প্রণয়ী পায়রা পর্ব-১৪

0
657

#প্রণয়ী_পায়রা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |

[কপি নিষেধ]

আমেরিকার ভার্জেনিয়ার এক হাসপাতালে উপস্থিত আছে ফায়ান। ওটির সামনের চেয়ারে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে সে। ফায়ানের পাশেই তার মা সারা খালাজানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেছে। ফায়ানের চোখ-মুখ অসম্ভব রকম লাল। ফায়ান চোয়াল শক্ত করেই মাকে নিজের দিকে টেনে নিলো এবং কাঠ কাঠ গলায় বললো,

-‘স্টপ মা! পাপা ইজ অলরাইট! ওই লুসিয়াস কী, ওর জাতকে আমি ছাড়বো না। তুমি ভেঙ্গে পরলে হয় না মা। প্রে ফর হিম, পাপা ফিরবে। ফিরতে তাকে হবেই!’

সারা সমানতালে ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে ওটি থেকে দুজন ডক্টর বেরিয়ে আসলো। ফায়ান তার মাকে ছেড়ে ডক্টরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

-‘ডক্টর, পাপা..?’

-‘হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার! ইউ ক্যান মিট উইথ হিম বাট অনলি ওয়ান পার্সোন! ওয়ান মোর থিং, ডোন্ট ক্রাই ইন ফ্রন্ট অফ হিম!’

-‘থ্যাংকস ডক্টর!’

ডক্টর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে তার সহকারী ডক্টরের সাথে চলে গেলেন। আজমানকে কেবিনে শিফট করা হয়। ডক্টর একজন করে দেখা করতে বলেছে তাই প্রথমেই সে নিজে বাবার কেবিনে ঢুকলো। নিস্তেজ দেহটা বিছানার সাথেই লেপ্টে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, মাথায় ব্যান্ডেজ করা। আজমান পিটপিট নজরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। ফায়ানের দিকে নজর যেতেই সেই ক্লান্ত-ভরাক্রান্ত নেত্রপল্লব মুহূর্তেই চিকচিক করে উঠে। অক্সিজেন মাস্কের ভেতর থেকে হাঁসফাঁস করলেন। হয়তো কিছু বলতে চান! ফায়ান তার পাশে গিয়ে বসলো এবং আজমানের ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

-‘উত্তেজিত হওয়ার প্রয়োজন নেই পাপা। দেখো, তোমার ছেলে এসেছে। কোনো চিন্তা নেই পাপা, রিলেক্স! যে তোমার এই হাল করেছে সে বাঁচবে না!’

আজমান কোনোরূপ পতিক্রিয়া করলেন না, সে নির্বাক হয়েই রইলো। শূন্য দৃষ্টিতে তার একমাত্র ছেলেটিকে দেখছে সে। হয়তো তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন, দৃষ্টির তৃষ্ণা! নার্স ভেতরে এসেই ইংলিশে বলতে লাগলো,

-‘পেশেন্টের মেডিসিন নেয়ার সময় হয়েছে। আপনি কাইন্ডলি বাইরে যান, পেশেন্ট এখন ঘুমোবে!’

নার্সের বলা বাক্যগুলো কর্ণগোচর হতেই ফায়ান আজমানের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বলে,

-‘টেক রেস্ট পাপা, দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসো! নাও টেক মেডিসিন এন্ড স্লিপ!’

আজমান স্মিত হাসলেন। ফায়ান তা অনায়াসেই খেয়াল করলেন। অতঃপর উত্তরে ফায়ান হেসে উঠে দাঁড়ায় এবং কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়৷ কেবিন থেকে বের হতেই দেখলো তার একজন গার্ড দাঁড়িয়ে। ফায়ানকে দেখতে পেতেই গার্ড দ্রুত পায়ে হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অতঃপর ‘হ্যালো’ বলে ইংলিশে তার তথ্য দিতে শুরু করলেন।

-‘স্যার, ইউ আর রাইট! এই দুর্ঘটনার পেছনে লুসিয়াসেরই হাত ছিলো। উনি-ই সন্ত্রাস লাগিয়ে আপনার বাবাকে আটক করেছিলেন!’

ফায়ান হাত-দুটি মুঠিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,

-‘ওই সন্ত্রাসদের ফুল ডিটেইলস আমার চাই, ভিকি! গো ফাস্ট!’

ভিকি সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। পুলিশ আসলে ভিকি তাদের নিয়ে বাহিরে চলে যায়। সারা আজমানকে দেখার জন্যে কেবিনের দিকে ছুটতেই ফায়ান পথ আটকে বলে,

-‘নো মা! পাপার রেস্টের প্রয়োজন। তুমি থাকো, হি নিড টু স্লিপ!’

———————————–

মুঠোফোনটির দিকে নজর বুলাতে বুলাতেই আরোরা তার ব্যাগ গুছাচ্ছে। হয়তো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার একটা ফোনকলের অপেক্ষায় আছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে আমেরিকায় চলে গিয়েছে? অবুঝ মন যে তার ফোনকল পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে। আরোরা তপ্তশ্বাস ফেললো। এই বিরহ সে নিজেও সহ্য করতে পারছে না। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আনমনেই মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে নেয়। অতঃপর ফোনটি কিছু সময় নিজ বক্ষে জড়িয়ে চোখ বুজে রয়। অনন্যার হাঁক কর্ণগোচর হতেই আরোরা চোখ মেলে তাকায়। আরোরা বাস্তবে ফিরে তার রুম প্রস্থান করলো।

-‘দেরী করিস না আরোরা, দ্রুত বের হ নয়তো এই রোডে রিকশা পাবি না!’

আরোরা মাথা নাড়ায়। মাকে বিদায় জানিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় সে। নিচে আসতেই সে দুজন কালো স্যুট পরিহিত গার্ডের মুখোমুখি হলো! আরোরা স্তব্ধ, বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালো। একজন মাথা নত করে বলে উঠে,

-‘ম্যাম! আপনি ভার্সিটি আমাদের হেফাজতে পৌঁছাবেন। দয়া করে গাড়িতে উঠুন!’

আরোরা বিস্মিত হলো। গার্ডদের দেখিয়ে দেয়া দিকটায় চোখ বুলাতেই দেখতে পেলো এক কালো রঙের গাড়ি তাদের গেট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে। আরোরার বিস্ময় দেখে পাশের গার্ড বলে ওঠে,

-‘বিচলিত হবেন না ম্যাম! আমরা স্যারের নির্দেশেই এসেছি। তার আদেশ, আপনি আমাদের সাথেই যাবেন!’

আরেক দফা বিষম খায় আরোরা। সে ঠিক কীরূপ অভিব্যক্তি দেখাবে বুঝলো না। পরমুহূর্তে পাশে দাঁড়ানো গার্ডকে সে চিনতে পারলো। ফায়ানের সঙ্গে কয়েকবার দেখেছিলো সে! আরোরার বুঝতে বাকি নেই ওরা ফায়ানেরই লোক। মুহূর্তেই নিভৃতে প্রশান্তির রেশ ছড়িয়ে পরলো। আরোরা আর দ্বিরুক্তি না করে গাড়িটির দিকে অগ্রসর হয়!

-‘আপনার নাম কী? আগেও আপনাকে স্যারের সঙ্গে দেখেছি?’

আরোরার এহেম প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় অনল। সে লুকিং গ্লাসে আরোরার দিকে বিচলিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার নামিয়ে ফেলে। আরোরা বুঝলো না অনলের এমন বিচলিত হবার কারণ। আরোরা কিছুটা জিজ্ঞাসু স্বরে বলে ওঠে,

-‘কী হয়েছে ভাইয়া? আপনি আমার প্রশ্নে জুবুথুবু হয়ে গেলেন যে? আমার প্রশ্নটি কী খুবই বিব্রতমূলক ছিলো?’

অনল তড়িৎ গতিতে লুকিং গ্লাসে তাকায়। অতঃপর অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,

-‘এমন কিছু নয় ম্যাম! আমি অনল। স্যারের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট!’

-‘তাহলে আমায় কেন ম্যাম ডাকছেন? স্যারের এসিস্ট্যান্ট, দ্যাট মিন আপনি অনেক বড়!’

অনল উত্তর দেয় না। পুরোটা সময় সে নিশ্চুপ রইলো। আরোরাও আর অনলকে ঘেটে দেখলো না। সে আনমনে বাইরে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মাঝেই গার্ড ব্রেক কষলো এবং আরোরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘ভার্সিটি এসে গেছি, ম্যাম!’

———————————–

রাত দশটা। রজনী এখনো সুদীর্ঘ হয়নি, গগনে দেখা দিয়েছে চাঁদের এক অংশ তাও অস্পষ্ট। আরোরা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। সে জানে তার এই অপেক্ষা নিছক বোকামী ব্যতীত কিছু নয় তাও তার এই অবাধ্য মন ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। এভাবে বহবান সময় কখন যে মাঝরাত অবধি পৌঁছে যায় আরোরার খেয়াল নেই। সেই একজন কাঙ্ক্ষিত মানুষের অপেক্ষা করতে করতে তার নেত্র ক্লান্ত হয়ে পরলো, ভর করলো রাজ্যের ঘুম। নিমিষেই আরোরা নিদ্রার ডাকে সাড়া দেয়!

এভাবে এক দিন, দু’দিন, তিন দিন! ফায়ানের সাথে তার কোনোরূপ যোগাযোগ হয় না। সময়ের সাথে সাথে আরোরাও সব ফাঁকা অনুভব করে। অনুভূত হয় এই বিশাল বিরহ। তার ভেতরটা বড্ড আনচান করে, একবারের জন্যে ফায়ানকে দেখার জন্য, এক বিন্দু কথা বলার জন্য। কিন্তু আরোরার আশায় সবসময় জল ছাড়া আর কিছু মিলে না। এতে ফায়ানের প্রতি বড্ড অভিমানও হয় তার। ভীষণরকম অভিমান। ক্ষণিকের জন্য ফায়ানের বলা শেষ কথাগুলো তার মস্তিষ্কে নাড়া দেয়। আরোরার মন আরও খারাপ হয়ে গেলো। সেদিনের কথায় আরোরা আঁচ করতে পেরেছিলো ফায়ান তাকে কোনোভাবে ভালোবাসে। যদি ভালোই বেসে থাকতো তাহলে এভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মানে কী? এর মানে কী নিতান্তই তার কথাগুলো মনগড়া ছিলো? এই ছোট্ট ভাবনাটাই তার মনে জাগা ক্ষীণ আলো নিমিষেই নিভে গেলো। চরমভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয় আরোরা। নেত্রের কোণে ভিঁজে ভাবটা উপলব্ধি করলো সে।

ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে আরোরা ইচ্ছে করেই অনলকে এড়িয়ে যায়। অনল তার এড়িয়ে যাওয়ার কারণ না বুঝলেও সে নির্বিঘ্নে আরোরার পথ আটকে বললো,

-‘গাড়ি ডানদিকে ম্যাম, আপনি ওদিকে যাচ্ছেন কেন?’

আরোরা থামলো এবং বিনা অভিব্যক্তি দেখিয়ে বলে,

-‘আমি আপনাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক নই ভাইয়া। আপনি অন্য কাউকে বুঝে নিন!’

-‘এসব কী বলছেন ম্যাম?’

-‘যা শুনেছেন তাই, আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালে খুশি হবো। আর হ্যাঁ! ফারদার আপনার ওই স্যার স্যার বলে আমার মাথা চিবিয়ে খাবেন না। ফর গড সেক!

আমি আপনার স্যারের খরিদ করা সম্পদ নই যে তার কথা মতো আমায় চলতে হবে!’

বলেই আরোরা অনলের উত্তরের অপেক্ষা না করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ভার্সিটি থেকে কিছুদূর যেতেই তার ফোনের রিংটোন শুনতে পেলো। পথে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই দেখলো ফায়ানের কল। আরোরা নিজের অজান্তেই খুশি হয়ে যায়। মুখশ্রীতে অভিব্যক্তি না এনে ফোন রিসিভ করলো এবং সালাম দিলো। কিন্তু সালামের উত্তরের বদলে সে পেলো বাজখাঁই গলার তীব্র হুংকার!

-‘হু দ্য হেল আর ইউ? তোমার সাহস কী করে হয় আমার অর্ডার অমান্য করার? দ্রুত অনলের সঙ্গে বাড়ি যাও! আমি যেন না শুনি আবার আমার কথার অমান্য হয়েছো! দূরে আছি বলে ভেবো না সাহস দেখাবে! আমি দেশে আসলে ফলাফল ভালো হবে না আরোরা! কঠিন দহনে পুড়বে তুমি!’

~চলবে।

গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।