নীল কণ্ঠ পর্ব-০৩

0
322

#নীল_কণ্ঠ💜
#পর্ব-০৩
#সাদিয়া

সকাল আটটা। ধরণীতে সূর্যর দেখা মিলেছে অনেক আগেই। বাহিরে বইছে মৃদু বাতাস। বাতাসে জানালায় থাকা শুভ্র রঙের পর্দাগুলো উড়ছে। বিছানায় নীল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কালকে রাতে বেচারার ভালো ঘুম হয়নি। সোফায় কি আর ভালো ঘুম হয়? অন্যদিকে সারারাত বিন্দাস ঘুমিয়ে এখন সোফায় বসে বসে বোর হচ্ছে কণ্ঠ। সে বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। একবার মনে হচ্ছে নিচে যাওয়া উচিত। তো পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সে নতুন বউ। তার এভাবে নিচে চলে যাওয়াটা বিশেষ শোভা পায় না। কণ্ঠ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন চাপতে লাগলো।

কণ্ঠ নিজের ফোনে তার আর নীলের ছবি দেখছে। ছবিগুলো তারা গতবছর সিলেটে ট্যুরে গিয়ে তুলেছিলো। একটা ছবি দেখে কণ্ঠ মৃদু হাসলো। ছবিটাতে নীল চোখমুখ কুঁচকে আছে। নীলকে দেখে মনে হচ্ছে ওকে কেউ জোর করে করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে। কণ্ঠ যখন ফোনে তার আর নীলের বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি দেখায় ব্যস্ত তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। কণ্ঠ ফোনটা সেন্টার টেবিলে রেখে দরজার দিকে গেলো।
দরজা খুলে দিতেই নীলের ছোট বোন নিতু রুমে প্রবেশ করলো।
–শুভ সকাল কণ্ঠ আপু।

কণ্ঠ নিতুর ডান গালটা আস্তে করে টিপে দিয়ে বললো,
–শুভ সকাল বাবু।

–জানো কণ্ঠ আপু আমি না কনফিউজড।

কণ্ঠ ভ্রু কুঁচকে বললো,
–কেন কেন শুনি।

–আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো? ভাবি নাকি আপু? আগে তো তুমি আমার আপু ছিলে। কিন্তু এখন? এখন তো তুমি ভাইয়ার বউ। ভাবি হও। তাহলে কি ডাকবো ভাবি নাকি আপু?

–চিন্তার বিষয়। কি ডাকবে বলো তো?

নিতু কিয়ৎক্ষণ নিজের থুতনিতে শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কয়েকবার বারি দেওয়ার ভঙ্গিতে কিছু ভাবলো। কণ্ঠ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিতুর দিকে। নিতুর বয়স দশ। সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। বয়স কম হলেও সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। সে মোটেও নীলের মতো গ’র্ধব টাইপের নয়। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা শেষে নিতুর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। সে সবসময়ের মতো চমৎকার হেঁসে বললো,
–আমি আজ থেকে মানে এখন থেকে তোমাকে ভাবিপু বলে ডাকবো। নামটা কেমন? পছন্দ হয়েছো?

কণ্ঠ আলতো হেসে বললো,
–পছন্দ হবে না আবার। খুব পছন্দ হয়েছে।

নিতু আবারো চমৎকার ভঙ্গিতে হাসলো। এই মেয়েটার ঠোঁটের কোনে সবসময় হাসি থাকে। যখন সে খুব খুশি হয় তখনও হাসে আর যখন খুব কষ্ট পায় তখনও হাসে।

–ভাবিপু এখন নিচে চলো। আম্মু তোমায় যেতে বলেছে।

–আচ্ছা চলো।
কণ্ঠ নিতুর সাথে নিচে আসলো। নীলের মা নীলিমা আর নীলের খালা মিলে টেবিলে নাস্তা দিচ্ছেন। কণ্ঠকে আসতে দেখে নীলিমা আদুরে কণ্ঠে বলে উঠে,
–কণ্ঠ মা আয়। নাস্তা করে নে। তুই তো আবার সকালের নাস্তা তারাতাড়ি করিস।

কণ্ঠ মৃদু হেসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
–আঙ্কেল কোথায় আন্টি?
নীলিমা নিরুত্তর। নীলিমাকে চুপ থাকতে দেখে কণ্ঠ আবার বলে,
–আন্টি?

কণ্ঠের ডাকে এবার নীলিমা ভ্রু কুঁচকালো।
–তুই কি আমাকে বলছিস?

–তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলবো।

নীলিমা যেন নারাজ হলো। বললো,
–আমাকে এখনো আন্টি বলেই ডাকবি কণ্ঠ? আমার কি শখ করে না নিজের ছেলের বউয়ের মুখে মা, আম্মু বা মামনি ডাক শুনতে?
কণ্ঠ এবার হাসলো। নীলিমা কণ্ঠকে অনেক স্নেহ করে। অনেক ভালোবাসেন তিনি কণ্ঠকে। আগে যখন কণ্ঠ এই বাড়িতে আসতো নীলিমা কণ্ঠের পছন্দের খাবার রান্না করে তাকে খাওয়াতো। কণ্ঠ নীলিমার রান্নার খুব ভক্ত। তার রান্না করা চিংড়ি মাছের মালাইকারি কণ্ঠের অনেক প্রিয়।
–আচ্ছা ঠিক আছে এখন থেকে মামনি বলেই ডাকবো।

–এইতো আমার লক্ষী মেয়ে।

–নীল কোথায় কণ্ঠ? উঠেনি এখনো?

–না খালামনি। নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে।

–ছেলেটাও না। এত ঘুমকাতুরে। তুই খাওয়া শুরু কর।

–বাকি সবাই কোথায়?

–সবাই রিসিপশনের কাজে ব্যস্ত আছে। তুই খা।
কণ্ঠ কোনো কথা না বলে খাওয়ায় মন দিলো। খাওয়া শেষ করে কণ্ঠ রুমে গেলো। নীল এখনো ঘুমাচ্ছে। শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। কণ্ঠের কেন যে নীলের এই শান্তির ঘুম সহ্য হলো না। ভেতর থেকে তার অন্তর আত্মা তাকে বার বার বলছে, ❝না কণ্ঠ না! তুই নীলকে এত শান্তিতে ঘুমাতে দিতে পারিস না। তোর উচিত নীলকে বিরক্ত করা। এটা তোর দায়িত্ব। তুই নিজের দায়িত্বে অবহেলা করতে পারিস না।❞ কণ্ঠ নিজের অন্তর আত্মার কথা শুনলো। সে নিজের শাড়ির আঁচলের এক মাথা চিকন করে মুড়ে তা দিয়ে নীলের কানে শুরশুরি দিতে লাগলো। নীল নড়েচড়ে উঠলো। একটু নড়েচড়ে নীল অপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। কণ্ঠের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কণ্ঠ এবার বাথরুম থেকে এক মগ পানি নিয়ে এসে তা নীলের দিকে ছুঁড়ে মা’রলো। পানির ঝাপটায় নীল হুড়মুড় করে উঠে বসলো। নীলের কান্ড দেখে কণ্ঠের হাসি যেন থামছে না।
কোনো মেয়েলী ঝংকার তোলা হাসির শব্দে নীল থেমে গেলো। মনে হচ্ছে তা বুকের ভেতরে কেউ হাতুড়ি পে’টা করছে। নীল সামনে তাকিয়ে দেখলো কণ্ঠ হাসছে। কণ্ঠকে হাসতে দেখে নীল ভ্রু কুঁচকালো। কিয়ৎক্ষণ পর তার মস্তিষ্ক সাইরেন বাজিয়ে তাকে জানান দিচ্ছে তাকে কণ্ঠ নামক সাংঘা’তিক রমণীটি-ই ভিজিয়েছে। তার এই হাসিটার কারণ কণ্ঠ নামক সাংঘা’তিক রমণী নীল নামক অবলা পুরুষকে জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও নীল নামক অবলা পুরুষটি সবসময়ই এই কণ্ঠ নামক তেজী রমণীর কাছে পরাজিত!
কণ্ঠ হাসি থামিয়ে এবার নীলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–ওই ব’লদ আর কতো ঘুমাবি। উঠ এবার। কত বেলা হলো খেয়াল আছে তোর। এত ঘুমকাতুরে কেন তুই?

–আই জাস্ট লাভ ঘুম। ঘুম আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।

–আর শেষ?
কণ্ঠের প্রশ্নে ভ্রু দ্বয়ের মাঝখানের ফাঁকা কমে এলো নীলের। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কণ্ঠের দিকে। কণ্ঠ নীলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
–উঠে ফ্রেশ হয়ে আয় গিয়ে। নাস্তা না করার ধান্দা করেছিস নাকি।
নীলকে এক ডজন ব’কা দিতে দিতে কণ্ঠ বারান্দায় চলে গেলো। নীল কণ্ঠের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত। সে কখনো এই মেয়েকে বুঝতে পারে। কণ্ঠকে বুঝবার অনেক চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। এক পর্যায়ে সে কণ্ঠকে বুঝতে পারার প্রয়াশ ছেড়ে দিলো। এ মেয়েকে বুঝতে পারার সাধ্য কারো নেই। কণ্ঠ কোনো গোলকধাঁধার চেয়ে কম নয় কোনো অংশে।

সকাল নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। কণ্ঠ একটা বেবি পিং কালারের গাউন পড়ে তৈরি হয়ে নিচে নামছে। কণ্ঠকে এভাবে দেখে নীলের বাবা জনাব কবির প্রশ্ন করলো,
–কোথাও যাচ্ছো কণ্ঠ মা?

–জ্বী বাবা। আসলে আমার হঠাৎ একটা আর্জেন্ট কাজ এসে গেছে। তাই যেতে হচ্ছে।

–কিন্তু রিসেশন?

–চিন্তা করবেন না খালামনি আমি দেরি করবো না। দুই ঘন্টার মধ্যেই চলে আসবো।

–সাবধানে যেও।

কণ্ঠ সকলকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। সে নীলদের বাসার গাড়ি নিয়ে যায়নি। নীলদের বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে কাউকে ফোন করতেই একটা সাদা রঙের প্রাইভেট কার এসে তার সামনে দাঁড়ায়। কণ্ঠ গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি চলতে শুরু করে। প্রায় আধঘন্টা পর গাড়িটি একটা আধপুরাতন বিল্ডিং এর সামনে এসে থামে। কণ্ঠ গাড়ি থেকে নেমে সচেতন পায়ে বিল্ডিংটির দ্বিতীয় তলায় উঠে যায়।
মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন রুম। রুমের এক কোনে একটা খাট আপর কোনে একটা টেবিল, চেয়ার আর এক পাশে একটা বুক সেল্ফ রাখা আছে। বুক সেল্ফে হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটা পুরাতন আর হালকা ছিঁড়ে যাওয়া বই রাখা আছে। কণ্ঠ সে দিকে নজর দিলো না। তর নজর খাটে জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে থাকা একজন অল্প বয়সী রমণীর উপর। রমণীর বয়স খুব বেশি হলে একুশ হবে। এই একুশ বছর বয়সী রমণীর উপর তার অগাধ রাগ। সে যে তার খুব প্রিয় কিছুর দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলো। তাকে কি সহজে ছেড়ে দেওয়া যায়? সহজে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? মোটেই না। তাকে শাস্তি পেতে হবে। কণ্ঠের জীবনের দিকে নজর দেওয়ার শাস্তি!আর এই শাস্তি তাকে কণ্ঠ নিজের হাতে দেবে। কণ্ঠ বার কয়েক তালি বাজালো। তালি বাজাতেই একজন তরুণ এবং একজন তরুণী ভেতরে প্রবেশ করলো।
–জ্বী ম্যাম।

–ওর জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক কাজ করো এক বালতি ঠান্ডা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো।
কণ্ঠের কথায় তরুণটি বিনা বাক্য ব্যায়ে চললো রুমের বাইরে। কিয়ৎক্ষণ পর সে ফিরে এলো এক বালতি ঠান্ডা পানি সমেত।

–পানির টেম্পারেচার কত?

–৫-৬ ডিগ্রি হবে ম্যাম।

–হুম। পানিতে কয়েকটা বরফের টুকরো ফেলে দাও রিশা।
রিশা নামের তরণীটি তাই করলো।

#চলবে…..ইনশাআল্লাহ