প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৩

0
630

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৩ |

[কপি নিষেধ]

শীতলময় পরিবেশ। কিঞ্চিৎ স্লো মিউজিক ব্যতীত খুব একটা শব্দ কর্ণধারে প্রবেশ করলো না। আবছা নীল আলোয় আলোকিত ক্যাফেটেরিয়া। বেশিরভাগ কাপলই এই পুরো ক্যাফেটেরিয়ায় উপস্থিত। এয়ারকুলারের কারণে গরমের ভাবটা অনুভূত হচ্ছে না। পুরো ক্যাফেটেরিয়ায় দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় আরোরা। দৃষ্টি বুলানো শেষে তার সামনের মানুষটির দিকে তাকালো। ফায়ান পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। গালে হাত গুঁজে বেশ স্টাইল করেই সাহেব খাবারের মেন্যু লিস্ট দেখছে৷ নেত্রে তার সেই গোল চিকন ফ্রেমের চশমা। চুল কয়েক গাছা কপালে এসে লেপ্টেছে। আরোরা মুগ্ধ নয়নে কিয়ৎক্ষণ তার নিকটই তাকিয়ে রইলো। ফায়ান চশমা ভেদ করে তার সরু দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো আরোরার পানে। আরোরার মুগ্ধ দৃষ্টিপাত ফায়ানের দৃষ্টি এড়ায় না। ফায়ান ঠোঁট বাঁকালো এবং মাথা তুলে আরোরার দিকে তাকালো। আরোরা সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করলো। ফায়ান প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো,

-‘কী খাবে?’

-‘এখন তো সন্ধ্যা.. খিদে নেই আমার!’

-‘তাহলে কষ্ট করে এখানে আনলাম কেন? কিছু তো বলো স্ন্যাকস, ড্রিংকস.. এনিথিং?’

আরোরা ঠোঁট কামড়ে তার সামনে থাকা মেন্যুলিস্টের দিকে তাকালো। অতঃপর বললো,

-‘লাচ্ছি?’

ফায়ানকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালো। ফায়ান নিরুত্তর দেখে আরোরা ফায়ানের দিকে মাথা তুলে তাকালো। ফায়ানের অপ্রস্তুত ভঙ্গি দেখে আরোরা প্রশ্ন করলো,

-‘কী হলো?’

-‘আম.. লাচ্ছি কী?’

আরোরা থতমত খেয়ে ফায়ানের দিকে তাকালো। ফায়ান ততক্ষণে মেন্যুলিস্ট ঘাটতে ব্যস্ত। হয়তো লাচ্ছি সম্পর্কে সামান্য ধারণা নেয়ার প্রচেষ্টা। আরোরা কিছুক্ষণ ফায়ানের দিকে হতভম্ভের মতো তাকিয়ে বললো,

-‘লাচ্ছি কী আপনি সত্যি জানেন না?’

-‘নো! আই হ্যাভ নো আইডিয়া!’

আরোরা বিস্মিত হলো৷ পরমুহূর্তে মনে পরলো ফায়ান তো আমেরিকায় জম্ম থেকে এই অবধি বড় হয়েছে। তার দই এবং বরফে মিশ্রিত এই মারাত্মক স্বাধের ড্রিংকের কী বুঝবে? আরোরার অধর-জোড়া প্রসারিত হলো। যাক, লেকচারারকে সে আজ নিজেও লেকচার দিতে পারবে! সাথে ফায়ানকে শিক্ষা দেয়ারও বুদ্ধি মস্তিষ্কে নাড়া দিয়েছে। আরোরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

-‘সারাজীবন তো ওই বিদেশের মাটিতেই পরেছিলেন! আমাদের দেশের খুঁটিনাটি সম্পর্কে কী জানবেন?’

-‘এক্সকিউজ মি! আমার বিডি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে। বাট এই বাঙালি ফুড নিয়ে ধারণা খুবই কম। আর এই নাম তো আমি ফাস্ট টাইম শুনলাম!’

আরোরা সশব্দে হেসে দেয়। অতঃপর হাসির শব্দ কমিয়ে বলে,

-‘বাঙালি খাবার সম্পর্কে জানেন না, ওপস! বিগ পয়েন্ট মিস করে ফেললেন!’

ফায়ান কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আরোরা গলা পরিষ্কার করে অন্যদিকে দৃষ্টি দিলো। প্রসঙ্গে এড়াতে ওয়েটারকে ডাকলো সে। ওয়েটারকে দুটি স্পেশাল লাচ্ছির অর্ডার দিতেই ওয়েটার সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। এই ধরণের ক্যাফেটেরিয়ায় লাচ্ছি পাবে সেটা আরোরা ভাবতেই পারেনি। ফায়ান ওয়েটারের দিকে দৃষ্টি দিয়ে হেলান দিয়ে বসলো এবং ফোনের দিকে মনোযোগী হয়। ফোনের মনোযোগ দেয়া দেখে আরোরার নিভৃতে বিরাট রাগের গোলা সৃষ্টি হয়। কই টুকটাক কথা বলবে তা না, গোমড়ামুখোর মতো ফোন নিয়ে বসেছে। আইমান এবং দিয়া এখন কোথায় আছে কে জানে। ক্যাফেটেরিয়ায় এসে আরোরা কোথায় ভাবলো তার সময়টা ভালো কাটবে, এদিকে ফায়ানকে দেখো। ওই মরাটা নিয়ে বসেছে৷ এই প্রথম মায়ের ডায়লগটা তার মাথায় ঘুরে উঠলো। ঠিক মায়ের মতোই সে ফোনকে ‘মরা’ উপাধি দিলো। প্রথমবারের মতো ফোন নামক অন্ধ ভালোবাসার প্রতি বিরাট রাগ পুষলো।
আরোরার এই কিড়মিড় দৃষ্টি ফায়ান ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে কিন্তু সে অতর্কিত ভাব মুখশ্রীতে এনে ফোনের দিকেই নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করে আছে।

বেশ খানিক সময় বাদে ওয়েটার লাচ্ছি নিয়ে হাজির হয়। ফায়ান ফোন রেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে লাচ্ছি দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার এমন চাহনি দেখে আরোরা অন্তঃপুরে হাসলো। ফায়ান এক গ্লাস আরোরার দিকে এগিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত গ্লাসটিও নিজের দিকে টেনে নিলো। আরোরা লাচ্ছিতে পেঁচানো পাইপটা নাড়তে নাড়তে ফায়ানের কান্ড দেখছে। অধর জোড়ায় তার বিদ্রুপের হাসি! ফায়ান আরোরার নাড়ানো অনুসরণ করে নিজেও নাড়ালো। অতঃপর লাচ্ছিটার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

-‘এটা মিল্ক শেক, রাইট? একে এতো কঠিন করে ‘লা~চ্ছি’ বলার কী আছে?’ ফায়ান কিছুটা টেনে প্রশ্ন করলো।

-‘বাংলা ডিকশনারি পুরোটাই কঠিন। আর এটা মিল্ক শেক আপনায় কে বললো? আগে খেয়ে দেখেন তারপর বুঝবেন!’ ফায়ান প্রতিত্ত্যুর না করে পাইপে অধর ছুঁয়ে খেতে লাগলো। দুই ঢোঁক গিলতেই তার কেমন স্বাদটা পরিচিত মনে হলো। গোল গোল চোখে আরোরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘এটা কী?’

-‘লাচ্ছি! দই, বরফ আরও কিছু উপকরণের সংমিশ্রণে তৈরি এটা।’

-‘ইয়েস, কারেক্ট! চাচ্চু কয়েক’বার এই দই নামের সুইটস খাইয়েছিলো।’

আরোরা হাসলো। ফায়ানকে লেকচার দিতে তার বেশ ভালো লাগছে। ফায়ান পুরোটা শেষ করলো। আরোরা তার লাচ্ছিটা শেষ করে টিস্যু দিয়ে অধর মুছতে মুছতে বলে,

-‘লাচ্ছি আমার ভীষণ প্রিয়! তবে এই নামি-দামী রেস্টুরেন্টের গুলো না। এই বড় রেস্টুরেন্ট গুলোতে লাচ্ছির আসল স্বাদ পাওয়া যায় না।’

বলেই গ্লাসটা হাত দিয়ে সরিয়ে নেয়। ফায়ান বেশ মনোযোগ দিয়ে আরোরার কথাগুলো শুনেছে। থুতনিতে হাত গুঁজে আনমনে ভাবলো,

-‘তোমার থেকে এখনো অনেক অজানা জানার বাকি আছে প্রণয়ী! আমার না জানা তোমার নিকট হতেই জানতে চাই, ভীষণভাবে জানতে চাই। ইউ নো হোয়াট, আজ থেকে তোমার এই প্রিয় খাবারটা আমার ফেভারিট লিস্টে চলে এসেছে। আমার তুমি নামক পুরোটাই যে প্রিয়!’

——————————

আইমানের সাথে গেম খেলতে ব্যস্ত আরোরা। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। আরোরা জিতে যেতেই সে খুশির আর্তনাদ করে উঠলো। আইমান বোনের এই হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে খুশি হলেও আরোরাকে বিব্রত করার জন্যে বলে উঠলো,

-‘তুই চিটিং করেছিস!’

-‘মোটেও না! আমি তোমার থেকে চার হাত দূরে আছি। তোমার ফোন তোমার হাতেই!’

-‘আই ডোন্ট বিলিভ দিস!’

আরোরা ফোন রেখে ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে আইমানের উপর ঝাপিয়ে পরলো। দুজন ফাইজলামি করার মাঝেই ফোনের রিংটোন শোনা যায়। আরোরা আইমানের ব্ল্যাঙ্কেটে মোড়ানো পিঠে উল্টো হয়ে শুয়েই তাদের থেকে কিছুটা দূরে থাকা আইমানের ফোনের দিকে খেয়াল করলো। ফোনে ‘দিয়া’-র নাম দেখে আরোরা দূরে সরে উঠে দাঁড়ায়। আইমান ঘর্মাক্ত হয়ে ব্ল্যাঙ্কেট নিজের থেকে উঠিয়ে কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আরোরার দিকে। আরোরা নখ কামড়াতে কামড়াতে মিনমিন স্বরে বললো,

-‘সরি, তুই বা আমি যে বাচ্চা নই ভুলে গেছি। থাক তুই ভাবীর সাথে আমি গেলাম। তবে হ্যাঁ! বিয়ে করতে বহুত দেরী, ততদিনে অবিবাহিত ভাইয়ের সাথে আমি বাচ্চার মতোই বিহেভ করবো। বাই বাই অবিবাহিত ভাইয়া!’

আইমান আরোরাকে ধোলাই দিবে তার পূর্বেই আরোরা ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে অবশ্য বাইরে থেকে লক করে দিয়ে গেছে। আরোরা প্রায়-ই এমন করে। লক লাগিয়ে সে নিজের ঘরে চলে যায়। আইমানের রুম থেকে চেঁচানোর শব্দ কর্ণকাচে প্রবেশ করলেও আরোরা তোয়াক্কা করেনি। রুমে এসে কিছুক্ষণ মনের সুখে হেসে নিলো। কিছুক্ষণ হেসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এভাবে ঘড়ির কাটা বারোটায় এসে ছুঁয়েছে। কিন্তু আরোরার নেত্রে ঘুমের দেখা নেই। আরোরা উঠে বসলো। কী মনে করে বেলকনির দিকে হাঁটা দিলো৷ প্রতিদিনকার মতোই উষ্ণ পরিবেশ বিদ্যমান। আরোরা দখিনা হাওয়ার লোভে বেলকনিতেই ছুটেছে। তৃপ্তি নিয়ে সেই শীতল বাতাস অনুভব করেই সে ঘুমাবে! বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একবার ঘুমন্ত শহরটার দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। অতঃপর দৃষ্টি নত করে রাস্তার দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠলো। এক বড় কালো গাড়ি তাদের এপার্টমেন্টের গেটের সামনে পার্ক করা। আরোরা তীক্ষ্ম নজর বুলাতেই লক্ষ্য করলো গাড়িটির বাম পাশের দরজার সাথে হেলান দিয়ে এক অবয়ব দাঁড়ানো। আরোরা ব্যাপারটাতে মাথা ঘামাতে যাবে এমন সময়ই ফোনের তীব্র রিংটোন তার কর্ণধারে তরঙ্গিত হলো এবং তার ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়। আরোরা বিনা-বাক্যে পুণরায় রুমে এসে টেবিলের থেকে নিজের মুঠোফোনটা হাতে নেয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত নম্বরটি দেখে আরোরা বিস্মিত হয়।
মাঝরাতে ফায়ানের কল? আরোরা কোনো কিছু না ভেবেই দ্রুত কল রিসিভ করলো! আরোরা ‘হ্যালো’ বলতে যাবে তার আগেই ফায়ান একদমে বলতে লাগলো,

-‘নিচে আসবে? আর্জেন্ট, কথা আছে!’

ফায়ানের কন্ঠস্বর বিষন্ন শোনালো। আরোরার পক্ষ হতে কোনো উত্তর না পাওয়ায় ফায়ান আবারও বললো,

-‘দারোয়ান নিয়ে ভেবো না, তার ব্যবস্থা আমি করেছি। তুমি প্লিজ একবারের জন্যে আসো। প্লিজ পিজ্যান, আই নিড ইউ!’

কাতর ভরা কন্ঠস্বর শুনে আরোরার আন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। সর্বাঙ্গে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো তার, সাথে একরাশ চিন্তাও মাথায় ভর করেছে। পারলো না সে ফায়ানের কথায় দ্বিরুক্তি জানাতে। আরোরা হেরে গেলো ফায়ানের আকুতিভরা টলটলে কন্ঠস্বরের নিকট। আরোরা কল কেটে মাথায় ওড়না জড়িয়ে নেয়। অতঃপর চোরের মতো বেরিয়ে গেলো ফায়ানের অনুরোধ রক্ষা করতে। নিচে গিয়ে সে সত্যি-ই দারোয়ান চাচাকে পেলো না। গেট খুলে বাহিরে আসতেই দেখলো ফায়ান তার গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। তাকে খুব এলোমেলো এবং উগ্র দেখাচ্ছে৷ আরোরার ভেতরটা ধক করে উঠলো। কিছু হলো না তো? পরমুহূর্তে ইয়ামিন নামটা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো। কেঁপে উঠলো সে। কিছুটা অস্থির হয়ে সে ফায়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরোরা যেই মুখ খুলবে তখনই ফায়ান অবাস্তব ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো। আরোরাকে শক্ত করে নিজের বাহুডোরে নিয়ে থমথমে গলায় বলে উঠলো,

-‘নড়িও না। ওয়ান উইকের ডিস্টেন্সটা কয়েক মিনিটের জন্য পূরণ করতে দাও! আই নিড দিস। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, কী করে থাকবো এই ওয়ান উইক সেই দূরের দেশে।’

-‘মা.. মানে?’ আটকে আটকে প্রশ্ন করলো আরোরা। আরোরার পুরো সত্ত্বা অদ্ভুত ভাবে কেঁপেই চলেছে। দম বন্ধ অবস্থা লাগছে তার।

-‘ওয়ান উইকের জন্যে আমেরিকা যাচ্ছি। তুমি ব্যতীত আমি অর্ধেক দিনই কাটাতে পারি না সেখানে ওয়ান উইক কীভাবে থাকবো? প্লিজ আমায় তোমার ওই ওড়না দিয়ে আমায় বেঁধে রাখো, আমি দূরে যেতে চাই না!’

~চলবে।

গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।