নবপ্রণয় পর্ব-০২

0
157

#নবপ্রণয় ( ২)
#হৃদিতা_রহমান

সকালে আবিরের ঘুম ভাঙ্গলো রুহির ডাকে। আবির ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রুহি বিছানায় বসে আছে। রুহির চাহনি দেখে আবিরের মনে হলো সে কিছু বলতে চায়। আবির জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিছু বলবে? ‘

‘ তুমি কি ভার্সিটিতে যাবে?’

‘ এটা কেমন প্রশ্ন? স্কুলে যাবো নাকি এতবড় মানুষ?’

‘ না মানে, একটু ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগতো। চেকআপের জন্য। ‘

‘ কখন যাবে?’

‘ সাড়ে এগারোটার দিকে যাবো। বারোটায় ডাক্তারের সাথে এপারমেন্ট আছে। মা বলছে তোমাকে যেনো সাথে নিয়ে যাই। তোমার সমস্যা হলে, দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।’

‘ কি আজব, আমার আবার কি সমস্যা থাকবে? আর তুমি একা যাবে মানে? তুমি কি আমাকে ঘর ছারা করতে চাও,না কি? তুমি একা ডাক্তারের কাছে গেলে তোমার শ্বশুর আমাকে আস্ত রাখবে মনে করছো? শুনো,আমি ভার্সিটিতে পেজেন্টেশন দিয়েই চলে আসবো। তুমি রেডি হয়ে থেকো।’

‘ আচ্ছা। ‘

আবির নাস্তা করে ভার্সিটিতে চলে গেলো। রুহি রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখে মায়ের ৬ টা মিসড কল। রুহির মনে হলো কলব্যাক করা দরকার। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি দরকারে ফোন করেছে। ডায়াল করতে চেয়েও রুহি ফোন রেখে দিলো। এই মুহুর্তে মন খারাপ করতে চায় না সে।

আবির ফিরে এলো এগারোটার আগেই। রুহি রেডি হয়েই ছিলো। আবির জামা পাল্টে বের হলো। জামান সাহেব ডয়িংরুমে বসে ছিলো, আবিরকে ডেকে বরলো,
‘ গাড়ি নিয়ে যা।’

অবাক হলো আবির। বাবা এর আগে কখনো তাকে গাড়ি নিতে বলে নাই। এমনকি আবির বাবার কাছে গাড়ি চেয়েও পায় নি। সেবার বন্ধুরা মিলে রাজশাহী ঘুরতে যাবার প্ল্যান করলো। যাবার আগে বাবার কাছে গাড়ির চাবি চেয়েছিলো আবির কিন্তু তিনি আবিরকে সাফ জানিয়ে দিলো গাড়ি দেওয়া যাবে না। তারপর থেকে জরুরি দরকার না হলে বাবার গাড়িতে আবির উঠেই নি। বাইকটাও ভাইয়া কিনে দিয়েছিলো। আবির বললো,

‘ বাবা, বাইক আছে তো।’

‘ বাইকে রুহির সমস্যা হবে। আর তুই তো ড্রাইভিং পারিস, লাইসেন্স ও আছে। সমস্যা কি?’

‘ কোনো সমস্যা নেই।’

আবির রুহিকে নিয়ে রওনা হলো।
” ডাক্তার আফরোজা আক্তার” দরজার উপরের নামটা পড়লো আবির। নামের নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, গাইনী বিশেষজ্ঞ সার্জন,এমবিবিএস ( ডিএমসি)।

বারোটা চার মিনিটে আবির রুহিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ডাক্তারের সাথে কথাবার্তা বলে রুহিকে তিনি ভিতরে যেতে বললেন। রুহি উঠলো, আবির ডাক্তারকে বললো,
‘ ম্যাডাম, পরিক্ষা করে শুধু দেখবেন বাচ্চা সুস্থ আছে কি না। ছেলে মেয়ে যাই হোক, তাতেই আমরা খুশি। আমাদের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ না।আপনিও বলবেন না।’

ডাক্তার আফরোজা আক্তার আবির দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ঘন্টা খানিক পর আবির রুহিকে নিয়ে বের হলো হাসপাতাল থেকে। গাড়িতে বসে আবির বললো,

‘ তুমি যে সব সময় এত এত জ্ঞান দাও, এখন তো দেখি তোমার নিজেরই জ্ঞানের অভাব। কোথাও যদি জ্ঞান কিনতে পাওয়া যেতো, তোমাকে দুি সের জ্ঞান কিনে দিতাম।’

‘ আরে অদ্ভুত, এসব বলতাছো কেনো?’

আবির গাড়ি ছেড়ে দিলো। হাসপাতালের গেইট ছেড়ে রাস্তায় নামলো গাড়ি। আবির বললো,
‘ ডাক্তার কি বললো শুনো নি? কানে তুলো দিয়ে ছিলে না কি?’

‘ বিশেষ কিছু বলেছে বলে তো শুনলাম না।’

‘ ডাক্তার বললো,তোমার শরীর দুর্বাল। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হচ্ছে। এরকম হতে থাকলে বাচ্চা পুষ্টি হীনতায় ভুগবে।’

‘ আরে দূরু। মায়ের কাছে কখনো মেয়ের খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম হয় না। এসব কথা ডাক্তাররা এমনি বলে। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি ডাক্তারের চেম্বারের সামনে যেয়ে দাড়িয়ে থাকো। দেখবে প্রতিটা মানুষকে তিনি একই কথা বলছেন।’

‘ হয়, তুমি তো সবজান্তা।’

বড় রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ছোট রাস্তায় নামলো। এই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে কয়েক মিনিট,তারপর বাড়ি। ধীরে সুস্থেই গাড়ী চালাচ্ছিলো আবির। হঠাৎ রুহি গাড়ি থামাতে বললো। আবির রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হলো?’

রুহি গাড়ির জানালা দিয়ে হাতের এশারা করে একটা দোকান দেখিয়ে বললো,
‘ওই দোকানের জিলাপি সেই লাগে। অনেকদিন খাওয়া হয় না। চলো জিলাপি খাই।’

‘ তুমি জিলাপী খাবে?’

‘ কোনো, সমস্যা কি?’

‘ নাহহ,কোনো সমস্যা নেই, চলো।’

গাড়িতে থেকে নামলো দুজন। দোকানটা মধ্যম রকমের। একপাশে মাটির চুলায় কাঠের খড়ি জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে জিলাপি। পেয়াজু,সিঙ্গারা,একই চুলায় ভাজা হয়। দোকানে তেমন ভীর না থাকলেও দক্ষিণ কোনের একটা টেবিলে চারটা ছেলে বসে আছে। আবির রুহিকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে জিলাপির অর্ডার দিলো। নয-দশ বছরের একটা পিচ্চি ছেলে এসে জিলাপী ভর্তি দুটো প্লেট রেখে গেলো টেবিলে। খাওয়া শেষে আবির বিল দিতে যাবে রুহি ডেকে বললো,
‘ বাসায় বাবা মা আছেন। এক কেজি জিলাপী তাদের জন্য প্যাকেট করে নিয়ে এসো।’

আবির জিলাপী নিয়ে, বিল দিয়ে রুহির কাছে চলে এলো। তারপর রুহিকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলো তখন কানে এলো,

‘ মালটা কিন্তু কড়া আছে রে,এই জন্যই তো বড় ভাইয়ের পর ছোট ভাই খাচ্ছে। এমন জিনিস তো ছাড়া যায় না।’

কথাটা আবিরের কানে আগুনের শিশার মত ঢুকলো। ঘাগ ঘুড়িয়ে ছেলে গুলোর দিকে তাকালো সে। ছেলে গুলো কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসছে। আবিরের চোখ দুটো লাল হয়ে গেলো রাগে। রুহি আবিরের হাত ধরে টেনে বরলো,
‘ চলো।’

নিঃশব্দে আবির রুহিকে নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলো। রুহিকে গাড়িতে বসিয়ে আবির বললো,
‘ ওহহ,বিল দেওয়ার সময় ম্যানিব্যাগ ফেলে এসেছি। তুমি বসে ৩০ সেকেন্ডে নিয়ে আসছি ওটা।’

আবির হোটেলে ঢুকে সোজা চুলার কাছে চলে এলো। তারপর একটা কাঠের খড়ি টেনে বের করলো চুলা থেকে। হাত চারেক লম্বা খড়ির মাথায় আগুন জ্বালছে দাউদাউ করে। আবির সেটা নিয়ে ছেলেগুলোর পাশে এসে দাড়ালো। ছেলে গুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো আর হাসছিলো। তারা চোখ তুলে আবিরকে দেখলো, আবিরের দিকে চাওয়া মাত্র আবির আঘাত করলো তখন কথা বলার ছেলেটার মুখে। আবির যে ফিরে এসে হঠাৎ আক্রমন করতে পারে কখনো ভাবতেও পারে নি ছেলে গুলো। বাকি তিনজন কিছু বুঝে উঠার আগে তাদের গালেও একটা করে বারি পড়লো। এদিকে আবিরের গায়ে যেনো ক্ষ্যপা মহিষের শক্তি। একের পর এক আঘাত করেই চললো ছেলে গুলোকে। খড়ির আগুন নিভে গেছে ততক্ষণে কিন্তু, আবিরের কোনো থামা থামি নেই। আঘাতের পর আঘাত করে চললো সে। চার জনের সাথে একা পেরে উঠার কথা নয়। কিন্তু, তারা চারজনই ছিলো বেকায়দায়। তারা আঘাত প্রতিরোধ করার আগেই অবস্থা খারাপের দিকে গড়ালো।

আবির হোটেলে ঢুকার সাথে সাথে রুহুির হুস হলো। সে বুঝতে পারলো আবির মানিব্যাহ আনতে যায় নি। গেছে ছেলে গুলোর কাছে। রুহি গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। হোটেলের দরজার সামনে আসতেই চিৎকার কানে এলো তার। দৌড়ে ভিতরে ঢুকে দেখলো ম্যানেজার আর কর্মচারী গুলো এক পাশে দাড়িয়ে আছে। ছোট বাচ্চাটা ভয়ে কাপছে রীতিমতো। রুহি দৌড়ে যেয়ে আবিরের হাত চেপে ধরলো। হাত থেকে কাঠের খড়িটা কেরে নিয়ে ছুড়ে দিলো দুরে। আবিরকে নিজের দিকে ফিরিয়ে রুহি বরলো,
‘ পাগল হয়েছো তুমি? কুকুর তোমাকে কামড় দিলে কি তুমিও কামড় দিবে?’

রুহিকে দেখে আবির শান্ত হলো। ছেলে গুলো দেখলো এই আজরাইলের হাত থেকে বাচার একমাত্র মাধ্যম রুহি। ছেলে গুলো রুহির পা চেপে ধরে ক্ষমা চাইলো। ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে রুহি দেখলো করুন অবস্থা সবার , নিশ্চিত হাসপাতালে থাকতে হবে সপ্তাহ খানিক। আবির ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করে বললো,
‘ কুকুর পায়ে কামড় দিলে,কুকুরকে কামড় না দিয়ে বাশ দিয়ে পিটাকে হয়৷ হাসপাতালের বিলটা আমার বাপের কাছ থেকে নিয়ে আসিস।’

আবির রুহির হাত ধরে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।

ঘড়িতে রাত, বারোটা। আবির ছাদে শুয়ে আছে। আকাশে থালার মত একটা চাঁদ। জোছনার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে সারা শহর। আকাশের ওই চাদের দিকে তাকিয়ে আবির ভাবছে আবিদের কথা।

আবিদ ছিলো আবিরের তিন বছরের বড়। আবির আবিদকে ভাইয়া বলে ডাকলেও তুই আমি করে কথা বলতো। দুজনের মাঝে সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুর মতই। আবিদ ছোটো বেলা থেকেই ছিলো অত্যান্ত মেধাবী,পড়াশোনা,খেলাধুলা ইত্যাদি সবকিছুতে সে ছিলো অন্যতম। এই জন্য বাবার আদর আবিদ বেশি পেতো। কিন্তু, আবিদ বাবার কাছে যতটা ভালোবাসা পেতো, তারচেয়ে কয়েক গুন বেশি ভালোবাসতো আবিরকে। আবিদ ক্লাস সেভেনে ক্যাডেক কলেজে চলে যায়। আবিদ যখন ছুটিতে বাড়ি আসতো তখন তার কাছে ক্যাডেট কলেজ,নিয়ম,শৃঙ্খলা, পড়াশোনা, অনিয়মের শাস্তি ইত্যাদি নানা রকম গল্প শুনতো আবির। আবিদ আবিরকে বলতো, “তোকে আমার মত হতে হবে না। আমি কিন্তু আমার মত হতে পারি নি। বাবা যেমনটা চেয়েছে তেমনি হয়েছি। কিন্তু তুই হবি তোর মত। নিজের ইচ্ছে মত, সব কিছু করবি। বাবাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি যেটা করতে পারি নি সেটা তুই করবি। স্বাধীন একটা জিবন তোর অধিকার।”

এই কারনেই আবিরের ভাইকে এত ভালো লাগতো। ভাইয়ের জন্য এমন কিছু নেই,যা সে করতে পারতো না। ছুটিতে বাড়িতে এসে আবিদ যদি সাহস করে দুই একটা ভুল করেও ফেলতো। বাবার কাছে ধরা খাবার পর সব দোষ আবির নিজের কাধে নিয়ে নিতো। আবির একবার জিজ্ঞেস করলো,
‘ দোষটা তো আমার, তুই কেনো নিজের কাধে নিলি? বাবার কাছে তো আরো খারাপ হয়ে গেলি।’

ভাইয়ের কথা শুনে আবির হাসতে বলেছিলো,
‘ বাবার কাছে তুই এমনিতেই গুড বয়। আর আমি জঘন্য। বাবার কাছে আমি আলকাতরা, আর তুই হলি দুধের মত। এখন দুধের মধ্যে একটা মাছি পড়লে কিন্তু দেখতে খারাপ লাগবে। অথচ,আলকাতরায় যতই মাছি পড়ুক তাতে কিছু যায় আসে না।’

বাবা যদি আবির কে বলতো বাসার ময়লা নিচে ফেলে আসতে আবির সেটা কখনো করতো না। কিন্তু, আবিদ যদি বলতো দশ কিঃমিঃ দূর থেকে ঘুরে আসতে সাথে সাথে চলে যেতো আবির। আবির এমনিতেই ছিলো উরুউরু টাইপের। তারপর, ভরইয়ের সমার্থন পেয়ে আরো খানিকটা বিগরে গেলো। জামান সাহেব একটা সময় পর হাল ছেড়ে দিলেন। তিনি বুঝে গেলেন ছোট ছেলেকে মানুষ করতে পারবেন না। ছোট ছেলে তার ধরা ছোয়ার বাইরে।

আবিদ ইন্টার মিডিয়েট শেষ করেই আর্মিতে জয়েন করলো। জামান সাহেবেরও এটাই ইচ্ছে ছিলো। তিনি পুলিশ অফিসার হলেও ছেলেকে আর্মির পোশাকে দেখতে চাইতেন। বিএমএ লং কোর্স, দুই বছর টেনিং শেষে আবিদ জয়েন করলো লেফটেন্যান্ট হিসেবে। মেধা,পরিশ্রম আর সাহসীকতার জন্য তিন বছরের মধ্যে কমিশন লাভ করে লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়ে গেলো। আবিদ প্রতিবার ছুটি শেষে যাবার সময় আবিরের কাধে হাত রেখে বলতো,
‘ শোন,তোর যা ইচ্ছে তুই তাই করবি। কিন্তু, সেটা পড়াশোনা ঠিক রেখে। আমি তোকে বলছি না,ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হ। বাবার সম্মানও বাড়াতেও বলছি না। বাবার এমনিতেই অনেক সম্মান আছে। আরো যদি বাড়াতে হয় তার জন্য আমি আছি। কিন্তু, তুই এমন কিছু কখনো করবি না যাতে বাবার সম্মানটা কমে যায়। তুই কিছু করতে না পারলেও বাবা তোকে কিছু বলবে না। কিন্তু আমাকে ধরবে। সেদিন, বাবার সামনে আমার মাথাটা যেনো নিচু না হয়ে যায়। বাবার সামনে আমি তোকে নিয়ে গর্ব করতেও চাই না। শুধু এতটুকু দেখাতে চাই, যে কড়া শাষনে না রেখেও সন্তান মানুষ করা যায়। সন্তানকে তার ইচ্ছে মত চলতে দিলেও সে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।তুই হলি বাবার সাথে আসার একটা খেলা, যে খেলায় আমাকে জিততেই হবে।’

‘ চিন্তা করিস না, বলটা যেহেতু আমি। সুতরাং, গোল তুই দিবি৷ কিন্তু… ‘

‘ কি? ‘

‘ আমার একটা বাইক লাগবে। বাইক ছাড়া মেয়ে পটানো কষ্টকর।’

আবিদ হেসে বললো,
‘ ভালো হয়ে যাও আবির। তুমি মিয়া ভালো হইলা না।’

ছয়মাস পর,
আবির ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে বাসায় তার পছন্দের বাইকের উপর আবিদ বসে আছে। ভাইকে দেখেই আবির চিৎকার করে উঠে জরিয়ে ধরে।
‘ তুই কখন আসলি?’
‘ আজকেই। ১৩ দিনের ছুটি। বাইক পছন্দ হয়?’

‘ এটা আমার?’

‘ নাহ,গায়ের লোকের।’

আবির ভাইকে জরিয়ে ধরে বলে,
‘ ধন্যবাদ ভাইয়া।’

আবিদ আবিরের হাতে বাইকের চাবি দিতে যেয়েও দিলো না। আবিদ বললো,
‘ চাবি দিবো কিন্তু তার আগে আমাকে একটা কথা দিতে হবে।’

‘ কি কথা?’

‘ যে ভাবে ইচ্ছে মরে যা, কিন্তু বাইক এক্সসিডেন্টে মরতে পারবি না।’

আবির ভাইকে ধরে কথা দিলো,
‘ ঠিক আছে, কথা দিলাম বাইক এক্সিডেন্টে মরবো না। চল একটা চক্কর দিয়ে আসি। তুই চালা, আমি শিখে রাখি।’

খুশি হলো আবিদ। ছোটো ভাইকে বাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

আবিদের ছুটি তের দিনের মধ্যে ছয় দিন শেষ। আবিদ মুখ কালো করে আবিরের রুমে ঢুকলো। আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিরে, মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে রাখছিস কেনো? এসপি সাহেব কি মাইর দিছে?’

‘ তারচেয়ে খারাপ কিছু।’

‘ কি?’

‘ বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চাইছে।’

ভাইয়ের কথা শুনে আবির একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। আবিদ বিরক্ত হলো।
‘ ষাড়ের মত চেচাচ্ছিস কেনো?’

‘ খুশির খবর শুনে চিৎকার করবো না?’

‘ এটা তোর কাছে খুশির খবর মনে হয়? আমার কাছে মহা বিপদ সংকেত।’

‘ আজব তো, বিপদের কি আছে? বিয়ের বয়স হয়েছে, বিয়ে করবি। সবারই তো একদিন বিয়ে করতে হয়। তুই কি বিয়ে করতে চাস না? সমস্যা কি বলতো? গোপন কোনো সমস্যা? বেজায়গায় গুলি টুলি লাগে নাই তো?’

‘ ফাজলামো বন্ধ কর। বিয়ে করায় আমার সমস্যা নেই। কিন্তু পাত্রী বাবার পছন্দ করা। এখন, আমার যদি পছন্দ না হয় তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। বাবাকে বলতেও পারবো না।’

‘ বাবাকে বলতে বলেছে কে তোকে? তুই আমাকে বলবি, আমি বাবাকে বলে দিবো। ঝামেলা শেষ।’

ছোট ভাইয়ের কথায় খুশি হলো আবিদ। আসলেই তো, বাবাকে যে কথা সে কখনো বলতে পারবে না, আবিরের কাছে সে কথা বলা কোনো ব্যপারই না। পরদিনই পাত্রী দেখতে চলে এলো সপরিবারে। আবিদ ভেবেছিলো পাত্রী পছন্দ হবে না। কিন্তু, দেখার পর পাত্রী তার পছন্দ হয়ে গেলো। বিশেষ করে মেয়েটার চোখ দুঠো, এক পলক দেখেই আবির হারিয়ে গেলো। এত সুন্দর চোখ এর আগে কখনো কারো দেখে নি। পাত্রী পছন্দ হয়েছে এই কথাও বাবাকে বলতে পারলো না আবিদ। বলতে হলো আবিরকে।

বড়রা চাইলো ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে আলাদা হয়ে কথা বলুক। রুহি আবিদের দিকে তাকিয়ে বরলো,
‘ আসুন।’

আবিদ আবিরের হাত ধরে নিচু স্বরে বললো,
‘ চল।’

‘ আমি কোথায় যাবো?’

‘ আমার সাথে। আমি একা একা যেতে পারবো না৷’

‘ তুই কি বাচ্চা নাকি? যে হিসু করতে যাবি,সাথে কাউকে যেতে হবে৷ তুই আর্মি অফিসার, তোর গরমই থাকবে অন্য রকম। দেখে মনে হবে বাঘ,অথচ তুই বিড়াল হয়ে আছিস কেনো? শোন হবু বউয়ের সাথে কথা বলতে যাবি, শত্রুর সাথে পতাকা বৈঠকে নয়। এখানে আমার কোনো কাজ নেই।’

‘ তোর কাজ না থাকলেও তোকে আমার দরকার। আর আমি বাঘ নাকি বিড়াল সেটা যানতে হলে তোকে আমার সাথে ক্যান্টনমেন্ট যেতে হবে।’

জামান সাহেব হয়ত বুঝতে পারলেন ব্যপারটা। তিনি আবিরকে আবিদের সাথে যেতে বললেন। বাসার ছাদে যাওয়ার সময় সিড়িতে আবিদ বললো,
‘ দেখ ভাই,এই জিবনে মা আর খালা- ফুপু ছাড়া আমি কখনো মেয়েদের সাথে কথা বলি নাই। কিন্তু এই বিষয়ে তুই বিদ্যাসাগর। এরকম একটা দিনে যদি তুই সাহায্যে না করিস, তাহলে তোকে আমার মত না বানিয়ে লাভ কি হলো? ‘

‘ আচ্ছা, আচ্ছা। চলেন সাব,যাওয়া যাক।’

আসার সময় টেবিল থেকে আবির দুইটা আপেল হাতে করে নিয়ে এসেছিলো। ছাদে এসে রুহি আর আবিদের মাঝখানে দাড়ালো সে। তারপর আপেলে কামড় দিয়ে রুহিকে বরলো,

‘ হ্যালো হবু ভাবি। আমি আবির, আর এ আমার বড় ভাই আবিদ হাসান। ক্যাপ্টেন অব বাংলাদেশ আর্মি। আসলে, আর্মি অফিসার যেমন হওয়া দরকার ভাইয়া কিন্তু ঠিক তেমনই, তবে সেটা মাঠে। আই মিন ক্যান্টানমেন্টে। ছোট বেলাতে পাবন জেলা স্কুলে ছিলো তারপর ক্যাডেট কলেজ এখন আর্মিতে। এই জিবনে তার মেয়েদের সাথে তেমন ভাবে কথা বলা হয়ে উঠে নাই। এখন, যেনো তাল হারিয়ে না যায়। সেই জন্যই আপনাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে দাড়িয়ে আছি। আপনি বিরক্ত হলে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।’

চলবে…..?