প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১২

0
648

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১২ |

উত্তাপময় গোধূলিবেলা। গরমের তীব্র তাপে পথঘাটের ব্যস্ততায় আবৃত মানুষদের জুবুথুবু অবস্থা। গরমে যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। জনবহুলে যাওয়ার মতো ইচ্ছে কারো না থাকলেও নিজ নিজ প্রয়োজনে সকলে এই ভীড় ঠেলে নিজেদের গন্তব্যে ছুটছে। আরোরা বিষম খেয়ে তার ভাইয়ের পাশের মেয়েটি অর্থাৎ তার হবু ভাবীর নিকট তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে তার দৃঢ় স্তব্ধতা! কারণ, মেয়েটি ফায়ানের সাথের সেই মেয়েটি। আজ আইমানের এঙ্গেজমেন্ট পার্টি। আরোরার এই ঠায় দাঁড়ানোর মাঝে সে তার ঘাড়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব করলো। আরোরার সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে এলো। সে আতঙ্কিত হয়ে পিছে ফিরে তাকালো! ফায়ানকে পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দেখে আরোরার গলা শুকিয়ে গেলো৷ কী সুদর্শন লাগছে ফায়ানকে। ফায়ান নীল পাঞ্জাবি পরেছে, কলারে পাথরের ডিজাইন। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা, সাথে চিরচেনা সেই মাতাল করা পারফিউমের ঘ্রাণ! সুঘ্রাণের আবেশে আরোরার চোখ বুজে এলো। পরমুহূর্তে তুড়ির শব্দে আরোরা চোখ মেলে তাকালো। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট। বিস্মিত নেত্রপল্লবের দিকে ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফায়ান থমথমে গলায় বলে উঠলো,

-‘কী দেখছো?’

আরোরা কিছু বলতে নিবে তৎক্ষণাৎ তার মস্তিষ্কে হানা দিলো দু’দিন পূর্বের ঘটনা। হানা দিলো দিয়াকে নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন। আরোরা দিয়ার দিকে ইশারা করে বলে,

-‘উনি আপনার কী হয়? আ..র উনি কী আপনার গা..’

-‘শাট আপ! শি ইজ মাই কাজিন, দিয়া! গার্লফ্রেন্ড কেন হবে? এতো ডার্টি মাইন্ড কেন তোমার? কোনো মেয়েকে পাশে দেখলেই তাকে গার্লফ্রেন্ড বানাতে ছাড়ো না। লিভ ইট, আর ইউ জেলাস?’ প্রথমদিকে ফায়ান ধমকালেও শেষোক্ত বাক্যটি সে আরোরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো।
আরোরা একটা শুকনো ঢোক গিলে দু’হাত দিয়ে ফায়ানকে সরিয়ে দিলো। অতঃপর ভারি নিঃশ্বাস ফেলে থমথমে গলায় বলে উঠলো,

-‘আমি জেলাস নই!’

-‘এজন্যই তো দু’দিন ভার্সিটি গ্যাপ দিয়েছো! এতো থ্রেট দিলাম তাও আসলে না। বেশ সাহস বেড়েছে তাই না?’

আরোরা কোণা চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর থমথমে গলায় বলে,

-‘আমি কেন জেলাস হবো তার জবাব দিন!’

ফায়ান বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে আরোরার কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

-‘আমায় ভালোবাসো, তাই। আমি যে তোমার অভ্যন্তরে বসবাস করছি। এটুকু-ই কী এনাফ না জেলাস হওয়ার জন্যে?’

ফায়ানের এমন মাদক মেশানো কন্ঠস্বর শুনে আরোরার ভেতরটা ধক করে উঠলো। অনুভব করলো হৃদপিণ্ডের ঢিপঢিপ বাড়ছে। আরোরা গোল গোল চোখে ফায়ানের দিকে তাকালো। ফায়ান নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করে আছে আরোরার মুখশ্রীতে। হয়তো উত্তরের আশায়। আরোরা ফায়ানের মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,

-‘আপনি ভুল ভাবছেন। আপনি আমার স্যার!’

-‘আমি তোমার জন্যেই স্যার হয়েছি, হাসবেন্ড হতে কিন্তু আপত্তি নেই!’

ফায়ানের এরূপ কথায় আরোরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। ফায়ানের থেকে এরূপ উত্তর সে স্বপ্নেও আশা করেনি। এমন শান্ত-চিন্তাশীল স্বভাবের মানুষ যে এমন ঠোঁটকাটা হবে জানলে সে আরও দূরে দূরে থাকতো। আরোরা দৃষ্টি নত করলো এবং হনহন করে অন্যদিকে চলে গেলো! ফায়ান সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। পরবর্তীতে কী মনে হতেই সে আরোরার পিছে হাঁটা দিলো।
আরোরা একমনে ফায়ানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিলো তখনই তার হাতে হেচকা টান অনুভব করলো। আরোরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই জনমানবহীন স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর তার কর্ণধারে ফিসফিসানির শব্দ উপলব্ধি করলো।

-‘তোমায় এই শাড়িতে মারাত্মক লাগছে পিজ্যান! তোমার রূপের ঝলকানিতে আমি পুরোদমে ঝলসে যাচ্ছি। ইচ্ছে তো করছে তোমায় পুরো দুনিয়ার থেকে নিজের মনকুঠুরিতে বন্দি করে রাখি। আল্লাহ’র এই অমায়িক, অপরূপ সুন্দর সৃষ্টিতে নিয়ে বড্ড ভয় হয় জানো। যদি কেউ তোমায় নিয়ে যায়?’

বলেই ফায়ান এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলো।

——————————————————-

উৎসবমুখর পরিবেশ। আত্নীয়-স্বজন খুব বেশি না থাকলেও মোটামুটি আছে। ইকবাল সাহেব তার গার্ডদের নানান আদেশ দিচ্ছেন এবং গেস্টদের সাথে কুশল বিনিময় করছেন। মুনীবের এখনো বিশ্বাস করতে পারে না তাদের মতো সহজ-সুলভ পরিবারে এতো বড় পলিটিক্সের মেয়ে দিচ্ছেন। এ যেন অনেক বড় ভাগ্যের ব্যাপার। মুনীব তার বেয়াই সাহেবের সাথেই দাঁড়িয়ে। অনন্যা এবং ছোট মায়ের মাঝেও বেশ ভাব জমেছে। আইমানকে আড়চোখে দিয়া এবং দিয়াকে আড়চোখে আইমান দেখছে। দুজনেরই এরেঞ্জ ম্যারিজ তাই দুজন দুজনের সম্পর্কে ধারণা খুবই স্বল্প। আইমান মিনমিন করে দিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

-‘আপনায় এই গাউনে ভীষণ সুন্দর লাগছে!’

আইমানের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে দিয়া মুগ্ধ হয়। দিয়া লাজুক হেসে পদতলের নিকট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-‘ধন্যবাদ!’

-‘আমরা কিন্তু প্রভাবশালী নই। আমি আপনাকে সৌখিনতাও দিতে পারবো না মিস। আমার নিকট আপনি শুধু সম্মান এবং ভালোবাসা-ই পাবেন।’

দিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। এই হাসির কোনো শব্দ নেই। দিয়া পুণরায় লাজুক স্বরেই বলে উঠলো,

-‘একজন নারীর জন্য এইটুকুই যথেষ্ট সাহেব। হই আমি নামকরা কারো মেয়ে, আমার বাসস্থান হোক ভিন্ন দেশ। আমার মন কিন্তু লালসায় ভর্তি নেই। আপনার দেয়া এই দুটো উপহারই আমার এই জীবনে অমূল্য সম্পদ।’

আইমান মুগ্ধ নয়নে দিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে যা ভেবেছিলো তার উল্টো চরিত্র এই দিয়া। এতো নম্র-ভদ্র, কেন যেন সব স্বপ্ন লাগছে তার। আরোরা এতক্ষণ ফায়ানকে নিয়ে আনমনে থাকলেও আইমানদের ফিসফিস করতে দেখে আইমানের পাশে গিয়ে বিনয়ী হাসি দিয়ে বললো,

-‘বাহ! গো এহেড ভাইয়া। তবে ভাবী, আমি কিন্তু আপনার একমাত্র ননদী।’

আরোরার কথার মাঝে আরিশা এসে ফোড়ন কেটে বললো,

-‘না, আমিও আছি। এই আইমান ভাইয়া! আমি কই গেলাম তাহলে?’

দুজনের ঝগড়ায় দিয়া হাসলো। কিন্তু আরোরাকে তার বড্ড চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। দিয়া প্রশ্নও করলো না, তার কেমন লজ্জা লাগছে।
অবশেষে বেশ সুন্দরভাবেই ওদের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো। বিয়ের ডেটও ফিক্সড হয় তাও আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই। ইকবাল তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বেশ ধুমধাম করেই দিবেন, কোনো কমতি রাখবেন না।

———————————————————

আরোরা অনেকবার আইমানকে বলতে চেয়েছিলো দিয়ার কাজিন ফায়ানই তার ভার্সিটির লেকচারার। কিন্তু কী ভেবে বারবার এই প্রসঙ্গ তার মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আইমান যেন আকাশে ভাসছে। দিয়াকে নিয়ে সে বেশ প্রজেসিভ হয়ে গেছে। অনন্যাও বেশ গুণগান গায় দিয়ার৷ পরিবারের এই সুখকর সময়ে সে চাইলেও এই প্রসঙ্গ ওঠাতে পারে না। এদিকে ফায়ানের বলা কথাগুলো তাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়ে চলেছে। সে না পারছে ফায়ানকে কিছু বলতে আর না পারছে কিছু হজম করতে। ফায়ানকে তার গলার আটকে থাকা কাঁটার মতো লাগছে। অস্থিরতা, নিজের মস্তিষ্কের এত প্রশ্ন নিয়ে তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ফায়ান তাকে কী বলেছিলো, পিজ্যান? পিজ্যান মানে তো পায়রা। ফায়ান তাকে নিকনেম দিয়েছে সাথে সেসব কথাবার্তা। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার ভাবতে ভাবতে। ইচ্ছে তো করছে ফায়ানের গলা টিপে দিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে। ভার্সিটি এমন ভাব করে যেন সে কিছুই জানে না। আকস্মিক ভাবে সে পুরোপুরি ভিলেনরূপি লেকচারারে পরিণত হয় আর প্রতিনিয়ত তার লেকচার শুনাতে থাকে৷ কে বলবে ফায়ানদের সাথে আরোরাদের আত্নীয়তা হয়েছে?

-‘স্যার! ইয়ামিন আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছে!’

ফায়ান হাসলো। অতঃপর বললো,

-‘খুঁজুক! পুরো বিডি, ফরেইন খুঁজুক হু কেয়ার’স?’

অনল আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ থেমে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-‘স্যার আপনার পরিকল্পনা কতদূর?’

-‘ওটা আমার প্ল্যানিং অনুযায়ী এগোচ্ছে, অনল। জাস্ট জেনে রাখো, ফায়ান ইজ কিং অফ মাফিয়া ওয়াল্ড! সে যাকে প্রাণপনে চায় তাকে পাবে না? হাউ ফানি, ম্যান! ইট’স ট্রু, তার চোখে আমি নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখেছি। রিলেক্স, সব হবে ধীরে ধীরে।’

আজ আইমান এবং আরোরা বেরিয়েছে শপিং এর জন্য। শপিংমলে গিয়ে ফায়ান এবং দিয়াকে দেখে আরেক দফা বিষম খেলো। আরোরা এই বিস্ময় বহিঃপ্রকাশ না করে দিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলো। অতঃপর ওরা যখন একসাথে শপিং এ যাবে পেছন থেকে ফায়ান আরোরাকে হেচকা টান দিলো। আরোরা ফায়ানের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। ফায়ান ফিসফিস করে বললো,

-‘কেমন মেয়ে তুমি? ওরা নিউ কাপল হতে চলেছে, একটু তো প্রাইভেসি দেও। তা না করে কাবাবের হাড্ডি হচ্ছো! এই আনরোমান্টিক কেন তুমি?’

~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।