দিওয়ানেগি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
409

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৪+৩৫+৩৬
#M_Sonali

“আমি তার কাছে অনেক আকুতি মিনতি করি যেন আমার স্বামী সন্তানের কোনো ক্ষতি না করে। কিন্তু সে আমার কথা মানতে নারাজ। সে আমাকে জানায় তার সাথে আরো কেউ একজন যুক্ত আছে। যে ওর সহপাঠী। তার সাথে থেকেই এত বড় ষড়যন্ত্র করেছে সে।”

এতোটুকু বলেই থেমে গেলেন শেফালী বেগম। ওনার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেহরিমা বলে উঠল,

“সেই সহপাঠী টা কে মা? আপনি কি তাকে চেনেন?”

“না আমি আজ অব্দি জানতে পারিনি তার সেই সহপাঠী কে? তবে আমার যতটা সন্দেহ হয় সহপাঠীটা নিশ্চয়ই আলমিরের খুব কাছের কেউ হবে। যে ওর পুরো ফ্যামিলির সব খবরা খবর জানে।”

উনার কথার উত্তরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো মেহরিমা। তারপর চট করে বলে উঠলো,

“আলমিরের কাছের কেউ বলতে শুধুমাত্র একজনের পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে দেখিনি আমি মা। তারা হলো ডক্টর ফিরোজ আহমাদ আঙ্কেলের পরিবার। তবে আঙ্কেলরাই ওনার সেই লুকোনো শত্রু? দিপুর সহপাঠী? সরণও কি তবে আলমিরের শত্রুদের মাঝে একজন?”

প্রশ্নগুলো করেই শেফালী বেগম এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মেহরিমা। ওর কথার উত্তরে তিনি ছোট করে একটি নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন,

“নাহ আলমিরের পরিবারের শত্রু ফিরোজ আহমাদের পরিবারের কেউ নয়। আর সরণ তো অনেক ছোটবেলা থেকে আলমিরের বন্ধু। আজ সরণ ছেলেটা না থাকলে হয়তো আমি এখন অব্দি তোমার সামনে বসে থাকতে পারতাম না। অনেক আগেই মারা যেতাম। সরণ কোন খারাপ ছেলে নয়। ও ভীষণ ভাল একটি ছেলে। আমার আলমিরকে সে বড্ড ভালোবাসে। ওদের মাঝে কেউ ওই পরিবারের শত্রু নয়। বরং ওরা আলমিরের শুভাকাঙ্ক্ষী।”

ওনার কথা শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল মেহরিমা। সে কিছুতেই মিলাতে পারছেনা আলমিরের পরিবারের কাছের লোক ফিরোজ আহমাদের পরিবার ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“আমিতো ফিরোজ আহমাদ আঙ্কেলদের ছাড়া অন্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছিনা মা। যারা আলমিরের পরিবারের কাছের লোক। আমি ওই বাসায় যাওয়ার পর থেকে শুধু ফিরোজ আঙ্কেলকে দেখেছি ওদের কাছাকাছি থাকতে। তাছাড়া আর কাউকে নয়।”

“আছে মেহরিমা এমন কেউ অবশ্যই আছে। হয়তো তুমি তাদের খবর জানো না। কিন্তু এমন কেউ তো অবশ্যই আছে যারা সবসময় আলমিরের সাথে থেকে ওর সব রকম খবরা-খবর ওর শত্রুদের কাছে পাচার করে। আমি যখন দিপুর কাছে বন্দি ছিলাম, তখন দেখেছি সে কেউ একজনের কাছে ফোন করে সব সময় খবর নিত। আলমির কখন কি করছে কোথায় যাচ্ছে সবকিছু। তাকে খবর দিত কেউ একজন। হয়তো সে এমন কেউ হবে যে সব সময় আলমিরের সাথে থাকে। যেমন গার্ডদের মাঝে কেউ।”

উনার কথা শুনে যেন চমকে উঠল মেহরিমা। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

“কি বলছেন মা আপনি। গার্ডদের মাঝে কেউ যদি সত্যিই আলমিরের শত্রু হয়ে থাকে। তাহলে তো মহাবিপদ। ও তো সব সময় গার্ডদের নিজের সাথে রাখে। তারা যদি সুযোগ পেয়ে ওর কোন ক্ষতি করে দেয়।”

“সেটা তো আমারও টেনশন মেহরিমা। কিন্তু আমার মনে হয়না গার্ডদের মাঝে কেউ শত্রু থাকলেও তারা কেউ এমন করবে। কারণ সবারই জীবনের ভয়ে আছে। আলমিরের গার্ডদের মাঝে হয়তো একজন ওর শত্রু হবে। কিন্তু তাছাড়াও ওর সাথে সব সময় আরো ১৫ থেকে ২০ জন গার্ড থাকে। যারা ওকে প্রটেক্ট করবে। তাই শত্রু গার্ডটা এমন করার সাহস পাবে না।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে ওনার কথাগুলো ভাবলো। তারপর শান্ত হয়ে বলল,

“তা আপনি ঠিকই বলেছেন মা। এটা একটি যুক্তিযুক্ত কথা। কিন্তু আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। আপনি যদি দিপুর কাছে বন্দী হয়ে থাকেন। তাহলে ছাড়া পেলেন কিভাবে? আপনি বললেন সরণ না থাকলে আপনি বেঁচে থাকতেন না। এর মানে কি? আর এত কিছু জানলেন কিভাবে? আপনি তো আমাদের বাসায় থাকেন না। তাহলে আমাদের সকলের সম্পর্কে এত কিছু কিভাবে জানেন? এমনকি আমার সম্পর্কেও!”

ওর কথার উত্তরে শেফালী বেগম একটি বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার। চোখটা মুছে নিয়ে ভিরু গলায় বলতে শুরু করলেন,

“ওই দিপু শয়তানটা তার প্ল্যান মত সুযোগ বুঝে আব্রাহাম আর আরহামের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করায়। ওরা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। সবাই জানে ওরা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কেউ বুঝতে পারে না তারা খুন হয়েছে। কিন্তু আমি জানি ওই শয়তানটা আমার স্বামী এবং ছোট সন্তানকে খুন করেছে। ওদের নেক্সট প্ল্যান ছিল আলমির এবং আমার শাশুড়িকে খুন করা। তারপর সব সম্পত্তি আমার নামে চলে এলে সে সব লিখে নেওয়া। কিন্তু কোন এক কারনে সে সেটা থেকে দূরে থাকে। ওদের উপর কোনরকম আটক করে না। আমাকে একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। কোনোভাবেই বের হওয়ার মতো উপায় ছিল না। সারাক্ষণ মাথা দেওয়ালে ঠুকরে কাঁদতাম। আত্মহত্যা মহা পাপ বলে সেটা করতে গিয়েও করতে পারিনি। আমায় এমন একটি ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলো যেখানে কোনো জানালা নেই। আছে শুধু দরজা। সেটাতে হাজার চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও বাইরের মানুষ শুনতে পেত না।”

কথাগুলো বলেই ঠুকরে কেঁদে উঠলেন শেফালী বেগম। তার চোখে পানি দেখে মেহরিমা ও চুপ থাকতে পারলো না। সেও অঝোরে কাঁদতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে কান্না করে নিয়ে মেহরিমা জিজ্ঞেস করল,

“তারপর আপনি সেখান থেকে বের হলেন কিভাবে মা?”

“সে বেশ কয়েক মাস আগের কথা। একদিন দিপু আমাকে খাবার দিয়ে যাওয়ার সময় একটা ফোন আসে। সে কথা বলতে বলতে দরজা লাগাতে ভুলে যায়। বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে ফোনে। আমি সুযোগ বুঝে তার পিছন দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় চলে আসি। সে খেয়াল করেনি। যতক্ষণে খেয়াল করেছে ততক্ষনে আমি অনেক দূরে চলে এসেছিলাম। কিন্তু খেয়াল হতেই ও আমার পিছু নেয়। ওর সাথে আরো কয়েকজন লোক ছিল। তাদেরকেও লাগিয়ে দেয় আমাকে ধরার জন্য। আমার শরীরে শক্তি ছিল না। অনেক কষ্টে দৌড়াতে দৌড়াতে একটি ঘরের পিছনে এসে লুকাই। তারা সেখানেও এসে আমাকে খুঁজতে থাকে। তখনই একটি গাড়ি দেখতে পাই। সাদা রঙের একটি গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিলো। আমি কোন কিছু না ভেবেই গাড়ির দরজা খুলে সেটাতে গিয়ে উঠে পড়ি। গাড়িতে একটি ছেলে ও তার ড্রাইভার ছিল। ছেলেটি আমাকে দেখে কিছু বলার আগে আমি তার কাছে হাত জোর করে ইশারায় আমায় বাঁচাতে বলি। সে আমার কথা বুঝতে পেরে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি স্টার্ট দিতে।

ছেলেটা আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িটা আমার অপরিচিত ছিল না। সেটা ছিল ফিরোজ আহমাদ এর বাড়ি। ওর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরেই আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি এই বাড়ির লোকের সাথে তার কি সম্পর্ক। ছেলেটি জানায় তার পরিচয়। কিন্তু আমি নিজের পরিচয় গোপন করি। ভাগ্য ভালো সেদিন ঐ বাড়িতে ফিরোজ বা তার স্ত্রী ছিলো না। আমি ছেলেটিকে নিজের জীবনের সবকিছুই খুলে বলি। শুধু পরিচয় দেই না, যে আমি আলমিরের মা। সে আমার কথা শুনে অনেক কষ্ট পায়। আমাকে হেল্প করতে চায়। তাই সে আমাকে একটি বাড়িতে বাসা ভাড়া করে রেখেছে। আমার কথা এখন পর্যন্ত কাউকে বলে নি। আমি এখন সেই বাসা বাড়িতেই থাকি। আমার সব খরচ সরণ চালায়। সরণ ছেলেটা বড্ড ভালো। ও আমার কাছে আপন মানুষের মতো সবকিছু শেয়ার করতে থাকে। তোমার কথা আলমিরের কথা। সবকিছুই বলতো আমার কাছে। ও যে তোমাকে ভালবাসে সেটা ও বলেছিল। ওর মুখ থেকেই তোমাদের সম্পর্কে সব খবরা খবর পেতাম। কিন্তু ও জানতো না যে আমি তোমাদের কি হই। সুযোগ বুঝে একদিন ওর ফোন থেকে তোমার নাম্বারটা কানেক্ট করি। ফোনটা আমাকে ও’ই কিনে দিয়েছিল। আমি ওকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম আমাকে এমন কোন সিম কিনে দিতে যেটা দিয়ে ফোন করলে আননোন নাম্বার লেখা উঠবে। নাম্বার দেখা যাবে না। সেটাও ও’ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জানো যখন ও জানতে পেরেছে আলমির এর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে। তখন আমার কাছে এসে অনেক কান্না করেছিল। তোমাকে সত্যিই ছেলেটা অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু তারপরেও আমি খুশি যে তোমার মত একটি মেয়ে আমার আলমিরের জীবনে এসেছে। আমার এতিম ছেলে টাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে।”

এতোটুকু বলে থামলেন শেফালী বেগম। ওনার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবল মেহরিমা। তারপর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল,

“সব কিছুই বুঝলাম মা। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছেনা। আপনি যদি সরণের মুখ থেকেই শুধু আমাদের কথা জেনে থাকেন। তাহলে আমরা যখন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম সেখানে যে আপনি চিঠি দিয়ে এসেছিলাম সেটা কিভাবে দিলেন? আমরা ওখানে যাবো কিভাবে জানলেন। আর ওইখানকার সিসিটিভি ফুটেজ’ই বা নষ্ট করলেন কিভাবে?”

মেহরিমার কথা শুনে বেশ অবাক হলেন শেফালী বেগম। তিনি কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে বললেন,

“এসব কি বলছ তুমি মেহরিমা? আমিতো এমন কিছুই করিনি! আর কোন রেস্টুরেন্টের কথা বলছ তুমি? আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

উনার কথা শুনে যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেল মেহরিমা। সে এবার ভীষণ টেনশনে পড়ে গেল। শেফালী বেগম যদি সেই চিঠি না দিয়ে থাকে তাহলে তাকে কে দিয়েছিল চিঠি? আর কে’ই বা সাবধান করে ছিল ওখানে। মেহরিমা উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বলে উঠল,

“আপনি যদি ওই চিঠি না দিয়ে থাকেন! রেস্টুরেন্টে আপনি যদি না গিয়ে থাকেন। তাহলে কে গিয়েছিল মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আর মেহেরকে স্কুলে জোকার সেজে গিফট বক্সে যে চিঠি ও আংটি পাঠিয়েছিল সেটাও কি আপনি পাঠাননি? অন্য কেউ ছিল?”

“এসব তুমি কি বলছ মেহরিমা? আংটি, গিফট বক্স, চিঠি! আমি তো তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না। তারমানে আমি ছাড়াও অন্য আরো কেউ আছে যে তোমাদের সাবধান করতে চাইছে। কিন্তু কে সে? আমি তো ওরকম কিছুই দেইনি তোমায়।”

এবার দুজনেই ভীষন টেনশনে পড়ে গেল। তারা কেউই বুঝতে পারছে না এটা কার কাজ। কে এমন আড়ালে থেকে উনার মতই মেহরিমা কে সাবধান করছে। আর এত দামি এক্সপেন্সিভ আংটিও গিফট করেছে। সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে মেহরিমার। দুজনে স্তব্ধ হয়ে বসে চিন্তা করতে লাগলো।
,
,
,
ওদিকে মেহরিমা কে নামিয়ে দিয়ে আলমির অফিসের কাছে পৌঁছেও মনে শান্তি না পাওয়ায় সে আবারো মেহরিমার বাসার সামনে ফিরে আসে। গাড়ি থেকে নেমে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে থাকে মেহরিমার বাড়ির দরজার কাছে। সেখানে যেতেই ভিতর থেকে চিৎকার শুনতে পায় সে। দ্রুত রুমে ঢুকতেই দেখে ফ্লোরে একটি মহিলা র-ক্তা-ক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে। তার পাশেই বসে আছে মেহরিমা র-ক্তা-ক্ত ছু-ড়ি হাতে নিয়ে। মহিলাটি কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ওনার কথা বোঝা যাচ্ছে না। চোখের সামনেই মহিলাটা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৫
#M_Sonali

আলমির গাড়ি থেকে নেমে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে থাকে মেহরিমার বাড়ির দরজার কাছে। সেখানে যেতেই ভিতর থেকে চিৎকার শুনতে পায় সে। দ্রুত রুমে ঢুকতেই দেখে ফ্লোরে একটি মহিলা র-ক্তা-ক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে। তার পাশেই বসে আছে মেহরিমা র-ক্তা-ক্ত ছু-ড়ি হাতে নিয়ে। মহিলাটি কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু ওনার কথা বোঝা যাচ্ছে না। চোখের সামনেই মহিলাটা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

চোখের সামনে দেখা দৃশ্যটি যেন মেনে নিতে পারে না আলমির। সে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে মেহরিমা এবং ওই মহিলাটির দিকে। মেহরিমাও হতভম্বের মত চুপচাপ ফ্লোরে বসে আছে ছুড়ি হাতে নিয়ে। একবার সামনে থাকা মহিলাটির লাশের দিকে আর একবার আলমিরের দিকে তাকাচ্ছে সে। এভাবে কিছুক্ষণ নীরব থাকে দুজনেই। তারপর হঠাৎ করেই মেহরিমা জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে যায়।
,
,
জ্ঞান ফিরে নিজেকে আলমিরের রুমে আবিষ্কার করে মেহরিমা। মাথাটা প্রচন্ড ভাড়ি হয়ে আছে তার। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে রুমে ও ছাড়া অন্য কেউই নেই। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সে মনে করার চেষ্টা করে তার সাথে কি হয়েছিল। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পরতেই যেন শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। ভয়ে শরীরটা কেঁপে ওঠে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে,

“আলমির, আলমির কোথায় আপনি। এখানে আসুন। কোথায় আপনি? আপনার মাকে ওরা মেরে ফেলেছে আলমির। আপনার মাকে ওরা মেরে ফেলেছে। কোথায় আপনি। কেন এলেন না নিজের মাকে বাঁচাতে। আপনার মা আমার চোখের সামনে খুন হলেন। আমি কিছু করতে পারিনি আলমির।”

চিৎকার করতে করতে কান্না করতে লাগল মেহরিমা। ওর চিৎকার শুনে বাইরে থেকে দৌড়ে এল আলমির। ওর পাশে এসে বসে ওকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মেহরিমা চোখ বন্ধ করে একের পর এক চিৎকার করে যাচ্ছে। আলমিরে কথার দিকে যেন খেয়ালই নেই তার। অবশেষে ওকে থামাতে না পেরে রেগে গিয়ে ঠাস করে একটি থাপ্পড় মেরে দেয় আলমির। থাপ্পড়টা এত জোরে মেরেছে যে মেহরিমার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো নজরে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আলমির একটি ছোট করে নিশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“পাগল হয়েছ নাকি? এভাবে চিল্লাচ্ছো কেন তখন থেকে? এটা একটা ভদ্রলোকের বাড়ি। এখানে এভাবে চিল্লিয়ে পরিবেশ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।”

মেহরিমা বুঝতে পারছেনা আলমির নিজের চোখে তার মায়ের লাশ দেখার পরেও কিভাবে এত স্বাভাবিক হয়ে কথা বলছে। ও গালে হাত দিয়ে ধরে থেকেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“আপনি কিভাবে এমন শান্ত হয়ে বসে আছেন আলমির? যেখানে নিজের চোখে নিজের মায়ের লাশ দেখেছেন আপনি। আপনার মাকে ওরা কত নির্মমভাবে খুন করেছে। আপনার কি একটুও খারাপ লাগছে না?”

ওর কথার উত্তরে আলমির রাগী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বলল,

“সে আমার মা নয়। আমার মা সেদিনই মারা গেছে। যেদিন সে আমাকে অসুস্থ ছেড়ে চলে গেছে। আর তুমি যাকে খুন করেছো সে আমার জীবনের অভিশাপ ছিলো। তাই এতে আমার কোনো আফসোস নেই। শুধু একটি কথা জানতে চাই। তুমি তাকে কেন মারলে? আর তাকে পেলে’ই বা কোথায়? সেখানে কি এমন হয়েছিল যে তুমি তাকে এভাবে খুন করেছ? ভয় পেয়োনা লাশটাকে আমি অনেক আগেই লুকিয়ে ফেলেছি। কেউ জানতেও পারবেনা তার কথা। তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি টপ বিজনেসম্যান আলমিরের স্ত্রী। তোমার কোনো কিছু হলে আমার মান সম্মান থাকবে না। তাই তোমাকে প্রটেক্ট করার দায়িত্ব আমার।”

ওর এমন কথা শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মেহরিমার। সে কল্পনাও করতে পারছেনা আলমিরের মন মানসিকতা এতটা নিচু হতে পারে। সে কিভাবে এমনটা বলতে পারে? তার কি একটুও আফসোস হচ্ছে না নিজের মায়ের জন্য? ধরে নিলাম তার মা ছোটবেলা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলে এতটাই ঘৃণার পাত্র হয়ে গেল যে স্ত্রীর হাতে তাকে খুন হতে দেখে ও সে আফসোস করছে না! বরং স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মেহরিমা বেশ রেগে গেল। চোখের পানি মুছে নিয়ে রাগী গলায় বলল,

“আপনি কি সত্যিই মানুষ আলমির? এসব কি বলছেন আপনি, আপনার কোন ধারনা আছে? কিভাবে নিজের মায়ের সম্পর্কে এমনটা বলতে পারেন? আর আপনি ভাবলেন কিভাবে আমি তাকে খুন করেছি? তাকে আপনি মা বলে স্বীকৃতি না দিলেও আমি তাকে নিজের মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম। যখন তার সাথে দেখা হয়েছে। আর আপনি কিনা এমন ভাবে কথা বলছেন? আপনার উপর আমার ঘৃণা হচ্ছে আলমির। সত্যিই আপনি অনেক নিচু মনের মানুষ।”

আলমিরের চোখ যেন মুহূর্তেই রক্তলাল হয়ে গেল। সে হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁত কিটমিট করে বলল,

“তোর সাহস কিভাবে হয় আমার সাথে এভাবে কথা বলার? কি ভেবেছিস তোকে ভালোবাসি বলে সবকিছু মেনে নিবো? তোর প্রতি প্রথম দিন থেকেই সন্দেহ ছিল আমার। সে সন্দেহটা আজকে প্রবল হয়েছে। তু’ই সেই, তাই না? যে কিনা আমার ওই নষ্টা মায়ের সাথে মিলে আমাকে মারার চেষ্টা করে আসছিস। এখন সত্যি করে বল কি প্ল্যান ছিলো তোদের? কেনো আমাদের সাথে ভালবাসার নাটক করে মারতে চাচ্ছিস? আর নিজের সহপাঠীকে কেনো খুন করলি নিজে হাতে?”

ওর মুখে এমন কথা শুনে যেন পায়ের নিচের মাটি সরে গেল মেহরিমার। মাথাটি যেন ভনভন করে ঘুরতে শুরু করলো তার। সে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আলমিরের দিকে। অবাক হয়ে কাপাকাপা গলায় প্রশ্ন করল,

“এ এসব আ আপনি কি বলছেন আলমির? আ আপনার কি মাথা ঠিক আছে?”

“যা বলছি ঠিক বলছি। এবার কোনরকম চালাকি না করে সত্যি করে বল, তুই এবাড়িতে কোন উদ্দেশ্যে এসেছিলি? কেনই বা মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করে এসেছিস এতদিন? আমার মা নামের ওই খারাপ মহিলার সাথে কতদিন হল পরিচয় তোর? তার সাথে মিলে কতবার মারতে চেয়েছিস। আর এত বড় বড় নাটক কেন করেছিস বল? আমি জানি আমাদের সব রকম খবরা-খবর তুই তাকে দিতিস। আর সে তার বিনিময়ে নিশ্চয়ই তোকে কিছু দিতো। তাহলে এখন কেন খুন করলি তাকে নিজের হাতে? সত্যি করে সব কিছু বল নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না। কি ভেবেছিস তোকে এত সুন্দর করে যত্নে বিছানায় শুইয়ে রেখেছি তোকে ভালোবাসি বলে? এটা ভুল, তোর কাছ থেকে সত্যিটা জানতেই এখানে তোকে নিয়ে এসেছি। আমি চাইনা বাইরে এসব খবর ছড়িয়ে আমার বদনাম হোক।”

আলমিরের প্রতিটি কথা যেন মেহরিমার কানে সুই এর মত বিধছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। সে যেন আলমির কে চিনতে পারছে না। এ যেন নতুন কেউ। তার সাথে যেন সেই আগের আলমিরের কোনরকম মিল নেই। মেহরিমা স্তব্ধ হয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। মুখে কিছু বলার মত যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। ঠোট কেটে রক্ত বেড়িয়ে সেখানে রক্ত শুকিয়ে দলা পাকিয়ে গেছে ওর। ওকে চুপ থাকতে দেখে আলমির আরো বেশি রেগে গেল। এবার ওর দু বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,

“কি হল চুপ করে আছিস কেন, উত্তর দে। কেনো করলি এসব। কেন এত নাটক করলি আমার সাথে আর দিদুনের সাথে? তোকে তো আমরা কম ভালোবাসা দিইনি। তার পরেও কেন ঐ নষ্টা মহিলার সাথে মিলে এত কিছু করলি। কেনই বা খুন করলি তাকে আজ। কি লাভ আছে তোর এতে? এইজন্যই তোর মত মেডেলক্লাস মেয়েদের আমি একদম পছন্দ করতাম না। তোরা টাকার লোভে সব কিছু করতে পারিস। তোদের মান ইজ্জত বলতে কিছু নেই। নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করিস না। নষ্ট ঘরের নষ্ট পরিবারের নষ্টা মেয়ে তোরা। এই জন্যই কোন মেয়েকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। আই হেট ইউ মেহরিমা আই হেট ইউ।”

কথাটি বলেই জোড়ে করে ঝাঁকি দিয়ে ছেড়ে দিল ওকে। মেহরিমা দুহাতে প্রচন্ড ব্যথা পেল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেলো আলমিরের এসব কথায়। সে এবার ভীষণ রেগে গেল। সবকিছু সহ্য করতে পারলেও নিজের পরিবার নিয়ে কথা বললে সেটা মেহরিমা একদমই সহ্য করতে পারে না। সে আলমিরের কাছ থেকে সরে বসে লাফিয়ে উঠে নিচে দাঁড়ালো। দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

“ঠিক বলেছেন আমি মেডেলক্লাস নষ্টা মেয়ে। তাই আপনার মত একটি মানুষ রূপি অমানুষ লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার। আপনার মতো একটি মানুষরূপী জানোয়ার কে ভালবেসেছি আমি। যে নিজের মাকে সম্মান দিতে জানে না। যে নিজের মায়ের ব্যাপারে এমন বিশ্রী ধারণা রাখে। সে অন্যের মেয়েকে কি সম্মান দেবে। আজকে নিজের আসল চেহারা দেখিয়েই দিলেন মিস্টার আলমির। ঘৃণা হচ্ছে আপনার প্রতি আমার।”

কথাগুলো বলে শেষ করতেই আলমির লাফিয়ে ওঠে সজোরে একটি থাপ্পর বসিয়ে দিল মেহরিমার গালে। তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়ল দেওয়ালের উপর সে। সাথে সাথে কপাল ফেটে গল গলিয়ে রক্ত বের হতে লাগল তার। আলমির সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে সেটা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলো মেহরিমার গায়ে। বেল্ট এর আঘাত সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতে লাগল ব্যথায়। নিচতলা থেকে দিলরুবা বেগম এবং মেহের ওর চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলো উপর তলায়। এসে দেখল মেহরিমা ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছে। আলমির ওকে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে। দিলরুবা বেগম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আলমির থেমে যায়। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে চলে যায় সে। মেহের দৌড়ে গিয়ে নিজের বোনকে জরিয়ে কাঁদতে লাগল আপু আপু বলে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৩৬
#M_Sonali

পুরো ১৫ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আসে মেহরিমার। আলমিরের হাতের প্রচন্ড আঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হাড়ায় সে। জ্ঞান ফিরতেই সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে সে। প্রায় ১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠেছে তার। জ্বরে যেন সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ফিরোজ আহমাদ অনেক রকম মেডিসিন ইঞ্জেকশন দিয়েও কোনভাবে জ্বর আয়ত্তে আনতে পারছেন না। মেহরিমার জ্ঞান ফিরতে দেখে কিছুটা আনন্দিত হলেও পরক্ষণেই মুখটা শুকিয়ে গেল তার। কেননা ওর জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে জ্বরের তাপ সহ্য করতে না পেরে আবারও জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলে। ওর এমন অবস্থা দেখে উঠে দাড়ায় ফিরোজ আহমাদ। দিলরুবা বেগম এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“আন্টি ওকে আর এভাবে বাসায় রাখা ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে এডমিট করতে হবে। মেহরিমার অবস্থা মোটেও ভালো দেখছিনা। আমি বুঝতে পারছি না ওর এত বেশি জ্বর উঠলো কিভাবে। আপনি আমাকে ঠিক করে কিছু বলছেনও না। ওর হাতে এগুলো কিসের চিহ্ন? দেখে মনে হচ্ছে কেউ নির্মম ভাবে মেরেছে ওকে। কিন্তু কে করলো এমন কাজ?”

দিলরুবা বেগম মুখে কাপড় গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ফিরোজ আহমাদের প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। নিজের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই পাশ থেকে মেহের কান্না করতে করতে বলে উঠল,

“হ্যা আঙ্কেল আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার আপুকে দুলাভাই অনেক মেরেছে। আমি দুলাভাইকে কখনো ক্ষমা করব না। কখনো তাকে আর ভাইয়া বলে ডাকবো না। সে খুব খারাপ, খুব পঁচা। আমার আপুকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সে।”

কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল মেহের। ওর কথা শুনে যেন অবাক হয়ে গেলেন ফিরোজ আহমাদ। তিনি বড় বড় চোখে দিলরুবা বেগমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,

“ও এসব কি বলছে আন্টি? আলমির মেরেছে মেহরিমাকে? কিন্তু এমন কেন করল ও? কয়েকদিন আগেই তো ওদের বিয়ে হয়েছে। কত আনন্দে ছিল ওরা। হঠাৎ এমন কি হলো যে এভাবে নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুললো আলমির। ওর কাছ থেকে অন্তত এটা আমি কখনোই আশা করিনি।”

উনার কথার উত্তরে দিলরুবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন,

“এখন ওসব কথা ছাড়ো ফিরোজ। আমি তোমাকে সব কিছুই বলবো। আমাকে একটু সময় দাও। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেহরিমাকে হসপিটালে নিয়ে চলো। মেয়েটির যেন কোন কিছু না হয়। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা।”

উনার কথার উত্তরে ফিরোজ আহমাদ আর কিছু বললেন না। দ্রুত মেহরিমা কে নিয়ে রওনা হলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
,
,
,
পুরো সাতদিন পর হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিলো মেহরিমা কে। সে এখন অনেকটাই সুস্থ। গত সাত দিনে এক মিনিটের জন্যও দিলরুবা বেগম ওর কাছ থেকে দূরে যায়নি। সারাক্ষণ ওর পাশে পাশেই থাকতো। কিন্তু মেহরিমা কোন প্রকার কথা বলে নি ওনার সাথে। সব সময় মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে অভিমানে। খুব প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলতো না। এমন কি এখন পর্যন্ত দিলরুবা বেগমের কাছে এটাও বলেনি যে কি কারণে আলমির তাকে এভাবে মেরেছে। কি এমন হয়েছিল। গত সাত দিনের মাঝে আলমির একবারের জন্যও আসেনি ওকে দেখার জন্য, বা ওর কোনো খোঁজ নিতে। তবে হসপিটালের সম্পন্ন বিল ও’ই মিটিয়েছে।

হসপিটাল থেকে ছেড়ে দিলে মেহরিমা কে বাসায় নিয়ে যেতে চায় দিলরুবা বেগম। কিন্তু মেহরিমা ও বাসায় আর ফিরবে না। সে মেহেরের হাত ধরে নিয়ে চলে যেতে নিলেই দিলরুবা বেগম সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর হাত ধরে বলে,

“দিদিভাই এভাবে চলে যেও না দোহাই লাগে তোমার। তুমি জানো না গত সাতটা দিন আমি ধুকেধুকে মরেছি। ঠিকমত খেতে পারিনি ঘুমাতে পারিনি। সারাক্ষণ একটা চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরেছে। তোমার কিছু হলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা। তোমাকে আমি নিজে নিয়ে এসেছিলাম ঐ বাড়িতে। আমার নাতি বউ বানাবো বলে। কখনো চিন্তাও করিনি এতো কিছু হয়ে যাবে তোমার সাথে। এখন পর্যন্ত জানিনা আলমির তোমাকে এভাবে কেন মেরেছে। ওকে অনেকবার প্রশ্ন করার পরেও উত্তর পাইনি। তুমিও কিছু বলছো না। এভাবে আমাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলে রেখে চলে চলে যেওনা। আমায় সব কিছু খুলে বলো। সব জানতে চাই আমি।”

মেহরিমা কাঁদো-কাঁদো চোখে দিলরুবা বেগম এর দিকে তাকাল। তার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভির গলায় বলল,

“আমাকে ক্ষমা করবেন দিদুন। আমি আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। কিছু জানতে হলে নিজের নাতিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আমার আত্মসম্মান আমার কাছে সবচাইতে বড়। নিজের আত্মসম্মানের সাথে কোনো রকম কম্প্রোমাইজ করতে পারবো না। আমার বাবা আমাকে কখনোই মাথা নত করে বাঁচতে শিখায়নি। আপনার নাতিকে বলে দিয়েন, খুব দ্রুত আমি তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো। তার সাথে সংসার করা তো দূর। তার মুখটাও আর কখনো দেখতে চাই না। পৃথিবীতে সবচেয়ে তীব্র ভাবে ভালবেসে ছিলাম তাকে। তার চাইতেও একশ গুন তীব্রভাবে আজ থেকে ঘৃণা করব তাকে। আমার নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে যে আমি তাকে কখনো ভালোবেসে ছিলাম। যে ব্যক্তি কোন কিছু না জেনে, না বুঝে নিজের স্ত্রীকে সন্দেহ করে। তাকে আঘাত করতে একবার ভাবে না। তার ব্যাপারে বিশ্রী ভাষা নিক্ষেপ করতে মুখে বাধে না। সেই ব্যক্তির সাথে আর যাই হোক একসাথে বসবাস করা যায় না। আমি তার নামটাও শুনতে চাই না। আপনি ফিরে যান দিদুন। আমি আপনাকে সম্মান করি, ভালোবাসি। ঠিক আগে যেমন বাসতাম তেমনই। কিন্তু তাই বলে আপনার কথা রেখে ওই বাড়িতে আমি আর কখনোই ফিরে যেতে পারব না। আজ থেকে আমার পথ আলাদা। আমি আমার বোনকে নিয়ে আলাদা থাকবো।”

কথাগুলো বলে দিলরুবা বেগম কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে মেহেরকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো মেহেরিমা। দিলরুবা বেগম অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে। ওকে আটকানোর মতো যেন আর কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। হসপিটাল থেকে বাইরে বের হতেই সরণ কে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মেহরিমা। ওকে দেখেও না দেখার ভান করে অন্য দিক দিয়ে চলে যেতে নিলেই সরণ দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। করুন গলায় বললো,

“এভাবে দেখেও না দেখার মতো করে কেন চলে যাচ্ছো মেহরিমা? ভালো না হয় না’ই বাসলে। একজন বন্ধু তো ভাবতে পারো। বন্ধু হিসেবে না হয় একটু কথা বললে আমার সাথে। আমি কি এতই খারাপ যে আমাকে বন্ধুও ভাবা যায় না?”

মেহরিমা কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ করে রইলো। তারপর ছোট করে নিশ্বাস নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে সরণের দিকে তাকিয়ে বলল,

“বিষয়টা ভালো খারাপ বা বন্ধুত্বের নয় সরণ। আমি চাই না কারো সাথে কথা বলতে। কারো সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখতে। আসলে মানুষ জাতির উপর থেকে বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা সব উঠে গেছে আমার। আর তারা যদি হয় বড়লোক তাহলে তো কথাই নেই। আপনি বাড়ি ফিরে যান সরণ। আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না আপনার সাথে। আমার রাস্তা ছাড়ুন।”

কথাগুলো বলে ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই আবারও সামনে এসে দাঁড়ায় সরণ। করুন চোখে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে বলে,

“প্লিজ মেহরিমা এভাবে আমাকে ইগনোর করো না। আমি কি কখনো তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছি? যে এভাবে আমায় শাস্তি দিচ্ছ। বিশ্বাস করো আমি আর কোন খারাপ মতলবে তোমার সামনে আসিনি। কখনো আসবোও না। শুধু তোমার একজন ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে চাই সারা জীবন। এর বেশি কিছু না। অন্তত একজন বন্ধু হিসেবে সাহায্য করতে দাও তোমার। তোমাকে সাহায্য করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। প্লিজ মেহরিমা আর না করো না। চলো আমি তোমাকে বাড়িতে পৌছে দিচ্ছি। গাড়িতে উঠো।”

ওর কথার উত্তরে মেহরিমা কিছু বলবে তার আগেই মেহের ওর হাতে ঝাকি দিয়ে বলে উঠলো,

“আপু চলনা আমরা ভাইয়ার গাড়িতে উঠি। শুধু শুধু কেন জেদ করছো। এভাবে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। লোকজন কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখো।”

ওর কথা শুনে মেহরিমা কিছু বলতে গিয়েও আর বলল না। চুপ চাপ গিয়ে সরণ এর গাড়িতে উঠে পরল। সরণ ভীষণ খুশি হয়ে ওর পিছুপিছু গিয়ে ড্রাইভার এর পাশে উঠে বসল। তারপর ওকে নিয়ে রওনা হল ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মেহরিমার বাবার বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামতেই গাড়ির দরজা খুলে মেহেরকে নিয়ে নেমে আসলো সে। দ্রুত গিয়ে বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখল দরজায় তালা দেওয়া। তখনই মনে পড়লো বাড়ির চাবিটা আনতে ভুলে গেছে সে। চাবিটা তো আলমির এর রুমে রয়েছে। কি করবে এবার সেটা চুপচাপ ভাবতে লাগলো মেহরিমা। ওকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহের বলে উঠলো,

“আপু বাড়ির চাবিটা তো মনে হয় তুমি ওই বাড়িতে ফেলে এসেছ। এখন কি করবে? ওই বাড়িতে গিয়ে চাবি নিয়ে আসবে? তুমি গেলেও আমি কিন্তু আর ওখানে যাবো না।”

মেহেরের কথা শুনে কোন উত্তর দিল না মেহরিমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। দেখল একটি ইটের টুকরো পরে আছে। সেটা তুলে নিয়ে এসে তালার ওপর সজোরে আঘাত করতে লাগলো সে। এতে হাতে বেশ ব্যথাও পাচ্ছে। তবুও যেন শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে তালাটি ভাঙার।

“আপু কি করছো তুমি! এভাবে কি তালাটি ভাঙ্গা যাবে নাকি। তোমার হাতে তো ব্যথা পাচ্ছ। হাত কেটে যাবে এরকম করো না।”

কিন্তু মেহরিমার কানে যেন এখন কোন কথাই ঢুকছে না। সে যেন শরীরের সমস্ত শক্তি এবং রাগ দিয়ে তালার উপর আঘাত করে যাচ্ছে। তখনই সরণ ওর কাছে এগিয়ে এলো। ওকে ডেকে বলল,

“পাগল হয়ে গেছো নাকি মেহরিমা? সবেমাত্র হসপিটাল থেকে ফিরলে। তোমার শরীর এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আর তুমি কিনা এমন শুরু করেছো। দেখি সরো আমি তোমাকে হেল্প করছি।”

কথাটি বলে একপ্রকার জোর করেই ওকে একটু দূরে সরিয়ে দিল সে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে বলল,

“এখানে দাঁড়াও আমি আসছি।”

গাড়ির কাছে ফিরে গিয়ে গাড়ি থেকে একটি লোহার রেন্স নিয়ে এসে সেটা দিয়ে তালার ওপর জোরে জোরে কয়েকটা বারি দিতেই ভেঙে গেল তালা। সাথে সাথে ভাঙা তালাটি সরিয়ে ফেলে রুমের দরজা খুলে মেহেরকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল মেহরিমা। তারপর সরণের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“অনেক ধন্যবাদ, আমাদের এতটা হেল্প করার জন্য। এখন আপনি আসতে পারেন।”

কথাটি বলেই ওর মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল মেহরিমা। তারপর মেহেরকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। সরণ সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর গাড়িতে ফিরে এসে ড্রাইভারকে বললো বাজারে যেতে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,