প্রিয়তমা পর্ব-১৩

0
361

#গল্পঃপ্রিয়তমা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে।অস্তমিত সূর্যের লাল আভা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে ধরনীর বুকে নামছে মৃদু অন্ধকার।একঝাক কাক কা কা করে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে।রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য,কোলাহলবিহীন।ছাদে দাঁড়িয়ে আছে প্রীতি।মাঝে কেটে গেছে সপ্তাহের বেশি কিছুদিন।আজ রাতেই রূপক রওনা হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।কাল সকালেই ফ্লাইট।
নিঃশব্দে ধীর পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে এসে পৌঁছালো রূপক।ঘরের প্রতিটি আনাচে কানাচে খুঁজে ও যখন প্রীতিকে পেলোনা তখনই বুঝতে পারলো প্রীতি ছাদেই আছে।
নিষ্প্রভ কন্ঠে ডেকে উঠলো রূপক,প্রীতি!
পেছন ঘুরে তাকালো প্রীতি।অভিব্যক্তি শান্ত,শিথিল।উদাসীন চোখে চেয়ে রইলো রূপকের মুখপানে।ঠোঁটে বুলি নেই।

রূপক কয়েক পা এগিয়ে প্রীতির সাথেই রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।নির্বোধের ন্যায় প্রশ্ন ছুড়লো,একটু পরই চারদিকে আজান হবে এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
প্রীতি নির্বিকার কন্ঠে জবাব দিলো,ভালোলাগছে তাই দাড়িয়ে আছি।
মুখের উপর উড়ে যাওয়া খোলা ছোট চুলের এলোমেলো ভঙ্গি পরোখ করে হাত এগিয়ে কানের পাশে চুলগুলো গুঁজে দিলো রূপক।প্রীতির কোনো নড়চড় হলোনা।
প্রীতির উদাসীন ভাব দেখে রূপক প্রশ্ন করলো,মন খারাপ করছে?

হুঁ?নাহ!মন কেনো খারাপ হবে?
প্রীতির উত্তরে সন্তুষ্ট হলোনা রূপক।বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেলো।মুশলধারায় বৃষ্টি নামার আগে পরিবেশ যেমন ভয়ঙ্কর থাকে ঠিক তেমনই ঝড় বয়ে যাচ্ছে রূপকের ভেতরে।বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যথার আভাস।শুকনো ঢোক গিলে মুহূর্তেই প্রীতিকে টেনে নিলো পাঁজরের মাঝে।শক্ত হাতের বাঁধনে চেপে রাখলো প্রীতির মাথা।
প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে তার লাব ডাব শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রীতি।অনুভব করতে পারছে এই তীব্র শব্দ শুধু তার নামে।কথাটা ভাবতেই শরীরে তীব্র ঝাঁকুনি ধরলো।এতক্ষণ যে ভালোলাগা ছিলো সেটা মুহুর্তেই কেটে গেলো।আবার কবে এই শব্দ তার কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হবে?কবে মানবটির বুকে মাথা রেখে শান্তি অনুভব করতে পারবে।বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো প্রীতি।
রূপক নিশ্চুপ।মুখে কোনো রা নেই।ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার বুকে।ভালোবাসা এমন কেনো হয়?কোনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় হৃদয়কে?
প্রীতির চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয় রূপক।প্রীতি মাথা তুলে তাকাতেই রূপকের চোখে চোখাচোখি হয়।

এখনো পুরোপুরিভাবে অন্ধকার নামেনি।আবছা আলোয় চোখের মনিতে ভেসে ওঠে প্রীতির মুখখানি।ঢিলে করে খোঁপা করায় তা ঘাড়ে এসে ঠেকেছে।সামনের দিকের চুলগুলো বড্ড বেহায়া হয়ে যাচ্ছে।যতই কানের পেছনে গোঁজা হোক তারা অবাধ্য হয়ে বিচরণ করছে চোখেমুখে।মায়াবী আঁখি যুগল চেয়ে আছে নির্নিমেষ।পলক ফেলবার চেষ্টা করছেনা।গরমের মধ্যেও ওষ্ঠ জোড়া কেমন শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে আছে।কিছু একটা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে রূপককে।
ঘোরের মাঝে এগিয়ে যায় প্রীতির সান্নিধ্যে।হালকা ঝুঁকে অধরে অধর ছোঁয়ালো।দুই জোড়া অধর একে অপরের সাথে ঠেসে আছে।
প্রীতি চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো।
চারদিকে সুমধুর কন্ঠে আজানের শব্দ ধ্বনিত হতেই প্রীতি সিটকে দূরে সরে যায়।চোখে মুখে সংকোচ,লজ্জার আভা।আর এক মুহূর্ত ছাদে না দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়।
প্রীতির যাওয়ার পানে তাকিয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপক।নিজেকে কেমন অনুভূতি শূন্য লাগছে।ভোঁতা অনুভূতি গুলোকে অনুভব করতে পারছেনা।

রূপকের জামাকাপড় সব আগেই গোছানো হয়ে গেছে।রূপক একটা স্মার্টফোন বের করে প্রীতির দিকে বাড়িয়ে দেয়।শান্ত আর মিহি কন্ঠে বলল,এটাতে সব ঠিক করে দেওয়া আছে।আমার সাথে ভিডিও,অডিও যেভাবে ইচ্ছে কথা বলতে পারবে।
প্রীতি হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে।দুর্বোধ্য হাসলো।ফোনের স্ক্রিন অন করতেই তাদের বিয়ের দিনের একটা ছবি সামনে ভেসে ওঠে।প্রীতির ঠোঁটের কোন আরো প্রসারিত হলো।

খাবার খাওয়ার জন্য হাজেরা বেগম হাঁক ছেড়ে ডাকলেন।উনার মনটাও বিষিয়ে আছে।মায়ের মন।এক ছেলে এমনিতেই দূরে থাকে,এবার অন্যজনও দূরে চলে যাচ্ছে মায়ের কাছ থেকে।গোপনে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি।কিন্তু ছেলের সামনে কাঁদবেননা,এক ফোঁটা ও না।নিজেকে শক্ত রাখলে রূপকও শক্ত থাকবে।পুরুষদেরকে আমরা যতই কঠিন বলিনা কেনো প্রিয় মানুষগুলোর জন্য তারা কঠিন নয়।তাদের চোখে নোনাপানির ক্ষরণ হয়না ঠিকই কিন্তু অন্তরের ক্ষরণ ঠিকই হয়।দুমড়েমুচড়ে যায় হৃদয়।
খাবারের জন্য ডাক পড়তেই সবাই নিচে নেমে আসে।হাজেরা বেগম নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন রূপককে।বাড়িতে প্রীতির পরিবার ও আছে।সবার খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হলো।প্রীতি কাজে হাত লাগাতে গেলে ফারিহা বাঁধা দিয়ে উঠে বলে,তুমি এখন ঘরে যাও।এদিকটা আমি সামলে নেবো।হাজেরা বেগমও ইশারায় প্রীতিকে যেতে বললেন।
প্রীতি একেবারে শক্ত,নির্লিপ্ত রইলো।রূপক ভেবেছিলো প্রীতিকে সামলাতে তার কষ্ট হবে।তাই নিজেকে শক্ত করার জন্য মনস্থির করলো।কিন্তু নাহ প্রীতিকে তারচেয়ে ও কঠিন দেখা যাচ্ছে।
রূপক কিছুটা নরম হলো।মোলায়েম কন্ঠে বলল,মন খারাপ করবেনা,আমি যাওয়ার পর কাঁদবেনা।সবার কথা শুনে চলবে,কলেজ থেকে সোজা বাড়ি ফিরবে।আমার অনুমতি না নিয়ে কোথাও যাবেনা।সময়মত খাবার খাবে,আমার ফোন ধরবে।
প্রীতি ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হেসে ওঠে।রূপককে আশ্বস্ত করে বলে,আমি মোটেও কাঁদবোনা।এখানে মন খারাপ করার কি আছে?আপনিতো আবার চলে আসবেন।
রূপক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রীতির দিকে।প্রীতি যে তাকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য মিথ্যে হাসছে তা রূপক জানে।রূপক চলে যাওয়ার পর প্রীতি কাঁদবে,খুব করে কাঁদবে সেটা ও রূপক জানে।
রূপককে ধারালো চোখে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে দিলো প্রীতি।রূপক নিজ থেকে একবার জড়িয়ে ধরলো প্রীতিকে।পিঠে প্রীতির হাতের ছোঁয়া পেতেই শক্ত হয় রূপকের হাতের বাঁধন।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রূপকের বাবা রূপককে নিয়ে বের হলেন।উনি ঢাকা পর্যন্ত যাবেন বলে মনস্থির করলেন।কালকের দিনটা রাহাতের বাসায় কাটিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবেন।গাড়িতে পেছনের সিটে বাবা ছেলে চুপচাপ বসে আছে।কারো মুখে রা নেই না আছে ঘুম।রূপক উদাসীন চোখে রাস্তার দিকে নজর রাখলো।ইচ্ছে হচ্ছে একছুটে প্রীতিকে নিয়ে পিঞ্জরে আটকে রাখতে।সব কিছু আবেগ দিয়ে হয়না।সব কাজে আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলেনা।বুকে পাথর চেপে চলল নতুন গন্তব্যে।

প্রীতির বাবা মা আজরাত রূপকদের বাড়িতেই কাটাবেন।হাজেরা বেগম নিরবে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছেন।প্রীতি এতক্ষণ নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল।চোখের পানি আর বাঁধ মানছেনা।মুখে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠে।বুক ভারী হয়ে উঠছে।ক্ষণে ক্ষণে কান্নার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।আটকে যাওয়া কন্ঠে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,আমি কাঁদছি!দেখুননা আমি খুব কাঁদছি আপনার জন্য।কষ্ট হচ্ছেতো আমার।কেনো গেলেন আপনি?
রাতে আর ঘুম হলোনা প্রীতির।সারারাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে।
আঁধার ডিঙিয়ে যখন মেদিনীর বুকে ভোরের আগমন ঘটলো সেই সময়টাতে দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো প্রীতির।তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা।দরজার কড়াঘাতে ঘুম ছুটে পালিয়ে গেলো।একটুপরই রূপক বিমানে উঠবে তাই এখন সবার সাথে একবার কথা বলে নিতে চাচ্ছে।প্রীতি দরজা খুলে দিতেই হাজেরা বেগম প্রীতির হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।প্রীতির চোখমুখ ফুলে আছে।চোখের ভেতরের সাদা অংশ রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে।ফোন কানে ধরতেই রূপক জিজ্ঞেস করলো,কেমন আছো?
প্রীতি নিরুত্তর রইলো।
রূপক চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,তোমার ফোনে কল দিলাম ধরলেনা কেনো?
এবারেও প্রীতি নিরুত্তর।
রূপক ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,কথা বলবেনা?
মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে প্রীতি বলল,পৌঁছে গিয়ে ফোন করবেন।বাড়তি আর একবিন্দু কথাও বললোনা।
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো রূপক।প্রীতি কথা বলছেনা দেখে নিজেও আর কথা বাড়ালোনা।রেখে দিলো কল।

মন বিষিয়ে থাকলেও প্রীতি সবার সামনে হাসিখুসি থাকছে।মনমরা ভাবটা কাউকে দেখাচ্ছে না।বাবা মা চলে গেলেন ঘন্টাখানেক হলো।সবার মন মেজাজ ভালো নেই ভেবে ফারিহা একাই রান্না বসিয়ে দেয়।তার সাথে যোগ হলো প্রীতি।ফারিহা না করলেও প্রীতি শোনেনি।ওর মনে হচ্ছে সবার সাথে থাকলে,কাজে মন দিলে একটু হলেও রূপককে মন থেকে দূরে রাখতে পারবে।

স্বপ্না আর ফারুখের ভালোবাসা দিনদিন বেড়েই চলেছে কিন্তু তার প্রকাশ ঘটছে কম।স্বপ্নার ভালোবাসা একেবারেই অপ্রকাশ্য।কবে যে ফারুখকে নিজের মনটা দিয়ে বসে আছে সেটা টেরই পেলোনা।তার ভালোবাসা অব্যক্তই রয়ে গেলো।সে মনস্থির করলো যেদিন লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে ফারুখের ঘরে পা রাখবে সেদিন ফারুখকে মন উজাড় করে ভালোবাসবে।তখন আর ভালোবাসাগুলো তার একান্ত ব্যক্তিগত না রেখে ফারুখের জন্য উন্মুক্ত করে দিবে।এখন ফারুখের চোখে চোখ রাখতে কেমন সংকোচ হয়,অস্থিরতা বেড়ে যায়।
————————————————★
অন্তরিক্ষ স্বচ্ছ।তারকারা জ্বলজ্বল করে উঠছে।চারিদিকে বহুতল অট্টালিকা বিরাজমান।রংবেরঙের লাইটের আলো জ্বলছে রাতের শহরে।রাস্তায় দামি দামি গাড়ি চলাচল করছে।জানবাহনের শব্দ কানে এসে বাজছে।একটা এপার্টমেন্টের সাততলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রূপক।এয়ারপোর্টের ঝামেলা শেষ করে বাসায় এসে গায়ের জামাকাপড় ছাড়িয়ে নিয়েছে।নতুন সিম সেট করে ফোন হাতে নিলো বাড়িতে কল দেওয়ার জন্য।
বাবা মাকে জানিয়ে দিয়ে এবার প্রীতিকে কল দিলো।
প্রীতি এতক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলো কখন রূপক কল দিবে?অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রূপকের কল আসলো।কল আসতেই রিসিভ করে কানে ধরলো।
দুজনেই নিশ্চুপ।নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে দুজনের মাঝে।শুধু একে অন্যের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে।দূর থেকেও অনুভব করছে একে অপরকে।
প্রীতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,রূপক!
সাথে সাথেই রূপক চোখ বুঝে নিলো।ঠোঁটে লেগে আছে একচিলতে হাসি।
#চলবে……..

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)