প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০৭

0
662

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৭ |

[কপি নিষেধ]

বৃষ্টিস্ন্যাত রজনী। বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটায় তীব্র ঝংকার তুলছে কাচের দেয়ালে। শব্দটা প্রায় খটখট। বিশাল কাচের অভ্যন্তরে রকিং চেয়ারে আলতো গতিতে দুলছে ফায়ান৷ কানে তার ফোন। কলের অপর প্রান্তের মানুষটি তার প্রথম প্রিয় ব্যক্তি৷ তার মা। এই সময়টি তার মায়ের জন্যে নিবদ্ধ। এই সময়টিতে তার কোনো কাজের ছায়া মাড়ায় না। বিছানার পাশের ল্যাম্পটাই জ্বলছে শুধু, বাকি রুমটা এই আবছা আলো কতোটুকুই বা আলোকিত করতে সক্ষম হয়? তাও আকাশের বজ্রপাত এবং হঠাৎ হঠাৎ ঝলকানিতে রুম খানিকটা আলোকিত হয়ে আসছে। এ যেন কালবৈশাখীর রাত। সব এলোমেলো করতে ব্যস্ত তীব্র ঝড় এবং বর্ষণ। অম্বর আজ কোনকিছুর বাঁধা মানছে না। সে প্রকৃতিকে ঠান্ডা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
নেত্রপল্লবে আলোর ঝলকানি লাগলো ফায়ানের। অপর প্রান্ত থেকে রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠলো,

-‘কবে আসবি এই অভাগা মাকে দেখতে বলতো?’

ফায়ান কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অতঃপর বাহিরের ঝড়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

-‘ভেরি সুন মা। আই নিড মোর টাইম ইন বিডি। ব্রেকফাস্ট করেছো?’

-‘ব্রেকফাস্ট করেই তো প্রতিদিন কথা বলতে বসি ফাই! তুই খাসনি?’

-‘ইচ্ছে করছে না মা!’

-‘এ কেমন কথা? দাঁড়াও আমি এক্ষুনি তোমার ছোটমা কে কল দিচ্ছি। তার এতো বড় সাহস আমার ছেলেকে না খাইয়ে রেখেছে!’

ফায়ান এক্সপ্লেইন করতে পারলো না। তার আগেই সারা কল কেটে দেয়। মায়ের বাচ্চামো দেখে ফায়ান না হেসে পারলো না। হেসে টলমলে ভাবে মাথা দেয় রকিং চেয়ারে! তার আঁখিপল্লব বুজে থাকলেও ঠোঁটে হাসি। কিছুক্ষণ বাদেই ছোট-মা ছুটে আসলো খাবার নিয়ে!

-‘আস্ত বদ ছেলে তো তুই। আমি তোকে না খাইয়ে রেখেছি? ভাবী আমায় কী কথাটা না শুনালো। ফাই! এখন চটপট খাবি তুই, নয়তো একটা চড়ও মাটিতে পরবে না। আমি নিজে বসে থাকবো তোর সামনে..’

ফায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে ডান দিকে ফিরলো। সেন্টার টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে ছোট-মা! ফায়ান শান্ত ভঙ্গিতেই বলে ওঠলো,

-‘দিয়া কোথায় ছোট-মা? আর কতদিন অপেক্ষা করবো বলো তো?’

—————————-

আরোরা কলম হাতে ইংলিশের ফন্ট আঁকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সে এতই বিরক্ত যে ঘর্মাক্ত কপালে ওড়না বুলাতেও বিরক্তিবোধ হচ্ছে। ফায়ান যেন আঁটঘাঁট বেঁধে মাঠে নামে। গতকাল রাতে এতো করে পড়লো এই আশায়, যে ফায়ানকে ভালো ভাবে পড়া দিয়ে ছুটি পাবে। অতঃপর রুহান এবং আরিশার সঙ্গে ফুচকাও খেতে যাবে। আইমানের বিয়ের কথা শুনে আরোরা টাকাও নিয়েছে বেশি করে। বিয়ে হবে বলতে পাত্রী দেখছে। সেদিনের গুড নিউজটা মূলত এটাই ছিলো। কিন্তু তা আর হলো কই? কথায় আছে ‘অভাগা যেদিকে যায় সেদিকেই সাগর শুকায়।’
তার এত এত প্ল্যানে মুহূর্তেই পানি ঢেলে দেয় দ্য ইংরেজ ফায়ার! রাগী ইংরেজ! রুহান এবং আরিশা কয়েকবার জানালা দিয়ে উঁকিও দিয়ে গেছে। যখন বুঝলো উপায় নেই তারা মুখটা বেজার করে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে।
আরোরা দাঁত কিড়মিড় করে ফায়ানের পানে তাকালো। ইচ্ছে করছে টেবিলের নিচে দিয়ে এক লাথি মেরে উড়িয়ে দিতে। তখন সাহেবের ভাব কোথায় যায় সেও দেখে নিতো। ব্যাটা, ইতরের হাড়ি। ফায়ান সূক্ষ্মাগ্র দৃ্ষ্টি নিক্ষেপ করলো আরোরার পানে। আরোরা সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করে খাতায় কলমের বিচরণ চালাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। ফায়ান কপাল কুচকে বললো,

-‘বাহিরে যাওয়ার জন্য মনে হচ্ছে জান বিলিয়ে দিচ্ছো?’

আরোরা থতমত খেয়ে ফায়ানের পানে তাকালো। বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘মানে?’

-‘তুমি ভালো জানো!’

আরোরা মাথা নত করে ফেললো। মিনিট খানেক পার হতেই সে ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করলো, ফায়ানকে কিছু বলার জন্যে। বেহুদা বসে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত, চরম বিরক্ত। আরোরা কিছু বলার জন্য যখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তখনই ফায়ান আরোরার হাত ধরে কেবিন থেকে বের হতে অগ্রসর হয়। আরোরা হতবিহ্বল হয়ে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টিতে স্তব্ধতা স্পষ্ট। আরোরা হতবুদ্ধি যেন নিমিষেই হারিয়ে ফেলে। যখন তার সম্বিৎ ফিরে তৎক্ষনাৎ সে তার হাত মুঁচড়া-মুঁচড়ি করতে করতে অস্পষ্ট গলায় বলে ওঠে,

-‘হা..ত কেন ধরেছেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়?’

-‘লাঞ্চে!’ ফায়ানের স্পষ্ট জবাব।

-‘ক্যান্টিন তো উপরে আপনি পার্কিং এর দিকে যাচ্ছেন কেন?’

-‘ক্যান্টিন অফ!’

বলেই আর কোনোরূপ উত্তর দিলো না ফায়ান। নিজের গাড়ির সামনে আসতেই সে তার গার্ডকে সরে যেতে ইশারা করলো। ব্ল্যাক স্যুটের বডিগার্ড দেখে আরোরা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আগে কখনো গার্ড দেখার মতো সৌভাগ্য তার হয়নি, তাও ব্ল্যাক সুটের বডিগার্ড! আরোরার এমন দৃষ্টি দেখে গার্ড হালকা কাশলো। অতঃপর রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো। আরোরার হাতে হঠাৎ টান খাওয়ায় তার ধ্যান ভাঙলো! ফায়ানের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো ফায়ান ভ্রু যুগল কুচকে তারই পানে তাকিয়ে আছে।

-‘গার্ডকে এভাবে দেখলে কেন? যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে?’ কন্ঠে গাম্ভীর্য ভাব স্পষ্ট। আরোরা বিষম খেলো। কোনোমতে নিজেকে সামলে ভরাট গলায় বললো,

-‘আমি স্যুট দেখছিলাম স..স্যার!’

-‘দেখতে হবে কেন? তুমি শুধু… লিভ ইট! গাড়িতে বসো!’

আরোরা পুণরায় গোল গোল চোখে ফায়ানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। বিমূর্ঢ় স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-‘মা~নে?’

-‘কানে শুনতে পাও না? আমি এক কথা রিপিট করতে লাইক করি না! ড্যাম..!’

বলেই ফায়ান ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। আর আরোরা যেন স্বপ্নের ভেলায় ভাসমান! যা সে কল্পনাও করতে পারে না সেসব তার সাথে ঘটছে! বাস্তব এবং স্বপ্নের অংক মেলাতে মেলাতে সে ফ্রন্ট সিটে বসে পরলো।

—–

-‘আমি তোমায় বাসায় পৌঁছে দিবো!’

-‘মানে? কষ্ট করার কী আছে স্যার, এখান থেকে রিকশা ধরলে কিছুক্ষণের ব্যাপার!’

-‘তোমার থেকে পারমিশন নেইনি আমি, আই জাস্ট সে মাই ওউন ডিসিশন।’

বলেই স্টেয়ারিং ঘোরালো ফায়ান। তার কন্ঠস্বরে গাম্ভীর্য ভাব স্পষ্ট। আরোরা ফায়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তার জোরালো অধিকারবোধ কেন যেন আরোরার নিকট ‘ভূতের মুখে রাম রাম’ টাইপ লাগছে। অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর! আরোরাকে আরও অবাক করে দিয়ে ফায়ান তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এতো এতো বিস্ময় মাথায় নিতে না পেরে আরোরার মুখটা নিজের অজান্তেই ফাঁক হয়ে গেলো।

-‘আপনি আমার এড্রেস পেলেন কোথায়?’

-‘আমি তোমার ভার্সিটির লেকচারার, এড্রেস পাওয়া কী খুব কঠিন নাকি আমি বাহিরের কেউ?’

আরোরা কাশি উঠে গেলো৷ প্রথমত জোরালো অধিকারবোধ, লাঞ্চ করানো তাও নিজ খরচে। অতঃপর বাড়ি পৌঁছে দেয়া, সবটাই আরোরার নিকট কল্পনার চেয়েও নিকৃষ্ট লাগছে। মানে কীভাবে সম্ভব? এতো কেয়ার, এতো যত্ন? হাউ??

————————

আরোরা বাদাম চিবুচ্ছে আর একপলকে তার গোলাপ ফুলের টবটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টান্ত আনমনে, বিমূঢ়। পাশেই আইমান তার বোনের ভাব-ভঙ্গি বোঝার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু নাহ। ঠাওর করতে পারছে না বোনের এমন আনমনে থাকার কারণ। আইমান নিজেকে দমাতে না পেরে আইমান তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,

-‘কী হয়েছে বল তো? ফুচকা খাওয়ার টাকা নিলি, খেয়েছিসও। তাহলে হাসি মুখের জায়গায় এমন থম মেরে আছিস কেন? কী এতো মনোযোগ দিয়ে ভাবছিস!’

-‘পরিচিত মুখ হঠাৎ কীভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠে, সেটারই হিসাব মিলছে না ভাইয়া!’ আরোরার রাশভারি কন্ঠস্বর। আনমনেই বললো সে।

-‘মানে?’ আরোরার কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে আইমান! আরোরার হুঁশ ফিরলো। সে সটান হয়ে বসে অতর্কিত কন্ঠে বলে ওঠে,

-‘কিছু না। বাদাম ছিলে দে। কিছুদিন পর তো বউয়ের অধীনে চলে যাবি!’

——

আজ আরোরাদের ক্লাসমেট মেহেদীর বাড়িতে বারবিকিউর আয়োজন হবে। গরমে বারবিকিউ, বিষয়টা হাস্যকর হলেও মেহেদী এই পার্টির এরেঞ্জ করেছে। ইদানীং বেশ ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে যার ফলে গরমের খুব একটা উত্তাপ নেই। এখানে আরোরাসহ তাদের ডিপার্টমেন্টের অনেকেই উপস্থিত থাকবে। দুজন টিচারকেও ইনভাইট করেছে মেহেদী। ফায়ান স্যার এবং জাকিয়া ম্যামকে। তাদের ভার্সিটিতে এই দুজন টিচারই ইয়াং জেনারেশনের। বলা যায় ভার্সিটির সবচেয়ে জুনিয়র টিচার এই দুজনই। তাই মেহেদী ওনাদের দুজনকেই নিজেদের নিয়েছে। ফায়ান গম্ভীর টাইপ মানুষ, সে কখনো তাদের আনন্দে ব্যাগড়া দিবে না। জাকিয়া ম্যাম মিশুক মানুষ, সে তো উল্টো তাদের আনন্দে আনন্দিত হবে। অনেকে ফায়ান এবং জাকিয়াকে নিয়ে বলাবলি করছে।
এদিকে আরোরা নিশ্চুপ। অন্তরালে এই ধরণের প্রসঙ্গ তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। কোনো স্যার/ম্যামদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা কতোটা যুক্তিযুক্ত? পরিশেষে দেখা যায় সমালোচক এত বেশি ভেবে বসে যা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এমন কিছুই হয়নি!

~চলবে, ইনশাল্লাহ।