প্রিয়তমা পর্ব-১২

0
368

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২

খা খা রোদ্দুর।সূর্যের তেজ অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু বেশি।গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে নাম জানা অজানা গাছগাছালিতে ভরপুর।দুপাশে আছে ধানক্ষেত।ঘাড়ে গামছা তুলে অনেকেই যাচ্ছে কাজের উদ্দেশ্যে।ছোট বাচ্চারা স্কল ড্রেস পরিধান করে কেউ কাধে ব্যাগ,কেউ হাতে বই নিয়ে ছুটে চলেছে স্কুলের পথে।গ্রামের এই মনোরম সৌন্দর্য যে কারো হৃদয় কেড়ে নিতে সক্ষম যদি সে প্রকৃতি প্রেমি হয়ে থাকে।
প্রীতি এসব দেখতে দেখতেই স্বপ্নাদের বাড়ির সামনে এসে থামলো।
রিকশার ভাড়া রূপক দিয়ে দিয়েছে তাই প্রীতি রিকশা থেকে নেমে একছুটে স্বপ্নাদের বাড়ির ভেতর ডুকলো।স্বপ্না মাটির চুলায় রান্না করছে।মাথায় ওড়না দেওয়া।আগুন নিভে যাওয়ার ধোয়া ছড়াচ্ছে।চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে স্বপ্না আগুণ পূনরায় জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।আজ মা একটু অসুস্থ থাকায় স্বপ্না নিজেই রান্না করতে এসেছে।
প্রীতি স্বপ্নাকে চুলার সামনে দেখে সেখানে এসে বসলো।স্বপ্না আগুণ ধরাতে এতটাই ব্যস্ত যে প্রীতিকে খেয়ালই করেনি।প্রীতি পেছন থেকে স্বপ্নাকে ঝাপটে ধরতেই স্বপ্না ও মাগো বলে চিৎকার করে উঠলো।প্রীতি হাসতে হাসতে ছেড়ে দিলো স্বপ্নাকে।স্বপ্নার বুক হাপড়ের ন্যায় উঠানামা করছে।এখনো ধুকপুক আওয়াজ তুলে চলেছে।স্বপ্না ভেবেছিলো কোনো ছেলে মানুষ তাকে ধরেছে।এই বুঝি তার প্রাণ পাখি উড়ে যেতো।
প্রীতিকে হাসতে দেখে গাল টিপে দিয়ে বলল,বিচ্যু মেয়ে!ভয় পাইয়ে দিলে,এক্ষুনি মরে যেতাম।

প্রীতি চোখ টিপে বলল,আমার ভাই তোমাকে মরতে দিবে?মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে উঠলো স্বপ্নার গালদুটি।খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল,বেশি কথা বলিশ তুই।
প্রীতি স্বপ্নাকে আরেকটু লজ্জা দেওয়ার জন্য বলল,তা এবার আমার ভাইয়ের জন্য হৃদয়ের টান আছেতো?টান অনুভব করো?নাকি আমি সবাইকে বলে দেবো তুমি ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাওনা।
স্বপ্না অস্থির হয়ে উঠে বলল,আমি একবারও বলেছি তোর ভাইয়ের জন্য আমার টান নেই।
প্রীতি সুর টেনে বলল,ওওওওওও!তাহলে টান আছে।
স্বপ্না নতজানু হয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয়।প্রীতি স্বপ্নার সাথে কথা বলে রূপকদের বাড়িতে যাওয়া ধরতেই স্বপ্নার মা শোয়া থেকে উঠে আসেন।উনি কিছুতেই প্রীতিকে না খেয়ে যেতে দিবেননা।প্রীতি কোনোমতে শাশুড়ীর কথা বলে বেরিয়ে আসে।সোজা শশুর বাড়িতে চলে যায়।

আজ রাহাত আর ফারিহা আসবে বাড়িতে।ফারিহাকে বাড়িতে দিয়ে আবার কালই রাহাত চলে যাবে।একদিনের ছুটি নিয়েছে।তাই বিকেলেই অফিস শেষে বাস ধরেছে।
হাজেরা বেগম দুই ছেলের পছন্দমতো রান্না করছেন।রূপক উনার কাছে থাকলেও তেমন সময় করে তার পছন্দের খাবার রান্না করা হয়না।হাজেরা বেগম কোনো কিছুই এক ছেলের জন্য করেননা।দুজনের জন্যই সমানভাবে সবটা করেন।রুবি আর প্রীতি পাশে দাঁড়িয়ে হাজেরা বেগমের রান্নায় সাহায্য করছে।খাবারের তালিকায় বেশিরভাগই বিভিন্ন পদের ভর্তা।দুই ভাইই ভর্তা পছন্দ করে।প্রীতি মাংস তেমন একটা রান্না করতে পারেনা।যতবারই রান্না করতে যায় কিছুনা কিছুর কমতি বা বাড়তি হয়ে যায়।তাই আজ হাজেরা বেগম নিজেই প্রীতিকে বললেন,মনযোগ দিয়ে দেখো আমি কিভাবে মাংস কষিয়ে নিই।স্বামী কি খেতে পছন্দ করে সেগুলো জেনে রাখবে।আমিতো সারাজীবন বেঁচে থাকবোনা?মায়ের দায়িত্ব মায়ের কাছে,বউয়ের দায়িত্ব বউয়ের কাছে।প্রীতি মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো হাজেরা বেগমের প্রতিটি কথা।

হাজেরা বেগম প্রীতির দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,আমি মাঝেমাঝে বকাঝকা করলে আমার উপর রাগ হয় তাইনা?
প্রীতি উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
হাজেরা বেগম আড়চোখে চেয়ে বললেন,তখন কি করতে মন চায়?আমার থেকে আলাদা হয়ে যেতে?

কাটা পেঁয়াজ গুলো এগিয়ে দিতে দিতেই প্রীতি বলে,যখন বাড়িতে ভুল করি তখন মা বকে।আমরা রাগ হই।মাঝেমাঝে মায়ের সাথেও তর্ক করি।কিন্তু মা আমাদের খারাপের জন্য কিছু বলেনা।মায়ের কথায় রাগ হলেও কি মা আর সন্তানের ভালোবাসা কমে যায়?মায়ের থেকে কি আমরা আলাদা হয়ে যাই?
এরকম ভুল করলে শাশুড়ী বকা দিবে তাই বলে শাশুড়ী থেকে কেনো আলাদা হবো?আমি ভুল করলে আমাকে শিখিয়ে দিবেন আম্মা।সব মানুষ সব কিছু পারেনা,কেউই সবদিক থেকে পরিপূর্ণ নয়।আপনি আমার আরেকটা মা।তাই নিজের মেয়ের মতো আমাকে শাসন করে শিখিয়ে নিবেন সব কিছু।
হাজেরা বেগম তৃপ্তির হাসি দিলেন।আল্লাহর কাছে হাজারও শুকরিয়া।দুই ছেলের জন্যই তিনি খাটি হীরে আনতে পেরেছেন।শুধু রূপে গুণে সুন্দরী হলেই চলেনা।দিল সাফ থাকলে তবেই তাকে আসল সুন্দরী বলা যায়।

হাতে হাতে সব কাজ এগিয়ে দিয়ে প্রীতি হাজেরা বেগমকে পাঠিয়ে দিলো ফ্রেশ হয়ে নিতে।রান্নাঘর ও গুছিয়ে নিবে।হাজেরা বেগম দ্বিরুক্ত করলেন না।রুবি এতক্ষণ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হাজেরা বেগম আর প্রীতির ভালোবাসা দেখলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো।ছোটবেলা থেকেই মাকে কাছে পায়নি।বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছে ওর মা মৃত।তাই মায়ের ভালোবাসা কাকে বলে সেটা রুবির জানা নেই।প্রথম প্রথম হাজেরা বেগম অনেক মায়া করতেন তাকে।কিন্তু যেদিন রূপকের বউ হওয়ার পরিচয় দিলো সেদিন থেকেই কেমন যেনো হয়ে গেছেন।এমনিতে কিছু বলেননা কিন্তা স্নেহ করাটা ছেড়ে দিয়েছেন।রান্নাঘর গুছিয়ে প্রীতি চলে গেলো গোসল করতে।রাত হলেও রান্নাঘরে থাকায় শরীর কেমন নোংরা লাগছে।শরীর দিয়ে যেনো আগুণ বের হচ্ছে।এরকম অস্বস্তি নিয়ে রাতে ঘুম ও হবেনা।
রূপক বাসায় নেই।সামনের দোকানে গিয়ে বসেছে।একঘন্টায় চারকাপ চা শেষ করলো পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর।রং চা শরীরের জন্য বেশ ভালো উপকারী।মাথাব্যথা,জ্বর থাকলে তখন চা খেলে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়।
পাঁচ নাম্বার কাপের চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে রূপক বাসার দিকে হাঁটা ধরলো।

প্রীতি গোসল করে বেরিয়েছে।রুমে হেঁটে হেঁটে চুল মুছতেছে।তখনই রূপক রুমে প্রবেশ করলো।প্রীতিকে ভেজা চুল মুছতে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পলকহীনভাবে।ব্লাউজের অনেকখানি জায়গা চুলের পানিতে ভিজে একাকার।চুল সামনে নিয়ে মোছার কারনে পিঠ উন্মুক্ত।রূপক নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,যাওয়ার শেষ মুহূর্তে এই মেয়ে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।এই মুহূর্তে আমি কোনো নেশা করতে চাইনা,নোহ!

পরোক্ষণে প্রীতিকে ধমক দিয়ে বলল,তুমি এখন গোসল করেছো কেনো?
প্রীতি ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বলল,আমি রান্নাঘরে ছিলাম।গরম লাগছিলো বলে গোসল করেছি।আপনি কখন এলেন?রূপক আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে মিহি কন্ঠে বলল,এখনই আসলাম।আবারও ধমকের সুরে বলল,তাড়াতাড়ি চুল মুছে মাথায় কাপড় দাও।
প্রীতি মুখ কালো করে বলল,এরকম ধমকাচ্ছেন কেনো?আমি আবার কি দোষ করলাম?
রূপক বিড়বিড় করে বলে,বড় ধরনের অপরাধ করে এখন জিজ্ঞেস করছে আমি কি দোষ করলাম?এই মেয়েটার জন্য অনুভূতি জন্মাতে কে বলেছিলো?নিজেকে সংযত রাখা দ্বায় হয়ে পড়েছে।

প্রীতি কিছু না বুঝতে পেরে বলল,কি বলছেন?
রূপক জবাব না দিয়ে প্রীতির হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে ওকে ঘুরিয়ে দিলো।দ্রুত চুল মুছিয়ে দিয়ে বলে এবার মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাখো।প্রীতি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

নিচ থেকে অনেকজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।ফারিহা আর রাহাত বোধহয় চলে এসেছে।প্রীতি দ্রুত নিচে নেমে আসে।রূপকও আস্তে আস্তে নেমে আসে।ফারিহা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে এবার প্রীতিকে জড়িয়ে ধরলো।প্রীতিও জড়িয়ে ধরলো।ফারিহা আগের চেয়ে আরো সুন্দরী হয়ে গেছে।একেকজনকে একেক জায়গার আবহাওয়ায় মানিয়ে যায়।
রাহাত প্রীতিকে বলল,দেখোতো আজ আমাদের দুই ভাইকে আলাদা করতে পারো কিনা?
প্রীতি মাথা নিচু করে হাসলো।প্রথমদিনের ঘটনা মনে পড়তেই খানিকটা লজ্জা পেলো।তার প্রিয় মানুষটাকে সে একহাজারটা রূপকের মাঝ থেকেও খুঁজে বের করতে পারবে।আগে মানুষটা অচেনা থাকলেও এখন সম্পুর্ন মানুষটাই তার চেনা।

রূপকের বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,এসেছো এবার ফ্রেশ হয়ে নাও।খেয়ে রেস্ট করবে।কথা কালকেও বলতে পারবে।
রাহাত আর ফারিহা চলে গেলো নিজেদের ঘরে।প্রীতি খাবার সব টেবিলে এনে রাখছে।রুবি নিচে নামেনি,হাজেরা বেগম ও নিজের ঘরে গেছেন।কেউ নেই দেখে রূপক প্রীতির সাথে হাতে হাতে তরকারির বাটিগুলো এনে টেবিলে রাখছে।প্রীতি আড়চোখে চেয়ে বলল,আপনাকে আমি বলেছি আমাকে সাহায্য করুন?
রূপক প্রীতির কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,আমার মন চাইলো তাই করছি।
প্রীতি আলগোছে হাসে।তা দেখে রূপকও হাসলো।
সবাই আসার আগে আগেই সবকিছু টেবিলে নিয়ে আসা শেষ।রূপক চেয়ার টেনে বসে পড়লো।একে একে সবাই নিচে নামলো।হাজেরা বেগম সব টেবিলে রেডি দেখে বলল,এরমধ্যে সব নিয়ে এসেছো?
ফারিহা খাবারের বাটি হাতে নিলো খাবার বাড়তে।হাজেরা বেগম বসিয়ে দিয়ে বললেন,কাল থেকে করিও।আজ আমি করে নিচ্ছি,প্রীতি তুমিও বসো।প্রীতি না করে দিয়ে বলল,সবাই খেয়ে উঠুক আমি আপনার সাথে পরে খাবো।ফারিহাও আর বসলোনা।বউ শাশুড়ী তিনজনে মিলে খাবার বাড়ছে।প্রত্যেক রমনী তার স্বামীর পেট ভর্তি করায় ব্যস্ত।অনেকদিন পর সবাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে।পছন্দের খাবার বলে কথা।কি সুন্দর দৃশ্য।রুবির একবার মনে হলো তরুণ আর ওর সম্পর্কটা স্বাভাবিক হলে নিশ্চিয়ই এরকম দৃশ্য তার বেলায়ও দেখা যেতো।পরোক্ষণে সব কিছু মনে পড়তেই নিজেকে সংযত করে নিলো।শত্রুরা কখনো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেনা।

খাবার পর্ব শেষে যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।রূপক প্রীতিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে শুয়ে আছে।মনে মনে আওড়ে যাচ্ছে বিদেশে গেলে প্রীতি নামক কোলবালিশ সে কোথায় পাবে?
#চলবে………

(গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)