নিয়তি পর্ব-০৩

0
334

#নিয়তি
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

৩.

পৌষমাস। ঘরে বাইরে শীতের হিমহিমে তিক্ততা। দুচালা বাড়ির মাঝের ঘরটাতে বসে আছে পদ্মজা। জল চৌকি টার পাশে হারিকেনের নিভু নিভু আলো। কোলে তার ছোট্র ফুটফুটে কন্যা শিশু। ধবধবে ছোট্র ফর্সা মুখটা যেনো একটু টুকরো চাদের আভাস দিচ্ছে। এমন ফুটন্ত মুখ খানা দেখে পদ্মজা বড় শখ করে মেয়ের নাম দিয়েছে শাফিয়াত শেহরীন। ঘুমন্ত শেহরীন কে পরম মমতায় কপালে চুমু খায় মা পদ্মজা। কোল থেকে শুইয়ে দেয় বিছানায়।-‘

-‘গাঁয়ের চাদর টা টেনে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে পেছনের জানালার দিকে। জানালার কাঠের কপাট দুটো খুলে দিতেই হুরহুর করে ঘরে ঢুকে এক আকাশ চাঁদের আলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে। সাদা মাটির মেঝেটা চাঁদের আলোয় ঝক ঝক করে উঠে। হারিকেন টা নিভিয়ে দিয়ে মেঝেতে পাতা জল চকিটার উপর বসে পদ্মজা। তখন কোনো দেয়াল ঘড়ি ছিলো না। পদ্মজা আকাশে চাঁদের অবস্থান দেখে ধরে নেয় আনুমানিক রাত ৯ টা বাজে। নব্বই দশকের মেয়ে হলেও রুপে, গুনে, বুদ্ধিতে পদ্মজা ছিলো অতুলনীয়। শিক্ষিতা ও মার্জিত রমনী।

-গ্রামগন্জে শীতকালের সন্ধ্যা মানেই মাঝরাত। শাফায়াত এখনো বাড়ি ফিরছে না বলে চিন্তায় পড়ে যায় পদ্মজা। সে জানে তার এ চিন্তা অহেতুক। সে তো রোজই মাতাল হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরে। কিছু একটা ভেবে মনটা বিষিয়ে উঠে তার।আজও কি শাফায়াত নেশা করে আসবে? মাতাল হয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করবে? পদ্মজার বিষায়িত মন আকাশসম আকাঙ্খা নিয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছে আজ অন্তত শাফায়াত স্বাভাবিক হয়ে বাড়ি ফিরুক। তার সাথে হেসে কথা বলুক।এক সাথে জল চকিতে বসে খাবার খাক। একটু একযোগে হাসুক। সেই প্রথম রাতের মতো। প্রথম পরিনয়ের মতো।

-‘পদ্মজা বেশ ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। মা ছিলেন গায়নি ডক্টর। পরিবারের সবাই মোটামুটি ভালো শিক্ষিত। এদিকে শাফায়েত ভবঘুরে,নেশাখোর আর নারীমগ্ন পুরুষ।তবে সহায়-সম্পত্তির কোনো অভাব নেই শাফায়েতের।পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় পদ্মজা আর শাফায়েতের।বিয়ের প্রথম কদিন ভালো চললেও কয়েকদিন পর থেকেই শাফায়াতের আসল রুপ বেরিয়ে আসে।রাত বিরাতে বাড়ি ফিরে।নেশা করে মাতাল হয়ে গায়ে হাত তুলে।বকা ঝকা করে।কোনো কোনো রাতে তো বাড়িই ফিরেনা।বিয়ের একবছরের মাথায় পদ্মজার কোল জুরে আসে শেহরীন।এখন তার বয়স ৭ মাস।

-‘অন্তঃসত্বা পদ্মজা কে কম জ্বালাতন পোহাতে হয়নি।দিনকে দিন শাফায়েত শুধু নির্যাতন ই চালিয়েছে গেছে।শ্বাশুড়ি কে জানালে শ্বাশুড়ি সাফ সাফ জানিয়ে দেয়,

-‘পুরুষ মানুষ সিংহ মানুষ তারা একটু আক্টু নেশা টেশা তো করবোই।এইডা নিয়া এতো মাতামাতি করার কি আছে পদ্ম?বউ মানুষ বউয়ের মতোই থাহো।খাও দাও সংসার করো।এতো মাথা কেন ঘামান লাগবো বুঝিনা বাপু!!

শ্বাশুড়ির এমন নাক ছিটকানো কথায় গা গতর জ্বলে উঠে পদ্মজার।অতিরিক্ত রাগে শরীর রি রি করে উঠে।তবুও নিজেকে ইতস্থ করে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলে,

-‘পুরুষ মানুষ সিংহ মানুষ। তাই যদি হয় তবে আপনি বোধ হয় আপানার গর্ভে কোনো বন্য হিংস্র পশুকে ধারন করেছিলেন, তাই না আম্মা?

পদ্মজার এমন ধারালো বাক্যবান বুঝে উঠতে পারলেন না তার শ্বাশুড়ি আম্মা।চোখ মুখ কুচকে পদ্মজার নির্লিপ্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।পদ্মজা আবারো বলে উঠে,

-‘পুরুষ মানুষ সিংহ মানুষ হয়।তবে সেটা শুধু মাত্র তার বীরত্ব, তেজ্বসীয়তা, অধিকার,কর্তব্য, দায়িত্ব আর সাহসিকতার ক্ষেত্রে মানানসই। নোংরামিতায় তাকে পশুই বলা যায়।সে শুধু বনের হিংস্র সিংহ পশুই হয়, কোনো সিংহ মানুষ হয়না।হতে পারেনা।

শেষ কথা গুলো বেশ তেজ নিয়েই বলে পদ্মজা।সেদিন রাতে শাফায়াত বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই তার মা রাজ্যের নালিশ জুড়ে দেয়।বিলাপ করতে করতে বলে,

-‘দুই কলম লেহাপড়া করছে বইলা কি তোর বউ আমগো মাথা কিন্না নিছে?আমি নাকি পেটে পশুর জন্মম দিছি।তোর বউ এতো বড় কথা কইলো আমারে।এর একটা বিহিত না করলে আমি এহনি চইলা যামু।তোর বউ লয়া তুই থাকবি একাই।

মায়ের এমন কথা শুনে ঝড়ের বেগে ঘরে ছুটে যায় শাফায়াত।পদ্মজাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চুলের মুঠি ধরে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে ।অসহায় পদ্মজা সেদিন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি।বিয়ের কয়েক মাস পর বাবা মারা যায়,তারপর মা।এই অবস্থায় সে কার কাছে যাবে?কাকে বলবে এমন কষ্টের কথা!!বড় ভাই জীবিত থাকলেও বড়ভাবীর মরিচপোড়ানো কথা পদ্মজা সইতে পারবেনা।তার চেয়ে বরং স্বামীর ঘরেই পরে থাকা ভালো।তার বুক জুরে কয়দিন পর নতুন কেউ আসবে।কথায় আছে না, বদল হলে ঘর,তখন সব ই হয় বর।স্বামী খারাপ হলেও বিয়ের পর তো সেই সব।

-‘কাঠের দরজার ঠকঠক আওয়াজ পেয়ে ভাবনার সুতো ছিড়ে পদ্মজার।অতীত নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে এতো সময় পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।রাত প্রায় শেষ হতে চলল।মুখ টা আচল দিয়ে মুছে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।দরজা খুলে দিতেই হুরমুর করে ঘরে ঢুকে পাঁচ সাত জন মানুষ।নেশায় বদ্ধ মাতাল।গা থেকে কি বিদঘুটে গন্ধ ছড়াচ্ছে।শরীর গুলিয়ে উঠে পদ্মজার।টাল সামলাতে না পেরে ওখানেই গরগর করে বমি করে ফেলে।শরীর ঘামে ভিজে একাকার।চোখের পলকেই বড্ড বিধস্ত দেখাচ্ছে তাকে।

-‘পদ্মজা চোখ তুলে তাকায়।কেউ একজন ঝট করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।পদ্মজার বুক কেঁপে উঠে।এতো মানুষের ভীরে সাফায়াত কে কোথাও দেখতে পায়না সে।পদ্মজার ফর্সা মুখটা ভয়ে লাল হয়ে উঠে।হাত পা অনবরত কাপতে থাকে।এক নজর তাকায় ঘুমন্ত শেহরীনের দিকে।বুকের কাপড় টা আরো একটু খানি সামনে টেনে নিতেই কেউ একজন খপ করে হাত টা ধরে ফেলে।মুখে বিভৎস বত্রিশ পাটির হাসি নিয়ে বলে উঠে,

-‘বুকের কাপড় টাইন্না কোনো লাভ নাই সুন্দরী একটু পর একটাও খুইজ্জা পাইবানা।ভালাই ভালাই দিয়া দেও।তোমারো লাভ আমগোও লাভ।বেশী লাফালাফি করলে হুদায় কষ্ট পাইবা আরো।

লোকটার কথা শুনে পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠে,

-‘কেন যে সাফায়েত আরো আগে এমন একটা জিনিসের খুজ দিলো না।এতো দিন কি ছাতা মাতার স্বাদ নিছি!!

এবার তৃতীয় কারো গলার স্বর ভেসে আসে পদ্মজার কানে,

-‘সাফায়াতের কি রুচি রে ভাই?ঘরে এতো মধু থুইয়া কেউ বাইরে বাসি মধু খাইতে যায়।

এমন নোংরা ইঙ্গিতে পদ্মজার শরীর তেতে উঠে।কিন্তুু এতো গুলো মানুষের সাথে শক্তিতে তার পেরে উঠা সম্ভব না।তার উপর তারা সবাই নেশায়বুধ।কি করবে সে ভেবে পায় না।কষ্টে যন্ত্রণায় হাউমাউ করে কেদে উঠে পদ্মজা।তার কান্নার শব্দে যদি কেউ এগিয়ে আসে বাঁচাতে।

কিন্তু পদ্মজার কান্না কে উপেক্ষা করে পশু গুলো গান ধরে,

-‘আজ পাশা খেলবো রে শাম
আজ পাশা খেলবো রে শাম।

একই কথা বারবার উচ্চারণে পদ্মজার কান বিষিয়ে উঠে।কি বিশ্রী তাদের অঙ্গভঙ্গি।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিয়তি সব উলট পালট করে দেয়।শরীর থেকে খুলে নেয় শেষ বস্ত্রটুকু।চোখের পলকেই হায়েনাদের দৃষ্টিচোগর হয় পদ্মজার টলটলে ফর্সা শরীরটা।পশুরা এক প্রকার চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে তাকে।পুরুষত্বরে বেপোরোয়া জ্বালাতনে নগ্ন দেহের উপর চলতে থাকে রাতভর মাতালদের অমানুষিক নির্যাতন।শক্তপোক্ত হাতের অস্বাভাবিক স্পর্শে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা গুলো ব্যাথায় বিষিয়ে উঠে।পদ্মজার ছটফট করতে থাকে।চোখের জল ফেলে আকুতি জানায়।কিন্তুু অসহায় পদ্মজাট বুক ভাঙা আর্তনাদ পশুদের কানে পৌঁছলোনা।

-‘ফজর আযান পড়ার আগে আগে পশুর দল পদ্মজাকে ছেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।বিধ্বস্ত পদ্মজা মাটিতে পড়ে আছে।ফর্সা শরীরটাতে রক্ত জমাট বেধে গেছে।শক্তিহীন হাতে পাশেই পড়ে থাকা শাড়িটা টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে থরথর শরীরে উঠে দাড়ায়।বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ৭ মাসের শিশু শেহরীন।শেহরীন কে ছুতে গিয়েও ছুলো না মা পদ্মজা।ফুটফুটে শরীরটাতে পাপ লেগে যায় যদি।

-‘,ভোরের আলো ফোটার আগেই সারাজীবনের মতো অন্ধকারে তলিয়ে যায় পদ্মজা।নাম রেখে যায় পরাজিত নারী হিসেবে।পরাজিত স্ত্রী হিসেবে।সেই সাথে একজন পরাজিত মা হিসেবে।শক্তপোক্ত ঘরের খুঁটিতে ঝুলতে থাকে নিজের শরীরটা।কয়েকবার তীব্র গুঙরানি তুলে চিরদিনের মতো বিদায় নেয় এই নোংরা পৃথিবী থেকে।

-‘শ্বাশুড়ির মুখে নিজের মায়ের এমন করুন কাহিনী শুনে শুনে ঠিক থাকতে পারলোনা শেহরীন।শ্বাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠে ।চিৎকার করে বলতে থাকে,-‘মা,,,,,মা গো,,,,,

চলবে,,,,,,,,,,,