প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০৮

0
656

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৮ |

[কপি নিষেধ]

কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। বর্ষণের পরবর্তী মুহূর্ত! তুলোর ন্যায় মেঘরাশি এখনো অম্বরের বুকে ভেলার ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে। হিম শীতল হাওয়ায় চারপাশ নিমজ্জিত। অতিরিক্ত বাতাসে আরোরার মাথা থেকে বারংবার ওড়নাটা পরে যাচ্ছে যার ফলে উম্মুক্ত অবাধ্য চুলগুলি অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। বিরক্তিতে কপালের ভাঁজ ফেলে বারংবার চোখ-মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে কানে গুঁজে মাথায় ঘোমটা দিলো সে। ওড়নাও তার দীঘল কালো কেশকে সামলে রাখতে পারছে না। আরোরা ছাদের এক পাশে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে শুধু রুহান আছে। আরিশা তার বড় আপু আর দুলাভাইয়ের সাথে অন্য কোথাও বেড়াতে গেছে। রুহান ছাদের রেলিং এ দু’হাত প্রসারিত করে গুণগুণ করে গান গাইছে। তার দৃষ্টি অদূরের নিকষকৃষ্ণ মেঘাম্বরেই নিবদ্ধ। আরোরা কোণা চোখে রুহানের ভঙ্গিমা লক্ষ করে কন্ঠস্বর চওড়া করে বললো,

-‘কী ব্যাপার, এতো গান আসছে কোথা থেকে?’

-‘মেকআপ ওয়ালি নেই আজ। তাই কিছুটা স্বস্তিতে আছি!’

-‘খবরটা লিক করলে কেমন হবে রে দোস্ত?’

রুহানের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীতে মুহূর্তেই বিষাদ হানা দিলো। মুখটা বেজার করে ঘাড় বাঁকিয়ে আরোরার দিকে তাকালো। রুহানের করুণ দৃষ্টিপাত দেখে আরোরা ফিক করে হেসে দেয়। রুহানের কাঁধে এক চাপড় দিয়ে বলে,

-‘মজা করেছি আমি। মুখ গোমড়া করতে হবে না। ইঞ্জয় ইওর টাইম!’

রুহান অধর জোড়া প্রসারিত করলো। আরোরা ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করলো। নাহ ফায়ানের এখনো আসার নাম নেই৷ আরোরা জানে না ফায়ানকে সে কেন খুঁজছে, তবে ফায়ান থাকলে তার কেমন যেন স্বস্তি অনুভব হয়! এই সুপ্ত স্বস্তিটা কেন আসে, সেই উত্তরটা তার মস্তিষ্ক আজও জানাতে অক্ষম৷ আরোরা নিশ্চুপ হয়ে শীতল বাতাসটা উপভোগ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ কাটতেই মেহেদী হাঁক ছাড়লো।

-‘কীরেহ তোরা দুজন কর্ণারে কী করিস? আমাদের সাথে আয়! একসাথে বারবিকিউ করি!’

আরোরা ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
-‘তোরা মজা কর, আমি এখানে ঠিক আছি।’

মেহেদী আর জোর করলো না। বলা যায় জোর করার সময়টা পেলো না। সে তার বন্ধুগণ এবং কাজিনদের নিয়ে আড্ডায় মত্ত। কিছুক্ষণ বাদে আরোরার অপেক্ষার অবসান ঘটে এবং তার অধরে নিজের অজান্তেই হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু ফায়ানের গাড়ি থেকে জাকিয়া ম্যামকে নামতে দেখে মুহূর্তেই আরোরার আনন্দ বেজারে পরিণত হয়। জমা হয় ফায়ানের প্রতি তীব্র অভিমান! ফায়ান এবং জাকিয়া ম্যাম হেসে হেসেই ভেতরে ঢুকলো। একজন স্টুডেন্ট তো সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো,

-‘আমাদের লাভ বার্ড আসছে। তাদেরকে ওয়েলকাম জানাতে হবে না?’

ক্লাসমেটের এরূপ উক্তিতে কিছু মেয়ে যেন জ্বলে উঠলো। তারা কোনরকম পতিক্রিয়া না করে নিজেদের মতোই রইলো। সেই ছেলের কথার কোনোরূপ আগ্রহ বা গুরুত্ব দেখালো না। আরোরার অদম্য মনটাও কেমন কেমন করছে.. অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আরোরা অন্তঃপুরের ভাবনা থেকে নিমিষেই বেরিয়ে আসলো এবং নিজেকে পরিবেশ উপভোগ করায় ব্যস্ত রাখলো।

——————————–

ফায়ান আরোরার থেকে কয়েক ফুট দূরে অবস্থান করছে। সেও আরোরার মতো কোলাহলে থাকাটা বিরক্তি হিসেবে নিয়েছে। সে আসতেও চাইছিলো না কিন্তু জাকিয়া ম্যাম জোর করায় সে আসতে বাধ্য হয়। আরোরা একা দাঁড়িয়ে আছে। রুহান এখন বারবিকিউর দায়িত্বে আছে। ফায়ান তার সুক্ষ্ম দৃষ্টিপাত এক অপরিচিত ছেলের দিকে নিক্ষেপ করে আছে। ছেলেটা প্রায় সময়ই আরোরাকে অদ্ভুতভাবে দেখছে।

আরোরা অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছে মেহেদীর এক কাজিন তার দিকে কীভাবে তাকিয়ে দেখছে। আরোরার অস্বস্তি অনুভূত হলেও সে নিশ্চুপ, বিমূঢ় হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার অভ্যন্তরের ভাবনাগুলো ঠিক কাকে এবং কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে, সেটাই বোঝার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে। পরমুহূর্তে খেয়াল হলো ছেলেটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। আরোরা ভয় পেলো, তার সত্ত্বা কেমন ঠান্ডা হতে শুরু করে দিলো। আরোরা প্রায় সময়ই অচেনা ছেলেদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মাঝেমধ্যে উপর দিয়ে শক্ত দেখালেও, ঝামেলা – ঝঞ্ঝাট বেশ ভয় পায়। তাও আরোরা অদূরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলো। যখন টের পেলো ছেলেটা তার নিকট প্রায় এসে গেছে তখনই আরোরা ঘাড় বাঁকিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ সুঠাম দেহী একজন পুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়ালো। পুরুষটির পরনে সবুজ টি-শার্ট দেখে আরোরার চিনতে বাকি রইলো না মানুষটি কে! মানুষটির পেছনটা আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেয় আরোরা। ফায়ান থমথমে গলায় বলে,

-‘এদিকে কী?’

ছেলেটি জানে ফায়ান একজন টিচার তাই সে হাসার চেষ্টা করে বললো,

-‘এমনি স্যার, তার সাথে একটু পরিচিত হতাম!’

ফায়ান ছেলেটির দিকে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে বলে,
-‘পরিচিত হওয়ার জন্য অন্য কাউকে বেছে নিন। এদিকে একা একটি মেয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এতে করে মেয়েটির অস্বস্তি হতে পারে। সব মেয়েদের তো আর ছেলেদের সাথে উঠা-বসা থাকে না।’

ফায়ানের যুক্তিতে ছেলেটি দ্বিরুক্তি করার সাহস পেলো না। সে ফায়ানের পেছনের মেয়েটির দিকে আরেক পলক তাকানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে চলে গেলো। ফায়ানের হুটহাট আরোরাকে হেল্প করা, কেয়ার করা আরোরার অনেকটা ভালো লাগা জুড়েই বিদ্যমান। আরোরা অধর প্রসারিত করে আনমনে ফায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে করলো ফায়ানকে ধন্যবাদ জানানোর কিন্তু তার গলার স্বর যেন মুগ্ধতায় হারিয়ে গেছে। ফায়ান আরোরার দিকে ফিরতেই আরোরা দৃষ্টিনত করলো। ফায়ান গলায় গাম্ভীর্যভাব এনে বললো,

-‘এসব ইডিয়েটের থেকে দূরে থাকবে। গট ইট?’

আরোরা চোখ বড় বড় করে মাথা তুলে তাকালো। ফায়ান কিছুটা ঝুঁকে আছে তার দিকে যা লক্ষ্য করতেই আরোরা ভড়কে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেলো মুহূর্তেই। আরোরা প্রশ্ন করার সুযোগ অবধি পেলো না। ফায়ান সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরোরার পাশে দাঁড়ালো এবং রেলিং এ দুই হাত প্রসারিত করলো। আরোরা তখনো স্তব্ধ, বিমূঢ়! ফায়ানের বলা বাক্যটি মস্তিষ্কে বারংবার তরঙ্গিত হচ্ছে তার।

—————————–

-‘স্যার জাকিয়া ম্যাম ওখানে, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে? আমার বারবিকিউও রেডি। খাবেন না?’

আরোরা কোণা দৃষ্টিতে মেহেদীর দিকে তাকালো। কেন যেন ইদানীং এই নামটা তার ভেতরে দহনের সৃষ্টি করে। ফায়ান রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে ফোনের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

-‘আই ডোন্ট লাইক দিস সাউন্ড’স, মেহেদী। জাকিয়া ম্যাম থাকুক। এখানে দিয়ে যেতে পারো ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড!’

-‘কী যে বলেন না স্যার। আমি দিয়ে যাচ্ছি!’

বলেই মেহেদী আরোরার দিকে তাকালো এবং কিছু একটা ইশারা করলো। আরোরা ইশারা বুঝে ঘাড় ডানে বামে নাড়ায় যার অর্থ ‘না’! মেহেদী আর কিছু না বলে চলে গেলো। প্রায় পত্যেকেই ওদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে যা আরোরার অজানা নয়। এই দৃষ্টির ভাষাও যেন আরোরা বুঝতে পারে। আরোরা কোণা চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো। ইংরেজের তার সাথে কী কাজ? কী পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক যাওয়ার নামগন্ধও নেই। এদিকে ছেলে মেয়ে গুলো কিসব ভাবা শুরু করেছে কী জানে? আরোরার ভাবনায় ছেদ ঘটালো ফায়ান।।

-‘ওদিকে যাচ্ছো না যে?’

-‘কোলাহল খুব একটা পছন্দ না। তার উপর এমন মেলামেশা, আমি এখানেই ঠিক আছি স্যার।’

অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো আরোরা। ফায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে আরোরার শুভ্র মুখশ্রীর দিকে তাকালো। বাতাসে কিছু চুল কপালে পরে আছে। অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো ফায়ানের তবে সে নিজেকে সংগত রাখলো। ফায়ান আবারও ফোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,

-‘আই লাইক ইওর ডিসিশন। ওদিকে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনও নেই। আমার সাথেই থাকো।’

—————————

-‘ওই কে তুই? তুই কার চ্যালা একবার বল, তারপর দেখ তোর কী হাল করি আমি!’ ইয়ামিন তীব্র হুংকারে ফোনের কানে দিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে শুধু হাসির শব্দ শোনা গেলো।

-‘আমি কারো চ্যালা, হাউ ফানি! তুই তো দেখছি কিছুই জানিস না। এনিওয়ে, এটুকু জেনে রাখ তুই আমার পায়ের নখেরও যোগ্য না। তুই আবার আমায় থ্রেট দিচ্ছিস, হা হা! আমার নিকট পৌঁছাতে তোর সাত সমুদ্র পার করা লাগবে।’ বলেই অপরজন থামলো। অতঃপর রুদ্ধশ্বাস ফেলে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠলো,

-‘তুই নিজেও জানিস না তুই কার পাল্লায় পরেছিস! তুই আমার জিনিসে নজর দিয়েছিস, তুই মরবি! তিলে তিলে মরবি! আমার সাথে লাগার চেষ্টা ভুলেও করিস না। তাই বললাম, সাবধান হয়ে যা৷ তোকে রাস্তায় নামাতে আমার দু’সেকেন্ডের ব্যাপার!’

ইয়ামিন হেসে উঠলো। অতঃপর হাসতে হাসতেই বললো,
-‘দেখা যাবে কে রাস্তায় নামায় আর কে নামে। আই এক্সেপ্টেড ইওর চ্যালেঞ্জ!’

-‘বেস্ট অফ লাক, দ্য সুপার কল্ড মন্ত্রীর চ্যালা! তোর আমার লড়াইটা বেশ জোস হবে। আই লাইক ইওর কনফিডেন্ট!’

বলতেই লাইন কেটে গেলো। ইয়ামিন ফোন কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিনে ভাসমান ‘প্রাইভেট নাম্বার’ লেখাটির দিকে তাকালো। পারলো না সে লোকটিকে ট্র‍্যাক করতে।

—-

-‘প্রিয় পায়রা! আমার জানো বিডির এই একটা পাখি-ই খুব পছন্দ। আই লাইক দিস বার্ড মোস্ট! অলসো ইউ। বাট, বাট। আই লাভ ইউ! ভালোবাসি! তোমায় দেখলে আমার মস্তিষ্কে একটি গানই তরঙ্গিত হয়..
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখবো,
ছেড়ে দেবো না!”

~চলবে।