নিয়তি পর্ব-০৫

0
282

#নিয়তি
লেখনীতে-বর্ষা ইসলাম

৫.

শ্বাশুড়ির কাধে মাথা এলিয়ে সোফায় বসে আছে শেহরীন।আয়না বেগম পরম যত্নে শেহরীনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।চোখে মুখে নিদারুন ক্লান্তি। চোখ দুটো বন্ধ করতেই নিঃ,শব্দে কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে আসে শেহরীনের পুুরো বুক জুরে।

-ভাবী কাল সারারাত ড্রয়িংরুমেই পার করেছে আম্মু। আবেশ ভাইয়া বাড়ি ফিরেনি। সারা রাত ধরে তার জন্য অপেক্ষা করে গেছে। দেখছো না চোখ মুখের কি হাল করেছে না ঘুমিয়ে, না ঘুমিয়ে। কালির স্তুপ পড়েছে।

মেয়ে আইরিনের কথায় বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো আয়না বেগম। আবেশ বাড়ি ফিরেনি!
কথা টা ভাবতেই বুকটা ধুক করে উঠে তার। মনের ভেতর অসস্তির ঢোল পিটালেও, কোনো ভাব মূর্তি প্রকাশ না করে ঠাঁই বসে রইলেন চুপচাপ। উপর থেকে হাতে করে একটা শাড়ি নিয়ে শেহরীনের দিকে এগিয়ে এলেন সাফিনা ফুফু। শাড়িটা শেহরীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

-মাইয়া মানুষের শাড়িতে আগুন লাগা মোটেও ভালা কাম না।এইডা অলক্ষইন। এমনতিতেই শাড়ি পোড়াইয়া বইসা আছো।আর নতুন কইরা কপাল পোড়াইওনা। যাও শাড়িটা বদলায় আসো ঘরে গিয়া।

সাফিনা ফুপুর কথায় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা শ্বাশুড়ি আয়না বেগম। শেহরীন একবার চোখ তুলে তাকায় সাফিনা ফুপুর দিকে। কিন্তু কোনো নড়াচড়া করলো না।আবারো আলগোছে চোখটা বন্ধ করে নেয়। ছিমছাম ফর্সা মুখটা এক রাতেই কেমন বিধস্ত হয়ে গেছে। কতশত রাত ঘুমানো হয় নি কে জানে।

-‘প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর।তার সাথে যার দাঙ্গা হবে তাকে আজীবনের শোক দিবো।অথচ কতশত মানুষ হেসে খেলে দিন পার করছে।তাদের সাথে তার কোনো মনমালিন্য নেই।আর অসহায় মানুষদের নিস্তার নেই।একাকিত্ব একত্রকরনে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার তুলনা হয় না।-‘

আয়না বেগমের চিন্তার মাঝেই কলিং বেজে উঠলো।ঘড়িতে ১০ টা বাজে।এই সময় কে আসতে পারে জানা নেই কারো।কয়েক মুহুর্তের জন্য পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে খেলে যায় পিনপতন নীরবতা।নীরবতার পার্ট চুকিয়ে সদর দরজার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সাফিনা ফুপু।বিরস মুখে দরজাটা খুলে দিতেই দেখা মিলে আবেশের।

সাফিনা ফুপু কোনো কথা না বলে দরজা থেকে একটু দুরে সরে দাড়ায়।কিন্তু আবেশ ভেতরে প্রবেশ না করে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে।সাফিনা ফুপু ভ্রু কুচকালো।বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠলেন,

-‘দরজায় ওমন কইরা দাড়াই আছোস কেন।জীবনে অশান্তি তো আর কম করলিনা বাপ!এবার ঘরে ঢুইকা উদ্ধার করো আমাগো।

সাফিনা ফুপুর কথা তেমন পাত্তা না দিয়ে সামনের দিকে ঝুকে আয়না বেগমের উদ্দেশ্যে বেশ জোর দিয়েই আবেশ বলে উঠলো

-‘একটু এদিক আসবে আম্মা?

আয়না বেগম অবাক হন।মেয়ে আইরিনের সাথে মুখ চাওয়া চাওয়ি হয় তার।হঠাৎ এভাবে কেনো ডাকছে আবেশ।কিন্তু কোনো কথা বলার আগেই আবারও আবেশের গলারস্বর ভেসে আসে,

-‘আসবে আম্মা?

আয়না বেগম এবার বিষয়টা মালুমে আনলেন।শেহরীনের পাশে আইরিন কে বসিয়ে দিয়ে উৎসুক চোখে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে।

-‘নতুন বউ সাথে এনেছিস যে আমাকে উঠে আসতে হলো অসুস্থ মেয়েটাকে রেখে।দিন কে দিন খুব উন্নতি হচ্ছে তোর।আজকাল রাতে বাড়ি ফেরারো প্রয়োজন বোধ করিস না।ঘরে যে এখন বউ আছে খেয়াল আছে তোর?

কথা গুলো বেশ রাগ আর বিরক্তি নিয়েই বললেন আয়না বেগম।মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই আড়াল থেকে দু হাতে ধরে আয়না বেগমের সামনে মেহরুবা কে দাঁড় করালো আবেশ।

আয়না বেগম এবার হতভম্ব, হতবাক।পুরো পৃথিবী ঘুরঘুর করে ঘুরতে লাগলো।অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

-‘মেহরুবা!!!

আয়না বেগমের মুখে মেহরুবার নাম শুনে আইরিন,সাফিনা ফুপু চমকে উঠলেন।তাদের বিস্ময়তার ভার আরো দ্বীগুন করে দিয়ে আবেশ বলে উঠলো

-‘আম্মা ও শুধু মেহরুবা নয়।মেহরুবা আমার স্ত্রী।আমার অনাগত সন্তানের মা।

আয়না বেগম কথা গুলো আর নিতে পারলেন না।কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন আবেশের গালে।আবেশ এক হাতে গাল চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল চোখে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।

দুর থেকে সোফায় বসে সব কিছু দেখলো শেহরীন।কোনো কথা বলছেনা।নিস্তব্দ লাগছে চারপাশ।অনুভূতি শূন্য হয়ে কানের কাছে ধরা দিচ্ছে আবেশের বলা শেষ শব্দ গুচ্ছ,

-‘মেহরুবা আমার স্ত্রী।আমার অনাগত সন্তানের মা।

কয়েক মুহূর্ত পার হলেও এই একই প্রতিধ্বনি শেহরীনের পৃথিবী কে বিষিয়ে তুলছে।বুকে ছটফটানি বাড়ছে।বিভৎস লাগছে সব কিছু।নিজেকে আর সামলাতে না পেরে অসুস্থ শরীরে উঠে দ্বাড়ায় শেহরীন।ঝড়ের গতিতে গিয়ে দ্বাড়ায় আবেশের সামনে।গগন বিদারী হুংকার ছেড়ে বলে উঠে,

-‘মেহরুবা আপনার স্ত্রী। আপনার অনাগত সন্তানের মা তাই না!!

তাহলে আমি?আমি কে আবেশ?আমি কেনো এসেছি এ বাড়িতে?

শেহরীন আবেশের মুখোমুখি দাড়াতেই আবেশ মাথা টা নিচু করে ফেলে।শেহরীনের কোনো কথার উত্তর আবেশ দিলো না।আবেশের এমন দায়সারা ভাবপনায় শেহরীনের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।দু হাতে আবেশের কলার টা চেপে ধরে কান্না করতে করতে বলে

-‘আমাকে কেনো বিয়ে করলেন আপনি?আমি আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম?বউ থাকা সত্বেও দ্বিতীয় বার বিয়ে কেনো করলেন আপনি?বিয়ের আগে কেনো জানালেন না আবেশ?বলুন না আমাকে?

আবেশ তখনও চুপ।শেহরীনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মেহরুবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আবেশ।নির্লিপ্ত গলায় শেহরীনের উদ্দেশ্যে বলে,

-‘পরে তোমাকে সব টা জানাবো শেহের।তুমি এখন অন্তত মেহরুবা কে নিয়ে ঘরে যাও।মেয়েটা এই শরীরে অনেকক্ষণ যাবত দাড়িয়ে আছে।প্লীজ মেহরুবা কে ঘরে নিয়ে যাও।

-‘শেহরীন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।হার্ট লক হয়।মানুষ এমনো হয়?এক স্ত্রী কে বলে অন্য স্ত্রী কে ঘরে নিয়ে যেতে?কোন ঘরে নিয়ে যাবে সে?তার ঘরে?যে ঘরটার আশায় এতো সপ্ন নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিলো !সেই ঘরে?

শেহরীনের মাথায় ঘুরপাক খায় এমন সহস্র প্রশ্ন।কি করবে সে?এ কেমন নিয়তি তার?

-‘আইরিন শেহের কে নিয়ে উপরে চলে যা এখান থেকে।-‘

আয়না বেগমের কথা শেহরীনের কান অবদি পৌছালো কি না কে জানে।শেহরীন চোখ মুখ মুছে শক্ত করে নেয়।নড়বড়ে শরীরে এগিয়ে যায় মেহরুবার দিকে।

-‘আপনাকে আমি কি বলে সম্বোধন করি বলেন তো?আপু নাকি বুবু?

শেহরীনের এমন কথায় গা গতর জ্বলে উঠে শ্বাশুড়ি আয়না বেগমের।গর্জে উঠে ধমক দিয়ে বলেন,

-‘কি হচ্ছে শেহরীন?তুমি কি এখন মেহরুবা কে আপ্যায়ন করা শুরু করবে?

শ্বাশুড়ির কথায় জোর করে হাসার চেষ্টা করে শেহরীন।বিদ্রুপে গলায় বলে,

-‘আর আপ্যায়ন!! এ সুযোগ টা কি আপনি করে দেন নি মা?

-‘শেহরীনের কথায় আয়না বেগম ভ্রু কুচকায়।তিনি যে শেহরীনের কথা ধরতে পারেন নি তা ভালোই বুঝতে পারলো শেহরীন।কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাশুড়ির উদ্দেশ্যে আবারো বলে উঠলো,

-‘এই মেহরুবা,আবেশ,আপনি,আপনারা প্রত্যেকে আমাকে ঠকিয়েছেন।কি গোপন করেছেন?কেনো করেছেন আমি জানিনা মা।তবে বিবেক কে প্রশ্ন করে দেখুন তো ঠিক করেছেন কি না?

থামে শেহরীন।চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।কথা গুলো শেষ করেই মেহরুবা কে নিয়ে দুতলায় রওয়া দেয় শেহরীন।

শেহরীনের বলা শেষ কথাটা বুক কাঁপিয়ে তুললো আয়না বেগমের।শেহরীনের অসহায় চাহনি ভেতরটা ভেঙে চুরমার করে দিলো।আয়না বেগম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, কি ভয়ংকর অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে ধাপে ধাপে পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে শেহরীন।মেহরুবা কে এক ধাপ আগানো তার জন্য হাজার বছরের পথ।হাজার বছরের সাধনার ধ্বংসাবশেষ।

-‘গভীর রাত।আকাশে তারা নেই।চাদের আলো নেই।ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশ আচ্ছন্ন।কোলে ফুটফুটে কন্যা শিশু।ভরা অন্ধকারে নিজের মেয়েকে নিয়ে হাঁটছে মেহরুবা।বেশ থমথমে প্রতিটা পদক্ষেপ। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বিশাল ছাদের শেষ কিনারায়।

মেহরুবা স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার পাশে কেউ দাড়িয়ে আছে।অন্ধকারে তার অবয়ব চেনা দায়।ভয়ে শরীর পাথর হয়ে যাচ্ছে।দুই কদম পেছনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।ফেরার পথ নেই।সামনেও আগানোর রাস্তা নেয়।সামনে খাদ পেছনে আগুন।তার পাশেই কারো বৃহৎ কার অবয়ব এই বুঝি ধাক্কা দিয়ে মা মেয়েকে ছিটকে ফেলে দিবে চোখের পলকেই।
মেহরুমার শরীর কেঁপে উঠে।মনোবল নড়বড়ে হয়।এখন কোন দিকে যাবে সে?

চলবে,,,,