নিয়তি পর্ব-০৪

0
291

#নিয়তি
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

।৪।

হাত পায়ে শিরশিরানি ব্যথা। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। হাত পা ফুলে টইটম্বুর। অসহ্য ছটফটানি তে মেজাজ খিটমিট করছে মেহরুবার। অধৈর্য চোখ নিয়ে আরেকবার তাকায় ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে রাত সোয়া আট টা বাজে।

বাইরে চোখ অন্ধকার করা বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপসা রুপে অস্পষ্ট চারপাশ। এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঝাপটা বাতাসের সাথে রুমে ঢুকে আবেশ। চুল আর শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে গায়ের শার্ট টা খুলে তাকায় মেহরুবার দিকে। মেহরুবা নির্লিপ্ত চোখে আবেশের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। অসস্তি লাগছে খুব। সময় যত যাচ্ছে শরীরের ছটফটানি তীব্র থেকে গাঢ় রুপ ধারন করছে।

-‘,ডান হাত পেটে চেপে ধরে বাম হাতে ভর দিয়ে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করে মেহরুবা। শরীরের টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে পড়ে যাওয়ার আগেই হুর মুর করে জড়িয়ে ধরে আবেশ। মেহরুবা আবেশের বুকে পড়ে পুরো শরীরের ভার টা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকে। আবেশ বুঝতে পারে মেহরুবার শারীরিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। হয়তো নিয়মিত খাওয়া দাওয়াটাও হচ্ছে না তার। মেহরুবার মুখের ছড়ানো ছিটানো চুল গুলো কানের পাশে গুজে দেয় আবেশ।কপালে আদুরে চুমু একে দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-বেশী খারাপ লাগছে তোমার মেহরু?

-আমি খুব একা হয়ে গেছি আবেশ।

মেহরুবার এমন হৃদকাপানো উত্তর আশা করেনি আবেশ।বুকটা ভারী হয়ে আসে। আহত গলায় বলে,

-‘তুমি ঠিক আছো? এই সময় এতো স্ট্রেস কেনো নিচ্ছো ?

-‘তুমি আমার থেকে অনেক দুরে চলে গেছো আবেশ। আমার ভীষণ একা লাগে। এই সময় তোমাকে আমার বেশী প্রয়োজন আবেশ। তুমি কি তা বুঝতে পারো না? আমি চলাফেরা করতে পারিনা। ভয় হয়। খুব ভয়।যদি পড়ে যাই! আমার সন্তান যদি পৃথিবীর মুখ না,,,

শেষ কথা টা বলার আগেই মুখটা চেপে ধরে আবেশ। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে উঠে,

-‘এমন কথা মুখেও এনো না মেহরুবা। কষ্ট হয়। খুব যন্ত্রণা হয়।এই তোমার জন্যই কত পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে আমার। জানো তুমি? প্রতিটা পদক্ষেপে শুধু কাটা আর কাটা। আমার পা দুটো রক্তাক্ত হয়ে গেছে। তুমি ছাড়া,আমাদের অনাগত সন্তান ছাড়া আমি নিঃস্ব মেহরুবা। পুরোটাই নিঃশ্ব।

-‘আর শেহরীন?

-‘মেহরুবার মুখে শেহরীনের নাম টা শুনে একটু কেপে উঠে আবেশ। কিন্তুু কোনো প্রতিক্রিয়া না করে মেহরুবা কে জড়িয়ে ধরেই চুপ করে রইলো। মেহরুবা অধৈর্য হয়ে পড়ে। কপাল কুচকে মাথা উঁচু করে তাকায় আবেশের দিকে। আবেশ বুঝতে পারে মেহরুবার প্রতিক্রিয়া।

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে উঠে,

-শেহরীন খুব ভালো আর শান্ত মেয়ে। আমার বিশ্বাস ওকে বুঝালে ঠিকই বুঝবে।

-এমন টা মনে হচ্ছে তোমার?
-কেনো নয়?

-‘স্বামী হচ্ছে এক অবিচ্ছেদ্য প্রান। যাকে চাইলেই ভাগ করা কিংবা স্থানান্তর করা যায় না আবেশ। আমরা মেয়েরা এটা পারিনা। একই ঘরের দুই বিছানাটা আমরা মেনে নিতে পারিনা।অথচ একই বাড়ির প্রতিটা বিছানা আমরা খুব যত্ন করে সাজিয়ে দিতে পারি। পরিপাটি করতে পারি। শেহরীন ও খুব সহজে তোমাকে আমার করে দিবে না।

-‘আমি কি তোমার নই মেহরু? আমার অংশ তোমার পেটে।আর তো মাত্র কয়েকটা দিন বাকী। আমরা আমাদের সন্তান কে কোলে নিতে পারবো। তার হাসি মুখ দেখতে পারবো। তার সাথে কথা বলতে পারবো। খুব মজা হবে বলো!

শেষের কথা গুলো খুব উচ্ছাস নিয়ে বলে আবেশ। কিন্তুু আবেশের এই আনন্দ উচ্ছ্বাস মেহরুবার মনে দাগ কাটলো না।আবেশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে,

-‘আমি তোমার সন্তানের মা হলে শেহরীনও তোমার বিয়ে করা বউ। লোক সমাজ সাক্ষী রেখে তুমিই তাকে কবুল করে নিয়েছো। তোমার ইচ্ছেতেই।

-সেখানে শুধুই আমার ইচ্ছে ছিলে মেহরুবা?

-আমি জানিনা।

মেহরুবার এমন খামখেয়ালি কথায় আবেশের মন খারাপ হয়ে যায়। কিছু বলে উঠার আগেই মেহরুবা আবারো বলে উঠে,

-আচ্ছা আবেশ তোমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে?একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়েছো? একান্ত ভাবে?

আবেশ হতবাক হশ। মেহরুবার এমন কথা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারলো না আবেশ।রাগে শরীর শিরশির করে উঠে।গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,

-‘মেহরুবা,,,,,,,,এ কি অধঃপতন হয়েছে তোমার?আমাকে এই চিনো তুমি?এই?বুক কাঁপলো না একবারো এমন কথা বলতে?একবারও মুখে আটকালো না?যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছো কখন থেকে?হোয়াই মেহরুবা হোয়াই?

মেহরুবা কোনো কথা বলেনা।দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে বুক ভেঙে একাকার।কিন্তু কোনো কথা বলছেনা।

চোখের কোনে চিকচিক করা যন্ত্রনার আদলে গড়া নোনাজল আবেশের চোখ এড়ালো না।আবেশ এগিয়ে আসে।বাহু দুটো চেপে ধরে আলতো করে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়।

মেহরুবা আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা।বুক ভেঙে কান্না এসে গেলো।আবেশ কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। যন্ত্রনা মাখা ভারী কন্ঠে আওড়াতে থাকে,

-‘তুমি কি আমার যন্ত্রণা বুঝতে পারছো না আবেশ।তুমি জানোনা কি নিদারুণ অস্থিরতার মাঝে আমার দিন কাটছে।আমি হারাতে চাই না তোমাকে।শেহরীনের কাছাকাছি হওয়ার আগে আমাকে তুমি মেরে ফেলো আবেশ।আমি তোমাকে ভাগ করতে চাইনা।আমি আর পারছিনা আবেশ।এই যন্ত্রণার ভার যে অনেক কঠিন।অনেক ভয়াবহ।আমি আর সত্যিই পারছিনা আবেশ।পারছিনা।

কথা গুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মেহরুবা।আবেশের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু ফোটা চোখের জল।অনুভবের দোয়ার সক্রিয় হয়।কষ্ট ঠেলে জোয়ার আসে।ভালোবাসার তীব্র অনুভূতি জাগিয়ে তোলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেহরুবা কে।মুখ ফুটে বেরিয়ে আসি পৃথিবীর অধিক সুখতর,সুন্দর, সুমিষ্ট শব্দ টি,

-‘ভালোবাসি-‘

-‘সদর দরজায় কলিং বেল বাজতেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দেয় শেহরীন।বাইরে দারোয়ান কে দেখা মাত্রই মন টা খারাপ হয়ে যায় তার।হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ টা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-‘বউ মনি এই নেন সকালের বাজার।

শেহরীন হাত বাড়িয়ে ব্যাগ টা নিয়ে ভেতরে চলে এলো।কোনো কথা বললো না।সারা রাত ধরে ড্রয়িংরুমে বসে আবেশের জন্যই অপেক্ষা করেছে।ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।বেশ অসস্তি লাগছে।টেনশনে টেনশনে চোখ মুখ কালিতে ডুবে গেছে।সকাল সকাল কলিংবেল বাজতেই দৌড়ে যায় সে।আবেশ এলো বলে।কিন্তুু তা আর হলো না।

-‘আকাশ সম দুশ্চিন্তা আর কষ্ট নিয়েই রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় শেহরীন।এটো বাসন পরিষ্কার করে চুলার দিকে অগ্রসর হয়।সসপেনে চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের জানালা টা খুলে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।রাতে বৃষ্টি হওয়ার সুবাদে প্রকৃতি বড়ই শান্ত।

জানালা খুলে দিতেই সকালের স্নিগ্ধ বাতাস হুরহুর করে প্রবেশ করছে।নিজের কষ্ট গুলো বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আকাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শেহরীন।ঠান্ডা বাতাসে মন খারাপির রেশ কমে গেলেও অসাবধানতায় শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে পড়ে জলন্ত চুলার ধাঁচে।চোখের পলকেই আগুনের শিখা শাড়িতে ল্যাপ্টে পড়ে।শেহরীন কিছু বুঝে উঠার আগেই চারপাশ ধোঁয়াশায় ভরে উঠে।

বাইরে থেকে সাফিনা ফুপুর আর্তনাদ ভেসে আসে পুরো বাড়িতে,

-‘ভাবী গো,আগুন!আগুন!

চলবে,,,