প্রণয়ী পায়রা পর্ব-০৯

0
659

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ০৯ |

[কপি নিষেধ]

নিকষকৃষ্ণ রজনী। ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁইছুঁই। অদূর থেকে কুকুরের হাঁক শোনা যাচ্ছে। ঘুমন্ত নিস্তব্ধ শহরের দিকে আরোরা নিশ্চুপ হয়ে চোখ বুলিয়ে নেয়। আরোরা নিদ্রাহীন, আজ এই দীর্ঘ রজনীতে কেন যেন ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মস্তিষ্কে তার রাজ্যের ভাবনা ভর করেছে। তার ভাবনা একজন মানুষকে কেন্দ্র করেই। রাতের মুহূর্তটুকু বারংবার তার চোখের সামনে ভাসছে। একপ্রকার কৈ মাছের ন্যায় ছটফট করছে সে। অস্বস্তি, জড়তা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। তার নিদ্রাহীন থাকার একমাত্র কারণ হচ্ছে ফায়ান। ফায়ানের এতো এতো কেয়ার, থ্রেট দেয়া, অধিকার ফলানো সবকিছুই আরোরার জন্য বিস্মকর! তার বারংবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি সে ফায়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলছে, ছিঃ এটা কখনোই সম্ভব না। আরোরা নিজের অন্তঃপুরে লড়াই করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো৷ আইমানের রুম থেকে শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই ল্যাপটপে মুভি দেখছে। আরোরা তপ্তশ্বাস ফেলে চা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। আইমানকে ডিস্টার্ব করলো না। পরে দেখা যাবে আইমান প্রশ্নের ঝুঁড়ি নিয়ে বসবে। আইমানের সামনে সে কখনোই বেজার মুখে থাকতে পারে না। আইমানের প্রশ্নে আরও মুখ ঘুচে যায়। আপাতত তার প্রশান্তি চাই। বেলকনির ডিভানে বসে একমনে চায়ের ধোঁয়া ওঠা দেখতে লাগলো। পথের ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলো বেলকনিতে আবছা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিছুক্ষণ পরপর হিম শীতল বাতাস আরোরার নিস্তেজ দেহকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এতে হালকা কেঁপে কেঁপেও উঠছে সে। চিন্তিত মনে চায়ে চুমুক দেয় এবার। বাহিরে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। কী মনে হতেই সে নিচে রাস্তায় তাকালো। কতো শুনশান, পিনপতন নীরবতা। চঞ্চল এবং কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় মানুষের ছায়াটাও নেই। কী ভয়ংকর নিস্তব্ধতা। হঠাৎ ল্যাম্পপোস্টের পেছনের আবছা আঁধারে কারো অবয়ব খেয়াল করলো। তার ভাব-ভঙ্গিতে অনুভূত হচ্ছে অবয়ব্লটি তার দিকেই স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। মুহূর্তেই আরোরার সর্বাঙ্গে খেলে গেলো তীব্র শিহরণ! এই শিহরণ ভয়মিশ্রিত! আরোরা আবার এসব ছায়ামূর্তি ভয় পায়। আরোরার একটা মুভির কথা মনে পরে যায়। মুভিটিতে এমন এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতো। যখনই সেই অবয়ব কোনো মানুষকে দেখতো তখনই তার উপর ঝাপিয়ে পরতো। এই ঘটনা পুণরায় মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই তার চিকন অধরজোড়া কাঁপতে লাগলো।

আরোরা ভয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে উঠে দাঁড়াতেই ছায়ামূর্তিটি নড়েচড়ে দাঁড়ালো এবং আলোতে চলে আসলো৷ মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন চলে গেলো। আরোরা অধর জোড়ার মধ্যে কিঞ্চিৎ ফাঁক করে ছেলেটির যাওয়া দেখে গেলো। চোখে-মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ! তবে ভয়টা কেটে গেছে। কে ছিলো সে?

ফায়ান ড্রাইভ করছে এবং হাসছে। তার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ঠিকই লক্ষ্য করেছে আরোরার ভয়ার্ত মুখশ্রী। এই ভয়ার্ত মুখশ্রীতে যেন হাজারো মায়ার মেলা বসেছিলো। কী অমায়িক লাগছিলো তাকে। চোখ যেন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসতো! ভাবতেই ফায়ান নিঃশব্দে হাসলো।

বাড়ি ফিরে তার পরিহিত শার্ট খুলে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো। শার্টের কিছু অংশে রক্ত লেগে আছে। দেয়ালে এক হাত দিয়ে সে চোখ বুজে রইলো। হাতে পানি লাগতেই মুখ ঘুচে এলো তার। চোখ মেলে হাতে দৃষ্টি বুলাতেই দেখলো সেখানে রক্ত জমে আছে। কেটেও গেছে খানিক। ফায়ান পাত্তা দিলো না। আজকের মিশনটা সে ফুলফিল করতে পেরেছে এবং তার প্রেয়সীকে দেখতে পেরেছে এটাই অনেক। প্রেয়সীর কথা মস্তিষ্কে আসলেই ফায়ান অধর-জোড়া প্রসারিত করলো।

শাওয়াত সেরে বেরিয়ে হাতে মেডিসিন লাগালো সাথে ব্যান্ডেজও করে নিলো। ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই ফোন নিয়ে কারো নাম্বারে ডায়াল করলো সে। ওপাশ থেকে অফিসার ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘বলুন স্যার!’

-‘বাহ! আমরা এদিকে শত্রু বিনাশ করে আসলাম আর আপনি পরে পরে ঘুমাচ্ছেন.. গ্রেট!’

ফায়ানের কন্ঠস্বর অফিসারের কর্ণধারে প্রবেশ করতেই সটান হয়ে উঠে বসলো অফিসার। খানিক অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে তাকে। অফিসার কিছু বলার জন্য যেই প্রস্তুতি নিলো। অতঃপর ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠলো,

-‘আসলে কখন যে চোখ লেগে গেলো বুঝতে পারিনি।’ অফিসারের কথায় পাত্তা না দিয়ে ফায়ান বলে ওঠলো।

-‘কথা ছিলো কাজ শেষ হলে পেমেন্ট আমার একাউন্টে পাঠিয়ে দিবেন। একাউন্টে কোনো টাকা আসেনি কেন? আমি কিন্তু গভার্মেন্টের গোলাম না! রিমেম্বার?’

অফিসার গলা শুকিয়ে এলো। ঘুমের কারণে সে টাকা পাঠাতেই ভুলে গেছে। অফিসার দ্রুত বলে উঠলো,

-‘সরি, সরি স্যার! আমার সত্যি খেয়াল ছিলো না। আমি এখনই দিচ্ছি। আপনি চাইলে এমাউন্ট আরও বাড়িয়ে দিবো!’

-‘ফায়ান এক কথার মানুষ! সে যা চেয়েছে তার এক টাকা কম বা বেশি সে নেয় না! ডিল ইজ ডিল! আপনার টাকার গাছ থাকলে গরীব দুঃখিদের হেল্প করুন।’

—————————–

ফায়ান কপালে পরা চুলগুলো পেছনে নিয়ে ঘর্মাক্ত কপালে আঙুলের বিচরণ চালালো। চোখে-মুখে চিন্তিত ভাব স্পষ্ট। জাকিয়া ম্যাম অনেকক্ষণ ধরেই ফায়ানকে চিন্তিত দেখছে। জাকিয়া কিছুটা সাহস জুগিয়ে মৃদ্যু স্বরে বলে ওঠলো,

-‘স্যার, আপনি কী কোনো কারণে আপসেট?’

ফায়ান জবাব দেয় না। তার মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠলো যা জাকিয়ার দৃষ্টি এড়ালো না। সে চুপসে গিয়ে সামনের দিকে ফিরলো। ফায়ান লাইব্রেরিতে এক মুহূর্তও বসলো না, বেরিয়ে যায়। বের হওয়ার পথেই একজন স্টুডেন্ট ফায়ানের সামনে আসলো। ফায়ান ভ্রু কুচকাতেই ছেলেটি বলে উঠলো,

-‘না স্যার, আজ উনি ভার্সিটি আসেনি। পাকা খবর!’

ফায়ান চোখের ইশারায় ছেলেটিকে চলে যেতে বললো। ছেলেটিও বিনা-বাক্যে ফায়ানের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ফায়ানের যেন রাগ তড়তড় করে বেড়ে যায়। সে কোনোরূপ অভিব্যক্তি না দেখিয়ে নিজের কেবিনের দিকে হাঁটা দেয়।

—————-

আরোরা টিভি দেখছে আর নাস্তা করছে। ঘুম থেকে উঠেছে এগারোটা নাগাদ। ফজরের নামাজের পরই তার আঁখিপল্লবে ঘুম ধরা দিয়েছিলো। দেরী করে ঘুমানোয় দেরী করেও উঠেছে সে। সকাল সকালই আরোরার মা চলে গেছে তার বোনের বাসায়। বাসায় আরোরা এবং বুয়া ব্যতীত কেউ নেই। বুয়া রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। আইমান এবং মুনীব সকালেই যে যার কর্মস্থলে চলে যায়। আরোরার খাওয়ার মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় মেসেজের টোন। ফোন কাছে ছিলো বিধায় তীব্রতর ভাবে শব্দটি কর্ণধারে প্রবেশ করলো আরোরার। ঘাড় ঘুরিয়ে আরোরা ফোনের দিকে তাকালো। ফোন হাতে তুলে মেসেজটি অন করলো। সিন করতেই চোখ বড় বড় করে তাকালো, ফোনের স্ক্রিনে।

-‘ফার্দার যদি দেখি রাত জেগে বেলকনির হাওয়া খাচ্ছো! এতো বড় মানুষও হয়ে যাওনি যে মাঝরাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দুঃখবিলাস করবে! ভার্সিটি গ্যাপ দিয়ে ভালো করোনি আরোরা!’

‘ইংরেজ’ নামের নম্বরটির থেকে এমন মেসেজ দেখে আরোরা মুহূর্তেই ঘাবড়ে গেলো। ফায়ান জানলো কীভাবে? আরোরা রাতে বেলকনিতে ছিলো সে কীভাবে জানলো? এই এক প্রশ্নের জন্যে আরোরা খাবার মুখে তুলতে ভুলে গেছে। বুয়া আসতেই যখন দেখলো আরোরা থম মেরে বসে আছে তখন সে আরোরাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বললো,

-‘আফা! খান না ক্যান? আমার তো বাসন ধুঁইতে হইবো! কই হারাইলেন আফা!’

আরোরা ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরলো। গোল গোল চোখে বুয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে খেতে মনোযোগী হলো!

———————-

-‘আ..আপনি জানলেন কী করে? সেদিন রাতের খবর আপনি কোথায় পেলেন?’

আরোরার কম্পিত কন্ঠস্বরের প্রশ্ন শুনে ফায়ান বাঁকা হাসলো। দু’পকেটে হাত রেখে আরোরার দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে বলে ওঠলো,

-‘ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে টিচার হইনি আমি মিস কেয়ারলেস! তোমার খবরা-খবর আমি না চাইলেও আমার কাছে পৌঁছে যায়! উত্তর পেয়েছো?’

আরোরা শুকনো দুটো ঢোক গিলে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দু’কদম পিছিয়ে গেলো। অসাবধানতায় পেছনের বুকশেল্ফের সাথে সজোরে পিঠে বারি খেলো। আরোরার মুখ ঘুচে এলো! ফায়ান উত্তেজনায় দ্রুত আরোরার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। অতঃপর চোখে মুখে রক্তিম ভাব এনে হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

-‘তুমি তো দেখছি পুরোটাই কেয়ারলেস! চলাফেরার সময় খেয়াল থাকে না নাকি? তুমি কী বাচ্চা? বাচ্চাদের মতোন আচরণ করো কেন? পেলে তো এখন ব্যথা! এমনেই হাড্ডি তার উপর এখন তো পিঠের হাড্ডি বাঁকা হয়ে গেছে! ডাফার!!’

~চলবে।