আলমির আর দেরি করলো না। ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলে উঠলো,

“আমি বুঝতে পারছিনা আপনাদের মত বেকুপ মানুষকে কিভাবে এত বড় একটা রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব দিয়ে ম্যানেজার রাখা হয়েছে। যার কিনা বিন্দুমাত্র কমনসেন্স মাত্র নেই। ওইখানে ক্যামেরা লাগানো দেখতে পাচ্ছেন? ওইটার ফুটেজ নিশ্চয়ই আছে? যত দ্রুত সম্ভব সেই ফুটেজগুলো আমাকে এনে দিন। রেকর্ডে দেখতে চাই ওয়াশরুম শেষবার কে ঢুকেছিল।”

ওর কথার উত্তরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো ম্যানেজার। তারপর দ্রুত হেঁটে চলে গেল ওই সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বের করতে। আলমির নিজে হাতে কম্পিউটার সামনে নিয়ে একে একে চেক করতে লাগল ফুটেজগুলো। দেখতে লাগল তারা এখানে আসার আগে সর্বশেষ কে এসেছিল। আর কেইবা শেষবার ঐ ওয়াশরুমে গিয়েছিল। চেক করতে করতে একটা জিনিস দেখে ভীষণ রাগ উঠে গেল আলমিরের। সে দেখল তারা আসার আগের ১৫ মিনিটের ভিডিও ফুটেজ শুধু অন্ধকার হয়ে রয়েছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না সেটা তে। বোঝাই যাচ্ছে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ ১৫ মিনিটের দৃশ্য ডিলিট করে দিয়েছে।

টেবিলের ওপর স্বজোরে একটা ঘুষি মেরে ম্যানেজারের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকালো আলমির। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“এসবের মানে কি? এই কম্পিউটারের দায়িত্বে কে রয়েছে? ডাকুন তাকে। এখানে ১৫ মিনিটের ভিডিও ডিলিট কেনো? ঐ ভিডিও আমার চাই। যেভাবেই হোক চাই ওটা। কম্পিউটারের দায়িত্বে যে রয়েছে তাকে এই মুহূর্তে ডাকুন।”

ওর কথার উত্তরে ম্যানেজার কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একটি লোক মাথা নীচু করে বলে উঠলো,

“স্যার এটার দায়িত্বে আমি রয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ১৫ মিনিটের ভিডিও আমি ডিলিট করিনি। এটা কিভাবে ডিলিট হল আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। মনে হয় আমি যখন কিছুক্ষণের জন্য ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম তখনই কেউ এই কাজটা করেছে
সরি স্যার।”

আলমিরের মাথায় যেন আগুন ধরে গেল রাগে। তার ইচ্ছা করছে এলোপাথাড়ি ম্যানেজার এবং এই লোকটিকে মারতে। কিন্তু সে তা করলো না। টেবিলের উপরে ঘুষি মেরে উঠে দাঁড়ালো। কিছু একটা ভেবে ম্যানেজার ও ঐ লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,

“রেস্টুরেন্টের দায়িত্ব যদি ঠিকমতো পালন করতে না পারেন। তাহলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসায় চুড়ি পরে বসে থাকবেন।”

কথাগুলো বলে আর দেরি না করে সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো সে। তারপর গাড়ি করে রওনা দিল বাসার উদ্দেশ্যে। যেন এখন তার মাথায় আগুন জ্বলছে। মেহরিমা আর মেহের কিছু বলছে না। ওরা আলমিরকে এমন রাগ করতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে। তাই অনেকক্ষণ আগেই একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে দুজন। কোন রকম কথা বলার সাহস নেই তাদের মাঝে।

গাড়ি করে এসে বাসার কাছাকাছি পৌঁছাতেই, হঠাৎ চারিদিক থেকে গুলি আসতে থাকে। ওদের গাড়িতে এলোপাথারি গুলি করছে কেউ চারিদিক থেকে। মেহরিমা এবং মেহের দুজনেই ভীষণ রকম ভাবে ভয় পেয়ে যায়। মেহের ভয়ে মেহরিমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে। কিন্তু এত এত গুলি আসা সত্বেও গাড়িতে কোনরকম ক্ষতি হয় না। আলমির সবাইকে চিৎকার করে বলে গাড়ি থেকে বাইরে বের না হতে। সে গাড়ির মাঝে থেকেই বাইরে দেখার চেষ্টা করে কারা গুলি করছে। কিন্তু অন্ধকারে কাউকেই দেখতে পায় না সে। তিনটি গাড়িতেই বুলেটপ্রুফ কাঁচ লাগানো থাকায় কোনো রকম ক্ষতি হয় না কারো। এভাবে বেশ কিছুক্ষন চলার পর চারিদিকে শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু সকলের মাঝে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজমান। আলমির সবাইকে সোজা বাসায় যাওয়ার জন্য হুকুম দেয়।
,
,
,
রাত ৩:০৫ মিনিট
মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে মেহরিমা। পাশেই ঘুমিয়ে আছে মেহের। মেহরিমা কিছুতেই আজকের ঘটনাগুলো ভুলতে পারছে না। সারাদিনের প্রতিটা ঘটনা যেন কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। সরণ এর বিয়ের প্রস্তাব থেকে শুরু করে আলমিরের সাথে বিয়ে, ফোনে আসা ম্যাসেজ, রেস্টুরেন্টে পাওয়া চিরকুট ও রাস্তায় হওয়া আক্রমণ সবকিছুই যেনো ভিষন রকম ভাবাচ্ছে তাকে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না তারা কারা, যারা এভাবে ওদের পিছনে পড়ে আছে। আলমিরকে খুন করার জন্য। আর কেনই বা খুন করতে চাইছে ওকে।

আজ যেখানে নিজের ভালবাসার মানুষটার সাথে তার বাসর রাত ছিল। এই রাতটিকে ঘিরে প্রতিটি মেয়ের কত স্বপ্ন কত আশা সাজানো থাকে। কিন্তু আজ যেন নানারকম টেনশন ঘিরে রেখেছে তাদের। তারা বিবাহিত হওয়া সত্বেও দুজন দুই রুমে শুয়ে আছে। তাদের মাঝে টেনশন ছাড়া আর কিছুই কাজ করছেনা। মেহরিমা একবার ভাবে সে উঠে আলমিরের কাছে যাবে। ম্যাসেজের সম্পর্কে বিস্তারিত বলবে ওকে। কিন্তু আবারও কিছু একটা ভেবে সে থেমে যায়। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ফোনটি পাশে রেখে চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
,
,
সকাল ৯:২৫ মিনিট,
খাবার টেবিলে বসে আছে সবাই। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। দিলরুবা বেগম অনেকক্ষণ হলো খেয়াল করছেন আলমির এবং মেহরিমা শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে। কিন্তু খাবার মুখে দিচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। তাই তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন,

“কি ব্যাপার দাদুভাই, তুমি খাওয়া ছেড়ে এভাবে কি এত ভাবছো? কখন থেকে দেখছি খাবার সামনে রেখে অন্য খেয়ালে হাড়িয়ে গেছো। মেহরিমা কেও দেখছি একই অবস্থা। কাল তো তোমাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু সকালে দেখলাম দুজন দুই রুমে ঘুমিয়েছো। কি হয়েছে বলতো?”

উনার কথার উত্তরে আলমির বা মেহরিমা কিছু বলার আগেই মেহের বলে উঠল,

“তোমাকে আমি বলছি কি হয়েছে। কালকে রাতে আমরা বের হয়েছিলাম না। তখন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে আপু একটি চিরকুট পেয়েছিল। আর বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় কারা যেন বৃষ্টির মত গুলি করেছিল আমাদের গাড়িতে। জানো দিদুন একটুর জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি আমরা। নইলে সবাই মারা যেতাম।”

ওর কথা শুনে যেন ভয়ে আতকে উঠলেন দিলরুবা বেগম। বড় বড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আলমিরের দিকে। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী বলছে ও আলমির! সত্যি কি কালকে রাতে এমনটা হয়েছিল? কারা গুলি করেছিল তোমাদের উপর? তোমরা সবাই ঠিক আছে তো।”

আলমির বেশ বিরক্ত হল। মেহেরের দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলল,

“উফ মেহের তুমি জাননা বড়দের মধ্যে কথা বলতে নেই। তোমাকে এখন কে বলেছে গত রাতের কথা এখানে বলতে। আর দিদুন তুমিও না পাগলের মতো কথা বলো। তুমি তো দেখতে পাচ্ছ আমরা একদম সুস্থ শরীরে তোমার সামনে বসে আছি। কিছুই হয়নি আমাদের। কাল রাতে যেটা হয়েছে সেটা আমি অবশ্যই বের করব। তুমি এটা নিয়ে চিন্তা করো না।”

ওর কথার উত্তরে মেহের মাথা নিচু করে ফেলল। সে আর কিছু বলল না। দিলরুবা বেগম একটু ধমক দিয়ে বললেন,

“ওকে বকছো কেন? ও তো ঠিকই বলেছে। মেয়েটি ভয় পেয়েছে কালকে রাতের অবস্থা দেখে। আর তাছাড়া আমি পাগলের মত কিছুই বলছি না। তোমাদের এখন যতটা সম্ভব সাবধানে থাকা উচিত। দু-দুবার এত বড় অ্যাটাক হওয়ার পরেও কেন সাবধানতা অবলম্বন করছো না তুমি আলমির। তুমি জানো তোমাকে নিয়ে কতটা টেনশনে থাকতে হয় আমাকে সারাক্ষণ। জানিনা জীবনে কি ভুল করেছিলাম। যার খেসারত এভাবে দিতে হচ্ছে। কে সেই গোপন শত্রু যে আড়ালে থেকে এভাবে তোমাদের পিছনে পড়ে আছে। আমার আর ভাল লাগে না। এভাবে ভয় আতঙ্কে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই হয়তো ভালো ছিল।”

” প্লিজ দিদুন তুমি অন্তত এভাবে কথা বলো না। তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি এসব নিয়ে কতটা টেনশনে রয়েছি। তার ওপর তুমি যদি এমন কথা বল, তাহলে কি করে চলবে। যেভাবেই হোক আমি খুজে বের করব কারা সেই শত্রু। যারা এভাবে আমাদের পিছু পড়ে আছে। অলরেডী লোক লাগিয়ে দিয়েছি আমি চারিদিকে। তুমি টেনশন করো না। এবার এর শেষ আমি দেখেই ছাড়বো।”

কথাটি বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে সোজা নিজের রুমে চলে যায় আলমির। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ রকম রেগে আছে সে। দিলরুবা বেগম আর কিছু বলেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচের দিকে তাকান তিনি।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩০
#M_Sonali

ড্রইংরুমে সোফার উপর বসে আছে মেহরিমা। পাশেই বসে আছেন দিলরুবা বেগম। দুজনে টুকিটাকি কথা বলছে বসে বসে। পাশে সোফার উপর বসে হোমওয়ার্ক করছে মেহের। আর কিছুক্ষণ পর পর ফিরে তাকাচ্ছে দিলরুবা বেগম এবং মেহরিমার দিকে। হঠাৎ দরজা দিয়ে কারো ভেতরে আসার শব্দে সবাই সে দিকে ফিরে তাকায়। দেখে সরণ এবং তার মা এসেছে। দুজনের মুখে মুচকি হাঁসি। সরনের মা সালমা বেগম দিলরুবা বেগমকে সালাম করে পাশে সোফার উপর বসে। মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“কি করছো হোমওয়ার্ক নাকি?”

মেহের ভীষণ বিরক্ত হলো। কিন্তু বিরক্তি না দেখিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,

“জ্বি আন্টি হোমওয়ার্ক করছি।”

কথাটি বলেই বই-খাতা তুলে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল সে। ও চলে যেতেই সরণ সালমা বেগমের পাশে এসে বসলো। দিলরুবা বেগম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি ব্যাপার সালমা, তোমরা এসময়? কিছু না জানিয়ে এলে যে? কোনো দরকারে এসেছ নাকি?”

উনার কথার উত্তরে এক গাল হাসলেন সালমা বেগম। তারপর বললেন,

“হ্যাঁ আন্টি আপনি তো জানেন কিছুদিন পরে আমার সরণ এর সাথে মেহরিমার বিয়ে। আর বিয়েতে বেশিদিন সময়ও নেই। তাই আমি চাই আমার ছেলের বিয়েতে যেন কোন রকম কমতি না থাকে। তাই বিয়ের শপিংয়ের জন্য আমরা মেহরিমাকে নিতে এসেছি। আপনি অনুমতি দি….!”

এতোটুকু বলতেই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে দিলরুবা বেগম গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,

“আলমিরের সাথে মেহরিমার গতকাল রাত্রে বিয়ে হয়ে গেছে। তাই এসব চিন্তা তোমরা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো সালমা। মেহরিমা এখুন এবাড়ির বউ।”

কথাটি যেনো বজ্রপাতের মতো গিয়ে লাগলো সালমা বেগম এবং সরনের গায়ে। তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে অবাক হয়ে দিলরুবা বেগম কে বললো,

“এসব আপনি কি বলছেন আন্টি? আলমিরের সাথে মেহরিমার বিয়ে?”

“আমি যা বলছি ঠিক বলছি। তোমরা ঠিক’ই শুনেছ। গতকাল রাতে আলমিরের সাথে মেহরিমার বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা দুজন দুজনকে আগে থেকেই পছন্দ করতো। ভালোবাসতো। সেটা তোমার ছেলেকেও মেহরিমা বলেছিল। কিন্তু তোমার ছেলেতো নাছোড়বান্দা। তাই বাধ্য হয়েই কালকে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করেছে ওরা।”

কথাগুলো বলে থামতেই সালমা বেগম গর্জে উঠে দাঁড়ালেন। রাগি গলায় বললেন,

“ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে এ কথাটা আমাদের আগে বলতে পারতেন! আপনি নিশ্চয়ই সব কিছুই জানতেন আন্টি! এভাবে নাটক করার কোন মানে হয় না। আমার একমাত্র ছেলের বিয়ের প্রায় সব আয়োজনই করতে শুরু করেছি আমরা। আর আপনি এতক্ষণে বলছেন আপনাদের এ কথা। আপনার কাছ থেকে অন্তত এটা আশা করিনি আন্টি।”

“গলা নামিয়ে কথা বল সালমা। ভুলে যেও না তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো। ফিরোজ আমার ছেলের মত, তাই তোমাকেও আমি মেয়ের মত ভালবাসি। তাই বলছি এমন কিছু বলো না যার কারণে আমাদের সাথে তোমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়। আমি যদি আগে থেকে এসব জানতাম তাহলে অবশ্যই তোমাদের বলতাম। আমিও এটা কালকে রাত্রে জেনেছি। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। আর তাছাড়া যেহেতু মেহরিমা তোমার ছেলেকে ভালোই বাসে না। তাহলে এত কথা বলার কি আছে। ওর কথা ভুলে যাও তোমরা।”

উনার কথার উত্তরে সালমা বেগম কিছু বলতে গেলেই সরণ তাকে থামিয়ে দিলো। তারপর চোখ দিয়ে ইশারা করে থামতে বলে বলল,

“সরি দিদুন, আসলে আমারই ভুল হয়েছে। আমার বোঝা উচিত ছিল যে আলমির আর মেহরিমা সারাক্ষণ একসাথে থাকে। তাই ওদের দুজনের মাঝে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। সরি মেহরিমা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আলমিরের সাথে আমি ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছি। ও শুধু আমার বন্ধুই না আমার ভাইয়ের মত। তাই ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসার বিনিময়ে আমি তোমাকে পেতে চাই না। তুমি বরং আলমিরের হয়ে থাকো। আমি তোমাদের দুজনকে বন্ধু হিসেবে ভালবেসে যাব সারা জীবন।”

মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে মৃদু গলায় কথাগুলো বলল সরণ। ওর কথা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন দিলরুবা বেগম এবং মেহরিমা। মেহরিমা মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ সরণ, আমাকে বোঝার জন্য। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সত্যিই আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাদের বিয়ের কথা জানার পর হয়ত সিনক্রিয়েট করবেন। অনেক ভয়ে ছিলাম। আমি কখনোই চাইনি আমার জন্যে আপনাদের সাথে এবাড়ির সম্পর্কটা নষ্ট হোক। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ সরণ। সত্যিই আপনি অনেক ভালো মনের মানুষ।”

ওর কথার উত্তরে সরণ কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নিচের দিকে দিয়ে মুচকি হাসল। তারপর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“বাসায় চলো আম্মু। আমার একটি জরুরি কাজ আছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। পরে একসময় আসবো কেমন।”

কথাটি বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সালমা বেগমের হাত ধরে একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলো সে। কেন জানেনা সরনের কথাগুলো শুনে বেশ খারাপ লাগলো মেহরিমার। সরণ হয়তো সত্যিই তাকে অনেক ভালোবেসে ছিল। কিন্তু মেহরিমা’ই বা কি করবে। সে তো আলমিরকে ভালোবাসে। আর তার সাথে ওর বিয়েও হয়েছে। মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফায় বসে থাকে। দিলরুবা বেগম ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে উঠলো,

“আসলে ভালোবাসা জিনিসটা বড় কঠিন জিনিস। এটা যার প্রতি একবার চলে আসে তাকে কখনোই মন থেকে ভোলা যায় না। সরণ হয়তো সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবেসে ছিলো। কিন্তু কিছুই করার নেই। তুমি ওর ভাগ্যে নেই। এখন শুধু দোয়া করো ও যেনো তোমার চাইতেও বেটার কাউকে পায়।”

উনার কথার উত্তরে মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,

“আমিন”
,
,
,
সকাল গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। এখনো বাসায় ফেরেনি আলমির। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বলে গিয়েছে জরুরি কোনো কাজে অনেক দূরে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ খবর নেই। মেহরিমার বারবার ইচ্ছে করছে ফোন করে তার খবর নিতে। কিন্তু লজ্জায় ফোন করারও সাহস পাচ্ছে না সে। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাদের। এখন এভাবে ফোন দেওয়াটা নিজের কাছে কেমন যেন লজ্জাজনক মনে হচ্ছে তার।

ফোনটা হাতে নিয়ে এসব কথাই ভাবছিলো মেহরিমা। হঠাৎ টুংটুং শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল মেহরিমার। আলমির ফোন করেছে। সে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,

“হ্যালো, কোথায় আছেন আপনি? সেই সকালে গিয়েছেন এখনো কেন আসলেন না বাসায়?”

কথাটা বলে যেন নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল সে। দ্রুত জিভে কামড় দিয়ে চুপ করে রইলো লজ্জায়। ওই পাশ থেকে কিছুক্ষণ নিরবতা দেখা গেল। তারপর আলমির আদুরে গলায় বলে উঠলো,

“৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে থাকো। আমি আসছি, তোমাকে নিয়ে শপিং করতে যাব।”

কথাটি বলেই ফোনটা কেটে দিলো আলমির। মেহরিমা কিছু বললো না। ভীষণ রকম লজ্জা পেয়ে গিয়েছে সে। ফোনটার দিকে একবার তাকিয়ে মনে মনে খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তারপর ফোনটা টেবিলে রেখে রেডি হতে চলে গেল।
,
,
বিশাল বড় এক শপিং মলে শপিং করতে এসেছে আলমির ও মেহরিমা। ওদের সাথে অনেকগুলো গার্ডও এসেছে। যারা চারিপাশে ওদেরকে ঘিরে রাখছে। শপিং মলের বাকি লোক গুলো কেমন করে যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো এতগুলো গার্ড সাথে আছে বলে। মেহরিমা অনেক দামী দামী জামা কাপড় কেনাকাটা করেছে। সবকিছুই আলমিরের পছন্দ। সে নিজে একটা একটা করে পছন্দ করে কিনে দিয়েছে মেহরিমা কে। মেহরিমার ভীষন লজ্জা লাগছে এভাবে আলমিরের সাথে শপিং করতে। আসার সময় মেহের কে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিল সে। কিন্তু জানেনা কেনো মেয়েটি কোনমতেই সাথে আসলো না। বলল ওদের দুজনের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হতে চায় না সে। তাই বাধ্য হয়ে একাই আসতে হল তাকে।

সব কিছু কেনাকাটার পর এবার মেহেরের জন্য কেনাকাটা করতে একটি বেবি শোরুমে ঢুকেছে তারা। তখনই হঠাৎ আলমিরের ফোনটা বেজে ওঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে মেহরিমাকে কেনাকাটা করতে বলে কিছুটা দূরে চলে যায়। শোরুমের বাইরে। মেহরিমা একটা একটা করে জামা দেখছে মেহেরের জন্য। যেটা ওকে পড়লে ভালো মানাবে। তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পায় সে। সে দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে কালো বোরখা ও হাত পায়ে কালো মোজা পরা একটি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মেহরিমা তার দিকে তাকিয়ে একটু সরে দাঁড়াতে চাইলেই মহিলাটি আস্তে বলে ওঠে,

“তোমার সাথে আমার কথা আছে মেহরিমা। দূরে যেওনা, আমার কাছে সময় অনেক কম। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবোনা।”

মহিলাটির মুখে নিজের নাম শুনতে পেয়ে যেন আঁতকে উঠল মেহরিমা। বড় বড় চোখে তাকালো তার দিকে। তার চোখটাও দেখা যাচ্ছে না। চোখের উপরে দুটো কালো পর্দা ফেলে রেখেছে। মেহরিমা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“কে আপনি? আমার নাম জানলেন কি করে?”

“আমি যে’ই হই সেটা জেনে তোমার কাজ নেই। আমি যা বলছি সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনো। তোমাদের চারপাশে অনেক বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। শপিং মল থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে তোমাদের উপর অ্যাটাক হতে পারে। তাই সাবধান। আর হ্যা আলমিরের চারপাশে সব সময় বিপদ রক্ষাকারীর ছদ্মবেশে রয়েছে। ওকে সাবধানে থাকতে বল। ওর আপন জনেরাই ওর ক্ষতি করতে চাইছে। কারণ ওর কোটি টাকার সম্পদ। স্ত্রী হিসেবে তোমার দায়ীত্ব ওকে বিপদ থেকে দূরে রাখা।”

এতোটুকু বলে থামল মহিলাটি। মেহরিমা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ভীষণ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কিন্তু এতকিছু আপনি কি করে জানলেন? আসলে কে আপনি? আর আমাকে কেন এসব বলছেন?”

মহিলাটার গলা হঠাৎ ভাঁড়ি হয়ে এলো। সে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল,

“আমি তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু হয়তো আমি তোমাদের সবচাইতে বড় বিপদের কারণ হব। তাই আমার পরিচয় জানতে চেয়ো না। যেটা বলছি সেটা মেনে চলো। আমি সময়মতো তোমাকে সব রকম খবর দিতে থাকব। তবে দয়া করে আমার কথাটা কাউকে বলবেনা। আলমির কেও না। এখন আমি আসি।”

এতোটুকু বলে ফিরে যেতে নিয়েও আবারো কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এলেন মহিলাটি। মেহরিমার দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বললেন,

“আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে? ভীষণ দরকার।”

মেহরিমা জানেনা তার কি হলো। সে কোনো কিছু না ভেবেই নিজের ব্যাগ থেকে অনেকগুলো ৫শত টাকার নোট বের করে মহিলাটির হাতে ধরিয়ে দিল মহিলাটি মেহেরিমা মাথায় হাত দিলো। ঐ টাকা গুলো আলমির ওকে দিয়েছিলো। মহিলাটি আর দেড়ি করলো না। দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল।

মেহরিমা বেকুবের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে এক নজরে তাকিয়ে রইল মহিলাটির চলে যাওয়ার দিকে। দোকানের মাঝে কোনো গার্ড না থাকায় কোনো কিছুই দেখতে পেল না কেউ। গার্ডেরা শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। আলমির বাইরে যাওয়ার কারণে সেও দেখতে পেল না। বেশ কিছুক্ষণের মাঝে ফিরে এলো আলমির। মেহরিমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,

” মেহেরের জন্য কিছু পছন্দ হয়েছে?”

মেহরিমা দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে দুটো নীল ও কালো রঙের জামা দেখিয়ে বললো,

“জ্বি, দেখুনতো এই জামা দুটো কেমন লাগে? আমাদের মেহেরকে সুন্দর মানাবে তাইনা?”

আলমির জামা দুটো হাতে নিয়ে মৃদু হাসলো। দুষ্টুমি করে বললো,

” হ্যা বেশ মানাবে দুষ্টু শালিকাকে। চলো এবার এগুলো নিয়ে বাসায় ফেরা যাক।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,