প্রিয়তমা পর্ব-১১

0
414

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১১

বেলা এগারোটা,সূর্য একেবারে মাথার উপর তীর্যকভাবে কিরণ দিয়ে যাচ্ছে।ঘাট বাঁধানো পুকুরে পা ডুবিয়ে বসেছে স্বপ্না আর ফারুখ।দক্ষিণাবহ বাতাস এসে স্বপ্নার ঘোমটা ফেলে দিলো।কিছু ছোট চুল উড়ে চোখের উপর পড়ায় স্বপ্না চোখ পিটপিট করে বিরক্তিতে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে নিলো।ফারুখ হাত উঁচিয়ে ওড়না নিয়ে স্বপ্নার মাথায় আবারও ঘোমটা দিয়ে দেয়।স্বপ্না চাপা গুঞ্জন করে বলে,আমার সময় লাগবে কিছুদিন।ফারুখের মুখ মুহূর্তেই পাংশুটে হয়ে গেলো।তবুও মৃদু হেসে শিথিল কন্ঠে বলল,তোমার যত সময় নেওয়ার নিতে পারো।আজ হোক বা কাল আমার প্রিয়তমা একজনই হবে।আর সেটা এই নারীটি ছাড়া আর কেউ নয়।
স্বপ্নার ভেতরে ঈষৎ ঢেউ খেলে গেলো।উষ্ণ রক্ত শিথিল হয়ে আসে।লজ্জারা ঘিরে ধরলো তাকে।আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,আমি যাই।
ফারুখ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।

রাজিব শেখ ও চাইছেন আরো কিছুদিন পর বিয়েটা হতে।একটাই তো ছেলে এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?
স্বপ্নার বাবা আগে যারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তাদেরকে না করে দিয়েছেন।ফারুখ বাবার সাথে স্বপ্নাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলো।এতদিন বাবার ব্যবসায় তার মন ছিলোনা।তাছাড়া রাজিব শেখও কখনো ছেলেকে ব্যবসার হাল ধরার কথা বলেননি।কয়েকমাস হলো ফারুখ বাবার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে।এখন বাবা ছেলে দুজনে মিলেই ব্যবসা সামলায়।

রূপক বিমর্ষচিত্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরলো।নিশুতি রাত।বারান্দায় দাঁড়িলেই দূরে ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ আলো জ্বলতে দেখা যায়।আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করে উঠছে।বিষাদ গ্রস্ত মন নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রূপক।প্রীতি বিছানার চাদর টান টান করে রূপককে ডাকতে আসলো ঘুমানোর জন্য।রূপক একপলক তাকালো প্রীতির দিকে।ম্রিয়মাণ কন্ঠে বলল,আচ্ছা প্রীতি আমি না থাকলে তুমি একা থাকতে পারবে?
প্রীতি হতবিহ্বল চাহনি দিয়ে বলল,আপনি থাকবেননা কোথায় যাবেন?শান্ত কন্ঠে রূপক বলল,এক বছরের ট্রেনিং এ যাচ্ছি কিছুদিন পর।দেশের বাইরে।শেষের কথাটা অস্পষ্ট স্বরে বলল।
প্রীতি বিস্ময়ে থেমে গেলো।অস্থির কন্ঠে বলল,আপনাকে কেনো দেশের বাইরে যেতে হবে?আপনি এখানেই থাকবেন।আমরা সবাই একসাথেই থাকবো।রূপক লম্বা শ্বাস ফেলে প্রীতির দুহাত খুব সন্তর্পণে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।শান্ত কন্ঠে বলল,দেশের জন্য লড়তে হলে যেতে তো হবেই।

এখানে থেকে কি দেশের জন্য লড়া যায়না?করুণ শোনালো প্রীতির কন্ঠস্বর।রূপক দুহাতে আঁজলা ভরে প্রীতির মুখ তুলে বলল,এত অবুঝের মতো আচরণ করলে হবে?বড় হচ্ছো তো তুমি।আমিতো আবার কাজ শেষ করেই ফিরবো।দেখবে দেখতে না দেখতেই সময় কেটে যাবে।ট্রেনিং শেষ হলেই আমি চলে আসবো।
প্রীতির চোখে পানি চিকচিক করছে।ধরে আসা গলায় বলল,আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?
রূপকের হার্টবিট বেড়ে গেছে দশগুণ।তড়িৎগতিতে বুকের বাম পাশে হৃদপিণ্ড নামক বস্তুটি লাবডাব সদৃশ আওয়াজ তুলছে যা তার নিজ কানে এসে তরঙ্গিত হচ্ছে।রূপক অনেকবার প্রীতিকে স্পর্শ করেছে।দুবার নিজের অধরের উষ্ণ ছোয়া দিয়েছে তবুও এবার কেনো জানি তার মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে।যদি সে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে?প্রীতিকে ছাড়া থাকতে যদি তার ভীষণ কষ্ট হয়?

রূপকের আকাশপাতাল ভাবনার মাঝেই প্রীতি রূপককে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখে।রূপক জেল থেকে পালিয়ে আসা আসামির ন্যায় দুহাত উপরে তুলে রাখে।প্রীতি ফুঁপিয়ে উঠতেই রূপক অস্থির হয়ে একহাতে প্রীতির পিঠে আলতো ছুঁয়ে অন্যহাত প্রীতির মাথায় রাখে।
প্রীতিকে বুঝানোর জন্য বলছে,এত মন খারাপ করলে চলবে?আমি যাওয়ার আগে তোমাকে ফোন কিনে দিয়ে যাবো।ভিডিও কলে কথা বলবো।তখন আর এতটা খারাপ লাগবেনা।মনে হবে আমরা একসাথেই আছি।
প্রীতি নাক টেনে বলল,আচ্ছা আপনি বিদেশে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবেননাতো?রূপক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।বুঝতে পারছে বিয়ের প্রথমদিনের ঘটনা এখনো প্রীতির মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়নি।
রূপক নিজের ভাবনা একপাশে রেখে প্রীতির গালে হাত রেখে বলল,আমার এমন সুন্দরী একটা বউ থাকতে আমি কেনো আবার বিয়ে করবো?প্রীতিই হবে রূপকের একমাত্র প্রিয়তমা।

প্রীতি জেদ ধরে বলল,আচ্ছা তাহলে প্রমাণ করুণ প্রীতি আপনার একমাত্র প্রিয়তমা।রূপক ভাবুক হয়ে বলল,উমম!তাহলে আমাকে কি করে প্রমাণ করতে হবে?
প্রীতি মুখ গুছে বলল,আমিও আপনার সাথে বিদেশে যাবো।রূপক চোখ বড় বড় করে বলল,তুমি বিদেশে গিয়ে কি করবে?
প্রীতি রোষানল কন্ঠে বলল,আপনি যেকাজে যাবেন আমিও সেই কাজে যাবো।আপনি ট্রেনিং নিবেন আমিও দরকার হলে ট্রেনিং নেবো।তবুও আপনার সাথে আমি যাবো।

রূপক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,ভিসা,পাসপোর্ট আছেতো তোমার?
প্রীতি মাথা নেড়ে না জানালো।রূপক বলল,তাহলে কিভাবে যাবে?আমিতো কয়েকদিন পরই চলে যাবো।আর বেশি সময় নেই।প্রীতি রূপকের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই রূপক প্রীতিকে কাছে টেনে প্রীতির নাকে নাক ঘষে বলল,আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।ততদিনে তুমি মন দিয়ে পড়ালেখা করবে।হুটহাট কোথাও যাবেনা ঠিকআছে?
রূপকের ছোঁয়া পেয়ে প্রীতি খানিকটা গুটিয়ে গেলো।গালদুটোতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।নতজানু হয়ে মাথা দুপাশে দুলিয়ে রূপকের কথায় সায় জানায়।রূপক ছেড়ে দিতেই প্রীতি ছুটে রুমে এসে শুয়ে পড়ে।
রূপক পেছন পেছন রুমে এসে প্রীতির পাশে শুয়ে পড়লো।প্রীতি খাটের এক কোনে গিয়ে শুয়েছে।রূপক প্রীতিকে টেনে নিজের বাহুর উপর শোয়ালো।প্রীতি অবাক হচ্ছে।এতো ভালোবাসা কেনো আজ উতলে পড়ছে?আমার থেকে দূরে যাবে বলে বুঝি ভালোবাসা বেড়ে গেলো?এতদিন যে আমি চাতক পাখির মতো তার ভালোবাসার অপেক্ষায় চেয়ে রইলাম?আজ বুঝি তার অবসান ঘটবে।

প্রীতির ভাবনাকে আর বাড়তে দিলোনা রূপক।কাঁথার উপর দিয়েই একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,এরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে না থেকে ঘুমাও।আর তুমি যা ভাবছো সেটার জন্য আগে বড় হও।
প্রীতি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো।চোখ খুলে থাকলে তাকে এখন আরো লজ্জায় পড়তে হবে।রূপক আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রীতিকে।প্রীতি বিড়বিড় করে বলল,পিষে ফেলুন আমাকে।তারপর আমার গুড়ো হওয়া হাড় ফাউডার হয়ে আপনার সাথে বিদেশে চলে যাবে।
রূপকের কানে কথাটা যেতেই সে ধমক দিয়ে বলল,বকবক না করে ঘুমাও।

রুবির ফোন অনবরত বেজে চলেছে।কিন্তু রিসিভ করার নাম নেই।রুবি নিচে এসেছিলো পানি নিতে।পানি নিয়ে উপরে যেতেই আবারও ফোনের রিংটোনে কম্পিত হলো পুরো রুম।ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা গেলো।এতক্ষণ ফোন না তুলে কোথায় ছিলি?
রুবি বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,আমার কি কোনো কাজ থাকতে পারেনা?আর যখন দেখেছো আমি রিসিভ করছিনা তখন এতবার কল দেও কেনো।সময় হলে আমি নিজেই ফোন করতাম।অজ্ঞাত ব্যাক্তি বাজখাঁই গলায় বলল,তোকে আমি ওখানে কেনো পাঠিয়েছি?তুই কি চাসনা রূপকের ধ্বংস হোক?
রুবি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,আমি চাইলেই কি?আমার মনে হচ্ছে তুমি চাইছোনা।চাইলে অবশ্যই অনেক আগেই রূপককে শেষ করে দিতে।এখনো কিসের অপেক্ষা করছো আমি সেটাই বুঝতে পারছিনা।
ওপাশের ব্যাক্তি বলল,ধীরে সুস্থে এগোতে হবে।হুট করে একজন পুলিশ অফিসার মারা যাবে এতো সহজে সব কিছু মিটে যাবে ভাবছিস?ওকে আস্তে আস্তে নিজের জালে ফাঁসিয়ে মারবো।একটাকেতো আগেই শেষ করেছি।আর কোনো ইনফরমেশন থাকলে তাড়াতাড়ি দে।
রুবি বলল,আপাতত কোনো ইনফরমেশন নেই।কিছুক্ষণ পরই বলল,ও হ্যাঁ একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয়ে ওঠেনি।রূপকের বউয়ের বয়স ১৬ বছর।বাল্যবিবাহ হয়েছে তার।
অজ্ঞাত ব্যাক্তি বলল,শিট!এই কথা এখন বলছিস আমায়?
রুবি বলল,এ কথা বলেও কি লাভ?কিছুই করতে পারবোনা আমরা।কারণ নিবন্ধন কার্ডে ১৮ দেওয়া আছে।
অজ্ঞাত ব্যাক্তি সুর টেনে বলল,আচ্ছা?তাহলেতো তার বউকে একবার দেখতে হচ্ছে।রুবি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,বউয়ের প্রতি ভালোবাসা ঝর্ণার পানির মতো গড়িয়ে পড়ছে।
অজ্ঞাত ব্যাক্তি বাঁকা হেসে বলল,ভালো,খুব ভালো।ভালোবাসাতো বউয়ের প্রতিই থাকবে।আজ তুই আমাকে অনেক বড় ইনফরমেশন দিলি।এখন ঘুমিয়ে পড় আমি রাখছি।
ফোন রেখে দিয়ে রুবি ও ঘুমিয়ে পড়লো।

রূপক ওয়াশরুম থেকে গোসল করে বের হলো।ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো।ফারুখ ফোন করেছে।প্রীতির সাথে কথা বলতে চায়।রূপক প্রীতিকে রান্নাঘর থেকে ডেকে আনলো।ফারুখ জানালো সে স্বপ্নাকে বিয়ে করবে।বাবা কাল গিয়ে কথা বলে এসেছেন।প্রীতি উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে।মুখে হাত চেপে নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।ফারুখ জানে এই বিয়েতে সবচেয়ে খুশি প্রীতি হয়েছে।স্বপ্না প্রীতির প্রিয় একজন মানুষ।প্রীতি নিজেকে সামলে বলল,আমি কলেজ শেষে যাবো আমার একমাত্র ভাবিকে দেখতে।
আচ্ছা যাস বলে ফারুখ হেসে দিয়ে কল কেটে দিলো।
রূপক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিলো প্রীতির দিকে।ফোন রাখতেই জিজ্ঞেস করলো এত খুশি হওয়ার কারণ কি?প্রীতি রূপককে ঝাপটে ধরে বলল,ভাইয়া আর স্বপ্না আপার বিয়ে।
রূপক অনেকবার প্রীতির মুখে স্বপ্নার নাম শুনেছে তাই চিনতে তেমন কষ্ট হলোনা।প্রীতি জানালো সে আজ কলেজেই যাবেনা।সোজা স্বপ্না আপার বাড়িতে যাবে।রূপক না করলোনা।এই হাসিমাখা মুখে বিষাদ নামতে দিতে ইচ্ছে করছেনা রূপকের।

প্রীতিকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে রূপক থানার পথে গাড়ি নিয়ে ছুটলো।সামনে চা দোকানে অনেকেই বসে আছে।রূপক গাড়ি থামালো চা খাবে বলে।সকালে প্রীতির উত্তেজনার ঠেলায় আর চা ও খেতে পারেনি।চা না খেলে সারাদিন মাথাব্যথা করবে।রূপকের বয়সি একজন বলল,আজ তোমার লাইসেন্স কই?
রূপক চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,বউ লাইসেন্স না ঘরের রানী বুঝলা?আর সে বাবার বাড়ি গেছে।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বিল মিটিয়ে গাড়িতে উঠলো রূপক।বাড়তি কোনো কথা বললোনা।
ছেলেটা মুখ বিকৃত করে বলল,সবই বউয়ের চামচা।আরেকজন উঠে বলল,এ কথাটা কে বলেছে তার চাঁদমুখ খানা দেখি?সারাদিনে যাকে ফোন করেও বউয়ের আঁচল ছাড়িয়ে বের করে আনতে পারিনা সে আবার অন্যকে বলছে?
ছেলেটি ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।দোকানে উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
#চলবে……..

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)