প্রিয়তমা পর্ব-০৩

0
515

#প্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩

হরিদশ্ব তার সোনালী কিরণ দিয়ে চারপাশ আলোকিত করে রেখেছে।সোনালী রোদ্দুরে ঝলমলিয়ে উঠছে ফুলের দলেরা।চারদিকে মৃদুমন্দ নির্মল হাওয়া বইছে।গ্রামের পথে ঘাটে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার পরপরই।প্রীতির চোখে মুখে নজর কাড়া বিস্তৃত হাসি খেলে যাচ্ছে।সকালের নাস্তা সেরে প্রীতি ঘরে এসে বসেছে।রূপক নাস্তা সেরেই বাইরে চলে গেছে।
সকালে জমজ নিয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রীতি রূপককে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দেখলো সে ঘুমে বিভোর।তাই আর কিছুই জিজ্ঞেস করা হলোনা।প্রীতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো রূপককে।কোনো ভাবেই দুই ভাইকে ওর মন মস্তিষ্ক আলাদা করতে পারছেনা।হয়তোবা আরো কয়েকবার দুজনকে একসাথে দেখলে কিছুটা হলেও পার্থক্য বের করতে পারবে।

রাহাত চাকরির জন্য ঢাকাতেই থাকে।ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং থাকায় ভাইয়ের বিয়ের দিন উপস্থিত থাকতে পারেনি।ওই মিটিং এ রাহাতকে এটেন্ড করাই লাগতো।বস ছুটি দেন নি উনি চাইবেননা উনার কোম্পানির কোনো লোকসান হোক।
মিটিং রাত দশটায় শেষ করে রাহাত বাসায় এসে গোসল সেরে জামাকাপড় গুছিয়েই রওনা দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।সকাল সকাল এসেই বাসার সীমানায় পদার্পণ করে।
রাহাত আর ফারিহা এখনো হাসছে প্রীতির অবাক হওয়া নিয়ে।
প্রীতির এরকম চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগছেনা তাই সারাঘরে হেঁটে হেঁটে রূপকের জিনিসপত্র ঘাটছে।মনি আর রুবি আসলো প্রীতির সাথে গল্প করতে।মনি রূপকের বোন।সে হোস্টেলে থেকে ঢাকায় পড়াশোনা করে।কিছুটা চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা।মনির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো প্রীতি সাথে রুবিকে দেখে অসন্তুষ্ট হলো।মেয়েটাকে দেখলে কেমন বিরক্তি ধরে যায়।রুবি দেখলো প্রীতি ওর দিকে কেমন আড়চোখে তাকিয়ে আছে।হালকা হেসে বলল,তুমি আমার উপর রেগে আছো তাইনা?এ বাসায় উঠে তোমাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।আসলে তরুণ সুস্থ থাকলে এখানে আসতাম না আমি।আমি নিরূপায় হয়েই রূপকের কাছে সাহায্য চেয়েছি।
প্রীতি জোর পূর্বক ঠোঁটে হাসিয়ে ঝুলিয়ে বলল,না না আমি কিছু মনে করিনি।তবে প্রথমেই আপনি আমাকে সবটা বলে দিলে এতটা রিয়েক্ট করতাম না আমি।
রুবি নতজানু হয়ে বলল,তখন তোমাকে আমি বললেও তুমি বুঝতেনা।ব্যাপারটা আরো বিদঘুটে হয়ে যেতো।মনি আগামাথা কিছুই বুঝলোনা।তবে আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও মন চাইলোনা।সর্বদা চুপচাপ থাকতেই সে পছন্দ করে।ফারিহা প্রীতির ঘরে এসে মনি আর রুবিকে ডাকলো নিচে ওকে কাজে সাহায্য করতে।মনি মাথা নেড়ে ফারিহার সাথে বেরিয়ে আসলেও প্রত্যুত্তরে রুবি জানালো সে মিনিট দু’য়েক পরেই আসছে।
ফারিহা সরুচোখে একবার সবটা পরোখ করে রান্নাঘরের দিকে পা চালিয়ে যায়।

রুবির কথার উত্তরে প্রীতি বলল,আপনি বুঝিয়ে বললে আমি সবটাই বুঝতাম।আমি কোনো ছোট বাচ্চা নই।রুবি শান্ত চাহনি দিয়ে বিস্তর হাসলো।বলল,তুমি বুঝি বড়??ছোট বলেইতো রূপক তোমাকে আমার সাথে ঘুমাতে বলল।কিন্তু তুমিতো রয়েই গেলে জেদ ধরে।
প্রীতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ভেংচি কেটে আবার সামনে তাকিয়ে বিজ্ঞদের মতো রুবিকে জ্ঞান দিতে লাগলো।বলল,আমি ছোট নই।গ্রামের মেয়েরা ১২ তেই ১৮ হয়ে যায়।১২ তেই সংসারী হতে হয়।নিজে না চাইলেও জোর করে হলেও তাদের সংসার চিনতে হয়।আর উনিতো আপনার অনেক বড় তাহলে আপনি উনাকে ভাইয়া না ডেকে নাম ধরে ডাকেন কেনো?
রুবি থতমত খেয়ে বলে,আসলে তরুণকে নাম ধরে ডাকতামতো তাই রূপককে নাম ধরেই ডাকি।তুমি বোধহয় আমাকে পছন্দ করতে পারোনি।তুমি চাইলে আমি আগ বাড়িয়ে আর কথা বলতে আসবোনা।
প্রীতি মুখ ছোট করে বলল,না না আমি বলিনি আপনাকে আমার পছন্দ না আসলে আপনি কালকে আমাকে সবকিছু বলেননি তাই এখন জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি।
রুবি মুচকি হেসে বলল,আচ্ছা তুমি থাকো আমি আসছি।
দরজা পর্যন্ত এসে হালকা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার দেখে নিলো প্রীতিকে।সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রূপকের জিনিসপত্র হাতাতে ব্যস্ত।

রূপক সকালে নাস্তার পরেই প্রীতির বাবার বাসায় এসেছে।সকাল সকাল রূপককে বাসায় দেখে প্রীতির মা ব্যস্ত হয়ে গেলো জামাই আপ্যায়নে।রূপক জানালো ব্যস্ত হতে হবেনা সে নাস্তা করেই এসেছে।এখন রাজিব শেখ আর ফারুখকে ডেকে দিতে।প্রীতির মা সেটাই করলেন।সকালে রূপককে দেখে রাজিব শেখের মনে কিছুটা ভীতি সৃষ্টি হয়।মেয়েটা সব বলে দিলে উনাকে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।কুশল বিনিময় করে সামনের সোফায় রাজিব শেখ আর ফারুখ বসতেই রূপক কথা উঠালো,শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলে কেনো প্রীতিকে বিয়ে দিলেন?ওর কি বিয়ে হতো না?১৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতনা নাকি?রাজিব শেখ নতমুখে বললেন আসলে বাবা আমার ও ইচ্ছে ছিলোনা মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার।কিন্তু এই এলাকা সহ আশেপাশের এলাকার যে হাল?মনে মেয়েটার জন্য অনেক ভয় জন্মে গেছে।একটাই মেয়ে আমার।যে হারে দুদিন পরপর মেয়েরা নিখোঁজ হচ্ছে।পুলিশ অভিজান চালিয়েও এখনো এর পেছনের রহস্য কিছুই উদঘাটন করতে পারেনি।আমি আর ফারুখ ব্যবসায়ের কাজে বাসায় থাকি খুব কম সময়।বাড়িতে তোমার শাশুড়ী আর প্রীতি থাকে।কোন সময় কোন অঘটন ঘটে যায় তাই দ্রুততার সহিত প্রীতিকে তোমার হাতে তুলে দিলাম।তুমিতো পুলিশ নিশ্চয়ই আমার মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারবে।

রাজিব শেখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে না উনি মিথ্যে কথা বলছেন।তবুও রূপক প্রশ্ন করলো,তাই বলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবেন?আপনারা চাইলেই মেয়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন।এখন একেতো আপনারা অন্যায় করেছেন তার উপর আমাকেও সেই অন্যায়ের ভাগিদার বানিয়েছেন।এখন শাস্তি কিভাবে মাথা পেতে নেবেন?
ফারুখ গা ঝেড়ে বলল,আমাদের শাস্তির ব্যবস্থা করলে তার দ্বিগুণ শাস্তি তোমাকেও পেতে হবে।এখন তুমি যদি শাস্তি মাথা পেতে নিতে পারো তবে বোনের জন্য আমরাও না হয় মাথা পেতে নেবো।রূপকের প্রথম থেকেই ত্যাড়া জবাবের কারণে ফারুখকে পছন্দ নয়।

রূপক ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,আমি এখানে ঝামেলা করতে আসিনি।এসেছি আপনাদের বোঝাতে যাতে ভবিষ্যতে এরকম আইন বিরোধী কোনো কাজ না করেন।
ফারুখ সামনে থেকে একটা পিঠা মুখে দিয়ে বলল,তা আমার বোনকে নিয়ে কি ভাবলে?
রূপক লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,আমি বিয়ে করেছি বউকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য না।এখন তার বয়স কম বলে তাকে আমি ছেড়ে দেবো।দুদিন পর যে আপনারা আবার বিয়ে দেবেননা তার কি গ্যারান্টি আছে?২৬ বছর যেহেতু অপেক্ষা করতে পেরেছি দু’বছর নিশ্চিয়ই একযুগ সমান সময় হয়ে যাবেনা আমার জন্য।ফারুখ হেসে উঠে বলল,ভালোই জ্ঞানী আছো দেখছি।

রূপকের ফোন বেজে উঠতেই স্ক্রিনে মনির নামটা ভেসে উঠলো।রিসিভ করে কানে ধরতেই মনি এক বাক্যে বলল,তাড়াতাড়ি বাসায় এসো সাথে ভাবির মাথায় দেওয়ার জন্য একটা ফুলের গাজরা নিয়ে আসবে আমি রাখছি।ফোন কেটে দিলো মনি।ওর এরকম স্বভাবের সাথে রূপক পরিচিত।সময় দেখে নিলো প্রায় ১২ টা ছুঁই ছুঁই।শশুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রূপক।ফারুখ রাজিব শেখকে উদ্দেশ্য করে বলল,এত চিন্তার কিছুই নেই।প্রীতি ঠিকঠাক থাকবে রূপকের বাসায়।কারো সাথে পেরে উঠতে হলে কথা জানতে হয় বুজলা?রাজিব শেখ শান্তির প্রশ্বাস ফেললেন।এতদিন মেয়েটাকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলেন উনি এবার নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন কিছুটা হলেও।এলাকায় প্রচুর হারে কিশোরী থেকে শুরু করে যুবতী মেয়েরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।পুলিশ অন্যান্য কেসের পাশাপাশি এই বিষয়টাও দেখছে খুব সুক্ষ্মভাবে।কিন্তু এসবের পেছনে যে বা যারা আছে তারা অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির।তাই পুলিশ তাদের নাগাল পাচ্ছে না।

বাড়িতে যাওয়ার আগে ফুলের দোকানে গিয়ে একটা বেলীফুলের গাজরা কিনে সেটা পকেটে ঢুকিয়ে বাসায় আসলো রূপক।বাসায় পা ফেলতেই রাহাত জলদি তৈরি হতে বলল।রূপক কথা না বাড়িয়ে রুমে এসে জামাকাপড় বের করলো।প্রীতি খাটে বাবু হয়ে বসে আছে।ফারিহা,মনি আর রুবি মিলি ওকে সাজিয়ে দিয়েছে।ওকে খাটের উপর দেখে রূপকের মনে পড়লো গাজরার কথা।পকেট থেকে গাজরা বের করে প্রীতিকে ঘুরে বসতে বলল।প্রীতি পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,আপনি কি রূপক নাকি রাহাত ভাইয়া?রূপক প্রীতিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মাথায় গাজরা লাগিয়ে দিয়ে বলল,রাহাত এইঘরে আসবেনা।জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো রূপক।প্রীতি খোঁপায় হাত ছুঁইয়ে দিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসলো।
গোসল শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপক নিজের ঘড়ি,পারফিউম খুঁজে চলেছে কিন্তু পাচ্ছেনা।এখানে প্রীতির জিনিসপত্র রাখা দেখে বলল,আমার জিনিসপত্র কই তোমার গুলো এখানে রেখেছো কেনো?প্রীতি নড়াচড়া করছেনা রোবটের মতো বসে থেকে বলল,আপনার জিনিসপত্র দেখুন কোথাও আছে আমি কোথায় রেখেছি মনে নেই।আপনার গুলো এখানে থাকলে আমার গুলো কোথায় রাখবো?
রূপক রাগ দেখিয়ে চেয়ে আছে প্রীতির দিকে।নিজে সরিয়ে এখন ওকে বলছে কোথায় আছে খুঁজে দেখতে।প্রীতিকে ধমকিয়ে বলল,তোমার জিনিসপত্র আমার মাথায় রাখবে।
প্রীতি নড়তে চাইছেনা।মনে হচ্ছে সাজ এদিক সেদিক হয়ে যাবে।তাই আবারো রোবটের মতো সামনে তাকিয়ে বলল,আপনার মাথা কি ড্রেসিং টেবিল?তাহলে আপনার নিজের জিনিসপত্র গুলো মাথা নামক ড্রেসিং টেবিলে রাখুন আমার গুলো কাঠের ড্রেসিং টেবিলেই ঠিক আছে।
পুলিশদেরকে এতটা ধৈর্য হারা হলে চলেনা।আসামির মুখ থেকে কথা বের করাতে হলে এর চেয়ে হাজারগুণ কাঠখড় পোহাতে হয়।প্রীতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করালো রূপক।বলল,নড়লে তোমার সাজ নষ্ট হয়ে যাবেনা এখন আমার ঘড়ি আর পারফিউম খোঁজা শুরু কর।প্রীতি খুঁজতে গিয়ে সবটা আরো এলোমেলো করে ফেলচে দেখে রূপক ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই খোঁজা শুরু করলো।

ফারিহা হাজেরা বেগমকে বলল,আম্মা রুবিকে দেখলাম সকালে প্রীতির সাথে একা একা কথা বলছিলো।হাজেরা বেগম ফারিহাকে কড়া আদেশ দিলেন,তুমি প্রীতির আশেপাশে থাকবে।ওই মেয়ে আমার ছেলেকে একবার ফাঁসিয়ে দিয়েছে।না জানি কখন আমার ছেলের সংসার খেয়ে বসে।এই রূপকটাকে কিছু বললেও কথা কানে নেয়না।তরুণ যদি কখনো সুস্থ না হয় তাহলে কি মেয়েটা সারাজীবন এখানে পড়ে থাকবে?ফারিহা শাশুড়ীর আদেশে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সায় জানায়।
প্রীতি খাটে বসে গান ধরেছে,
“দুলাভাই দুলাভাই!ও আমার দুলাভাই”
রূপক রেডি হয়ে প্রীতির চোখের নিচে কাজল লেপ্টে যাওয়ায় টিস্যু দিয়ে কাজল ঠিক করে দিয়ে বলল,আমি তোমার দুলাভাই না বর হই।এখন নিচে চলো।
#চলবে………

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)