প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১০

0
772

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১০ |

[কপি নিষেধ]

আরোরা শক্ত দৃষ্টিতে সামনের আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে জমেছে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিজের অজান্তেই দু’একটা শুকনো ঢোক গিলে আরোরা। ইয়ামিন বিকৃতি দৃষ্টিতে আরোরাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। অতঃপর রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ফাইনালি তোমায় আমি পেলাম, বেব!’

আরোরা টু-শব্দও করলো না। ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করে বেসামাল কন্ঠে বলে ওঠে,

-‘কী চান?’

ইয়ামিন হাসলো। হেসে গুটিগুটি পায়ে আরোরার দিকে দু’ধাপ এগিয়ে বললো,
-‘আফ কর্স তোমাকে!’

আরোরা দুই ধাপ পিছিয়ে যায়। অতঃপর কাঠ কাঠ গলায় বলে,

-‘দূরে থাকুন, আমার থেকে দূরে থাকুন! আমার চেয়ে কোনো লাভ নেই!’

-‘কেন নেই বলো তো? তোমার সাথে তো আমার বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েই গেছিলো। কিন্তু তোমার মাথায় কোন ভেজাল এসে নাড়া দিয়ে সব ভেস্তে দিলো। তুমি আজ এখুনি বাসায় গিয়ে বলবে তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও!’

-‘আপনার মতো বাজে লোককে বিয়ে করা তো দূর তাকালেও ঘৃণায় নাক সিটকে আসে!’ ঘৃণিত স্বরে বলে ওঠে আরোরা। মুহূর্তেই ইয়ামিনের সতেজ মেজাজ ক্ষোভে পরিণত হলো। সে আরোরার হাত চেপে শক্ত কন্ঠে বললো,

-‘বিয়ে তো তোমার আমাকেই করতে হবে! ইয়ামিনের নজরে পরেছো তুমি, এত সহজে ছাড় পাবে না। পরিবার নিয়ে বিয়ে করতে চাইছি তোমায়, ভালো কথা কী কানে যায় না? নাকি জোর-জবরদস্তি তোমার পছন্দ, কোনটা?’

ঘৃণায়, লজ্জায়, অস্বস্তি এবং হাতের যন্ত্রণায় আরোরার চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। এক মুহূর্তের জন্যেও এই শয়তানটাকে তার সহ্য হচ্ছে না। আরোরা বারংবার নিজের হাত মোচড়া-মুচড়ি করতে করতে বললো,

-‘আবর্জনা ময়লা ফেলার স্থানেই সুন্দর। আপনি কিনা আবর্জনা হয়ে হিরের স্বপ্ন দেখছেন? হাত ছাড়ুন!! আপনার ওই আবর্জনায় আবৃত হাত আমার হাতে মানায় না!’

ইয়ামিন সশব্দে হাসলো। অতঃপর হাসি থামিয়ে আরোরার মুখের কাছে এসে বলে ওঠে,

-‘তাহলে চলো, তোমায়ও আমার আবর্জনায় সামিল করি!’

ঠিক তখনই ইয়ামিনের ডান গাল বরাবর জোরে এক ঘুষি বসলো। ঘুষির ব্যথায় তাল সামলাতে না পেরে ইয়ামিন আরোরাকে ছেড়ে মাটিতে মুখ থেতলে পরলো। আরোরা ঝাপসা দৃষ্টিতে সামনে তাকালো! ফায়ান তার সামনে দাঁড়িয়ে। আরোরার বিস্ময়ে অধজোড়া ফাঁক হয়ে গেলো। ইয়ামিন উঠতে নিতেই ফায়ান এলোপাথাড়ি মার দিয়ে আরোরার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। সবকিছু এতোই দ্রুত হলো যে ইয়ামিন খেয়াল করতে পারেনি, কে তাকে এরকম ধোলাই দিয়েছে। আরোরা রোবটের মতো ফায়ানের সঙ্গে হাঁটছে৷ হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে সে। ফায়ানের মুখশ্রীর লাল আভা তাকে ভয়ংকর রাগের জানান দিচ্ছে। ফায়ান মিনমিন করে বললো,

-‘তোকে আমি ছাড়বো না, ইয়ামিন! ইউ উইল বি ফিনিশড!’

——————————-
আরোরা ডিনারে আনমনে খাবারে হাত নাড়ছে আর আপনমনে ভেবে চলেছে। আইমান খেতে খেতে বোনের এরূপ আচরণ ভালোই লক্ষ্য করলো কিন্তু বাবা-মায়ের সামনে কিছু বললো না। পা দিয়ে আরোরাকে খোঁচা দিলে আরোরার ধ্যান ভাঙ্গে এবং সে অপ্রস্তুত নয়নে আইমানের দিকে তাকালো! আইমান ইশারায় আরোরাকে খেতে বললো। আরোরা ইশারা বুঝতে পেরে খেতে শুরু করলো। রাতে আইমান তার পিছু ছাড়লো না। আরোরা নিরাশ হয়ে চুপ করেই বসে রইলো। আইমান আরোরার পাশে নিশব্দে বসলো।

-‘আরোরা!’

-‘________’

-‘কি হয়েছে তোর? এমন আনমনে কেন? কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস?’

আরোরা একপলক আইমানের দিকে তাকালো। আইমানের চোখে-মুখে ভর করেছে রাজ্যের দুশ্চিন্তা!আইমান আরোরার মাথায় বিলি কেটে দিয়ে বললো,

-‘বলবি না আমায়? দেখ, বলতে না চাইলেও তোকে বলতে হবে!’

আরোরা এবার নিরুত্তর হয়ে আইমানের কোলে মাথা মাথা শুয়ে পরলো। আইমানের হাত আরোরা চুলের মধ্যে এনে চোখ বুজে বলে উঠলো,

-‘আমার প্রশান্তি লাগবে ভাইয়া। দুনিয়ার ঝামেলা আমার আর ভালো লাগে না!’

-‘কী হয়েছে?’

আরোরা চোখ মেলে তাকালো। অতঃপর তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-‘ইয়ামিন আমার পিছু ছাড়েনি ভাই। আঠার মতোন লেগে আছে, সেই প্রথমদিন থেকেই। এতদিন আশেপাশে দেখিনি, কিন্তু আজ আবার তার কালো ছায়া আমার জীবনে প্রবেশ করেছে।’

আইমানের চোয়াল নিমিষেই শক্ত হয়ে গেলো। আরোরা ঘাড় ঘুরিয়ে আইমানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-‘আমার খুব ভয় লাগছে ভাইয়া, মুড়িয়ে নিবি তোর এই নিরাপদ চাদরে?’

————————

“ঘুম চলে যায়
তোমার চোখে বেড়াতে,
পারি না তাকে
কোনো ভাবে ফেরাতে।”

মিনমিন করে গাওয়া গানটা দূর অবধি না পৌঁছালেও ফায়ানের পাশের মেয়েটি শুনে ফেললো। মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো,

-‘আমার চোখে ঘুম নেই কিন্তু!’

ফায়ান হাসলো। মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে সে চলে আসলো তার সিক্রেট প্লেসে। সিক্রেট রুমটায় একটা ছেলে বাঁধা অবস্থায় পরে আছে। কিছুটা দূরে অনল আর একটা গার্ড ছুঁরিতে ধার দিচ্ছে। ফায়ান বাঁকা হেসে অনলের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘ধার দেয়া শেষ?’

অনল পরীক্ষা করে দেখালো। ফায়ান এবার হিংস্র হাসি দিয়ে অনলের দিকে তাকালো। বাঁধা অবস্থায় থাকা ছেলেটি এসব দেখে চেঁচিয়ে বললো,

-‘আমি কিছু জানি না! সত্যি, আমি কিছু জানি না! আমায় কিছু করবেন না, দোহাই লাগে।’

ফায়ান অনলের থেকে ছুঁরিটা নিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটি আকুতি মিনুতি করেই চলেছে কিন্তু সেটা ফায়ান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে বাঁকা হেসে ছুঁরি হাতে নিয়েই এক পা, এক পা করে ছেলেটির দিকে এগোতে লাগলো। ফায়ানের হিংস্র মুখশ্রী দেখে ছেলেটির জান যায় যায় অবস্থা। ফায়ান যখন তার কাছাকাছি চলে আসে ঠিক তখনই কেঁদে উঠে এবং বলে,

-‘আমি বলছি, সব বলবো। ইয়ামিনের দু’নম্বরী সব বিজনেসের লিস্ট করে দিবো, আমায় মারবেন না!’

ফায়ান শুধু হাসলো৷ হাসিতে যেন রহস্যের ভান্ডার! সে নিজেও জানে না সে ছেলেটির কী হাল করতে চলেছে।
সব জানার পরপরই ছেলেটিকে ছেড়ে দেয়া হয়। ছেলেটি যখন দৌড়ে ইয়ামিনের দিকেই যাচ্ছিলো তখনই এক বিরাট ট্রাক তাকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। যার ফলে ছেলেটি গুরুত্বর আহত হয়ে সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। ফায়ান বেসিনের কলের সামনে মাথাটা দিয়ে মাথায় পানি দিচ্ছিলো, তখনই তার কল আসলো। ফায়ান হ্যাঙ্গার থেকে তোয়ালটা নিয়ে সেটা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। সেন্টার টেবিলের থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে তাকালো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ফোন পেয়ে ফায়ান এক গাল হেসে রিসিভ করলো।

-‘স্যার, কাজ হয়ে গেছে!’

ব্যাস! আর কিছু শুনলো না ফায়ান। খট করে কলটা কেটে দিয়ে বিছানায় রাখলো। অতঃপর বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পিরে মিনমিন করে বলে ওঠলো,

-‘তোদের থেকেও আমি আরও ছয় ধাপ এগিয়ে। কী ভেবেছিস এতো সহজে ছেড়ে দিবো? ফায়ানের কবলে যেই পরবে সেই ফিনিশড! শুধু একজন বাদে। আমার হিংস্রতায় হোক, কোমল মেঘের মাঝে হোক। আমার প্রণয়ের সঙ্গে তাকে নিয়ে দীর্ঘ সময় উড়ে বেড়াবো। এ যে আমার এক অবাস্তব ইচ্ছা। বাট, আই উইল ফুলফিল মাই এনি উইশ, উইথ ইউ! বিকজ, এক প্রণয়ী পায়রাতেই ফায়ান বাঁচে এবং বারংবার মৃত্যুবরণ করে। আই কান্ট লিভ উইদাউট ইউ মাই পিজ্যান!’

—————————-

সায়াহ্নের শেষ প্রহর। আরোরা এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তীব্রভাবে হাঁপাচ্ছে সে। সিলিং ফ্যানের নিচে অবস্থান করলেও ভয়ে আরোরা ঘেমে একাকার। আরোরা অদ্ভুত নয়নে চারপাশে ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো। দৃষ্টিতে তার ভীতি ছাপ স্পষ্ট। আরোরা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এবনহ ওয়াশরুমে চলে গেলো। মাথা তীব্র ভাবে ভনভন করছে। কিয়ৎক্ষণ নিজের ইচ্ছে মতো মাথায় পানি দিয়ে বেরিয়ে আসলো। এখন কিছুটা ভাল্লাগছে তার। কিন্তু মনের অস্থিরতা কিছুতেই যাচ্ছে না। এক পা, এক পা করে আরোরা বিছানার দিকে গেলো এবং আপনমনেই বসে পরলো। ফায়ানকে বড্ড মনে পরছে। ফায়ানকে নিয়েই মূলত দুস্বপ্নটি দেখেছে। ফায়ান এবং সে পাশাপাশি হাঁটছে। হঠাৎ ইয়ামিন এক ছায়ামানবের মতো তাদের সামনে এসে ফায়ানকে তারই সামনে… নাহ আর ভাবতে পারছে না সে। আরোরা দুহাতে নিজের চুল মুঠোবদ্ধ করে ফেললো। ফুঁসফুঁস শব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। কিছুক্ষণ ওভাবেই কেটে যায়। কী মনে করে আরোরা ফোন খুঁজতে শুরু করলো। বালিশ সব এদিক সেদিক ছুঁড়ে মেরে ফোনটা হাতে নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল লিস্টে ঢুকলো সে। যেই ‘ইংরেজ’ এ টাচ করবে এক আকাশ সমান জড়তা তাকে ঘিরে ধরলো। অদ্ভুতভাবে তার আঙুলটি কাঁপতে লাগলো। জড়তা, অস্বস্তি সব সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। এখন তার মনের প্রশান্তি আসাটা বেশি জরুরি। ফায়ানের কন্ঠস্বর শুনলেই সে নিজেকে সামলাতে পারবে। এর আগে নয়। কিয়ৎক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে আরোরা ফায়ানকে কল করেই ফেললো। দু-তিনবার রিং হতেই….

~চলবে।