প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১১

0
681

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১১ |

[কপি নিষেধ]

-‘হ্যালো?’

ওপাশ থেকে ঘুমঘুম কন্ঠে বলে ওঠে ফায়ান। ফায়ানের ঘুমে কাতর থাকা কন্ঠস্বর শুনে মুহূর্তে নিভৃতে শিহরণ খেলে গেলো। এক অজানা শীতল শিহরণে আরোরার সর্বাঙ্গ বরফের ন্যায় জমে যায়। অধর জোড়া কিঞ্চিৎ কম্পিত। ফায়ান অপরপাশ থেকে আবারও হ্যালো বললো কিন্তু আরোরা নিরুত্তর। একসময় খট করে কল কেটে দেয় সে। মুঠোফোনটি হাতে নিয়ে পদতলের নিকট দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে।

——————————-

-‘এই তুমি গতকাল রাতে আমায় ফোন দিয়েছিলে কেন?’

আরোরার গাল ভারি হয়ে গেলো। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। পুরোটা সময় ফায়ানের থেকে দূরে দূরে থেকেছিলো, সবশেষে ফায়ানের কাছে সেই ধরাই পরে গেলো? আরোরা শুকনো ঢোক গিললো। ঢোক গিলার সময় অনুভূত হলো, তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আরোরা যেই ফায়ানের পাশ কেটে যাবে তৎক্ষণাৎ ফায়ানের বলিষ্ঠ হাত তার ডান হাতটি চেপে ধরলো। আরোরা পুণরায় কেঁপে উঠলো। ফায়ান কাঠ কাঠ গলায় বলে,

-‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি। কেন ফোন দিয়েছিলে? আমি কতোটা টেনশনে পরে গেছিলাম, হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া?’

আরোরা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ফায়ানের দিকে তাকালো। ফায়ান তার অগ্নিময় দৃষ্টি আরোরার দিকেই নিক্ষেপ করে আছে। আরোরা চোখ নামিয়ে নরম স্বরে বলে উঠলো,

-‘মিস্টেক করে আপনায় কল দিয়েছিলাম! আমি তো আমার ভাইকে কল দিতে গেছিলাম কিন্তু আপনাকে…’

বানোয়াট কাহীনির শেষে এসেই আরোরা চুপ মেরে গেলো। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। কোনো ভাবে কী ফায়ান বুঝে নিবে? আরোরা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। মুক্ত হাত দিয়ে ফায়ানের ধরে রাখা হাত ছাড়িয়ে দৌড় লাগালো। ফায়ান ভ্রু যুগল কুচকে আরোরার যাওয়া দেখলো। অতঃপর কী মনে করে নিশব্দে হাসলো।

আরিশা এবং রুহানের সামনে বসে অনবরত হাঁপাচ্ছে আরোরা। আরোরার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে আরিশা এবং রুহান। তাদের দৃষ্টিতে চিন্তার ভাব স্পষ্ট। আরিশা ভ্রু যুগল কুচকে সরু কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘কোথায় গিয়েছিলি?’

আরোরা নিনির্মিশেষ দৃষ্টিতে আরিশার দিকে তাকালো কিন্তু কোনোরূপ উত্তর দিলো না। ইয়ামিনদের কথা আরোরা এখনো ওদের বলেনি। রুহান কী মনে করে বললো,

-‘ও ভালো কথা, কথায় কথায় খেয়াল ছিলো না। এই ওইদিনের ছেলেটা কে রে? দেখে মনে হচ্ছিলো তোকে উত্ত্যক্ত করছে?’

রুহানের কথা শুনে আরিশা যেন আরও পেয়ে বসলো। আরোরা বুঝলো এবার ওদের সাথে পারবে না তাই এক তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে সব একে একে বলতে লাগলো। এও জানালো এই দু’দিনের ঘটনায় আরোরা বেশ চিন্তিত এবং উগ্র! কথার ছলে ভুলবশত সে ফায়ান নামটাও উঠিয়ে ফেললো। এতে যেন ওদের সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। আরিশা ভ্রু কুচকে বললো,

-‘ওই উটকো ঝামেলার মধ্যে স্যার আসলো কই থেকে? দেখ আরু, কিছু লুকাবি না বলে দিলাম। সব সত্যি বল!’

আরোরা এক ঢোক গিলে বলে, ‘একচুয়ালি, সেদিন ওই ইয়ামিনের সাথে স্যার ঝামেলা করেছিলেন। আমি স্যারকে নিয়ে ভয়ে আছি আরিশা! ইয়ামিন ভালো না, যদি কোনোভাবে স্যারের ক্ষতি করে?’

শেষোক্ত বাক্যটি ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে আরোরা। আরিশা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

-‘কিচ্ছু হবে না, স্যার কার ভাতিজা দেখিস না? ইয়ামিন তার টিকিটাও নাড়াতে পারবে না, কুল!’

আরিশার কথার মাঝে ফোড়ন কেটে রুহান বলে উঠলো, ‘হঠাৎ স্যারের জন্যে তোর দরদ আসছে কেন বলতো? ইদানীং দেখছি তুই আর স্যার বেশ কাছাকাছি-ই থাকিস। প্রেম-ট্রেম চলছে নাকি? কিছু লুকাচ্ছিস না তো?’

আরোরা হাতের ব্যাগ রুহানের দিকে সজোরে ছুঁড়ে মেরে কাঠ কাঠ গলায় বললো,

-‘তোর এসব বি নেগেটিভ মার্কা কথাবার্তা তোর পকেটেই রাখ! এসব ভিত্তিহীন কথাবার্তা আরেকবার উচ্চারণ করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে রুহান!’

-‘ও তো ঠিকই বলেছে। তোকে সিমপ্যাথি দেখাতে গিয়ে তো এই বিষয় মাথা থেকেই উড়ে গেছিলো!’

-‘সিমপ্যাথি?’ বলেই এক ঘা লাগালো আরিশার পিঠে। অতঃপর আরেক ঘা বসিয়ে বলে,

-‘সিমপ্যাথি তাই না? তোরা বন্ধু নামে কলঙ্ক! তোদের চেয়ে মির জাফরকেও আমার আপন লাগছে! ময়দা ভূতনী আর কৈ মাছের ডিম!’

——————————

ক্লাসের বাইরে একমনে পড়ে যাচ্ছে আরোরা। আজ তাদের ভাইবা ইক্সাম আছে। ফায়ান কিছুক্ষণ আগেই তাকে ডেকে নিয়ে বলেছে আজ ফায়ানের এক্সট্রা ক্লাস নেই। ফায়ান নাকি কী কাজে বাহিরে বের হবে। আরোরা একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পরমুহূর্তে মন খারাপ করলো কারণ, ফায়ানের সাথে তার সময়টা আর কাটবে না। মন খারাপ টারাপ সাইডে রেখে আরোরা বইয়ে ডুব দেয়। কিয়ৎক্ষণ পরেই আরিশা এবং রুহানের ডাক পরলো। দুজন আলাদা আলাদা সময়ে নিজেদের ভাইবা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এবার আরোরার পালা। আরোরা বই এবং ব্যাগটি আরিশাকে দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ক্লাসে প্রবেশ করলো।

বেশ ভালোভাবেই আরোরা তার ভাইবা কমপ্লিট করলো। তার মনটাও বেশ ফুরফুরে মেজাযে আছে। আরোরা সিদ্ধান্ত নিলো সেদিনের অপূর্ণ ইচ্ছেটা সে আজ পূরণ করবে। অপূর্ণ ইচ্ছেটা হচ্ছে ফুচকা খাওয়া। ইয়ামিনও নেই। শুনেছে ফায়ানের ধোলাইতে সে হাসপাতালে ভর্তি। আরোরা আনন্দ মেজাজ নিয়ে ফোঁস করে বলে উঠলো,

-‘আরিশা, রুহান! চল, ফুচকা খাওয়ার অপূর্ণ ইচ্ছেটা পূরণ করি।’

আরোরার প্রস্তাবে রুহান দ্বিমত জানালো।
-‘নাহ, তোদের মতো রাক্ষসের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব না। তোরা যে পরিমাণে ঝাল খাস, ভাবতেই আমার ভেতরটা গুলিয়ে আসে!’

আরোরা তার নেত্রপল্লব ছোট ছোট করে বললো,
-‘সেদিন তো খুব যেতে চাইছিলি, আজ গিরগিটির ন্যায় রূপ বদলালি যে?’

-‘রাখ তো এই চিংড়ির কথা! এর যাওয়া না যাওয়ায় আমার কোনো ক্যারা নেই। এ তো জাত চিংড়ি, কোনোদিক না দিকে শুধু লাফাতেই জানে!’

রুহান কিড়মিড় চোখে আরিশার দিকে তাকালো। আরোরা যখন বুঝলো অবস্থা বেগতিকে যাবে তখনই ওদের মাঝে ফোড়ন কেটে বললো,

-‘হয়েছে থাম তো! রুহান, তুই খাস বা না খাস, তোকে যেতে হবেই। বেশি কথা না বাড়িয়ে চল! দেরী হলে সমস্যা!’

রুহান আর তার মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না। সে চোয়াল শক্ত করে ওদের ফেলেই সামনের দিকে যেতে অগ্রসর হয়! আরিশা কোণা চোখে রুহানের যাওয়া দেখলো। আরোরা মুচকি হেসে বললো,

-‘ওভাবে তাকাস কেন?’

-‘ইয়ার! আমি একজনকে পছন্দ করলে ওর সমস্যা কী? কাউকে পছন্দ করলেই বলে তোর মতো মেকাপ সুন্দরীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না! ভাল্লাগে এসব? মেকাপ জিনিসটা আমার রক্তে মিশে গেছে। দেখিস ভাই, রুহান যদি কাউকে পছন্দ করে না, আমিও ওরে খুব চেতাবো!’

-‘আহা! এতো লাগিস কেন? কুল! রুহান শুধু মজা নেয়, তুইও নিচ্ছিস সিম্পল! সিম্পল ব্যাপারটাকে নিয়ে বেশি হৈ-হুল্লোড় করে কাজ নেই!’

আরিশা উত্তরে কিছু বললো না। অতঃপর আরোরা এবং আরিশা উভয়ই বেরিয়ে যায় ভার্সিটি থেকে। ফুচকার দোকানের সামনে আসতেই দেখলো রুহান আগেই ফুচকার অর্ডার করে ফেলেছে। আরোরা কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

-‘যাক, তোর এতদিনে বুদ্ধি হয়েছে!’

-‘এতোটাও বোকা ভাবিস না। আমি নিজের জন্যে ঝাল ছাড়া এক প্লেট আর তোদের জন্য দ্বিগুণ ঝালের অর্ডার দিয়েছি! আমায় মিনিটে মিনিটে পচাবা আর আমি ছেড়ে দিবো ভাবসো! এখন এগুলা খাও আর ওয়াশরুম দৌড়াও! আমার আবার ঘুম পাচ্ছে!’

——————————

আরোরা গোল গোল দৃষ্টিতে রাস্তার অপর পাশের একটা মেয়ের সাথে ফায়ানকে দেখছে। দুজনের চলাফেরা খুব ক্লোজ এবং কাঁধেও হাত দেয়া। এসব দেখে আরোরা নিভৃতে চিনচিন করে উঠলো। একদম অদ্ভুত ব্যথা অনুভূত হচ্ছে তার হৃদয়ে। একরাশ খারাপ লাগা তার মনকুঠুরিতে কালো মেঘের ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরোরার হাত ধরে যে রুহান রাস্তা পার করাচ্ছে, সেদিকে আরোরার খেয়াল নেই। বড্ড ভবঘুরে এবং মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে গেছে সে। তাদের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই আরোরা রাস্তা পার হয়। রুহান তাকে এক ঝাকুনি দিতেই আরোরা গোল গোল চোখে রুহানের দিকে তাকালো। অতঃপর বিনা-বাক্যে ফায়ানের দিকে যেতে অগ্রসর হলো। আরিশা এবং রুহান সেখানেই বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

ফায়ান এবং মেয়েটি যখন হেসে হেসে শপিংমলে ঢুকবে ঠিক তখনই ওদের পথ আটকে দাঁড়ায় আরোরা। এতে ফায়ান এবং মেয়েটি উভয়ই চমকে যায়। আরোরা মেয়েটিকে আপাদমস্তক দেখে নেয়। বেশ সুন্দরী মেয়েটি। আরোরার কী হলো সে জানে না, ভেতর থেকে সে অদ্ভুতভাবে ভাঙ্গতে শুরু করলো৷ প্রখরভাবে! মেয়েটি আরোরার দিকে তাকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘এক্সকিউজ মি? পথ আটকে দাঁড়ানোর মানে কী? হু আর ইউ?’

ফায়ান মেয়েটির হাত ধরে থামিয়ে দেয়। মেয়েটি থামলে ফায়ান গলায় গাম্ভীর্য এনে বললো,

-‘তুমি এখানে কী করছো?’

আরোরা একপলক ফায়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর মেয়েটিকে দেখিয়ে আটকে আটকে বলে,

-‘উ…নি কে?’

ফায়ান কিছুক্ষণ নির্বিকার হয়ে আরোরার নেত্রপল্লবে তাকিয়ে রয়। অতঃপর মেয়েটির কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

-‘তোমায় বলতে বাধ্য নই, সরে দাঁড়াও!’

আরোরা নির্বিকার হয়ে সরে দাঁড়ায়। অতঃপর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সে প্রস্থান করলো। দিয়া ফায়ানের বুকে এক চড় মেরে দূরে সরে দাঁড়ায় এবং বলে,

-‘ঢং করতে এসেছো ভাইয়া? মেয়েটা কে ছিলো? তুমি ওকে আমার পরিচয় দিলে না কেন?’

ফায়ান বাঁকা হাসলো। অতঃপর দিয়ার গাল টেনে বলে,

-‘তুই বুঝবি না! কিছু সময় কিছু সত্যের সন্ধান করতে হলে অনেক কিছু করতে হয়!’।

~চলবে।