নিয়তি পর্ব-০৬

0
282

#নিয়তি
লেখনীতে- বর্ষা ইসলাম

চোখমুখ ভয়ার্ত। হাত-পা থরথর করে কাপছে। গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আশংকায়, অস্থিরতার ঘামের নহর। হৃদপিণ্ডে কেউ আথালিপাথালি ভাবে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।গলা শুকিয়ে কাঠ।কলিজায় অসহ্য হাহাকার।

ভরপুর আলুথালু শরীরটা নিয়ে নড়াচড়া করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে মেহরুবার। অনিচ্ছা থাকা সত্বেও দু হাতে পেট আগলে ধরে বিছানায় উঠে বসে। রুমে এসি থাকা সত্বেও অনবরত ঘামছে সে।অজানা আশংকায় বুক কেঁপে কেপে উঠছে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই মেহরুবা এমন ভয়ংকর সপ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।লাগাতার ভাবে কেনো এমন সপ্ন দেখে যাচ্ছে তা তার কল্পনার বাইরে।

-‘আর কিছু ভাবতে পারে না মেহরুবা। অসস্তি শরীরে, ভয়ে,চিন্তায়, পেটে চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে। ভাঙা ভাঙা গলায় অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর সবচেয়ে করুন বাক্যবান,

-‘তুই কি আসবিনা বাবুই?

মেহরুবার এমন করুন আর্তনাদ তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিধে পড়লো পাশে শুয়ে থাকা আবেশের কানে। রাত প্রায় শেষের দিকে। অথচ মেহরুবা এই শরীরে এভাবে কান্না করছে। কান্নার বেগ বাড়তেই ঘুমঘুম চোখে ধুচমুচিয়ে উঠে বসে আবেশ।

এমন অসহায় অবস্থায় মেহরুবা কে দেখে বুকটা ধুক করে উঠে আবেশের। চোখের পলকেই ঘুম যেনো নাই হয়ে গেলো। আবেশ একটু স্থির হয়। বসে থাকা অবস্থায় ই দু হাতে আগলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় মেহরুবা কে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

-‘শরীর কি বেশী খারাপ লাগছে মেহরুবা?

মেহরুবা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে জবাব দেয়।যার অর্থ না।আবেশ স্বস্তি পায়।মেহরুবা কে স্বাভাবিক করতে বাচ্চাশুলভ কন্ঠে ছোটো ছোটো বুলি আওড়িয়ে বলতে থাকে,

-‘আমার মেহের পাখিটা কে কি এখনো কান্না মানায়?তার বাবুই টা কি ভাব্বে শুনি!!ভাব্বে যে তার বাবাই অনেক খারাপ।অনেক পঁচা। রাত বিরাতে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে তার মাম্মাম কে।কান্না করাচ্ছে।এটা কি ঠিক বলো তো?বাবুই পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছো!!তুমি তো বেশ ধরিবাজ মেহরুবা!!!

মেহরুবা কিঞ্চিত হেঁসে উঠে।চোখে পানি আর ঠোঁটের কোনে হাসি যুক্ত মেহরুবা কে দেখে আবেশ শান্ত হয়।প্রশান্তি আসে হৃদয়জুড়ে।এই একটা মানবিকেই আবেশ এতো এতো এতো ভালোবাসে।তার এ-তো টুকু মন খারাপও আবেশের বুক কাঁপিয়ে তুলে।পাজড় তোলপাড় করে ফেলে।অথচ সে-ই কিনা এতো অসস্তি নিয়ে দিন পার করছে,রাত কাটাচ্ছে।কষ্টে চোখ ভেজাচ্ছে।আবেশের কি হলো কে জানে। মেহরুবা কে দু হাতে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে।কপালের চুল গুলো ঠিক করে কানের কাছে গুজে দিয়ে আস্তে করে বলে উঠে,

-‘আমি আছি তো মেহরুবা।

-‘আমার ভয় হয় আবেশ।আমি জানি না কেনো এমন সপ্ন দেখি।আমাকে আর আমার মেয়েকে কেউ আগুনে পুড়ে ফেলতে চায়।খাদে ফেলে দিতে চায়!কি বিশাল আকৃতির অবয়ব।আমি শক্তিহীন হয়ে পড়ি।চোখ দিয়ে জল গড়ানোর ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলি।চিৎকার দিতে পারিনা।শুধু চোখের সামনে মা মেয়ের করুন পরিনতি মেনে নিয়ে ঘুম ভাঙ্গি।

এমন কেনো হয় আবেশ?বলো না?

মেহরুবার কথায় খুব রয়ে সয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আবেশের বুক চিড়ে।কিন্তুু সেই দীর্ঘ শ্বাসের সুর মেহরুবার কান অবদি পৌঁছানোর আগেই আবেশ আদুরে ভঙ্গীতে বলে উঠে,

-‘আমার বাবুর আম্মুর বুদ্ধি টা এখনো হাঁটু ছুঁতে পারলো না মেহরু।সে কি বুঝে না!”সপ্ন শুধুই সপ্ন।বাস্তবিকতায় তার কোনো অস্তিত্ব নেই।আমরা দিনে যা ভাবি তার অধিকাংশই আমরা ঘুমের ঘোরে সপ্ন রুপে ফিরে পাই।তোমার ইদানীং অনেক বেশী মুড সুয়িং হয়। এই সময়ে এটা স্বাভাবিক। তাই বলে শুধু নেগেটিভিটি ভাবলে হবে না মেহরুবা।ধৈর্য রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে।

আবেশের কথায় আর কোনো কথা বাড়ালো না মেহরুবা।গুটিশুটি মেরে আবেশের বুকেই চুপ করে রইলো।অথচ বুকের এক পাশ আবেশের ভালোবাসায় মুড়িয়ে উঠলেও অন্যপাশ হুংকার ছেড়ে দিয়ে বলছে,

-‘সপ্ন শুধুই সপ্ন। আসলেই কি বাস্তবিকতায় তার কোনো অস্তিত্ব নেই!!!!

রাত পোহালো।রাতের নিশুতি অন্ধকার কেটে গিয়ে প্রকৃতি ধারন করলো ভোরের কালসিটে রং। গাছ গাছালি,ঝোপঝাড়ের ডগায় তখনো জমাট বাঁধা অন্ধকার। ভোরের হাওয়ায় ভেসে আসছে পাখিদের ঘুমকন্ঠি কিচির মিচির গান।

আবছা অন্ধকারে ডিম লাইটের কমলা রঙা আলো চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠতেই ঘুম ভাঙে শেহরীনের।হেলদোল শরীরে উঠে বসতেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠে।পাশে আবেশ নেই।অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা ফুঁপিয়ে উঠে।তবুও মন খারাপি কে পাত্তা না দিয়ে উঠে দাড়ায় বিছানা থেকে।এলোমেলো চুল গুলো হাত খোপায় পেঁচিয়ে নিতে নিতে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে।রাতে বৃষ্টি হওয়ার সুবাদে ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস বইছে।ভোরের শীতল বাতাসের সাথে ভেসে আসছে প্রান জুড়ানো আযানের সুমিষ্ট ধ্বনি।আযানের সাওয়াল জওয়াব শেষ করে নামাযের দিকে অগ্রসর হয় শেহরীন।

ততক্ষণে ভোর রাতের কালসিটে অন্ধকার ভেদ করেছে। একটু একটু করে ফুটে উঠেছে সোনালী সূর্যের মন ভুলানো হাসি।দু তলার ঘর টা পেরিয়ে উঠানে নেমে আসে শেহরীন।মাথার উপর থেকে আঁচল টা সরিয়ে দু হাত মেলে দেয় আকাশে।বুক পুড়ে নিতে থাকে স্নিগ্ধ সকালের সুন্দর, নির্মল বাতাস।বাধনহারা শাড়ির আচল তখন সাই সাই করে বাতাসে উড়ছে।উড়ছে মাথাভর্তি লম্বা খোলা চুল।নিজেকে মুক্ত করে দিয়ে প্রকৃতিতে ছুঁড়ে দেয় নিজের মনের অপ্রকাশিত বাক্যবান-‘

-‘আষাঢ়ের ধরা বাধা নিয়মে
রাত বৃষ্টি র সঙ্গমে
ফুল ফুটুক,এবার বসন্ত আসুক
এই মানবীর দরুনে!!

সকাল ৯ টা।
ঘর কন্যার সমস্ত কাজ একা হাতে সামলে নিয়েছে শেহরীন।সকাল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে শরীর পুরো নেতিয়ে পড়েছে।কপালে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।এঁটো বাসন গুলো পরিষ্কার করে ডায়নিং এ সাজিয়ে দেয়।এলোমেলো শাড়ির আঁচলের ভাজে হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে আসতেই দেখা পায় মেহরুবার।দু হাতে কোমড়ে ভর করে সিড়ি থেকে নামার চেষ্টা করছে।মেহরুবা কে দেখা মাত্রই দ্রুত গতিতে ছোটে যায় শেহরীন।

-‘আরে বুবু এভাবে এই অবস্থায় একা নামে কেউ।আমাকে ডাকলেই পারতেন।পড়ে টড়ে গেলে কি হতো!!

শেহরীনের কথায় ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করে হাসার চেষ্টা করে মেহরুবা। পুরো ড্রয়িংরুম টা একবার দেখে নেয়।ডাইনিং খালি।না চাইতেও মেহরুবা প্রশ্ন করে বসে,

-‘সবার কি নাস্তা করে হয়ে গেছে শেহের?

শেহরীন মেহরুবা কে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলে,

-‘মা অসুস্থ। আইরিন সকালে কোচিং এ গেছে।সাফিনা ফুপু উপরেই আছেন।এখনো কেউ খাবার টেবিলে বসেনি বুবু।

-‘আর আবেশ!!

মেহরুবার কথায় একটু চমকে উঠে শেহরীন।ভেতরটা টলমল করে উঠে।তবুও নিজেকে তটস্থ করে বলে,

-‘উনি তো আপনার ঘরেই ছিলো।সকাল থেকে তো দেখিনি বের হতে।

এবার মেহরুবাও বেশ অবাক হয়।আবেশ তো ঘরেও নেই।সেই সকাল থেকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাকে।শেহরীন কে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেহরুবার ভাবনার মাঝেই প্রবেশ করে আবেশ।

হাতে শপিং ব্যগের ছড়াছড়ি। ব্যাগ গুলো নিয়ে রাখে মেহরুবার পাশে।গাল ভর্তি হাসি নিয়ে মেহরুবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

-‘ব্যগ গুলোতে তোমার প্রয়োজনের কিছু কাপড়চোপড় আছে, প্রসাধনী আছে।চেক করে নিও তো।আর যদি কিছু বাকি থাকে তবে লিস্ট করে দিও আমি এনে দিবো পরে।কেমন!!

-‘মেহরুবা মাথা নাড়ে।ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে মেহরুবা।অল্পতেই আহামরি খুশী হয়ে যায়।আবেশ তাকে কতটা কেয়ার করে,কতটা তাকে নিয়ে ভাবে এসব ভেবেই বুকটা শান্তি তে ভরে উঠে মেহরুবার।

আবেশ উপরে চলে যায় ফ্রেশ হতে।শেহরীন কে সে যেনো দেখেও দেখলো না।এদিকে কি ভেবে মেহরুবা জিনিস গুলো দেখতে গিয়েও দেখলো না কে জানে!!পাশ ফিরে শেহরীন কে খুজতে থাকে।।

কিন্তুু শেহরীন নেই।পুরো ড্রয়িংরুমের কোথায়ও নেই।একা একা মেহরুবা মুখটা ভার করে সোফাতেই বসে রইলো।

-‘রান্না ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে শেহরীনের।চোখ দুটো কষ্টে বন্ধ হয়ে আছে।চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সহস্র নোনাজল।দু হাতে শাড়ি খামচে ধরে বুকে পাথর জমানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।কষ্ট কি আর বাধ মানে?

-‘রেজিষ্ট্রি করে দলিল করে নেওয়া মানুষটাও যখন ভাগাভাগি হয়ে যায় তখন কি আর যন্ত্রণার দল মিছিলে নামবে না!!বুকে ভিড় জমাবেনা এমনও হয় কখনো?চাইলেই কি তাদের আটাকানো যায়?যায় না।শেহরীনও পারেনি।দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মুখ গুমড়ে ফুপিয়ে করুন সুরে কেঁদে উঠে।

-‘স্বামী ভাগ হওয়ার মতো এমন অসহ্য যন্ত্রনার মতো যন্ত্রণা কি পৃথিবীতে আরো দুটো হয়?

চলবে,,,,