দিওয়ানেগি পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
503

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩১+৩২+৩৩
#M_Sonali

সব কিছু কেনাকাটা শেষ হওয়ার পর শপিং মল থেকে বের হওয়ার জন্য গেটের কাছে পৌঁছাতেই, মেহরিমা হাত টেনে ধরল আলমিরের। এতে সে বেশ অবাক হল। আবেগি দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল মেহরিমার দিকে। সে এই প্রথমবার হাত ধরেছে তার। তাও আবার শপিংমলের এত জনসমাগম এর মাঝে। ব্যাপারটা বেশ আবেগী করে তুলছে আলমিরকে। সে দুষ্টু হেসে আদুরে গলায় আস্তে করে বলল,

“কি ব্যাপার মেহু? কিছু বলবে? আর কিছু কেনাকাটা বাকি আছে নাকি?”

মেহরিমা দ্রুত তার হাত ছেড়ে দিয়ে হালকা লজ্জা পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর গম্ভীর মুখ করে বলল,

“বাইরে যাবেন না আলমির। বাইরে আমাদের জন্য বিপদ লুকিয়ে আছে। আমাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে বাইরে বেরুনোর সাথে সাথে।”

ওর এমন কথায় ভীষণরকম অবাক হল আলমির। ভ্রু কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর ওর হাতটা ধরে শান্ত গলায় বলল,

“তুমি নিশ্চিন্তে থাকো মেহু। এমন কিছুই হবে না। আর তাছাড়া এতক্ষণ সময় শপিংমলের মধ্যে থাকার পরেও যখন কোন আক্রমণ হয়নি, তাহলে বাইরে ও কিছু হবে না।”

কিন্তু মেহরিমা যেনো নাসরবান্দা। তার হাতটা আবার টেনে ধরে বলল,

“আমার ভীষণ ভয় করছে আলমির। আমি নিশ্চিত বাইরে আমাদের জন্য কোন বিপদ লুকিয়ে আছে। আমরা বের হওয়ার সাথে সাথে আক্রমণ হবে আমাদের উপর। প্লিজ আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন।”

এবার বেশ বিরক্ত হলো আলমির। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সবাই কেমন বাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সে এবার একটু ধমকের সুরে বলে উঠল,

“মেহরিমা আশেপাশে তাকিয়ে দেখো সবাই কি ভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এখানে দাঁড়িয়ে সিনক্রিয়েট করো না। চলো আমার সাথে। কিছুই হবে না তোমার।”

কথাটি বলেই একপ্রকার জোর করেই মেহরিমার হাত ধরে গার্ডদেরকে নিয়ে শপিং মল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল আলমির। গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে যখনি গাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ ওপর দিক থেকে একটি গুলি এসে লাগল গাড়িতে। একটুর জন্য আলমিরের মাথায় লাগেনি গুলি। পাশ কেটে বেরিয়ে গিয়ে গাড়ির সাথে লেগেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন স্থির মেরে গেল। গার্ডরা দ্রুত নিজেদের পজিশন নিয়ে আলমির এবং মেহরিমা কে গাড়িতে ঢুকতে সহযোগিতা করল। তারপর তারা যেদিক থেকে গুলি এসেছে সে দিকে খুঁজতে লাগল, কে গুলি করেছে। কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। যেন আকাশ থেকে উড়ে এসেছে গুলিটা। সবাই দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করল।

আলমির যেনো এখনো হতভম্বের মত চুপচাপ মেরে আছে। তার মুখে কোন কথা নেই। সে এখনো ঘটনাটি মেনে নিতে পারছে না। মেহরিমা ততক্ষণে কান্না করে ফেলেছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে সে।

পুরোটা রাস্তায় বাসায় আসার সময় আর কোনো আক্রমণ হয়নি তাদের ওপর। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আলমিরের মাথা থেকে ঘটনাটা কিছুতেই যাচ্ছেনা। সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা মেহরিমা আগে থেকে কিভাবে জানলো আক্রমণের কথা? তবে কি মেহরিমা আগে থেকেই জানতো? কিন্তু কিভাবে?

কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো ওদের গাড়ি। আলমির এবার মেহরিমার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল মেহরিমার দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছে। এতে আলমিরের কেন জানে না ওর প্রতি মায়া হলো না। বরং সন্দেহ কাজ করছে তার মানে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না সে। মেহরিমার হাত ধরে বলল,

“আমরা বাসায় পৌছে গেছি আর কান্না করো না। আর কোন ভয় নেই।”

কথাটি বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে মেহরিমা কে নামতে সাহায্য করল। বাসায় ঢোকার আগে ওকে আবারও চাপা গলায় বললো,

“নিজের চোখ মুছে নাও মেহু। দিদুন বুঝতে পারলে খামাখা আতঙ্কিত হতে পারেন।”

মেহরিমা কোন উত্তর দিল না। নিজের চোখের জলটা মুছে নিল সে। কিন্তু এখনো কাঁপছে ভয়ে। আলমির কোন পাত্তা না দিয়ে ওকে রেখে বাসার মধ্যে ঢুকে গেল। ওকে চলে যেতে দেখে মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু পায়ে হেঁটে বাসার ভেতর ঢুকলো। দিলরুবা বেগম এবং মেহের সামনেই সোফায় বসেছিলেন। ওদের দুজনকে আসতে দেখে মেহের দৌড়ে এসে বললো,

“আপু তোমরা এসেছো? কি কি শপিং করেছ দেখি?”

মেহরিমা জোরপূর্বক মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বললো,

“সবকিছুই ব্যাগে রাখা আছে। তুই দেখ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

কথাটি বলে দ্রুত সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেল মেহরিমা। আলমিরও বাসায় ঢুকে কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেছে। ব্যাপারটা দিলরুবা বেগম এর চোখ এড়ালো না। তার মনের মাঝে একটি সন্দেহ কাজ করলো। দুজন গার্ড সবগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে এসে দিলরুবা বেগমের সামনে রাখলো। তার একবার ইচ্ছা হলো গার্ডদের কাছে জিজ্ঞেস করতে কি হয়েছে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে থেমে গেলেন তিনি। ইশারায় গার্ডদের চলে যেতে বললেন। তারা চলে যেতেই মেহের এসে পাশে বসে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল,

“দিদুন এ গুলো খুলে দেখি কি কি আছে?”

দিলরুবা বেগম মুখে কিছু বললেন না। মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
,
,
,
বিকেল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে ধীরে ধীরে। জানালার কাছে বসে আছে মেহরিমা। আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। নানারকম ভাবনায় ডুবে আছে সে। এই মুহূর্তে সে যেন একটি অথৈ সমুদ্রের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিছুতেই কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।বুঝতে পারছে না তার কোন দিকে যাওয়া উচিত। তার মাথায় বারবার একটি প্রশ্নই আসছে। ওই মহিলাটি কে ছিল? যে তাকে সতর্ক করে দিয়ে গেল। একবার তার মনে হচ্ছে এই ব্যাপারে আলমিরের সাথে কথা বলা উচিত। কিন্তু পরক্ষণেই সে মনকে বারণ করছে। কারণ মহিলাটি বারবার তাকে বলে গেছে তার ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলতে। এসব ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে মেহরিমা।

হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পাওয়ায় সে দিকে ফিরে তাকায় সে। দিলরুবা বেগম বেশ কিছুক্ষণ হলো তার রুমে এসেছে। সে সেটা খেয়াল করেনি। ওকে তাকাতে দেখে দিলরুবা বেগম ওর পাশে এসে বসে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,

“শপিং মল থেকে ফেরার পর থেকেই দেখছি তুমি ও আলমির দুজনেই অনেক টেনশনে আছো। কি হয়েছে বলোতো? ওখানে কিছু হয়েছিল নাকি আবার তোমাদের সাথে?”

ওনার প্রশ্নে হকচকিয়ে ওঠে মেহরিমা। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছিনা সে। মাথা নিচু করে বসে থাকে চুপচাপ। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিলরুবা বেগম আবারো বলে ওঠে,

“কি হলো মেহরিমা আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন? সত্যি করে বল কি হয়েছিল?”

“শপিং মল থেকে বের হওয়ার পর আমাদের ওপর অ্যাটাক হয়েছিল দিদুন। একটুর জন্য আলমির স্যারের মাথায় গুলি লাগে নি। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন ওনাকে।”

ওর কথা শুনে দিদুন যেন কেঁপে উঠেন। তিনি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলেন,

“ইন্নালিল্লাহ, কি বলছো এসব মেহরিমা। আমাকে এতক্ষণ কেন বলনি তুমি? আল্লাহ তোমার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আমার আলমির কে ঠিক রাখার জন্য। এজন্যই তোমাদের বারবার বলেছি এভাবে কোথাও না যাওয়ার জন্য। কিন্তু তোমরা তো আমার কথাই শোনো না।”

কথাটি বলেই রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন দিলরুবা বেগম। মেহরিমা কিছু বলল না। সে বুঝতে পারছে দিলরুবা বেগম ভীষণভাবে ঘাবড়ে গিয়েছে। তাই এমন কথা বলে গেলেন তিনি।

মেহরিমা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পরেই তার রুমের মাঝে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল দুটি মেয়ে। মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো মেহরিমা। এই মেয়ে দুটিকে এর আগে দেখেনি সে। সে মেয়ে দুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“আপনারা কারা? আর এখানে কি করছেন?”

মেয়ে দুটি মৃদু হাসল। বলল,

“সরি ম্যাম অনুমতি না নিয়েই রুমে ঢুকে পরার জন্য। আমরা পার্লার থেকে এসেছি। আলমির স্যার নিয়ে এসেছেন আমাদের। আপনাকে সাজানোর জন্য। আজকে তো আপনাদের বাসররাত তাই আপনাকে সাজাতে এসেছি আমরা।”

মেয়ে দুটির কথা শুনে বেশ অবাক হল মেহরিমা। সে মনে মনে ভাবল আলমিরের কি মাথা খারাপ হয়েছে, এমন একটা পরিস্থিতিতে কীভাবে সে এসবের কথা চিন্তা করে। মেহরিমা রাগী গলায় কিছু বলবে তার আগেই আলমির এসে উপস্থিত হয় সেখানে। মেয়ে দুটিকে ইশারা করে বলে বাইরে গিয়ে বসার জন্য। তারা এক মুহূর্ত দেরি না করে বাইরে চলে যায়। আলমির রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। ওকে দরজা লাগাতে দেখে মেহরিমা কিছুটা ভড়কে যায়। কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়াতেই আলমির ওর পাশে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে। ওর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলে,

“এই মেয়ে, এত ভীতু কেন তুমি? কি হয়েছে কি না হয়েছে সে চিন্তায় কি আমাদের বিয়েটা খারাপ করবো নাকি হুম? তুমি জানো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। কতটা নিজের করে পেতে চাই। আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ দুদিন। অথচ এক মুহূর্তের জন্য তোমাকে স্ত্রী হিসেবে কাছে পাইনি আমি। আগের মতই এখনো দুজন আলাদা রুমে ঘুমাই। আজকে আর কোন বাধা মানবো না। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আজ আমাদের ফুলশয্যা। এক স্বপ্নের রাত। এই রাতটার অপেক্ষা কতদিন হল করছি আমি। তাকি তুমি জানো? বড্ড ভালোবাসি তোমাকে বউ। একদম নিজের করে আপন করে পেতে চাই তোমায় এই বাহুডোরে। যেখানে থাকবে না কোনো দূরত্ব, কোনো সঙ্কোচ।”

ঘটনার আকস্মিকতায় মেহরিমা কি বলবে তা যেন ভুলে গেছে সে। বুকের মাঝে ধুকপুকানি যেন বহুগুণে বেড়ে গেছে তার। এই মুহূর্তে যেন হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা হয়েছে তার। সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আলমির এর দিকে। ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলমির মৃদু হাসে। ওকে ছেড়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,

“এভাবে তাকিয়ে থেকো না জান। তাহলে কিন্তু আর তর সইবেনা আমার। এখনই কিছু করে বসবো। আমি এখন যাচ্ছি। পার্লারের মেয়েদুটোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি জলদি রেডি হয়ে নাও। I am waiting for you darling. please come to me early dear. ”

কথাটি বলেই ওর কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আলমির। মেহরিমা যেনো এখনো কোনো ঘোরের মাঝে আছে। সব দুশ্চিন্তা ভুলে তাকিয়ে আছে আলমিরের চলে যাওয়ার পানে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩২
#M_Sonali

বাসর ঘরে বউ সেজে বসে আছে মেহরিমা। পুরো রুম টাই অনেক সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে আলমির। অল্প কিছু সময়ের মাঝেই রুমটা যেন একটা ফুলের বাগান করে তুলেছে সে। বেশ অনেকক্ষণ সময় হলো চুপচাপ খাটের উপর বসে আছে মেহরিমা। মনের মাঝে তার হাজারো রকম চিন্তা ভর করে আছে। সেই সাথে এক অজানা ভালো লাগা ও ভয় কাজ করছে মনে। কিন্তু এখন অব্দি আলমিরের আসার কোনো নাম নেই। মেহরিমা বেশ বিরক্ত হচ্ছে। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। এখন পর্যন্ত আলমির কেন আসছে না সেটা ভেবেই যেন বিরক্তির সীমা পার হয়ে যাচ্ছে তার।

ঘুমে চোখটা বারবার লেগে আসছে তার। কিন্তু ঘুমাতে পারছে না সে। এই সময় ঘুমালে কেমন দেখাবে সেটা ভেবে। শেষে বিরক্ত হয়ে নিজের ফোনটা হাতে তুলে নিল মেহরিমা। ফোনের মাঝে মেহেরের কিছু ছবি বের করে সেগুলো একটা একটা করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ টুংটাং শব্দ করে মেসেজ আসলো তার ফোনে। সে দেরি না করে দ্রুত মেসেজটা সিন করতেই দেখল। একটি নাম্বার থেকে মেসেজটা এসেছে। নাম্বারটা তার অচেনা। মেসেজে লেখা আছে,

“বধুর সাজে তোমাকে কেমন লাগে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ইচ্ছাটা পূরণ হলো না। তবে দেখবোই কোন একদিন তোমাকে শুধু আমার করে। কারণ ভালবাসি অনেক।”

মেসেজটা পড়ে বেশ অবাক হল মেহরিমা। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না এই মেসেজটা তাকে কে পাঠালো। একবার মনে মনে ভাবল এটা নিশ্চয়ই আলমির পাঠিয়েছে। ও ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। ভাবনাটা মাথার মধ্যে আসতেই মুচকি হাসল সে। ফোনটা বালিশের পাশে রেখে অপেক্ষা করতে লাগল আলমিরের জন্য। কিছুক্ষণ পরেই খট করে দরজা খোলার শব্দে নিজের ঘোমটাটা আরেকটু টেনে দিল সে। দেখল আলমির রুমের মাঝে প্রবেশ করছে। দরজা লাগিয়ে ওর পাশে এসে বসল আলমির। হালকা গলা খাকারি দিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“সরি মেহু, আমার আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। অনেক্ষন আমার জন্য অপেক্ষা করতে হলো তাই না?”

মেহরিমা উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল। আলমির আর কথা বাড়ালো না। আর একটু কাছে এগিয়ে বসে মেহরিমার ঘুমটা এক হাতে তুলে দিলো। সাথে সাথে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভীষণরকম লজ্জা পাচ্ছে সে। ঘুমটা তুলে ওর থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা একটু উঁচু করে বলে উঠলো,

“মাশাআল্লাহ। আমার বউটা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের মাঝে একজন। যেন এক ফালি আকাশের চাঁদ বসে আছে আমার সামনে। যে চাঁদের জোছনায় ভিজতে ইচ্ছে করবে প্রতিটা সময় প্রতিটা মুহূর্ত। ভালোবাসি বড্ড বেশি। ভালোবাসি তোমায় মেহু।”

মেহরিমা এবার ধীরে ধীরে চোখ খুলে ওর দিকে তাকাল। তাকিয়েই ভীষণ লজ্জা পেয়ে আবারো চোখ নামিয়ে নিল সে। আলমির ড্যাবড্যাব করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, নেশাতুর দৃষ্টিতে। ওকে লজ্জা পেতে দেখে মৃদু হাসল সে। পকেট থেকে একটি বক্স বের করে তা থেকে একটি ডায়মন্ড আংটি ওর হাতে পরিয়ে দিয়ে হাতে চুপু খেয়ে বলল,

“বিয়ের রাতে স্ত্রীকে কিছুনা কিছু গিফট দিতে হয়, দিদুন বললো। কিন্তু তোমাকে যা কিছু দেই না কেনো আমার মন ভরবে না। তাই এই ছোট্ট উপহারের সাথে এক বুক ভালোবাসা দিলাম। নিজের করে রাখো। আমার ভালোবাসা টুকু গ্রহণ করে তোমার ভালবাসায় আমাকে পূর্ণ করো মেহু। তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনতে যে আমি পাগল হয়ে গেছি। সেটা কি তুমি বুঝো না? আমি জানি আমার মত তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু কেন সেটা মুখ ফুটে কখনো বলোনি। আজ এই রাতে তোমার ভালবাসা পেতে চাই আমি। বলো দিবে না?”

মেহরিমা চোখ তুলে তাকালো। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। আলমিরের হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“আপনি আমার স্বামী আলমির। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ পুরুষ আপনি। আপনার আগে যেমন আমার জীবনে কোনো পুরুষ ছিলো না। তেমনি আপনার পরেও কেউ আসবে না। আমার বাবা-মায়ের পর যদি কাউকে এতটা ভালোবেসে ও বিশ্বাস করে থাকি সেটা শুধুই আপনি। আজ আপনাকে কথা দিচ্ছি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনাকে ভালবেসে যাব। আপনার প্রতিটি বিপদে-আপদে পাশে থাকবো আমি। কখনোই আপনাকে ছেড়ে দূরে যাব না। তবে একটাই অনুরোধ। কখনো আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না। ছোটবেলা থেকেই নিজের আত্মসম্মান টাকে বড্ড ভালোবাসি। তাই সেটায় কখনো আঘাত করলে আমি সহ্য করতে পারবো না। আপনার কাছে শুধু আমি বিশ্বাস ও সম্মান টুকু চাই। আর কিছু নয় আলমির। ভালবাসি আমিও।”

এতোটুকু বলে থামল মেহরিমা। ওকে থামতে দেখে মৃদু হাসলো আলমির। শক্ত করে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। কপালে চুমু দিয়ে বলল,

“কথা দিচ্ছি জান। কখনো এমন কিছু করব না যাতে তোমার আত্মসম্মানে বিন্দুমাত্র আচ আসে। সারাক্ষণ এভাবেই ভালবেসে বুকে জড়িয়ে রাখবো তোমায়।”

(তারপর বাকিটা পাতিহাঁস।😴)
,
,
,

সকালে অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় মেহরিমা। তারপর ফজরের নামাজ পড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। আলমির কে আজ নিজ হাতে নাস্তা বানিয়ে খাওয়াবে সে। ও চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ওর ফোনের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আলমিরের। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনে একটি নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ফোনটা রেখে দেবে ভেবেও কিছু একটা ভেবে ফোনের মেসেজ সিন করে দেখে সেখানে লেখা,

“কাল সারারাত তোমায় ভেবে ঘুমাতে পারিনি। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তুমি আজ অন্য কারো বুকে। তবুও আমার বুকে তোমার জন্য আগের মতই জায়গা রয়েছে মেহরিমা। তোমার জন্যই অপেক্ষা করে আছি আমি। জানি একদিন তুমি আমার কাছেই ফিরে আসবে। কারন তুমিও যে আমাকেই ভালোবাসো। তোমার ভালবাসায়, তোমার অপেক্ষায় থাকবো সারাজীবন।”

মেসেজটা পড়েই যেন চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল আলমিরের। সে উঠে বসে রাগে কাঁপতে শুরু করলো। মেসেজ চেক করে দেখলো গতরাতে আরেকটি মেসেজ এসেছে এই নাম্বার থেকেই। মেসেজ টা সিনও করেছে মেহরিমা। আলমির একবার ভাবলো মেহরিমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে মেসেজটা ডিলিট করে দিলো সে। আর ফোনটা আগের জায়গায় রেখে উঠে ফ্রেস হতে চলে গেল। গোসল করতে করতে নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল সে। সে জানতে চায় এই মেসেজগুলো মেহরিমা কে, কে করছে। আর আদৌ মেহরিমা তার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে আছে কিনা।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে রেডি হয়ে ডাইরেক্ট নিচে চলে গেল আলমির। নিচে গিয়ে দেখল মেহরিমা তার পছন্দের বেশকিছু খাবার বানিয়ে ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করছে। ওর পাশেই বসে আছেন দিলরুবা বেগম ও মেহের। দুজনেই টুকিটাকি গল্প করছে মেহরিমার সাথে। আলমির কে উপর থেকে নামতে দেখে লজ্জামাখা হাসি দিলো মেহরিমা। তারপর নিজের কাজে মন দিলো সে। দিলরুবা বেগম হেসে দিয়ে বললো,

“এসেছো দাদুভাই। দেখো তোমার বউ আজকে তোমার জন্য কি কি রান্না করেছে। বিয়ের পরদিন বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য কিন্তু অনেক কম পুরুষেরই হয়। এদিক দিয়ে তুমি খুব ভাগ্যবান বলতে হয়। কি বল দাদুভাই?”

কথাটি বলেই হাসতে লাগল দিলরুবা বেগম। তার কথায় মেহরিমা আরো বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। কিন্তু আলমির এর মাঝে কোন রকম ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে চুপচাপ এসে ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,

“দ্রুত নাস্তা দাও আমাকে অফিস যেতে হবে। আজ অফিসে আর্জেন্ট কিছু কাজ আছে।”

ওর কথায় মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল দিলরুবা বেগম ও মেহরিমার মুখ। দিলরুবা বেগম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

“এটা কেমন কথা হলো আলমির? আজ তোমাদের বিয়ের দ্বিতীয় দিন। আজকে কেউ অফিসে যায় নাকি? অন্ততপক্ষে সাত দিন তো তুমি মেহরিমাকে সময় দিবে। দুজন একসাথে সময় কাটাবে। আগামি সাতদিন তোমাকে অফিস যেতে হবে না বুঝেছ।”

” বাচ্চাদের মতো কথা বলো না দিদুন। তুমি ভালো করেই জানো আমি আমার কাজ নিয়ে কতটা সিরিয়াস। তাই এ ব্যাপারে আর কোন কথা বলো না। আর তাছাড়া আমি তো আর মেহরিমা কে ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আর মেহরিমাও আমার সাথেই অফিস যাবে।”

ওর কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই মেহরিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“উনি তো ঠিকই বলেছেন দিদুন। আপনি শুধু শুধু টেনশন করবেন না। আমি তো ওনার সাথে থাকবো। আর তাছাড়া বাসায় থাকা আর অফিসে দুজন একসাথে থাকা একই কথা। আমার কোন আপত্তি নেই।”

দিলরুবা বেগম আর কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। খাওয়া শুরু করলেন। সবাই খাবারের অনেক প্রশংসা করলেও আলমির কোনরকম প্রশংসা করল না। সে এক প্রকার জোর করে খাবারটা খেয়ে উপরে যেতে যেতে বলল,

“মেহু তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হয়ে নাও। আমাদের অফিস যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলেই উপরে চলে গেলো সে। এতে মেহরিমার খুব মনক্ষুন্ন হলো। সে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অনেক কষ্ট পেল। সে ভেবেছিল আলমির তার খাবারের প্রশংসা করবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। ওর মনের কথা বুঝতে পারল দিলরুবা বেগম। তিনি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উপরে চলে গেল মেহরিমা। অফিসের জন্য রেডী হতে শুরু করল সে। আলমিরের রুমের সাথে একটি স্টাডি রুম আছে। সেখানে অফিসের যাবতীয় ফাইল রাখা এবং সেখানেই কাজ করে আলমির। কিছু একটা কারণে সেই রুমে গেছে আলমির। মেহরিমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হতে ব্যস্ত। হঠাৎ তার ফোনটা টুংটাং শব্দে বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিতেই দেখল আননন নাম্বার থেকে কল এসেছে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৩
#M_Sonali

ফোনটা হাতে নিয়ে ধরবে কি ধরবে না এমন চিন্তায় যেন দোটানায় পড়ে গেলো মেহরিমা। এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে দেখে নিল আশেপাশে কেউ আছে কিনা। যখন দেখল রুমে আলমির নেই, তখন ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরে আস্তে করে “হ্যালো” বলল। সাথে সাথে অপর প্রান্ত থেকে একটি মহিলা কন্ঠ বলে উঠলো,

“মেহরিমা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সাথে দেখা করো প্লিজ। অনেক ইম্পরট্যান্ট কিছু কথা বলার আছে তোমায়। আমার হাতে সময় অনেক কম। আমি তোমার বাবার বাড়িতে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি চলে এসো। আর হ্যা আমার কথা কাওকে ভুল করেও বলো না। তোমাদের চারিপাশে অনেক বিপদ।”

কথাটা বলে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিল। মেহরিমা যে কিছু বলবে সেটা আর হলো না। তখনই পিছন থেকে আলমির ডেকে বলে উঠলো,

“কে ফোন করেছে মেহু? কার সাথে কথা বলছো তুমি?”

আলমিরের কথায় যেন কেঁপে উঠল মেহরিমা। দ্রুত ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে পিছনে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“ক কই কেউ ফোন করেনি তো।”

“কিন্তু আমিতো স্পষ্ট শুনলাম, তুমি কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলে।”

মেহরিমা দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। তারপর মৃদু হেসে বলে উঠলো,

“আসলে সিম অফিস থেকে ফোন করেছিল। ওরা তো সব সময়ই ফোন করে না না রকম অফার দেয়। তাই কানের কাছে ধরে গান শুনছিলাম। আর কিছু নয়। চলুন অফিসে যাই। আমাদের না দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

ওর কথার উত্তরে আলমির কিছু বলল না। মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো তার। মনের মাঝে এক আকাশ রাগ নিয়ে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহরিমা আর দেরি না করে দ্রুত তাঁর পেছু ছুটলো একসাথে যাওয়ার জন্য। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে দিলরুবা বেগম কে বলে গেলেও আজকে কাউকে কিছু না বলেই সোজা হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলো আলমির। তার এখন রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সে ভাল করেই জানে মেহরিমা কারো সাথে কথা বলছিল। কিন্তু ও কেন লুকালো সত্যিটা? ব্যাপারটা ভীষণরকম খোঁচাচ্ছে আলমিরকে। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে মেহরিমাকে ঠাটিয়ে দুটো থাপ্পর মেরে জানতে চাইতে, কার সাথে কথা বলছিল সে। তবে কি সত্যিই মেহরিমার কারো সাথে সম্পর্ক আছে?

কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই আরো বেশি রাগ হলো আলমিরের। সে মনে মনে পণ করলো। সে মেহেরিমার উপর নজর রাখবে। তাকে সরাসরি কিছু না বলে তার ব্যাপারে সবকিছু জানবে। আসলেই কি মেহরিমা তাকে ভালবেসে ইচ্ছাকৃতভাবে তার সাথে বিয়ে করেছে? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। মেহরিমা কি তার শত্রু পক্ষের কেউ? যে ভালবাসার অভিনয় করে ওর পিট পিছনে ছুড়ি বসানোর চেষ্টা করছে।

মেহরিমা সোজা এসে গাড়িতে আলমিরের পাশে বসলো। আলমির ওর দিকে তাকাল না। বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে দাঁত কটমট করতে লাগলো। এখন ওর দিকে তাকালেই রাগ হবে তার। তাই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল সে। তখনই আমতা আমতা করে মেহরিমা বলে উঠলো,

“আমাকে একটু আমার বাড়িতে ছেড়ে দেবেন আলমির প্লিজ। আসলে অনেকদিন হলো নিজের বাড়িতে যাই না। তাই বাবা মাকে ভিষন মনে পরছে। তাদের ছবি দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। আমি একঘন্টা পরেই ফিরে আস,,,!”

আর বলতে পারলোনা মেহরিমা। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আলমির বলে উঠলো,

” ঠিক আছে যাওয়ার সময় নামিয়ে দিয়ে যাব। আর ড্রাইভার কে পাঠিয়ে দিব তোমায় নিয়ে যাবে।”

মেহরিমা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সে কল্পনাও করতে পারেনি আলমির এত সহজে তার কথা মেনে নিবে। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো সে। এই সুযোগে ওই মহিলার সাথে দেখা করতে পারবে সে। তার থেকে সবকিছু জানতে পারবে সে।

মেহরিমার বাড়ির সামনে এসে ওকে নামিয়ে দিল আলমির। মেহরিমা সোজা গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। আলমির আর দেরি না করে ড্রাইভারকে বললো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অফিসে যেতে। ও গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই মেহরিমা বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলো বোরকা পরা একটি মহিলা ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে আসছে। মেহরিমা কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি সোজা এসে ওর হাত ধরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজের বোরখার মুখটা খুলে দিল। মেহরিমা হা করে তাকিয়ে রইল মহিলাটির দিকে। মহিলাটির চেহারা অনেকটাই মিল আছে আলমিরের সাথে। মেহরিমা মনে মনে আন্দাজ করে নিল ইনিই আলমিরের মা। অর্থাৎ তার শাশুড়ি।

“আমি জানি মেহরিমা তুমি হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছো আমি কে। তবুও নিজের পরিচয় দিচ্ছি। আমি আলমিরের মা। যে তাকে ও তার ছোট ভাইকে ছোটবেলা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।”

উনার কথার উত্তরে মেহরিমার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো। সে অবাক হয়ে স্থির গলায় জিজ্ঞেস করল,

“কিন্তু আপনি এমন কেন করেছিলেন? কেনই বা এত ছোট ছোট দুটি বাচ্চা ছেলেকে একা রেখে চলে গিয়েছিলেন?”

“বলবো মেহরিমা, আজ মন খুলে সব কিছুই বলবো আমি তোমায়। আমাকে একটু সময় দাও।”

কথাটি বলেই হাঁফাতে লাগলো শেফালী বেগম। মেহরিমা তাকে হাপাতে দেখে হাত ধরে নিয়ে খাটের উপর বসলো। তারপর দ্রুত গিয়ে একগ্লাস পানি ভরে নিয়ে এসে সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“পানিটা খেয়ে নিন মা। তারপরে বলুন সব।”

ওর মুখে মা কথাটি শুনতে পেয়ে করুন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল শেফালী বেগম। দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার। হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। তারপর গ্লাস টা ওর হাতে দিয়ে বলল,

“আজ কত বছর পর কারো মুখে মা ডাক শুনতে পেলাম। মনটা যেন জুড়িয়ে গেল। মেহরিমা তুমি জানো না এই ডাক টার মাঝে কতটা মধু লুকিয়ে আছে। যেটা আমি নিজের ইচ্ছায় অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করে এসেছিলাম শুধু মাত্র নিজের স্বামী ও সন্তানের সম্মান বাঁচানোর জন্য।”

ওনার কথা শুনে মেহরিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল ওনার দিকে। ওনার পাশে বসে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

“মানে, আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না মা।”

শেফালী বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চোখের পানি মুছে নিয়ে বললেন,

“আলমিরের তখন প্রচুর জ্বর। আর আরহাম তখন অনেক ছোট। সেই মুহূর্তে আমি ছেলে দুটিকে রেখে নিজের কলিজা ছিড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তার কারণ জানো? কারণ ছিল আমার চাচাতো দিপু। আমি ছোটবেলা থেকেই চাচা চাচির সংসারে মানুষ হয়েছি। তাদের বাড়িতে কাজের মেয়ের মত থেকেছি। তবুও চাচা আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। চাচি অনেক দজ্জাল মহিলা ছিল। সে আমাকে প্রচুর কষ্ট দিত। বিয়ের পর অনেক সুখ শান্তি খুঁজে পাই আমি তোমার শ্বশুরের কাছে। কিন্তু সেই সুখটা আমার বেশিদিনের ছিলনা। কারণ বিয়ের আগে আমার চাচাতো ভাই আমাকে একাধিক বার ধর্ষণ করেছিল। যেটা কেউ জানতো না আমার চাচি ছাড়া। ওরা আমাকে এত বেশি অত্যাচার করত যে, ওদের ভয়ে আমি এই কথাটা চাচাকে বলতেও পারিনি। সব সময় শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি কিভাবে ওই জাহান্নাম থেকে বের হতে পারি। একদিন সেই সুযোগ এলো। তোমার শশুরের ভালোবাসা পেয়ে আমি ওই পরিবার ছেড়ে তোমার শশুরের হাত ধরে চলে আসি। সুখের সংসার গড়ি দুজন। কিন্তু তখনও জানতাম না আমার জন্য এত বড় একটি বিপদ লুকিয়ে আছে। তোমার শ্বশুর তখন দেশের টপ বিজনেসম্যান হওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করে চলেছেন। সেই মুহূর্তে আমার চাচাতো ভাই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। সে বিয়ের আগে আমায় ধর্ষনের সময় কি করে যেনো ভিডিও করে রেখেছিলো। সেটা পাবলিশ করে দিয়ে তোমার শশুরের সকল সম্মান শেষ করে দিতে চাইলো। দিপু আমায় বললো সে আব্রাহামকে বলবে আলমির আর আরহাম দিপুর সন্তান। আব্রাহামের নয়। আর এই কথাটি বিশ্বাস করানোর মতো সকল রকম প্রমাণ ছিল দিপুর কাছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। আমার সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে। আমি জানতাম আব্রাহাম আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। সে কখনোই আমাকে অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু দিপুর কাছে এমন ভিডিও ছিল যে সে বিশ্বাস না করে থাকতে পারত না। যদিও সেখানে আমার কোনরকম দোষ ছিল না। আর আরহাম বা আলমির আব্রাহামের’ই সন্তান ছিল। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। ভীষণ রকম ভয় পেয়ে যাই। পাগলের মত হয়ে যাই। কি করব বুঝে পাইনা। শেষে বাধ্য হয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে, দিপুর কথা মতো সংসার ছেড়ে তার সাথে চলে যাই। কারণ ও শর্ত দিয়েছিল আমার যত গয়নাগাটি টাকা সম্পদ আছে সবকিছু নিয়ে ওর সাথে চলে যেতে। আর যাওয়ার আগে চিঠিতে লিখে যেতে আমি স্বেচ্ছায় চলে গেছি।”

এতোটুকু বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন শেফালী বেগম। ওনার কথা শুনে আর কান্না দেখে মেহরিমার চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। সে কিছু বলার মত ভাষা খুজে পাচ্ছে না। শেফালী বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলেন,

“ওই শয়তানটা শুধু আমাকে নিয়ে গিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। আমি জানতাম না সে কতটা ডেঞ্জারাস প্ল্যান করে রেখেছে। আমার কাছ থেকে সকল টাকা-পয়সা এবং গয়নাগাটি হাতে নিয়ে আমাকে বন্দী করে রাখে সে। ততদিনে আমার চাচা মারা গিয়েছিলো। তাই আমাকে তার হাত থেকে বাঁচানোর কেউ ছিলো না। আমাকে সে এমন একটি জায়গায় বন্দী করে রাখে যেখান থেকে পালানোর মতো কোনো উপায় ছিল না। আমি তাকে বারবার জিজ্ঞেস করি সে কেন এমন করছে। তখন সে যেটা বলে সেটা শুনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অনেক বড় একটি ষড়যন্ত্র করেছিল। টাকার লোভ তাকে ভেতর থেকে গ্রাশ করে নিয়েছিল। সে আমায় বলে,

“তুই কি ভেবেছিস তোকে শুধু টাকা-পয়সার জন্য ব্ল্যাকমেইল করে এখানে নিয়ে এসেছি? পাগল মেয়ে তুই সে বোকা বোকাই থেকে গেলি। তোকে নিয়ে আসার কারণ তোর স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া। এখন তুই আমার হাতের মুঠোয়। তোর স্বামী তোকে তালাক দিবে না আমি জানি। তাই এখন যদি তোর স্বামী সন্তানদের কে আমি খুন করি। তাহলে স্ত্রী হিসাবে তার সকল সম্পত্তি পাবি তুই। আর তুই পাবি মানেই তোর থেকে সম্পত্তি সব নিয়ে নেওয়া কোন ব্যাপারই না।”

এতোটুকু বলে থামলেন শেফালী বেগম। ওনার কথা শুনে চমকে উঠল মেহরিমা। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,

“ইয়া আল্লাহ। কি শয়তান লোক, কতটা ডেঞ্জারাস তার প্ল্যান। তারপর কি হল মা?”

“আমি তার কাছে অনেক আকুতি মিনতি করি যেন আমার স্বামী সন্তানের কোনো ক্ষতি না করে। কিন্তু সে আমার কথা মানতে নারাজ। সে আমাকে জানায় তার সাথে আরো কেউ একজন যুক্ত আছে। যে ওর সহপাঠী। তার সাথে থেকেই এত বড় ষড়যন্ত্র করেছে সে।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,