প্রিয়তমা পর্ব-১০

0
354

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০

আধারিয়া রজনিতে রাস্তায় ল্যামপোস্টে হরিদ্রাভ আলোর ছটা।পরিবেশ শান্ত,স্তব্ধ।কেউ ঘুমাচ্ছে তো কেউ নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।মাঝেমধ্যে দুই একটা গাড়ি সাঁ সাঁ করে রাস্তার গাছগুলোকে পেছনে ফেলে ছুটছে নিজের গন্তব্যে।
রাতের খাবার খেয়ে প্রীতি বিছানা ঝাড়ছে ঘুমানোর জন্য।রূপক সোফায় বসে প্রীতির দিকেই তাকিয়ে আছে।বিকালের পর থেকে গুণে গুণে যতটা কথা বলেছে প্রতিটি কথা খোঁচা মেরে বলেছে প্রীতি।
প্রীতি আড়চোখে রূপককে দেখে নিতে গিয়ে চোখাচোখি হলো দুজনের।রূপকতো স্থিরনেত্রে তাকিয়েই ছিলো।চোখাচোখি হতেই প্রীতি চোখ সরিয়ে নিলো।
রূপক পাংশুটে মুখে বলল,শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।আর জীবনে এত জোরে ধমক দেবোনা তোমাকে।প্রীতি মিটিমিটি হাসছে রূপকের কথা শুনে।আজকে আচ্ছামতো এড়িয়ে চলেছে মানুষটাকে।প্রীতিকে হাসতে দেখে রূপক নিজেও ফিক করে হেসে দিলো।হাসির খেলায় মেতে উঠলো দুজনে।রূপক হাসি থামিয়ে বলল,রাগ কমেছে?
প্রীতি রূপককে শাসিয়ে বলল,অন্যের রাগ আমার উপর ঝাড়লে এবারতো আপনার সাথে এসেছি পরেরবার এমন জায়গায় যাবো আপনি খুঁজেও পাবেননা হুহ।
রূপক সোফা থেকে উঠে খাটে এসে বসলো।প্রীতির হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো।শান্ত কন্ঠে বলল,কোথায় যাবে তুমি?গুহার ভেতর?সেখান থেকেও টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসবো।এখন পড়ালেখা শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়ো।

প্রীতি মুখ ভেংচি কেটে রূপকের দিকে মুখ করে শুয়েছে।কিৎকাল অতিবাহিত হওয়ার পর রূপক চোখ খুললো।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,কি?ঘুমাও না কেনো?
প্রীতি মাথা নেড়ে কিছুনা জানালো।
রূপক চোখ বন্ধ করে প্রীতির একহাত মুঠো করে ধরে বলল,এবার ঘুমাও।প্রীতি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো।

ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই।গ্রামের মানুষের জন্য এটা গভীর রাত।দূর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে।গ্রামের মানুষ গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।ফারুখ এখনো আসছেনা দেখে স্বপ্না জানালা বন্ধ করে দিলো।গতকাল বিকেলে একবার দেখা হয়েছিলো।স্বপ্না উঠানে বসা ছিলো।ফারুখ তাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একবার তাকিয়েছিলো।আজ আর আসেনি।স্বপ্না কাঁথা টেনে নিয়ে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।গালের নিচে দুহাত ভাঁজ করে ভাবতে লাগলো,এই বুঝি তার ভালোবাসা?নাকি ভালোবাসাটা ফুরিয়ে গেছে?
পরক্ষণে নিজের ভাবনাকে ধিক্কার জানিয়ে স্বপ্না আনমনেই বলল,কোনো বিপদ ওতো হতে পারে বা উনি অসুস্থ ও তো হতে পারেন।তাছাড়া উনি না আসলে আমার কি?
সব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে স্বপ্না পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে।

ফারখ রাতে যখন রাজিব শেখকে জানালো সে স্বপ্নাকে বিয়ে করতে চায় তখন রাজিব শেখ নাকচ করে দেন।একটা বিবাহিত মেয়েকে বাড়ির বউ করে তুলবে তাও আবার নিজের অবিবাহিত স্বাস্থ্যবান ছেলের জন্য?এটা রাজিব শেখ মানতে পারবেন না।স্বপ্না নিসন্দেহে সুন্দরী,তাতে কি?ফারুখের জন্য পাত্রীর কথা বললে গ্রামের সব মেয়েদের বাবারা পাগল হয়ে যাবে এমন পাঠানের মতো ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য।তার উপর টাকা পয়সা কি কম আছে নাকি?
কোনোটা বলেই রাজিব শেখ ফারুখকে বোঝাতে পারলেননা।ফারুখ শক্ত খুটির মতো বসে রইলো।সে স্বপ্নাকেই বিয়ে করবে।ফারুখের মা প্রথমে নাকচ করলেও পরে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজিব শেখকে অনুনয়ের স্বরে বলল,সংসারতো করবে ছেলে।আপনি মেনে যান না।তাছাড়া আমাদের সংসারও তো…..
রাজিব শেখ থামিয়ে দিলেন উনার স্ত্রীকে।বাজখাঁই গলায় বললেন,তুমি এখানে আমাদের সম্পর্ক টানছো?বাড়ির মহিলা মানুষ মহিলা মানুষের মতো থাকো।পুরুষের ব্যাপারে নাক গলাতে এসোনা।
প্রীতির মা দমে গেলেন।ঢোক গিলে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে চলে গেলেন নিজের কাজে।মানুষটা মাঝেমধ্যেই এমন কথা বলে ওঠে তখন আর তার চোখের সামনে থাকতেও মন চায় না।

ফারুখ এতক্ষণ মাথানিচু করে সোফায় বসা ছিলো।এবার মাথা তুলে বলল,মা তো ভুল কিছু বলেনি।যা বলেছে ঠিকই বলেছে।আর আমিও স্বপ্নাকেই বিয়ে করবো।
রাজিব শেখ ফারুখের পিঠে হাত দিয়ে বলল,আহহা!রেগে যাচ্ছিস কেনো?দেখ তোর জন্য মেয়ের অভাব হবেনা।স্বপ্নাকে বউ হিসেবে এই বাড়িতে মানায়না।ওকে তো…

আর একটাও কথা না।চেঁচিয়ে উঠে রাজিব শেখকে থামিয়ে দিলো রূপক।
আপনি যেটা মনে এনেছেন সেটা মন থেকে মুছে ফেলুন।স্বপ্না এই বাড়িরই বউ হবে।নয়তো আমি সব কিছু তছনছ করে দেবো।এবার সিদ্ধান্ত আপনার আপনি কি করবেন?
ফারুখ খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো।রাজিব শেখ রুধিরাক্ত আঁখি যুগল নিক্ষেপ করলেন ফারুখের যাওয়ার পথে।
পরে অনেক ভেবে চিন্তে তিনি নিজেই ফারুখের ঘরে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত রেখে জানালেন কালকেই স্বপ্নাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।ফারুখ আনন্দে রাজিব শেখকে জড়িয়ে ধরলো।রাজিব শেখ চলে যেতেই ফারুখ স্বপ্নাকে দেখতে বের হতে যেয়েও থেমে গেলো।কালকেই একসাথে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।ফারুখের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে।কবে ভোর হবে?কবে নিজের প্রিয় মানুষটির চমকে যাওয়া মুখশ্রী দর্শন করবে?স্বপ্না নিশ্চয়ই চমকে উঠবে।

গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে রুবি।কেউ একজন তার ঘরে তারই অগোচরে তাকে দেখে যাচ্ছে।যেনো কতদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে।একজোড়া মানব চক্ষু রুবির সারা শরীরে বিচরণ করে চলেছে।হাত উঁচিয়ে ছুঁয়ে দিলো রুবির কপোল।হালকা নড়ে উঠলো রুবি।মানবটি দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো।মুচকি হেসে ব্যালকনির দরজা খুলে পাইপ বেয়ে নেমে গেলো।
প্রীতির ঘুম আসতেই রূপক উঠে পড়ে নিজের কিছু কাজ গুছিয়ে নেয়।ব্যালকনির দিক থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ হতেই রূপক সেদিকে গেলো।বাইরে লাইটের আলো জ্বলছিল বলে রূপক ব্যাক্তিটির পিছন দিক দেখেই চিনে ফেললো।উপর থেকেই বলল,যেখানে আছিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক।আর এক পা ও সামনে বাড়াবিনা।তরুণের পা থেমে গেলো।রূপক দ্রুত নিচে নেমে তরুণকে আড়লে নিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,তুই এখানে কেনো এসেছিস?এখনো তুই সম্পুর্ন সুস্থ না।

তোকে মারার জন্য নারী পাচারকারীরা ওত পেতে আছে।আর তুই কিনা ঢাকা থেকে একটা মেয়ের জন্য এখানে চলে আসলি?এখন আবার ফিরেও যাচ্ছিস।
তরুণ শান্ত চোখে চেয়ে বলল,নিজের বউকে ভালোবাসিস না তুই?মাসের পর মাস তাকে না দেখে থাকতে পারবি?
রূপক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,প্রীতি আমার স্ত্রী।আমাদের মাঝে কোনো ছলনা নেই।আর তোদের সম্পর্ক কি?সেটাও তোর জানা আছে।
তরুণ তাচ্ছিল্য হেসে বলল,রুবি ও তো আমার স্ত্রী।হোকনা তার ভালোবাসাটা অভিনয় কিন্তু আমিতো সত্যিই ভালোবাসি।
রূপক আর পারলোনা তরুণকে কিছু বলতে।কে জানতো তরুণ ও ওদের ফাঁদে পা দিবে?তরুণকে সাবধান করে দিয়ে গাড়িতে তুলে দিলো রূপক।তরুণ আসার সময় গাড়ি নিয়েই এসেছে এখন সেই গাড়িতেই যাচ্ছে।
রুমে এসে প্রীতির দিকে একপলক তাকালো রূপক।এই মেয়েটাকে ছাড়া এখন বাড়িটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে।রূপকের মনে অনেকটায় জায়গা করে নিয়েছে মেয়েটা।

——————————————————★
রূপককে নাস্তা দিয়ে প্রীতি রেডি হতে চলে গেলো।দ্রুত রেডি হয়ে নিচে নামলো।রূপক খাওয়া শেষ করে প্রীতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।কলেজের সামনে গাড়ি থামিয়ে প্রীতিকে নিজের দিকে টেনে নিলো।প্রীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।রূপক প্রীতির দিকে এগিয়ে গিয়ে মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে নিকাব ঠিক করে দিয়ে সরে গেলো।বলল,এবার ক্লাসে যাও।সাবধানে বাসায় যেও।প্রীতি মাথানিচু করে বলল,আপনিও সাবধানে যাবেন।রূপক খানিকা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।
প্রীতি সোজা ক্লাসে গেলো।রূপক ওকে নিজের দিকে টেনে ধরেছে দেখে সে ভাবলো হয়তো চুমু টুমু দিবে কিন্তু নাহ!নিকাব ঠিক ছিলোনা বলে সেটা ঠিক করে দিলো।মানুষটার মধ্যে কি কোনো রসকষ নেই নাকি?
রূপক হাসতে হাসতেই থানার দিকে গেলো।প্রীতি কি ভেবেছে সেটা রূপক ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

সকাল হতে না হতেই ফারুখ তৈরি হয়ে বসেছিলো কখন যাবে স্বপ্নাদের বাড়িতে।কিন্তু রাজিব শেখ আস্তে আস্তে সব কাজ করছেন।খাবার খেতে বসেও একঘন্টা সময় লাগালেন।অথচ অন্যদিন পাঁচ মিনিটে খাওয়া হয়ে যায় উনার।
ফারুখ দাঁতে দাঁত চেপে সব হজম করলো।অবশেষে রাজিব শেখ পিট পাঠ হয়ে বেরুলেন ফারুখকে নিয়ে।
স্বপ্নার বাবা কাজের জন্য বের হচ্ছিলেন।নিজের বাড়িতে রাজিব শেখ আর তার একমাত্র পুত্র ফারুখকে দেখে অবাক হলেন।বললেন,আরে শেখ সাহেব আমার বাড়িতে?কই গো স্বপ্নার মা দুটো মোড়া দিয়ে যাও।রাজিব শেখ গলা ঝেড়ে বললেন,আপনি থাকুন কথা আছে কিছু।স্বপ্না উঁকি দিয়ে দেখলো কে এসেছে।ফারুখকে দেখে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।স্বপ্নার মা স্বপ্নার হাতে মোড়া দুটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,যা উনাদের মোড়াগুলো দিয়ে আয়।স্বপ্না মাথায় কাপড় দিয়ে মোড়া দিয়ে সালাম দিলো রাজিব শেখকে।রাজিব শেখ সালামের জবাব দিলেন।স্বপ্না আবারও আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

রাজিব শেখ গলা ঝেড়ে বললেন,স্বপ্না আমাদের গ্রামেই মেয়ে।ওকে আমরা ভালো করেই চিনি।প্রথমবারে মেয়েটার ভাগ্য খারাপ ছিলো বলো স্বামী মারা যায়।এখন কথা হলো স্বপ্নাকে আমার বাড়ির বউ করে নিতে চাই।রাজিব শেখের কথায় স্বপ্না চমকে ওঠে।ফারুখের দিকে তাকাতেই দেখলো সে হাসিমুখে এদিকেই তাকিয়ে আছে।চোখ দুটি জলে ভরে উঠলো স্বপ্নার।গড়িয়ে পড়ার আগেই ঘরে ঢুকে গেলো।রুমের দরজা আটকে দিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো।এত সুখ কি আছে ওর কপালে?
#চলবে…….

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)